আফগানিস্তানের জয়রথ ছুটেই চলেছে। তিন ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়ে টানা ৯টি টি-টুয়েন্টি জিতে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে আফগানিস্তান। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় আয়ারল্যান্ড, স্টুয়ার্ট থম্পসন, গ্যারি উইলসন এবং পোর্টারফিল্ডের ব্যাটে চড়ে ১৬৬ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয় তারা। কিন্তু আফগান ব্যাটসম্যানদের কাছে তা মামুলি লক্ষ্যে পরিণত হয়। ব্যাট করতে নেমে শেহজাদ, সামিউল্লাহদের তাণ্ডবে ১২ বল হাতে রেখেই জয় তুলে নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে আফগানিস্তান।
ক্রিকেটে আফগানিস্তানের উন্নতি খুব দ্রুত হচ্ছে। তাদের আগে ক্রিকেটে আসা আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়েদের বলেকয়ে হারাচ্ছে তারা। তাদের এ জয়রথ শুরু হয়েছে গতবছর টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর মধ্য দিয়ে। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৪ বার, আয়ারল্যান্ডকে ৩ বার, ওমানকে ১ বার হারিয়ে টানা ৯ ম্যাচে জয় তুলে নেয় আফগানিস্তান।
এর আগে আয়ারল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড টানা ৮টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ জিতে একটানা সবচেয়ে বেশি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড নিজেদের দখলে রেখেছিল। বর্তমানে টি-টুয়েন্টিতে আফগানিস্তান যেকোনো দলের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাদের দলে শেহজাদ, নবী এবং রশিদ খানদের মতো টি-টুয়েন্টি স্পেশালিস্ট ক্রিকেটার আছে। আইপিএলের ১০ম আসরে রশিদ খান দল পেয়েছেন চড়া দামে। মোহাম্মদ নবীও দল পেয়েছেন এবারের আসরে। আফগানিস্তান ৫৭টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ৩৭ ম্যাচে জয় পেয়েছে, বিপরীতে তাদের হারের সংখ্যা মাত্র ১৯টি। শতকরা জয়ের দিক দিয়েও সবার উপরে আছে আফগানিস্তান। শতকরা ৬৬ ভাগ জয় পেয়েছে তারা ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে।
আফগানিস্তানের ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্তি অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। দ্রুত সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উন্নতি করেছে দলটি। ২০০১ সালের ঘটনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের লোকজন যেখানেই তাকাতো, সেখানেই দেখত রক্ত। যুদ্ধে জর্জরিত আফগানিস্তানের জনগণ খেলার জন্য খালি মাঠ পর্যন্ত পেত না। যদিও তখন খেলাধুলা তাদের কাছে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জীবনের কোনোরূপ নিরাপত্তা নেই সে দেশে তখন। যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হত, সেখানে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলা তো কল্পনাতীত।
এক সময় তালেবান হিংস্রতার হাত থেকে মুক্তি পেল আফগানরা। তখনো কাবুল-কান্দাহারের ভূমি রক্তাক্ত। এমতাবস্থায় খেলাধূলা তাদের কাছে দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আফগান সরকার খেলাধুলার প্রতি জোর দিল। ২০০১ সালে আফগানিস্তান আইসিসির কাছে আবেদন করে অ্যাফিলিয়েটেড সদস্যপদ পাওয়ার আশায়। আইসিসিও যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিকে নিরাশ করেনি। তখন থেকে আফগানিস্তানে ক্রিকেট খেলার প্রচলন শুরু হয়। এতে অবশ্য প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। আফগানিস্তানে বসবাসরত পাকিস্তানিদের দেখাদেখি আফগানিস্তানে ক্রিকেটের চর্চা শুরু হয়। তখনো আফগানিরা ক্রিকেটের নিয়মকানুন রপ্ত করতে পারেনি। প্রবাসী পাকিস্তানিরাই টুকটাক ক্রিকেট খেলতেন, ধীরেধীরে আফগানিরাও ক্রিকেট চর্চা শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই আফগানিস্তান ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো বিদেশ সফরে যায়। সফরটা খুব বেশি দূরে ছিল না। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের আঞ্চলিক দলের সাথে তিনটি সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলে তিনটিতেই পরাজিত হয় তারা। কিন্তু দুটি বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে হার এড়াতে সক্ষম হয় আফগানিস্তান।
