Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বদলে যাওয়া তাসকিনের নেপথ্যে…

নামের আগে ‘গতিতারকা’ আর পরে ‘এক্সপ্রেস’ তকমা তার ক্ষেত্রেই প্রথম বসেনি। পেসার-স্পিনার-ব্যাটসম্যান মিলিয়ে ‘উদীয়মান প্রতিভা’ কিংবা ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন রত্ন’ ধরনের বিশেষণও যে তিনিই প্রথম পেয়েছিলেন, এমনটিও নয়। তাই মাঝপথে যখন খেই হারালেন আচমকাই, ছিটকে গেলেন কক্ষপথের বাইরে, হা-হুতাশ আর আক্ষেপের গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেলেও অবাক করা অনুভূতিটা ঠিক হয়নি। এই হারিয়ে যাওয়ার পথটা তো তাসকিন আহমেদের আগেই মাড়িয়ে গেছেন শত-সহস্রজন। তিনি সেই রথেরই যদি আরেক যাত্রী হবেন, তো এতে আশ্চর্য হওয়ার জায়গাটা কোথায়!

***

বয়সটা ২৬ হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পার করে ফেলেছেন সাত বছর। দুরন্ত শুরু-অফ ফর্ম-চোট-প্রশ্নবিদ্ধ অ্যাকশন; সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উত্থান-পতনের ইসিজিটাও ধরে ফেলতে পারার কথা এতদিনে। সাত বছরের ক্যারিয়ারেই তো তিন কাল দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে তার!

এমন গর্জনেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল তাসকিনের। ছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা আচমকা হলেও যথেষ্ট আলোকোজ্জ্বল। মাশরাফির ইনজুরিতে স্ট্যান্ডবাই থেকে স্কোয়াডে ঢুকেই খেলে ফেললেন ম্যাচ। মঞ্চটাও বিরাট, ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অভিষেকের আগের দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছিলেন, ওয়াটসন আর ম্যাক্সওয়েলের উইকেট নিতে চান। ওয়াটসন সে ম্যাচে খেলেননি বলে বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে ম্যাক্সওয়েলকে বোল্ড করে চাওয়া-পাওয়ার মাঝে সমন্বয়টা যে তিনি রাখতে জানেন, সে বার্তা ঠিকই ছড়িয়েছিলেন। ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল এর মাসদুয়েক বাদে। সেদিন তাসকিন যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন, ‘স্বপ্নের অভিষেক’ শব্দবন্ধ খুব সম্ভবত তেমন কিছু বোঝাতেই ব্যবহার করা চলে। যদিও ২৮ রানে ৫ উইকেট নিয়েও সে ম্যাচটা জেতাতে পারেননি বাংলাদেশকে।

তবে তাসকিনকে বাংলাদেশের নতুন পেস সেনসেশন বানাতে ওই পারফরম্যান্সই তো ঢের। গতির ঝড় তোলার যে আভাস দিয়েছিলেন অভিষেকের আগেই, তা অনূদিত করেছিলেন জাতীয় দলের হয়েও। ২০১৫ বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন মাত্র তিন ম্যাচের অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে, কিন্তু রুবেল-মাশরাফি-সাকিবদের টপকে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন তিনিই। তিন মাস পরের ভারত সিরিজটা মুস্তাফিজময় হলেও সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে শিখর ধাওয়ান আর বিরাট কোহলিকে ফিরিয়ে প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল তাসকিনের মাধ্যমেই।

কিন্তু ধাক্কাটা যে বিপরীতমুখী হয়েও ফেরত আসতে পারে, তাসকিন যেন ভুলে গিয়েছিলেন সেই অমর সত্যটাই। কী ভুল করেছিলেন ওই সময়টায়, পেছনে তাকিয়ে তাসকিন এখন বুঝতে পারেন পরিষ্কারই,

