জন্ম তার লাহোরে। বেড়েও উঠেছেন পাকিস্তানে। কিন্তু বিশ্ব চেনে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার লেগস্পিনার হিসেবে। তবে তার আসল পরিচয় একজন যাযাবর ক্রিকেটার!
হ্যাঁ, ক্যারিয়ারে পঁয়ত্রিশের উপরে দলে ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন। দুনিয়ার সব প্রান্ত ঘুরে ঘুরে ফ্রাঞ্চাইজি লিগ, ঘরোয়া ক্রিকেট; নানারকম খেলছেন। আইপিএল, কাউন্টি ক্রিকেট, পিএসএল; যেখানেই খেরুন না কেন, ইমরান তাহিরের সমর্থকের অভাব হয় না। আর ইমরান তাহির বলছেন, এই ঘুরে ঘুরে ক্রিকেট খেলে বেড়ানোটাই তার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
৩৯ বছর বয়সী লেগস্পিনার ইমরান তাহির ক্যারিয়ারে ২৫৩টি আন্তর্জাতিক উইকেট নিয়েছেন। এখন খেলছেন ডারহামের হয়ে ইংল্যান্ডের ভাইটালিটি ব্লাস্ট টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট।
ইমরান তাহির বলছিলেন, ডারহামের হয়ে এই খেলাটাও তিনি দারুন উপভোগ করছেন,
“আমি সবসময় কাউন্টি ক্রিকেটে এবং ইংলিশ কন্ডিশনের চ্যালেঞ্জে খেলাটা উপভোগ করি। কাউন্টি ক্রিকেটের প্রতিটা পর্বই ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে সামনে আসে। এটা সবসময় খুব উপভোগ্য এবং রোমাঞ্চকর একটা অভিজ্ঞতা। আমি ডারহামের কাছে কৃতজ্ঞ যে, তারা আমাকে ইংল্যান্ডে এসে এই মৌসুমে ৯টা ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি সত্যিই ডারহামে আমার এই সময়টা উপভোগ করছি। যখন ব্যক্তি হিসেবে আপনি ভালো করবেন, উইকেট নিতে থাকবেন এবং দল ভালো করবে ও ম্যাচ জিততে থাকবে; তখন আসলে সবকিছুই ভালো লাগে।’
তবে এই জীবনটা বাইরে থেকে দেখে যেমন মনে হয়, ঠিক তত সোজা নয়। রোজ দিন এই ক্রিকেট খেলে যাওয়া, ঘরোয়া ক্রিকেটেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতো করে চাপ নেওয়া; এটা কঠিন একটা কাজ। তাহির বলছিলেন, এই দিনের পর দিন ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে খেলতে গেলে নিজেকে অনুপ্রাণিত করার কাজটা নিজেকেই করতে হয়।
তাহির বলছেন, নিজের কাজটা মন দিয়ে করাটাই তার কাছে উপভোগের মন্ত্র। আর এটা করতে পারলেই এরকম ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে খেলার অনুপ্রেরণাটাও থাকে,
“আমি যত দলের হয়েই খেলি না কেন, বিশ্বের যে প্রান্তেই খেলি না কেন; অনুপ্রেরণার কমতি হয় না। এটা ঠিক যে, এরকম ঘুরে ঘুরে খেললে কেউ আপনি অনুপ্রাণিত কি না, সেটা এসে নিশ্চিত করবে না। এটা আপনাকে নিজে নিজেই করতে হবে। এটা ভেতর থেকে আসতে হবে। আপনার যদি নিজের আবেগ এবং আরও ভালো করার ইচ্ছা না থাকে, খেলার ইচ্ছা না থাকে, তাহলে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যে কাজই করুন না কেন, সেটা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করতে হবে।’
এই আবেগ বা ভালোবাসার অভাব তাহিরের কখনো হয় না। যখন যে দলের হয়ে ক্রিকেট খেলুন না কেন, একটা উইকেটের জন্য তিনি নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারেন। একটা উইকেট পাওয়ার পর যে বুনো উল্লাস তিনি করে থাকেন, সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাহির বলছিলেন,
“আমি যখন উইকেট পাই, তখন আমার মনের মধ্যে কী চলে, সেটা আমি বলতে পারি না; নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমার মনে হয় একটু স্বস্তি মেলে উইকেট পেলে। প্রতিটা উইকেট পাওয়ার পর আমার মনে হয়, আমি সর্বোচ্চ স্তরে ক্রিকেট খেলার জন্য যে দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি, অবশেষে তার সুফল পেলাম। ফলে আমি স্রেফ উপভোগ করি। আর প্রতিটা উইকেট স্মরণীয় করে রাখতে চাই। আমি মনে করি, প্রতিটা উইকেট আমার জন্য বিশেষ কিছু। সেটা আমি ক্লাব ক্রিকেটে পাই আর আন্তর্জাতিক উইকেটে পাই; একই মূল্য আমার কাছে। সম্ভবত আমার ভেতরে যে আবেগ জমা হয়ে থাকে ক্রিকেট নিয়ে সেটাই উইকেট পাওয়ার পর বেরিয়ে আসে।”