২০০৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলে আফগানিস্তান। দেশটি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আয়োজিত এসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে। নিজেদের প্রথম আসর স্মরণীয় করে রাখে বাহরাইনকে হারিয়ে। এসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করার তিন বছরের মাথায় আফগানিস্তান প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়ে যায় ওমানকে হারিয়ে এসিসি টি-টুয়েন্টি কাপ জয়ের মধ্য দিয়ে। এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান এসিসি টি-টুয়েন্টি কাপের শিরোপা ২০০৭, ২০০৯, ২০১১ এবং ২০১৩ সালে ঘরে তুলেছে।
২০০৮ সালে বিশ্ব ক্রিকেট লীগের ৫ম বিভাগের সেরা দল হয়ে ২০১১ সালের বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আফগানিস্তান। ঐ আসরের ফাইনালে জার্সিকে হারিয়ে এই যোগ্যতা অর্জন করে দেশটি। শেষপর্যন্ত ২০১১ সালের মূলপর্বে জায়গা করে নিতে না পারলেও আফগানিস্তানের জনগণের কাছে ক্রিকেট হয়ে ওঠে জনপ্রিয় খেলা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছিলেন ক্রিকেটাররা। ২০০৯ সালে তৃতীয় বিভাগের ম্যাচে নামিবিয়াকে ২১ রানে হারিয়ে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে যায় আফগানিস্তান। মাত্র ৮ বছর আগে যে দেশটির জাতীয় ক্রিকেট দল ছিল না, তাদের জন্য এটি একটি বিরাট অর্জন। নিজেদের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচেই স্কটল্যান্ডকে হারায় আফগানিস্তান।
২০১০ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় আফগানিস্তান। ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের লড়াকু মনোভাব সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। ঐ বছরে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে আইসিসি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জিতে নেয় তারা। আইসিসির সহযোগী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ বিবেচনায় প্রথম শ্রেণীর এই আসরে খেলার টিকেট পেয়ে যায় আফগানিস্তান এবং আস্থার সর্বোচ্চ প্রতিদান দিয়ে শিরোপা জিতে নেয় দেশটি। ২০১০ সালের এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম আসরেই সবাইকে চমকে দিয়ে রানার্স আপ হয়ে রৌপ্য পদক জিতে নেয় আফগানিস্তান ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-২৩ দলের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর হার মানতে হয় তাদের।
২০১২ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে রানার্স আপ হয়ে আবারো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় আফগানিস্তান। ভারত এবং ইংল্যান্ডের মতো ক্রিকেটীয় পরাশক্তিদের বিপক্ষে লড়াইটা তেমন জমিয়ে তুলতে না পারলেও ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব ভালোভাবেই জানান দেয় আফগানরা। ঐ বছরেই প্রথমবারের মতো পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ খেলে আফগানিস্তান। ২০১৩ সালে বিশ্ব ক্রিকেট লীগে রানার্স আপ হয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হয় তাদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির বেঁচে থাকার উৎস হয়ে দাঁড়ায় ক্রিকেট। যে দেশটিকে বছর পাঁচেক আগে জার্সির সাথে ৫ম বিভাগের ম্যাচ খেলতে হয়েছিলো তারা ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ খেলার টিকেট পেয়ে যায়। এ গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানাবে।