”শুরুর দিকের দুই-আড়াই বছর তো ফেইম-নেইম-এনডোর্সমেন্ট সবকিছু স্মুথলি আসা শুরু করল। আমার মাথায়ই আসেনি, আমারও ইনজুরি-অফ ফর্ম আসতে পারে। তখন মনে হয়েছে, ভালো খেলাটা, এনডোর্সমেন্ট করাটা – এটাই তো নরমাল লাইফ, এটাই সবকিছু।”

মাঝে এমন বিমর্ষ বদনটাই হয়ে গিয়েছিল তাসকিনের প্রোফাইল পিকচার। ছবি: গেটি ইমেজেস

তাসকিনের ক্যারিয়ারে প্রথম পাল্টা ধাক্কা এসেছিল আইসিসির তরফ থেকে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালীন হঠাৎই জানিয়েছিল, তার বোলিং অ্যাকশনটাই নাকি শুদ্ধ নয়। যদিও এই ধাক্কাটা সামলে তাসকিন ফিরেছিলেন খুব তাড়াতাড়িই। কিন্তু ওই তাসকিন কি আর এলেন? অ্যাকশন শোধরানোর পরে যে তাসকিনের দেখা মিলল, তিনি যেন আগের ওই গতিতারকা নন মোটেই। তার বলগুলোও যেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য হুমকি হতে পারছে না আর।

এখান থেকেই শুরু হলো, ‘তাসকিন: পার্ট টু’। পরিসংখ্যানেও পড়ল তাসকিনের বদলে যাওয়ার ছায়া। অভিষেকের পর থেকে ২০১৫ অব্দি যে ম্যাচগুলো খেলেছিলেন তাসকিন, তাতে ১০২ ওভার বল করে ২৬.৮৫ গড়ে উইকেট নিয়েছিলেন ২১টি। ওভারপ্রতি রান খরচের হারটাও ছিল সাড়ে পাঁচের আশেপাশে। কিন্তু বোলিং অ্যাকশন শুধরে যে তাসকিন ফিরলেন, গড়-স্ট্রাইক রেট-ইকোনমি রেট প্যারামিটারের সংখ্যাগুলো বেড়ে চলল লাফিয়ে লাফিয়ে। তাসকিন তাই ছিটকে গেলেন দলের বাইরে, স্বাভাবিকভাবেই। তুলনামূলক একটা চিত্র বুঝতে পারবেন নিচের ছবিটা থেকে।   

তাসকিনের দুই অধ্যায়; ছবি: Roar Media

***

কিন্তু এই নিয়তিটা তো তাসকিনের আগেই বহুজনকে বরণ করতে হয়েছে। তালহা জুবায়েরের হারিয়ে যাওয়াটা তো গত জন্মের স্মৃতিই মনে হয় অনেক সময়; মাহবুবুল আলম রবিন, সাজেদুল ইসলাম, আবুল হাসান রাজুদের পথ ধরে ছিটকে গিয়েছেন কামরুল ইসলাম রাব্বি, শুভাশিস রায়রাও। কিন্তু সেই চেনা গল্পগুলোই যদি কপচাবেন, তবে তাসকিনকে নিয়ে আর নতুন করে লেখা কেন!

লিখতে হলো তৃতীয় পর্বের তাসকিনের জন্য। মাঝে করোনার জন্য যে দীর্ঘ বিরতি মিলেছিল, তাসকিন সেই ফাঁকা সময়টার ফায়দা লুটেছেন পুরোপুরি। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময়টায় নিজের ফিটনেস লেভেল ঠিক রাখতে স্থানীয় এক জিমে গিয়ে নিয়মিতই ঘাম ঝরিয়েছেন তিনি। বাড়ির গ্যারেজকে পিচ বানিয়ে বোলিং আর সিঁড়িকে ব্যবহার করেছেন দৌঁড়ানোর জন্য। কাজ করেছেন মানসিক দৃঢ়তা বাড়াতেও। মাঝে যে তাসকিনের আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটার একটি ছবি সাড়া ফেলেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তাসকিন তা করেছিলেন মেন্টাল ব্রেকথ্রু পেতেই।

