Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লুইস মন্টি: ভিন্ন দুই দেশের হয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন যিনি

ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে পারা সহজ কথা নয়। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই আসরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের অংশ হওয়ার কৃতিত্ব সারা জীবন গর্ব করে বলার মতো। যদিও বিশ্বকাপের একুশটি আসরে ফাইনাল খেলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবে টানা দুটি ফাইনাল খেলা খেলোয়াড় পাওয়া যাবে খুব অল্প সংখ্যক। টানা ফাইনাল খেলার অনন্য কীর্তি শুরু হয়েছিল ইতালির হাত ধরে। ১৯৩৪১৯৩৮ সালের দুই আসরেই তারা জিতে নিয়েছিল শিরোপা ও দুই আসরেই খেলেছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম মেয়াজ্জা ও ফেরারি।

ইতালির পর টানা দুটি বিশ্বকাপ শিরোপাজয়ী ব্রাজিলের ১৯৫৮১৯৬২ দলে ছিলেন জাগালো, পেলে, ভাভা, গারিঞ্চা, সান্তোসের মতো কিংবদন্তিরা। তাছাড়া বিশ্বকাপ না জিতলেও টানা দুটি ফাইনাল খেলার সৌভাগ্য হয়েছে নেদারল্যান্ডসেরও। টানা ফাইনাল খেলার মতো অনবদ্য কৃতিত্বকে একধাপ এগিয়ে নিয়েছিল জার্মানরা। তারা ১৯৮২-৯০ সাল পর্যন্ত তিনটি টুর্নামেন্টেই ফাইনাল খেলেছিল।

সুতরাং পরপর আসরে ফাইনাল খেলা দল সচরাচর দেখা না গেলেও, এই কৃতিত্ব গড়েছেন বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি। লুইস মন্টি, পরপর দুটি ফাইনাল খেলা কোন দলে, এই নামটি আপনি দেখতে পাবেন না, যদিও তিনি খেলেছিলেন বিশ্বকাপের পরপর দুটি আসরের ফাইনালে। আলোচিত বাকিদের থেকে এখানেই মন্টির কৃতিত্ব এক ও অনন্য। কারণ এই কিংবদন্তি ভিন্ন দুই দেশের হয়ে খেলেছিলেন ধারাবাহিক দুটি ফাইনাল এবং একটি আসরে চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন!

প্রথম বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দল; Image Source: mundoalbiceleste.com

১.৭০ মিটার উচ্চতার এই মাঝমাঠের খেলোয়াড় ছিলেন তার সময়ের সেরাদের একজন, মাঠে যার প্রভাব সর্বদা ছিল লক্ষণীয়। মন্টি ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিরল মিডফিল্ডারদের একজন, যিনি ছিলেন দারুণ শারীরিক সক্ষমতার সাথে কৌশলী ফুটবলের নিদারুণ সংমিশ্রণ এবং খেলতে পারতেন সেন্টার হাফ বা রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবেও। তাই মন্টি যেমন মাঝমাঠের নিচে এসে রক্ষণে সাহায্য করতেন, তেমনি আক্রমণের সময়ও তিনি পুরো সক্রিয় থাকতেন। শারীরিক সক্ষমতার দরুন মাঠের বিশাল একটা অংশ জুড়ে বিচরণ করতে পারতেন তিনি, যা সে সময়ের ফুটবলে তেমন একটা দেখা যেত না। তাই তাকে ডাকা হত ‘Doble Ancho’ বা ‘Double Wide’ বলে।

নিজ দলের কাছে বল না থাকলে, বলের দখল নিতে মন্টি সবসময় পরিশ্রমী ও শারীরিক ফুটবল খেললেও, বল পায়ে আবার ঠিক একজন প্লে-মেকারের ভূমিকা পালনে তার জুড়ি মেলা ছিল ভার। সেরা তারকা হিসেবেই আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছিলেন। ১৯৩৪ সালের ফাইনালে যখন ইতালির হয়ে তিনি মাঠে নেমেছিলেন, তখনও দলের অন্যতম ভরসা ছিলেন তিনি।