আফগানিস্তান ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পায়। নিজেদের প্রথম আসরেই বাংলাদেশকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দেয় তারা। ফতুল্লায় গ্রুপ পর্বের ৫ম ম্যাচে সামিউল্লাহ শেনওয়ারি এবং স্টানিকজাইয়ের ব্যাট চড়ে ৩২ রানের জয় পেয়েছিল আফগানিস্তান। ম্যাচ শেষে তাদের উদযাপন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ক্রিকেট তাদের মাঝে নতুন প্রাণ নিয়ে এসেছে।
বর্তমানে আফগানিস্তান ১১তম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা করে নেওয়ার দোরগোড়ায় আছে। জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড এবং অন্যান্য সহকারী দেশগুলোর চেয়ে তাদের উন্নতি চোখে লাগার মতো। এখন পর্যন্ত ৭৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ৩৮টি জয় পেয়েছে আফগানিস্তান। জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ডকে টপকে ওয়ানডে টিম র্যাংকিংয়ের সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে দেশটি। তাদের ক্রিকেটের উন্নতির গল্পকার মোহাম্মদ নবী, মোহাম্মদ শেহজাদদের মতো ক্রিকেটাররা। তাদের দেখাদেখি ক্রিকেটকে জীবনের আরেকটি অংশ হিসাবে বেছে নিয়েছেন রশিদ খান, নাজিবুল্লাহ জাদ্রান এবং রহমত শাহদের মতো তরুণরাও।
মোহাম্মদ নবী আফগান ক্রিকেটের প্রধানতম মুখ। এই আফগান তারকা জন্মেছেন পাকিস্তানির এক রিফিউজি ক্যাম্পে। তখন তার প্রিয় স্বদেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত। যুদ্ধ চলাকালীন দেশ ছাড়ে তার পরিবার। রিফিউজি ক্যাম্পেই শৈশবের ১৬ বছর কাটান নবী। ২০০১ সালে রিফিউজিদের সাথে দেশে ফেরেন নবী। পরিবারের কেউ ক্রিকেট খেলেনি, এমনকি সেটা পছন্দও করতেন না। কিন্তু নবী সুযোগ পেলেই শরণার্থী শিবিরের পাশে খালি জায়গায় কাগজ-কাপড়ে জোড়াতালি দিয়ে এক ধরনের বল তৈরি করে নেমে পড়তেন মাঠে। তখনকার অবস্থায় আফগানিস্তানে ক্রিকেট খেলাটা অসাধ্য ছিল, একটুখানি খালি মাঠও পাওয়া যেতো না খেলার মতো। ক্রিকেটের প্রতি নিরেট ভালোবাসার কারণে ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে আসতে পেরেছেন নবী। বর্তমানে নিজ দেশের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতে বিশ্বের নানান দেশ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি।
আফগান উইকেটরক্ষক মোহাম্মদ শেহজাদের উত্থানও প্রায় একইরকম। পেশোয়ারের রিফিউজি শিবিরে বেড়ে ওঠা তার। সেখানে কাপড় মুড়িয়ে বল বানিয়ে ক্রিকেট খেলতেন তিনি। শেহজাদ বলেন, ঐ সময় আমাদের দুটো কাজ ছিল। ঘুমানো আর ক্রিকেট খেলা। অনেকসময় তো আমি ঘুমের মধ্যেও ক্রিকেট খেলতাম।
রিফিউজি ক্যাম্পে দু’টি মাত্র টি-শার্ট ছিল শেহজাদের। টি-শার্ট দুটোর পিঠে অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিংয়ের নাম এবং পাকিস্তানের মঈন খানের নাম লিখিয়েছিলেন। ক্রিকেটার হয়ে রিকি পন্টিংয়ের মতো ব্যাটসম্যান এবং মঈন খানের মতো উইকেটরক্ষক হওয়ার আশা ছিল বলেই হয়তো একাজ করেছিলেন। ২০০৯ সালে আফগান পেসার হামিদ হাসানের কথায় বোঝা যায় ক্রিকেটের প্রতি তাদের আবেগ এবং উন্মাদনা। কিম্যান আইসল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক জয়ের পর হামিদ বলেছিলেন, “আমি অনেক লোককে মরতে দেখেছি, কখনো কাঁদিনি। কিন্তু ক্রিকেট আমার চোখে জল এনেছে।” বছর পাঁচেক পর হয়তো আফগানিস্তান রশিদ খান, নবীদের হাত ধরে ক্রিকেটের পরাশক্তিতে পরিণত হবে।