আগুনের ওপর হাঁটছেন তাসকিন। ছবি: ইউটিউব

 

অবশেষে ২০২১ সালের গোড়ায় দলে ফিরেই তাসকিন চমকে দিলেন সবাইকে। তাসকিন যে বদলে গেছেন, তা বোঝা যাচ্ছে খালি চোখেই। ঝরঝরে শরীরে গতি-আগ্রাসনে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষার মুখে ফেলছেন হরহামেশাই। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, দলে ফেরার পর ৭ ওয়ানডেতে তাসকিন উইকেট নিয়েছেন ৭টি। কিন্তু তাসকিনের বোলিংয়ে চোখ রেখেছেন, এমন যে কেউই জানেন, ভাগ্যের ছিটেফোঁটা সহায়তা পেলেই সংখ্যাটা দ্বিগুণ (কিংবা তারও বেশি) হতে পারত অনায়াসেই।

বাংলাদেশের বর্তমান বোলিং কোচ ওটিস গিবসন এর কৃতিত্বটা পুরোপুরিই দিতে চান ফিটনেসকে। তাসকিন এখন সম্পূর্ণ ফিট দেখেই বলে বলে উজাড় করে দিতে পারছেন নিজেকে, এমনই মনে করেন তিনি।

তাসকিন ৩.০; ছবি: এসএলসি

প্রশ্নটা হচ্ছে, কেবল ফিটনেস আর মানসিকতার উন্নতিতেই কি এই নতুন তাসকিনের দেখা মিলছে? নাকি বোলিংয়েও কোনো বদল এনেছেন তিনি? সম্প্রতি উৎপলশুভ্রডটকম-এর সাক্ষাৎকারে এসে তাসকিন নিজেই জানিয়েছেন, বিশাল কোনো রদবদল নয়, বরং সামান্য কিছু ফাইন টিউনিং করেই বোলিংয়ের ছন্দটা ফেরত পেয়েছেন তিনি।

সেই সামান্য পরিবর্তনগুলো কোথায় কোথায় হলো? সম্প্রতি ডেইলি স্টারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওটিস গিবসন জানিয়েছেন, রানআপের কারণে আগে নো-বল করার প্রবণতা ছিল তাসকিনের। দু’জনে মিলে তাই কাজ করেছেন রান-আপ নিয়ে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে তাসকিন তাই যে ৬৮ ওভার বল করেছেন, একবারও ওভারস্টেপিং করেননি তিনি।

বদল এসেছে তাসকিনের ডেলিভারি স্ট্রাইডেও। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আগেকার তাসকিনের ফ্রন্ট ফুট কন্ট্যাক্ট যেভাবে হতো, তাতে তার অ্যাকশনটা ‘ফ্রন্ট-অন’ হয়ে যেত। এখন ক্রিজে ফ্রন্টফুটের ল্যান্ডিংটা স্টাম্পের অনেক কাছে হয় বলে তাকে ‘সেমি সাইড-অন’ বোলার বলে অভিহিত করা চলে।

ফ্রন্ট ফুট ল্যান্ডিং-এর তফাৎটা ধরা যাচ্ছে কি? ছবি: লেখক

ফ্রন্ট ফুট কন্ট্যাক্ট ঠিক রাখতে তাসকিন বদল এনেছেন বাঁ হাত বা নন-বোলিং আর্মের ব্যবহারেও। বডি অ্যালাইনমেন্ট ঠিক রাখতে বাম হাতটা ইদানিং ‘ক্লোজ টু দ্য বডি’ রাখার চেষ্টা করছেন তিনি।