প্রথম বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলেও ইতালির হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন মন্টি। দুটি ভিন্ন দেশের হয়ে ফাইনাল খেলা মন্টির ধারেকাছেও কেউ নেই এই অর্জনের বিচারে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মৃত্যুর হুমকি নিয়েই তাকে খেলতে হয়েছিল ফাইনাল দুটি এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনার হয়ে জিতলে ও ইতালির হয়ে হারলে তার জীবন সংশয়ের উভয় হুমকিই ছিল ভিন্ন দুই ফ্যাসিস্ট সরকারের।

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মন্টি; Image Source: thesefootballtimes.co

আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে ১৯০১ সালে জন্ম নেওয়া লুইস মন্টি তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্থানীয় ক্লাব অ্যাটলেটিকো হুরাকান ক্লাবে। প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের স্বাদ নিয়ে মাত্র এক মৌসুম কাটানোর পর তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বোকা জুনিয়র্সে, যদিও মূল দলের হয়ে এখানে খেলা হয়নি তার। কারণ তিন মাস পরেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন সান লরেঞ্জোতে, যেখান থেকেই মন্টির সাবলীল উত্থান।

লরেঞ্জো দলে মন্টি ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের একজন। তার সময়ে লরেঞ্জো ১৯২৩ ও ১৯২৪ সালে টানা দুটি চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অর্জন করে এবং ১৯২৭ সালে তৃতীয় শিরোপা জিতে নেয় ক্লাবটি। এখানেই দুর্দান্ত খেলতে থাকা মন্টি চোখে পড়ে যান আর্জেন্টিনার কোচের এবং ১৯২৪ সালে তিনি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান। তার মতো একজন খেলোয়াড় সময়ের সাথে জাতীয় দলের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠবে, তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। ১৯২৭ সালের দক্ষিণ আমেরিকা চ্যাম্পিয়নশিপ জয় ও পরের বছরে অলিম্পিকে উরুগুয়ের কাছে পরাজিত হয়ে রৌপ্যপদক জেতা দলে ছিলেন মন্টি। অলিম্পিক ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী উরুগুয়ের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার একমাত্র গোলটি তিনিই করেছিলেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের সুযোগ তৈরি হয় ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপে।

ফুটবল বিশ্বে তখন উরুগুয়ে খেলে যাচ্ছে ব্যাপক দাপটের সাথে। ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালের অলিম্পিকে তারা স্বর্ণপদক অর্জন করে। তখন ফুটবল বিশ্বকাপ না থাকায়, অলিম্পিকে ফুটবলই ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা। প্রথম বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে শক্তিশালী উরুগুয়ে যে ফাইনাল খেলবেই, এই ব্যাপারে কারও তেমন দ্বিধা ছিল না। প্রথম পর্বে উরুগুয়ের শুরু পেরুকে ১-০ ও রোমানিয়াকে ৪-০ গোলে হারানোর মধ্য দিয়ে। সেমিফাইনালে এই বিধ্বংসী উরুগুয়ের বিপক্ষে ৬-১ গোলে উড়ে যায় যুগোস্লাভিয়া।

নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচে মন্টির আর্জেন্টিনা ফ্রান্সের বিপক্ষে ১-০ গোলের জয় পায়। একমাত্র এই গোলটি করেছিলেন মন্টি। মেক্সিকো ও চিলিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। উরুগুয়ের মতোই প্রতিপক্ষকে ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা, যেখানে গোলের সূচনা করেছিলেন কিংবদন্তি মন্টি। বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে শক্তিশালী উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার ফাইনাল যে ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তা বলা বাহুল্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ম্যাচটি উরুগুয়ে জিতে নেয় ৪-২ গোলে। এই ম্যাচে খুবই সাদামাটা পার্ফরম্যান্স করেছিলেন মন্টি। প্রথমার্ধে ১-২ গোলে স্বাগতিকদের বিপক্ষে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ে ৩ গোল করে জিতে নেয় ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ।

