বিশ্বকাপ মানেই কেবল মাঠের লড়াইয়ের গল্প নয়। বিশ্বকাপ মানেই কেবল জয়-পরাজয়ের গল্প নয়। এখানে আরও কিছু হাসি-কান্নার গল্প থাকে। ইনজুরি বা অসুস্থতা শেষ মুহুর্তে কেড়ে নেয় অনেকের বিশ্বকাপ। তেমনই দশ তারকার গল্প রইলো আজ।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (স্পেন, ১৯৬২)
এমনিতেই ডি স্টেফানোকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের ছোট্ট তালিকায় রাখা হয় সবসময়। কিন্তু একটা জায়গায় তাকে এক নম্বরে রাখতে হয়। তিনি বিশ্বকাপ না খেলা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা।
বিশ্বকাপ খেলার জন্য চেষ্টা কম করেননি। প্রথমে জন্মভূমি আর্জেন্টিনার হয়ে কিছুদিন খেলেছেন। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ৬টি ম্যাচও খেলেছেন। কিন্তু ১৯৫০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খেলতে অস্বীকৃতি জানালে সে বিশ্বকাপ খেলার প্রথম সুযোগ নষ্ট হয় এই রিয়াল মাদ্রিদ গ্রেটের। এরপর ১৯৫৪ বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি আর্জেন্টিনা। এরপর কিছুদিন তিনি কলম্বিয়ার হয়ে খেলেছেন। যদিও কলম্বিয়ার এই ম্যাচগুলো ফিফা স্বীকৃত ছিলো না। তারপর ১৯৫৭ সাল থেকে ডি স্টেফানো যোগ দেন স্পেন দলে। যেহেতু রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলতে এই দেশটিতে দীর্ঘকাল কাটিয়ে ফেলেছেন, তাই এতে সমস্যা হয়নি। তখন সামনে ছিলো ১৯৬২ বিশ্বকাপ।
স্পেন তখন দুর্দান্ত একটি দল। এই দলের সাথে ডি স্টেফানোর বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত। কিন্তু সেই সময় হানা দিলো ইনজুরি। মাংসপেশীর এক ইনজুরিতে বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সময় ছিটকে পড়লেন তিনি। বিশ্বকাপ তার জন্য এক হতাশার নাম হয়ে রইলো।
ড্যানিয়েল প্যাসারেলা (আর্জেন্টিনা, ১৯৮৬)
আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে দেশটিতে তিনি তখন অনেক বড় কিংবদন্তী। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৮২ বিশ্বকাপ আর তার খেলা হয়নি। এর মধ্যে আর্জেন্টিনা দলে চলে এসেছেন নতুন তারকা ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার সাথে প্যাসারেলার সম্পর্ক শুরু থেকেই শীতল ছিলো। তারপরও কোচ কার্লোস বির্লাদো প্যাসারেলাকে দলে ডেকেছিলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে দারুণ খেলেছিলেনও তিনি। বিশেষ করে পেরুর বিপক্ষে তার গোল আর্জেন্টিনাকে বাছাইপর্ব পার হতে সহায়তা করে।
ম্যারাডোনা বনাম প্যাসারেলা সম্পর্কটা দিনেকে দিন খারাপ হতে থাকে। ম্যারাডোনাকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেন সাবেক অধিনায়ক প্যাসারেলা। এর মধ্যে ম্যারাডোনাকে অধিনায়ক ঘোষণা করে দেন কোচ। দুজনের সম্পর্ক বিশ্বকাপকে বিপদে ফেলে কি না, এ নিয়ে সংশয় ছিলো। কিন্তু এর মধ্যেই কোলনের এক অসুখে আক্রান্ত হয়ে একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন প্যাসারেলা। ফলে তার আরেকটি বিশ্বকাপ আর খেলা হলো না।
মার্কো ফন বাস্তেন (হল্যান্ড, ১৯৯৪)
