বাংলা ভাষায় ‘পাগলা হাওয়া’ কথাটা বেশ প্রচলিত, ঝড়ের মৌসুমে আচমকা বাতাসের ঝটকা সামনে যা পায় সবকিছুকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। মূলত এ কারণেই ঝড়ো হাওয়াকে অনেকে পাগলা হাওয়া হিসেবে অভিহিত করেন। ক্রিকেটেও কিছু ব্যাটসম্যান রয়েছেন যাদের ব্যাটিং স্টাইলের সাথে এই পাগলা হাওয়ার বৈশিষ্ট্যের সাথে অনেক মিল। তেমনই একজন ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দর শেবাগ।
১৯৭৮ সালের ২০ অক্টোবর হরিয়ানায় তার জন্ম, ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি একটি আলাদা টান অনুভব করতেন তিনি। কিন্তু ১২ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একটি দাঁত ভেঙে যাওয়ায় শেবাগের বাবা কৃষাণ শেবাগ তাকে ক্রিকেট থেকে সরে আসার নির্দেশ দেন। তবে মায়ের সহায়তায় সেই যাত্রায় তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেঁচে যায়, পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের খেলাটাও চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে দিল্লির হয়ে খেলার মাধ্যমে শেবাগের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। শচীনকে আদর্শ মানতেন বলে তার ব্যাটিং স্টাইলের সাথে লিটল মাস্টারের বেশ কিছু মিলও ছিল। দ্রুত গতিতে রান তোলার সাথে কার্যকরি অফ স্পিন করার ক্ষমতা– সবমিলিয়ে দুই বছরের মধ্যেই নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান তিনি। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার।
তবে শুরুটা মোটেও আশাব্যঞ্জক কিছু ছিল না, শোয়েব আখতারের বলে এলবিডব্লিউ এর শিকার হয়ে মাত্র ১ রান করে সাজঘরে ফিরে যান তিনি। এছাড়া বল হাতেও সেই ম্যাচে অনুজ্জ্বল থাকায় পরের ম্যাচেই দল থেকে বাদ পড়তে হয় তাকে। এভাবে বাদ পড়ায় কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর কেটে যায় দেড় বছর, ভারতীয় দলে কিছুতেই আর সুযোগ পাচ্ছিলেন না তিনি। ভারতের তৎকালীন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি শেবাগের কঠিন সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে আরো কঠোর পরিশ্রম করার পরামর্শ দেন।
২০০০ সালের ডিসেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে খেলার মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পান শেবাগ। এবার ব্যাট হাতে ১৯ রান করলেও বল হাতে তিনি তুলে নেন ২ উইকেট। এরপর আরো বেশ কিছু ম্যাচে সুযোগ পেলেও সেভাবে জ্বলে উঠতে পারছিলেন না। এমন সাদামাটা পারফরম্যান্সের কারণে তার দল থেকে বাদ পড়াটা যখন অবধারিত হয়ে যাচ্ছিল, তখন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে পায়ের ইনজুরিতে আক্রান্ত হন শচীন টেন্ডুলকার। স্কোয়াডে বিকল্প ওপেনার না থাকায় শেবাগকে ইনিংস ওপেন করতে পাঠানো হয় আর সেখানেই বাজিমাত! মাত্র ৬৯ বলে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতে নেন তিনি। তবে শচীন দলে ফেরার পর আবারো মিডল অর্ডারে ফিরে যান তিনি।
২০০১ সালের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্লুমফ্রন্টেইন টেস্টে খেলার মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে শেবাগের। এখানে অবশ্য অভিষেকেই বাজিমাত, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিকূল পরিবেশে মিডল অর্ডারে খেলতে নেমে ১০৫ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে সৌরভের ইনজুরিতে ওয়ানডেতে আবারও ওপেনার হিসেবে সুযোগ পান তিনি, ৫৮ বলে ৫১ রান করে আবার সুযোগ কাজে লাগান তিনি।
ওয়ানডেতে উদ্বোধনী জুটি হিসেবে সৌরভ-শচীনের রেকর্ড ছিল ঈর্ষণীয়। তবে ওপেনার হিসেবে শেবাগের ব্যাটিংয়ে খুশি হয়ে দলে ফিরে আসার পরে নিজে তিন নাম্বার পজিশনে ব্যাট করে শেবাগকে ওপেনার হিসেবে খেলার সুযোগ করে দেন সৌরভ। আবার কয়েক ম্যাচে শচীনকে চারে খেলিয়ে শেবাগকে নিয়ে সৌরভ নিজেও ইনিংস সূচনা করেছেন। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের সেই ঐতিহাসিক ফাইনালে ভারতের ৩২৬ রান তাড়া করার ক্ষেত্রে সৌরভ-শেবাগের উদ্বোধনী জুটি বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিল।