প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দল; Image Source: thesefootballtimes.c

ফাইনালে কেন সহজাত মন্টিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে দুটি। প্রথমত, শোনা যায় যে, ফাইনালের আগে ইনজুরিতে আক্রান্ত ছিলেন মন্টি। আর্জেন্টিনা তাদের সেরা খেলোয়াড় ছাড়া মাঠে নামবে, তা অসম্ভব। তাই ইনজুরি নিয়েই ফাইনালে নেমেছিলেন মন্টি। দ্বিতীয় কারণটি অবশ্য গুরুতর অভিযোগ এবং এই দাবি করেছেন মন্টির নাতনি লরেনা মন্টি। অনেকদিন পর তিনি দাবি করেছেন, লুইস মন্টির পারফর্মেন্স শুধুমাত্র ইনজুরির কারণেই প্রভাবিত হয়নি। লরেনার দাবি, “অর্ধেক সময়ে, আর্জেন্টিনা যখন ২-১ গোলে এগিয়ে, তারা বলেছিল, যদি আর্জেন্টিনা না হারে, তাহলে তারা দাদি ও আন্টিকে মেরে ফেলবে।” মন্টি তার নাতনিকে আরও বলেছিলেন, পুরো আর্জেন্টিনা দলকেই হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে পরিষ্কার ও ভয়াবহ হুমকি পেয়েছিলেন আর্জেন্টিনার সেরা খেলোয়াড় লুইস মন্টি। শেষপর্যন্ত আর্জেন্টিনা ফাইনালে পরাজিত হয় এবং অবধারিতভাবেই মন্টির পরিবার নিরাপদ ছিল।

যা-ই হোক, সময়ের সেরা তারকা হলেও মন্টির আয় ছিল সামান্য। লাতিন আমেরিকায় তখনো বলার মতো পেশাদার ফুটবল চালু হয়নি। ফুটবলের পাশাপাশি মন্টি স্থানীয় পৌরসভায় একটি চাকরিও করতেন। দুই পেশা মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে মাসে তার আয় ছিল ২০০ ডলারের কাছাকাছি। বিশ্বকাপের পর মন্টি আবার লরেঞ্জোতে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখানে দুজন ইতালিয়ান তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এবং সেই সাথে বদলে গিয়েছিল মন্টির জীবন ও ক্যারিয়ার।

আর্জেন্টাইন-ইতালিয়ান কিংবদন্তি মন্টি; Image Source: sportsavour.com

ইতালিয়ানদের কাছ থেকে মন্টির কাছে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, তিনি যদি রাজি হন তাহলে তার আয় মাসে একবারে বেড়ে দাঁড়াবে ৫০০০ ডলার। তাছাড়া তাকে বাড়ি ও গাড়িও দেওয়া হবে। সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হওয়ার বদৌলতেই মন্টি এই প্রস্তাব পাননি, সাথে আনুষঙ্গিক আরো কিছু ব্যাপারও ছিল।

উরুগুয়ের পর বিশ্বকাপ আয়োজিত হবে ইতালিতে। তাই দেশটির স্বৈরশাসক মুসোলিনি বিশ্বকাপ আসরকে তার ক্ষমতা প্রদর্শনীর একটি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু মন্টির পূর্বপুরুষেরা ইতালির উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন, সেহেতু ইতালির প্রতি একটি আলাদা টান ছিল মন্টির। মুসোলিনিও চাইছিলেন মন্টির মতো একজন সেরা খেলোয়াড় তার দেশের হয়ে খেলুক। যদিও মুসোলিনির প্রিয় ক্লাব লাৎসিও নয়, মন্টিকে প্রস্তাব করে হয়েছিল জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ার। আর্জেন্টিনা ছেড়ে ইতালিতে পাড়ি জমানোর পূর্বে জন্মভূমির হয়ে মাত্র ১৬টি ম্যাচ খেলে তিনি গোল করেছিলেন ৫টি।

