টানা চার ম্যাচ জিতে এবারের প্রিমিয়ার লিগে উড়ন্ত সূচনা পেয়েছে দুই বড় দল লিভারপুল ও চেলসি। তবে পয়েন্ট টেবিলে বড় চমক হিসেবে এসেছে ওয়াটফোর্ডের টানা চার জয়, ঘরের মাঠে এই রাউন্ডে টটেনহামকে হারিয়ে দিয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে এই দলটি। অন্যদিকে চরম নাটকীয় ম্যাচে কার্ডিফ সিটিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় জয় তুলে নিয়েছে উনাই এমেরির আর্সেনাল। আর বার্নলির বিপক্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ২-০ গোলের জয়ে এই দফায় নিজের চাকরি বাঁচিয়ে নিলেন হোসে মরিনহো।
শনিবার প্রিমিয়ার লিগে ছিল মোট সাতটি ম্যাচ। দিনের প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠ কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে লিভারপুলকে আতিথ্য দেয় লেস্টার সিটি। সাধারণত ক্লপের লিভারপুলই হাই-প্রেসিং ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে, কিন্তু এ দিন ঘরের মাঠে উল্টো অলরেডদেরই হাই-প্রেস করে খেলতে শুরু করে লেস্টার সিটি। রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের ভুলের কারণে সেই কৌশল কাজে লাগেনি। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খেলার ৯ মিনিটের সময়ে বাঁ প্রান্ত দিয়ে দারুণভালে বল টেনে নিয়ে সাদিও মানের দিকে বল বাড়িয়ে দেন রবার্টসন। সেই সহজ সুযোগ থেকে গোল করতে ভুল করেননি মানে, লিভারপুল এগিয়ে যায় ১-০ গোলে।
এগিয়ে যাওয়ার পর আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে লিভারপুল। তবে দ্বিতীয় গোলে পেতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রথমার্ধের একদম শেষ পর্যন্ত। মিলনারের কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন রবার্তো ফিরমিনো। দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের রক্ষণভাগকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে খেলায় ফেরার চেষ্টা করতে থাকে লেস্টার সিটি। কিন্তু দলের সেরা খেলোয়াড় জেমি ভার্ডির অনুপস্থিতি তাদের বেশ ভোগাতে থাকে। তবে ৬২ মিনিটে লিভারপুল গোলকিপার এলিসন অতি আত্মবিশ্বাসী হতে গিয়ে কেলেচি ইহানেচোর কাছে বল হারালে সেই সুযোগ থেকে গোল করে দলকে খেলায় ফেরান র্যাচিড ঘেজাল। লেস্টারের শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি, ঘরের মাঠে তাদের ২-১ গোলে হারিয়ে টানা চার ম্যাচ জয়ের সাথে শীর্ষস্থানটা ধরে রাখলো লিভারপুল।
লিভারপুলের মতো চেলসির জয়রথও ছুটেই চলেছে। ঘরের মাঠ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে বোর্নমাউথের বিপক্ষে প্রথমার্ধে অবশ্য শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলো সারির দল। গোলের দেখা পেতে ৬৫ মিনিটে উইলিয়ানের পরিবর্তে পেদ্রোকে নামান চেলসি বস সারি, আর এই সিদ্ধান্তটাই কাজে লেগে যায়। ৭২ মিনিটে পেদ্রোর দুর্দান্ত এক গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা। খেলার ৮৪ মিনিটে মার্কোস আলোন্সোর সাথে দারুণ বোঝাপড়ায় গোল করে দলের ২-০ গোলের জয় নিশ্চিত করেন ইডেন হ্যাজার্ড। এই জয়ের ফলে টানা চার ম্যাচ জিতে প্রিমিয়ার লিগে স্বপ্নের মতো এক সূচনা পেলেন সারি।