যেখানে ওয়ানডেতে ওপেনারদের জায়গা দেওয়া নিয়ে চলছিল মধুর সমস্যা, সেখানে ভারতের টেস্ট দলে ওপেনার খুঁজে পাওয়া নিয়েই সমস্যা চলছিল। ওয়ানডের তিন ওপেনার শচীন, সৌরভ ও শেবাগ– তিনজনই টেস্টে ব্যাট করতেন মিডল অর্ডারে। ওপেনার হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাটসম্যানকে সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ সেভাবে সুবিধা করতে পারছিলেন না।
এদিকে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের টেস্ট সিরিজও ছিল সন্নিকটে, এমন পরিস্থিতিতে ওয়ানডের মতো টেস্টেও শেবাগকে ওপেনার হিসেবে খেলানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন সৌরভ গাঙ্গুলি। মূলত জহির খানের পরামর্শেই সৌরভ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওপেনারদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে ইংলিশ কন্ডিশন, তাই স্বাভাবিকভাবেই সৌরভের এই প্রস্তাব শুনে শেবাগ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওপেনিংয়ে খারাপ করলে দল থেকে বাদ না দিয়ে আবারো মিডল অর্ডারে সুযোগ দিতে হবে– সৌরভের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে তবেই টেস্টে ওপেনার হতে রাজি হয়েছিলেন শেবাগ।
তবে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রেক্ষাপট আর তৈরি হয়নি, এই একটি সিদ্ধান্ত শেবাগের টেস্ট ক্যারিয়ারকে পুরো অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়! লর্ডস টেস্টে খেলেন ৯৬ বলে ৮৪ রানের ইনিংস। ট্রেন্টব্রিজে পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়ে যান শেবাগ। ইংলিশ কন্ডিশনে ওপেনার হিসেবে এমন পারফর্ম করার পর কেউ কি আর মিডল অর্ডারে ফেরার কথা চিন্তা করতে পারে?
পরের বছরের শুরুতে নিউ জিল্যান্ডের কঠিন পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ১১২ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন শেবাগ। ২০০৩ বিশ্বকাপে অবশ্য খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি, ১১ ম্যাচ খেলে মাত্র দুটি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস ছিল তার। তবে এর মধ্যে একটি ইনিংস ছিল ওই আসরের ফাইনালে, অজিদের ছুঁড়ে দেওয়া ৩৬০ রানের পাহাড়সম লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ভারত যা কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, তা শেবাগের ৮২ রানের কল্যাণেই।
২০০৩ সালেরই নভেম্বরে হায়দ্রাবাদে ত্রিদেশীয় সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন শেবাগ, তার এই ইনিংসের কল্যাণে ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় ভারত। ফাইনালে অবশ্য নিষ্প্রভ ছিলেন তিনি, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৭ রানে সেই ফাইনাল হারে ভারত। এরপর অস্ট্রেলিয়া সফরে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে যায় ভারত, প্রথম দুই টেস্টে জ্বলে না উঠলেও তৃতীয় টেস্টে নিজের স্বরূপে ফিরেন শেবাগ। মেলবোর্নে প্রথম ইনিংসে ভারত অলআউট হয় ৩৬৬ রানে যেখানে শেবাগ একাই করেছিলেন ১৯৫ রান! তারচেয়েও বড় কথা- এই রান করতে তার প্রয়োজন হয়েছিল মাত্র ২৩৩ বল, অর্থাৎ ৮৩.৫৯ স্ট্রাইক রেটে সেদিন এই বড় ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
২০০৪ সালে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় ভারত, আর সেখানেও প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন শেবাগ। ক্রিকেটের প্রচলিত বেশ কিছু সমীকরণ বদলে দেওয়ার জন্যে ওয়ানডে সিরিজিটি বিখ্যাত আর প্রতিটি ম্যাচে ঝড়োগতিতে ব্যাট চালিয়ে সেই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন শেবাগ। তবে আসল খেলাটা দেখিয়েছিলেন টেস্ট সিরিজে। মুলতান টেস্টে প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করার অনন্য নজির গড়েন তিনি। পুরো সিরিজেই ভালো ব্যাটিং করার পুরস্কার হিসেবে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি।
পরের বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে আবারো জ্বলে ওঠেন শেবাগ। ব্যাঙ্গালোর টেস্টে দারুণ এক ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে কোণঠাসা ভারতকে সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেন তিনি। সেবার ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় পর ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। ২০০৫ সালের বাকি সময়টুকু শেবাগের খুব একটা ভালো কাটেনি, তবে ২০০৬ সালের শুরুতেই স্বরূপে ফেরেন এই মারকুটে ওপেনার।