১৯৩১ সালে মন্টি জুভেন্টাসে যোগ দেন এবং সেই সাথে তাকে ইতালির নাগরিকত্বও দেওয়া হয়। তুরিনে আসার পর দেখা যায়, ক্লাবটির নতুন এই তারকা অতিরিক্ত ওজনের এবং মাঠে নামার অনুপযুক্ত। বেশ কিছুদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর তৈরি হয়ে যান মন্টি এবং নিজেকে প্রমাণ করে দেখান তিনি। জুভেন্টাসের হয়ে দুর্দান্ত শুরু করেছিলেন মন্টি। তুরিনের ক্লাবটিতে খেলেছেন প্রায় ৯ বছর ও গোল করেছেন ২০টি। ক্লাবটির হয়ে টানা ৪ স্কুদেত্তো জয়ে বড় ভূমিকা রাখা মন্টি একসময় ক্লাব ক্যাপ্টেনের দায়িত্বও পালন করেছেন। ইতালি দলে ডাক পেতে বেশি সময় লাগেনি তার, কারণ তাকে ইতালিতে আনা হয়েছে দেশটিকে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্যই। ইতালির কোচ তখন ভিত্তরিও পোজ্জ। তার খেলার ধরনের সাথে আক্রমণাত্মক সেন্টার হাফ হিসেবে মন্টি ছিলেন আদর্শ খেলোয়াড়।

মন্টিকে দুটি ফাইনালই খেলতে হয়েছিল জীবন হাতে নিয়ে; Image Source: elgrafico.com.ar

পোজ্জ ২-৩-৫ ফর্মেশনের সাথে ব্যবহার করতেন ২-৩-২-৩ ফর্মেশন, যা আসলে ২-৩-৫ ফর্মেশনের পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপ। প্রতিপক্ষ ও তাদের খেলার ধরনের উপর এই ফর্মেশনে পরিবর্তন আনা হতো। পোজ্জ চাইতেন মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলতে। তাই তিনি ফরোয়ার্ডদের থেকে দুজনকে নিচে নেমে মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে বলতেন। এখানে সুবিধা হলো, এতে রক্ষণও শক্তিশালী হয় এবং সেই সাথে প্রতি-আক্রমণে আলাদা সুবিধা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, রক্ষণ ও আক্রমণের সাথে মাঝমাঠের যোগসূত্র তৈরি করা এবং এক্ষেত্রে একজন পরিশ্রমী ও আক্রমণে সহজাত ভূমিকা রাখার মতো খেলোয়াড় দরকার ছিল ইতালিয়ান কোচের। ইতালি দলের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য কোচের পছন্দ ছিলেন মন্টি।

ইতালি ‘৩৪ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ৭-১ গোলে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ ছিল স্পেন, ১-১ গোলে ড্র হয় বিতর্কিত সেই ম্যাচটি। ম্যাচটিতে বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া মুসোলিনির ইতালির পক্ষে রেফারির সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ছিল। ম্যাচটি ড্র হওয়ায় পরবর্তীতে তৎকালীন নিয়ম অনুসারে আবারও ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ইতালির বিপক্ষে শারীরিক ফুটবলের চূড়ান্ত প্রদর্শনীর প্রথম ম্যাচের ধাক্কা সামাল দিতে না পারায় স্পেনের প্রথম পছন্দের সাতজনই অনুপস্থিত ছিল দ্বিতীয় ম্যাচটিতে। এই ম্যাচেও স্পেনের তিনজন খেলোয়াড় আহত হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত মেয়াজ্জার একমাত্র গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইতালি।

সেমিফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ শক্তিশালী অস্ট্রিয়া তখন খেলতো অসাধারণ গোছানো ফুটবল। বলা হয়, এই দলটির খেলা থেকেই টোটাল ফুটবল অনেকটা প্রভাবিত ছিল। ভাগ্য এবং মন্টির কারণে ম্যাচটিতে জয় পেয়ে যায় ইতালি। বৃষ্টির কারণে নিজেদের স্বাভাবিক সুন্দর ফুটবল খেলতে সমস্যা হচ্ছিলো অস্ট্রিয়ার। অন্যদিকে মন্টির দায়িত্ব ছিল অস্ট্রিয়ার সেরা খেলোয়াড় ম্যাথিয়াস সিনডেলারকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। এনরিকের একমাত্র গোল ও মন্টির পারফর্মেন্সের সুবাদে ইতালি শিরোপা জয়ের চূড়ান্ত মঞ্চে উঠে আসে, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ চেকোস্লোভাকিয়া। এই ম্যাচটিতেও রেফারির বিপক্ষে স্বাগতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ সত্ত্বেও ফাইনালে ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পান সুইডিশ রেফারি ইভান এক্লিন্ড।

ইতালি ‘৩৪ বিশ্বকাপে স্বৈরশাসক মুসোলিনির প্রভাব ছিল স্পষ্ট; Image Source: soccernostalgia.blogspot.com

রোমের স্তাদিও নাজিওনালে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগের দিন ইতালির দলের হোটেলে খোদ মুসোলিনির স্বাক্ষরিত একটি টেলিগ্রাম আসে, যেখানে বলা হয়েছিল, “জয়, না হয় ধ্বংস।” ইতালির কোচ ও খেলোয়াড়দের প্রতি মুসোলিনির এই বার্তার অর্থ খুবই সহজ ছিল, মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে মাঠে নামতে হয়েছিল মন্টিসহ গোটা ইতালি ফুটবল দলকে। মন্টির জন্য এমন হুমকি নতুন কিছু না হলেও সেদিনের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।

ফাইনাল ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্য ড্রতে। বিরতির সময় ইতালির কোচ পোজ্জর কাছে আরেকটি বার্তা আসে, যেখানে বলা ছিল, “সাফল্যের দায়ভার আপনার উপরে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে ঈশ্বর আপনার সহায় হন।” ক্রমাগত হুমকির মুখে খেলতে থাকা ইতালিয়ানদের পারফর্মেন্স দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা উন্নত হলেও দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটেই অ্যান্তোনিনের গোলে পিছিয়ে পড়ে ইতালি। ম্যাচ শেষ হওয়ার মাত্র ৯ মিনিট আগে আর্জেন্টিনা থেকে ইতালিতে চলে আসা আরেক খেলোয়াড় আইমুন্ডো অরসির গোলে সমতায় ফেরে ইতালি। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ে কঠিন কোণ থেকে গোল করে ইতালির নায়ক বনে যান অ্যাঞ্জেলো শিয়াভিও। নিজের প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি তার গোল বাঁচিয়ে দিয়েছিল গোটা ইতালি দলকেও। পরপর দুবার মন্টি একরকম ফিরে এসেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে, একবার বিশ্বকাপ হাতছাড়া করে এবং শেষবার বিশ্বজয়ী হয়ে।

ইতালি ‘৩৪, যে বিশ্বকাপ জীবনের চেয়েও দামী; Image Source: fifa.com

মজার ব্যাপার হলো, শিরোপাজয়ী দল হিসেবে ইতালিকে জুলে রিমে ট্রফি দেওয়া হয়নি। মুসোলিনি মনে করতেন, জুলে রিমের মতো ছোট ট্রফি দিয়ে জয়ী দলকে অবমাননা করা হয়। ইতালিকে দেওয়া হয়েছিল মুসোলিনির নির্দেশনায় তৈরি অপেক্ষাকৃত বড় ট্রফি।

হুমকিগুলো মন্টির খেলার ইতিবাচক না নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল, তা বলা কঠিন। ভিন্ন দুই দেশের হয়ে মন্টি শুধু ফাইনালই খেলেননি, ভিনদেশ ইতালির হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপও। ফুটবল ইতিহাসে মন্টির অনন্য এই রেকর্ড অদূর ভবিষ্যতে হাত বদল হওয়ার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেই বিচারে বিশ্বকাপ ইতিহাসে মন্টি থাকবেন চিরভাস্মর হয়েই।

ফিচার ইমেজ- sportswallah.com

Related Articles