আগের ম্যাচে হোঁচট খাওয়া ম্যানচেস্টার সিটি ঘরের মাঠ ইতেহাদে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে জয়ের লক্ষ্যেই মাঠে নামে। সেই লক্ষ্যপূরণে শুরু থেকেই আক্রমণের বন্যা বইয়ে দেয় সিটিজেনরা। খেলা শুরুর ৮ মিনিটের মাথায় বেঞ্জামিন মেন্ডির পাস থেকে রাহিম স্টার্লিং যখন গোল করলেন, তখন মনে হচ্ছিলো এ ম্যাচে বুঝি তারা গোল উৎসবই করবে। এর কিছুক্ষণ পরই ব্যবধান দ্বিগুণ করার ভালো সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলো ম্যানসিটি, কিন্তু জেসুসের শট নিউক্যাসল গোলরক্ষক মার্টিন দুব্রাভকা ফিরিয়ে দেন। এরপর আগুয়েরো ও জেসুসের শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাইরে চলে যায়।
৩০ মিনিটে ধারার বিপরীতে গোল করে নিউক্যাসলকে সমতায় ফেরান ইয়েডলিন। খেলায় ফিরে আসার পর বেশ আঁটসাঁট রক্ষণভাগ সাজিয়ে ম্যানসিটিকে বেশ চাপে ফেলে দেয় দলটি। তবে খেলার ৫২ মিনিটে রাইটব্যাক কাইল ওয়াকারের দুর্দান্ত এক গোলে খেলায় আবারো এগিয়ে যায় সিটিজেনরা। ব্যবধান আরো বাড়াতে পারতো তারা, কিন্তু নিউক্যাসল গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় তা হয়নি। শেষপর্যন্ত ২-১ গোলের এই জয়ে এক ম্যাচ পরেই আবারো জয়ের ধারায় ফিরলো বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।
শনিবারের অন্য ম্যাচগুলোতে ক্রিস্টাল প্যালেসকে ২-০ গোলে হারিয়ে মৌসুমে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নিয়েছে সাউদাম্পটন। ব্রাইটন ও ফুলহ্যামের ম্যাচ শেষ হয়েছে ২-২ গোলে। এদিকে রিচার্লিসনের লাল কার্ড কান্ডের পর ওয়ালকটের ইনজুরিতে বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছে এভারটন। ঘরের মাঠে হাডার্সফিল্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছে মার্সিসাইডের ক্লাবটি। আর ওয়েস্ট হ্যামকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের প্রথম জয় তুলে নিয়েছে উলভারহ্যাম্পটন।
রবিবার ছিল মোট তিনটি ম্যাচ। দিনের প্রথম ম্যাচে কার্ডিফ সিটির মাঠে আতিথ্য নেয় আর্সেনাল। আগের ম্যাচে জয়ের রাস্তায় ফেরা আর্সেনাল এই ম্যাচেও জয়ের লক্ষ্যেই শুরু থেকে আক্রমণ চালাতে থাকে। তবে খেলার ৬ মিনিটের মাথায় বিপদে পড়ে যেতে পারতো আর্সেনাল। গোলরক্ষক পিটার চেক কার্ডিফ মিডফিল্ডার হ্যারি আর্টারের পায়ে বল তুলে দিলেও সেই বল আর্টার গোলবারের বাইরে মারায় সেই যাত্রায় বেঁচে যায় গানাররা। এরপর অবশ্য আর্সেনালই এগিয়ে গিয়েছে। গ্রান্ট জাকার নেওয়া কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে তাদের ১-০ গোলে এগিয়ে দেন সেন্টারব্যাক মুস্তাফি। এই গোলের পরও টানা আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছে আর্সেনাল। তবে স্ট্রাইকারদের গোল মিসের মহড়ায় অনেকগুলো সুযোগ নষ্ট হয়।
উল্টো প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে আর্সেনাল ডিফেন্ডারদের হ-য-ব-র-ল মার্কিংয়ের সুযোগ নিয়ে কার্ডিফকে সমতায় ফেরান ভিক্টর ক্যামারেসা। আবারো এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দ্বিতীয়ার্ধে পুরোদমে আক্রমণ চালাতে থাকে গানাররা। ৬১ মিনিটে তাদের ২-১ গোলে এগিয়ে দেন পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াং। গোল পাওয়ার আনন্দেই হয়তো আবারো আর্সেনালের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা নিজেদের আসল কাজটা ভুলে যায়। ৭০ মিনিটে পেনাল্টি বক্সে পুরো আনমার্কড অবস্থায় গোল করে স্কোরলাইন ২-২ করেন ড্যানিয়েল ওয়ার্ড। ৭৮ মিনিটে এগিয়েও যেতে পারতো কার্ডিফ সিটি। তবে সহজ সেই সুযোগ সেযাত্রায় কাজে লাগাতে পারেনি তারা। উল্টো এর দুই মিনিট পর আলেক্সান্দ্রে ল্যাকাজাত্তের অসাধারণ ফিনিশিংয়ে গানারদের ৩-২ গোলের জয় নিশ্চিত হয়। টানা দুই ম্যাচ জিতে মৌসুমের শুরুর ধাক্কা সামলে ওঠার আভাসই যেন দিয়ে গেলো লন্ডনের দলটি।