লাহোর টেস্টে আগে ব্যাট করতে নেমে ৬৭৯ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড় করায় পাকিস্তান। রাহুল দ্রাবিড় ও বীরেন্দর শেবাগের উদ্বোধনী জুটি অবশ্য এই পাহাড়সম রানের চাপে ভড়কে যায়নি, দুজনে মিলে গড়েন ৪১০ রানের দারুণ এক জুটি। বলা বাহুল্য, জুটিতে বড় অবদান ছিল শেবাগের, ২৪৭ বলে ২৫৪ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। তবে অল্পের জন্য উদ্বোধনী জুটির সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হাতছাড়া হয় তাদের।
২০০৭ বিশ্বকাপে তারকাবহুল এক দল নিয়ে হট ফেভারিট হিসেবে খেলতে গিয়েছিল ভারত, ওই আসরে বারমুডার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন শেবাগ। তবে বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় তাদের। অবশ্য ঐ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় ভারত, ওই দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে থাকলেও ইনজুরির জন্য বেশ কিছু ম্যাচ মিস করেন শেবাগ।
২০০৮ সালের শুরুতেই আবারো অনবদ্য রূপে ফিরে আসেন এই ড্যাশিং ওপেনার, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চেন্নাই টেস্টে মাত্র ২৭৮ বলে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দ্রুততম ট্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন তিনি। একই বছর গল টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। পরের বছরেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মুম্বাই টেস্টে আবারো জ্বলে ওঠেন শেবাগ, সেবার অবশ্য ডাবল সেঞ্চুরিকে ছাপিয়ে আরো বড় কিছুর দিকে যাচ্ছিলেন। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে তিনটি ট্রিপল সেঞ্চুরির অনন্য এক নজিরের খুব কাছাকাছি চলে গেছিলেন তিনি, মাত্র সাত রানের জন্য সেই অনন্য মাইলফলক মিস করেন তিনি।
২০১১ সালে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাথে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করে ভারত। ঢাকায় উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশের মুখোমুখি হয় ভারত। আগের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে ভরাডুবির কারণে এ ম্যাচে ভারতের ওপর আলাদা রকমের একটা চাপ ছিল। তবে দলের এই কঠিন মুহূর্তে জ্বলে ওঠেন শেবাগ, তার ১৪০ বলে ১৭৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে সহজ জয় দিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে ভারত।
সেবার পুরো আসরজুড়েই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট চালিয়ে ভারতকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন শেবাগ, স্ট্রাইক রেট ছিল ১২২.৫৮! ৪৭.৫ গড়ে ৩৮০ রান সংগ্রহ করে ওই আসরের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ভারতের বিশ্বকাপজয়ে তার এই পারফরম্যান্সের বড় একটি ভূমিকা ছিল। ওই বছরেরই শেষদিকে ইন্দোরে উইন্ডিজের বিপক্ষে আরেকটি নতুন রেকর্ড গড়েন শেবাগ, ২১৯ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। তৎকালীন সময়ে এটিই ছিল ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস, পরে অবশ্য তার স্বদেশী রোহিত শর্মা রেকর্ডটি ভেঙে দেন।
এরপরেই শেবাগের ক্যারিয়ারের শেষের শুরু হয়ে যায়, বয়স তার উপর একটু বেশিই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। অবশ্য এমনটা হওয়ারই ছিল, আজীবন আনঅর্থোডক্স স্টাইলে ব্যাট চালানো এই ড্যাশিং ওপেনার হাত ও চোখের সমন্বয়ে শট খেলার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। বয়সের কারণে রিফ্লেক্স ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তার পারফরম্যান্সে বড়সড় ধস নামতে শুরু করে। তাছাড়া ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিনিয়র খেলোয়াড়দের অবসরে যাওয়ার ব্যাপারে তাগাদা দিতে থাকেন তৎকালীন অধিনায়ক ধোনী।
একই সময়ে ওপেনার হিসেবে রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ানের উত্থানে শেবাগের দল থেকে ছিটকে পড়াটা একপ্রকার নিশ্চিতই হয়ে যায়, এমন আচমকা দল থেকে বাদ পড়ায় জাতীয় দল থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায়টাও তিনি পাননি। ২০১৩ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হায়দ্রাবাদ টেস্ট ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অবশেষে ২০১৫ সালে সব ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ওপেনার।