বাঁয়ের তাসকিন এখনকার, ডানেরটা আগেকার। ছবি: লেখক

এই দুই বদলের সুফলগুলোও বেশ ভালোই পাচ্ছেন তিনি। কিছুটা সাইড-অন বোলিং অ্যাকশনের কারণে তার আউটসুইং ডেলিভারিগুলো আরও বেশি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। আর ফ্রন্ট-অন অ্যাকশনে বল করার কারণে আগে তার শরীর পাশে ঝুঁকে যেত অনেক, ফলতঃ ফরোয়ার্ড মোমেন্টামটা শিফট হয়ে যেত অন্যদিকে। কিন্তু এখন ল্যান্ডিংটা স্টাম্পের আরও কাছ থেকে হচ্ছে বলে ফরোয়ার্ড মোমেন্টামটা কাজ করছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। এই ফরোয়ার্ড মোমেন্টাম কাজে লাগিয়েই পিচে বল ফেলতে পারছেন বেশ জোরের সঙ্গে। গতি-আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে তাসকিনের বোলিংয়ে বাড়তি বাউন্স আর নিয়ন্ত্রণেরও যে দেখা মিলছে, তা এ কারণেই।

এই তাসকিনের সামর্থ্যের পুরোটা কীভাবে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেওয়া হবে, প্রশ্ন হতে পারে তা নিয়েও। বিশেষত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে দুর্দান্ত বোলিং করার পরও যে তাসকিন পুরো কোটা পূরণ করতে পারলেন না, তা কৌতূহল জাগিয়েছে সব মহলেই। তাসকিনের তামাম ক্যারিয়ারে দৃষ্টি ফেললেই দেখা যায়, টপ অর্ডার আর মিডল-অর্ডারে জুটি ভাঙায় বেশ সিদ্ধহস্ত তিনি। ক্যারিয়ারে যে ৫২ উইকেট পেয়েছেন, এর ৪১টিই ১-৭ নম্বরে ব্যাট করতে নামা ব্যাটসম্যানের; শতাংশের হিসেবে যা প্রায় ৭৯ শতাংশ। এবার ফেরার পরও ওই ধারাই ধরে রেখেছেন তাসকিন; যে ৭টি উইকেট পেয়েছেন এখন অব্দি, এর ছয়টিই টপ কিংবা মিডল-অর্ডারের ব্যাটসম্যানের। ২০১৫-১৯ সময়কালে একদিনের ক্রিকেটে পেসারদের মধ্যে মাঝের ওভারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট ছিল লিয়াম প্লাঙ্কেটের, ইংল্যান্ডের ২০১৯ বিশ্বকাপ মিশনেও তার ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। তাসকিনকেও একইভাবে ব্যবহার করা যায় কি না, ভেবে দেখতেই পারে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট।

কার বিপক্ষে তাসকিন কেমন? ছবি: Roar Media

তবে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের লোভে পড়ে তাসকিনকে যেন অতিব্যবহারও না করা হয়, নিশ্চিত করতে হবে তা-ও। এই তাসকিন যে আর নিজ দোষে হারাচ্ছেন না, তা অনেকটা অঙ্গীকারের সুরে বলেছেন তাসকিন নিজেই,

‘নেক্সট পাঁচ-সাত বছর ফুলটাইম প্রফেশনাল ক্রিকেটারের মতো লাইফ লিড করতে চাই। এটাই ফার্স্ট গোল।’

তাসকিনকে সুস্থ রাখার দায়িত্বটা তাই আরও বেশি করে বর্তেছে টিম ম্যানেজমেন্ট আর বোর্ডের ওপর। তাসকিন ভালো করছেন বলেই ম্যাচের পর ম্যাচ খেলানোটা উচিত হবে না দলের। বরং, কতটুকু পরিশ্রমে তাসকিনের ওয়ার্কলোডটা তার শরীরের সহ্যক্ষমতার মাঝে রাখা যায়, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে ম্যানেজমেন্টকে।

হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় আরও এক সংযোজনের বদলে তাসকিন তখন অন্য এক শ্রেণিরই উদাহরণ হবেন। প্রত্যাবর্তনের আশায় দিন কাটানো ক্রিকেটাররা জানবেন, তাদের আগেই তাসকিন আহমেদ দুর্দান্ত এক ‘প্রত্যাবর্তনের গল্প’ লিখে গিয়েছেন।

This article is in Bangla language. This ar is on Taskin Ahmed and his remarkable comeback. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Background image © Associated Press

Related Articles