সাধারণ হিসেবে বার্নলির বিপক্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচে আলাদা কোনো আকর্ষণ থাকার কথা নয়। এমন ম্যাচে রেড ডেভিলরা জিতবে সেটাই বরং প্রত্যাশিত ফলাফল। তবে আগের দুই ম্যাচে হারার পর এ ম্যাচেও হারলে হোসে মরিনহো বরখাস্ত হতে পারেন- এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় ম্যাচের উত্তাপ বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চাপের এই ম্যাচে শুরু থেকেই কিছুটা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে থাকে মরিনহোর দল। ম্যাচের ২৬ মিনিটে অ্যালেক্সিজ সানচেজের ক্রসে হেড করে রেড ডেভিলদের ১-০ গোলে এগিয়ে দেন রোমেলু লুকাকু। প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে জটলা থেকে বল পেয়ে সেই লুকাকুই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন।
দ্বিতীয়ার্ধেও খেলায় দাপট ধরে রাখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ৬৮ মিনিটে পেনাল্টিও পেয়ে যায় তারা। তবে পগবার নেওয়া পেনাল্টি দক্ষতার সাথে ফিরিয়ে দেন বার্নলির গোলরক্ষক জো হার্ট। এর দুই মিনিট পর অসদাচরণের দায়ে মার্কাস রাশফোর্ড লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে প্রাণহীন ম্যাচে কিছুটা উত্তেজনা ছড়ায়। অবশ্য এই ঘটনা ম্যাচে কোনো প্রভাব ফেলেনি। বাকিটা সময় নিজেদের রক্ষণভাগ অক্ষুণ্ণ রেখে ২-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে রেড ডেভিলরা। এই জয়ের ফলে মরিনহোর চাকরি আপাতত বেঁচে গেলেও কতদিন ইউনাইটেডের কোচ হিসেবে তিনি থাকতে পারেন সেটি নিয়ে সংশয় কিন্তু রয়েই গিয়েছে।
এই রাউন্ডে সবচেয়ে বড় চমক দেখিয়েছে ওয়াটফোর্ড। ঘরের মাঠে টটেনহামের বিপক্ষে শুরু থেকেই আঁটসাঁট রক্ষণভাগ নিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকিং ফর্মেশনে খেলতে থাকে ওয়াটফোর্ড। প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। তবে দ্বিতীয়ার্ধের ৫৩ মিনিটে ডোকৌরের আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়েছিলো ওয়াটফোর্ড। ৬৯ মিনিটে হোসে হোলবাসের ফ্রি-কিকে মাথা ছুঁইয়ে দলটিকে সমতায় ফেরান ট্রয় ডিনি। ৭৬ মিনিটে ওয়াটফোর্ডকে এগিয়ে দেন ক্রেইগ ক্যাথকার্ট। এবারের যোগানদাতাও সেই হোলবাস। এই গোলটিই খেলার ব্যবধান গড়ে দেয়। টানা চার জয় তুলে নিয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে ওয়াটফোর্ড। আর আগের তিন ম্যাচে জেতার পর এই অপ্রত্যাশিত হারে বেশ বড় ধাক্কা খেলো টটেনহাম।
চতুর্থ রাউন্ড শেষে ৪ ম্যাচে ১২ পয়েন্ট নিয়ে যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছে লিভারপুল, চেলসি এবং ওয়াটফোর্ড। গত রাউন্ডের মতো এই রাউন্ডেও গোল ব্যবধানে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে লিভারপুল। ১০ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ম্যানসিটি। ১ পয়েন্ট কম নিয়ে পরের স্থানে রয়েছে টটেনহাম। আর সমান ৬ পয়েন্ট নিয়ে যথাক্রমে নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে দুই বড় দল আর্সেনাল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। একমাত্র দল হিসেবে এখনো পয়েন্টের দেখা পায়নি ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড। টানা চার ম্যাচ হেরে বেশ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির দলটি। তবে গতবার প্রথম পাঁচ ম্যাচে হারার পরেও যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো ক্রিস্টাল প্যালেস, সেই ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিতেই পারে হ্যামার্সরা।
ফিচার ইমেজ: Statesman