সামনে ২০১৯ বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের দিকে আরও অনেকের মতো চেয়ে আছেন ইমরান তাহির। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার যে একটা দুর্ভাগ্য প্রতিটা বিশ্বকাপে এসেছে, এ অবধি, তাতে তাদের জন্য আরেকটা বিশ্বকাপ মানে কঠিন আরেকটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ব্যাপারটাকে বাস্তব করার জন্য মুখিয়ে আছেন তাহির। বলছিলেন,
“আমি আগামী বছরের বিশ্বকাপ খেলার জন্য মুখিয়ে আছি। আমি চাই, দক্ষিণ আফ্রিকা যেন এবারের বিশ্বকাপটায় ভালো করতে পারে। আমাদের ভালো একটা দল আছে। আর অসাধারণ একদল ক্রিকেটার আছে, যারা শেষ অবধি লড়াই করবে এবং কখনোই হাল ছাড়বে না। আমি এটা বলতে পারি না যে, আমরা বিশ্বকাপ জিতবোই। তবে এটুকু বলতে পারি যে, আমরা সেমিফাইনাল অবধি অন্তত যাবোই। তারপর তো যে কোনো কিছুই সম্ভব।”
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নটার পথে সাম্প্রতিক সময়ে দুটো বড় ধাক্কা হলো মরনে মরকেলের অবসর ও ডেল স্টেইনের ইনজুরি। স্টেইন বিশ্বকাপের পর আর সাদা বলের ক্রিকেট খেলবেন না, এটা নিশ্চিত এখন। এই দুজনকে বাদে আফ্রিকার পথচলাটা যে কতটা কঠিন হবে, সেটা আর সবার মতোই ইমরান তাহিরও জানেন। তিনি বলছিলেন, এই দুই বোলারের বিকল্প খু ঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন,
‘জ্যাক ক্যালিসের মতোই ব্যাপারটা। আপনি স্রেফ মরনে মরকেল আর ডেল স্টেইনের বিকল্প খুঁজে পাবেন না। এরা দুজন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের অনন্য দুই সেবক। আমি এরকম দুজন পারফরমারকে শুধু স্যালুট জানাতে পারি। এখন আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা দল আশা করতে পারি যে, স্টেইনকে আমরা বিশ্বকাপে দারুনভাবে একটা বিদায় জানাতে পারবো।’
ইমরান তাহির কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে চিন্তা করেন, ব্যাপারটা তা নয়। বিশ্ব জুড়ে যে লেগস্পিনারদের উত্থান ঘটছে, তাতে দারুন খুশি তিনি। বিশেষ করে নিজের মাতৃভূমি পাকিস্তানে শাদাব খানের মতো একজন তরুন লেগস্পিনার উঠে আসায় বেশ উচ্ছসিত প্রতিক্রিয়া জানালেন তাহির। বলছিলেন, শাদাব কেবল একজন লেগস্পিনার নয়, অলরাউন্ডার হিসেবেও রোমাঞ্চকর,
‘মনে হচ্ছে, বিশ্ব জুড়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লেগস্পিনাররা একটা নতুন করে শক্তি পাচ্ছে। আমি মনে করি, শাদাব কেবল একজন ভালো লেগস্পিনার নয়, সে দারুন একজন অলরাউন্ডার। সে খুবই প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার। সে যেখানেই ক্রিকেট খেলুক, এরই মধ্যে পৃথিবীকে দেখাতে পেরেছে যে, সে একজন বিশ্বমানের বোলার। এখন সে অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আরও ভালো হবে। তাকে সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।’
শুধু শাদাব খান নয়, লেগস্পিনার হিসেবে আদিল রশীদকেও বেশ পছন্দ তাহিরের। আদিল কিছুদিন আগে বড় দৈর্ঘের ম্যাচ খেলা ছেড়েই দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে টেস্ট ক্রিকেটে ডাক না পেয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তার পারফরম্যান্স দেখে তাকে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দলে ডাকা হয়েছে।
আদিল রশীদকে টেস্টে ডাকা এবং একেবারেই ব্যবহার না করা নিয়ে বিতর্ক কম হচ্ছে না। তবে তাহির মনে করেন, আদিলের ক্ষমতা আছে, টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করার,
“আপনার দল যদি আপনাকে টেস্ট খেলতে ডাকে, আপনি তো ‘না’ বলতে পারেন না। আদিল কাউন্টিতে লাল বলের ক্রিকেটকে ‘না’ বলে দিয়েছিলো। কিন্তু দেশের পক্ষে খেলার যখন ডাক এলো, তখন ও ইংল্যান্ডকে ‘হ্যাঁ’ বলেছে। দেশের পক্ষে খেলাটা একটা গর্বের ব্যাপার। আমার ধারণা, আদিল টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করবে। ও অসাধারণ একজন ক্রিকেটার।’