১০৪ টেস্টে ৪৯.৩৪ গড়ে ৮,৫৮৬ রান যেকোনো ওপেনারের জন্যই ঈর্ষণীয়, তার সাথে যোগ করুন ৮২.২১ স্ট্রাইক রেট! ওয়ানডেতে ২৫১ ম্যাচে রান সংখ্যা ৮,২৭৩, গড় ৩৫.০৬ হয়তো আহামরি কিছু না। কিন্তু এর সাথে যদি ১০৪.৩৩ স্ট্রাইক রেটের ব্যাপারটা যোগ করেন, তবে শেবাগের মাহাত্ম্য বোঝাটা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা না। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়ে এই মারকুটে ভাব বজায় রাখতে গিয়ে ভক্তদের অজস্র ভালোবাসায় যেমন সিক্ত হয়েছেন, তেমনি পরিস্থিতি না বুঝে হঠকারী শট খেলে আউট হওয়ায় সমালোচনার বাণেও বিদ্ধ হয়েছেন। তবে তাতে তিনি দমে যাননি, ঝুঁকি নিয়ে ব্যাট চালিয়ে গেছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। শেবাগের ব্যাপারে তার সতীর্থ ও সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বলেন,
প্রথাগত দৃষ্টিতে ওপেনারদের মূল কাজ হচ্ছে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে ঝুঁকি না নিয়ে বারবার ছেড়ে দেওয়া। ফলশ্রুতিতে বলের উজ্জ্বলতা কমে যাবে এবং পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের পক্ষে কাজটা সহজ হবে। কিন্তু শেবাগ একদম ভিন্ন নিয়মে ওপেন করে গেছে, সে বেধড়ক পিটিয়ে বলকে পুরোনো করতো।
এই মারকুটে ভাবের অন্যতম কারণ ছিল শেবাগ ক্রিকেটকে অনেক বেশি উপভোগ করতেন। পরিস্থিতি যেমনই হোক, নিজের কাজটা করে গেছেন চাপমুক্ত থেকে। এতটাই ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন যে, ব্যাটিংয়ের সময়ে অনবরত গান গেয়ে যেতেন তিনি! একবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের সময়েও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে গান গাইছিলেন, তখন পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক কামরান আকমল নিজের পছন্দের গান গাওয়ার জন্য তার কাছে অনুরোধ করেছিলেন। অর্থাৎ শুধু দর্শক নয়, ব্যাট করার সময়ে প্রতিপক্ষকেও বিনোদন বিলিয়ে গেছেন তিনি।
এই মারকুটে ভাব বজায় রাখতে গিয়ে শেবাগ যে বহুবার বহু মাইলফলক মিস করেছেন, তা ইতিমধ্যে এই লেখাতেই চলে এসেছে। এক্ষেত্রে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। মুলতান টেস্টে ধুন্ধুমার ভঙ্গিতে ব্যাট চালাচ্ছিলেন শেবাগ, এদিকে কিছুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি মিস করেছিলেন তিনি। এমন অবস্থা দেখে শচীন বলেছিলেন, ”আরেকবার ছক্কা মারতে গেলে তোকে আমি এই ব্যাট দিয়ে পিটাবো।” মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই টেস্টের সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি ও ট্রিপল সেঞ্চুরি– তিনটি মাইলফলকেই শেবাগ পৌঁছেছিলেন ছক্কা হাঁকিয়ে!
এই মারকুটে ব্যাটিং স্টাইলের ব্যাপারে শেবাগকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
সেই সময়ে আমার সতীর্থ হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ, সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন টেন্ডুলকারের মতো বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যান ছিলেন, যারা প্রত্যেকেই ২০০ বলে সেঞ্চুরি করতেন। এখন আমিও যদি ঠিক তাদের মতোই ব্যাট চালিয়ে রান করতাম, তাহলে এত তারকার ভীড়ে আমার নাম হয়তো কেউ মনে রাখতো না। আমি দ্রুতগতিতে রান তুলতে পারতাম বলেই এতজন মহারথীর মাঝে আমার নামটিও কিন্তু দর্শকরা মনে রেখেছে!
কথাটি অবশ্য ভুল বলেননি শেবাগ, বহু তারকার মাঝে থেকেও নিজের একটি আলাদা অবস্থান ঠিকই গড়ে তুলেছিলেন তিনি। আর এ কারণেই ভারতের সেই সোনালী প্রজন্মের নাম উঠলে শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, কিংবা লক্ষ্মণের সাথে বীরেন্দর শেবাগের নামটিও দর্শকরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। দিনশেষে ক্রিকেট তো বিনোদনেরই একটা অংশ, তাই ‘দ্য আল্টিমেট এন্টারটেইনার’কে মনে রাখাটাই তো স্বাভাবিক।
খেলাধুলা সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) বাংলাদেশের লোকজ খেলাধুলা
২) এগারো (বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটারের গল্প)
৩) খেলাধুলার আইন কানুন