১৯৯০ বিশ্বকাপে মার্কো ফন বাস্তেনকে দেখাটা বিশ্ববাসীর কাছে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিলো। যদিও দুই বছর আগে হল্যান্ডকে ইউরো জেতানোর পথে যা করেছিলেন বা ক্লাবের হয়ে যা করেছেন, তার কিছুই বিশ্বকাপে করতে পারেননি। তারপরও তার দৌড়, মাঠের স্টাইলে মুগ্ধ হয়ে যায় কোটি কোটি দর্শক। নব্বই বিশ্বকাপে ব্যর্থ হলেও প্রতিশ্রুতি ছিলো যে, পরের বিশ্বকাপে জ্বলে উঠবেন তিনি।
সেভাবেই ক্লাব দল মিলানকে নিয়ে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপের প্রায় এক বছর আগে কার্যত বাস্তেনের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। ১৯৯৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলতে এসেছিলেন ইনজুরি থেকে সেরে উঠে। কিন্তু ফাইনালে বাসিলে বলির এক ট্যাকল তাকে মাঠ থেকে ছিটকে দেয়। এরপর থেকে বাস্তেন সেরে ওঠার কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময় বোঝা যায়, তার পক্ষে আর বিশ্বকাপ খেলা সম্ভব হচ্ছে না।
রোমারিও (ব্রাজিল, ১৯৯৮)
১৯৯৪ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন রোমারিও। তার অসাধারণ সব গোল এবং দারুণ ফর্ম তাকে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতিয়েছিলো। সেই সাথে দলকে তিনি করেছিলেন চ্যাম্পিয়ন। চার বছর পরও রোমারিও ছিলেন দারুণ ফর্মে। বিশ্ববাসী চেয়েছিলো, আরেকটি বিশ্বকাপে রোমারিওর জাদু দেখবে বলে।
কিন্তু মাংসপেশীর ইনজুরি ছিটকে দিলো রোমারিওকে।
এই ছিটকে যাওয়া নিয়ে অবশ্য কম নাটক হয়নি। রোমারিও সেরে উঠছেন, সেরে উঠছেন; এমন সব খবর বাজারে চাউর ছিলো। কিন্তু ফিফার কাছে দল জমা দেওয়ার শেষ দিনেও দেখা গেলো রোমারিও সেরে ওঠেননি। ফলে তার নাম জমা দেওয়া হয়নি। এরপর ২০০২ বিশ্বকাপে বয়সটা বেড়ে গেলেও তাকে দলে রাখেননি লুই ফেলিপ স্কলারি। এ নিয়ে স্বয়ং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হস্তক্ষেপ করেছিলেন ঘটনায়।
এমারসন (ব্রাজিল, ২০০২)
১৯৯৮ সালে তিনি ছিলেন রোমারিওর বদলী। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। ২০০২ বিশ্বকাপে সেই তাকেই ইনজুরিতে পড়ে বাইরে বসে দেখতে হয়েছে দলের বিশ্বকাপ জয়।
তাকে অধিনায়ক করেছিলেন স্কলারি। একটি হালকা চালের প্রস্তুতিমূলক ম্যাচে পড়ে যান এমারসন। পড়ে গিয়ে কাঁধ স্থানচ্যুত হয় তার। সেই ইনজুরি থেকে আর সেরে ওঠা হয়নি। তার বদলী হিসেবে দলে এসেছিলেন গিলবার্তো সিলভা।
মাইকেল বালাক (জার্মানি, ২০১০)
মাইকেল বালাক তখন জার্মানির অধিনায়ক এবং দলের প্রাণভোমরা। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে এফএ কাপের ফাইনালে ইনজুরিতে পড়েন তিনি। কেভিন-প্রিন্স বোয়াটেংয়ের রাফ ট্যাকলে বিশ্বকাপ মিস হয় তার। বোয়াটেং ভাইদের এই কেভিন-প্রিন্স ছিলেন ঘানা দলের সদস্য। যে ঘানা আবার বিশ্বকাপে জার্মানির প্রতিপক্ষ ছিলো। তাই কেভিন-প্রিন্স ইচ্ছে করে এই ইনজুরি ঘটিয়েছেন, এমন গুজবও সে সময় বাজার গরম করে ফেলেছিলো।
এই ইনজুরি বাস্তবিক অর্থে বালাকের ক্যারিয়ারে প্রবল প্রভাব ফেলে।
ডেভিড বেকহ্যাম (ইংল্যান্ড, ২০১০)
দক্ষিণ আফ্রিকায় ডেভিড বেকহ্যামের যাওয়াটা নিশ্চিত ছিলো। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম স্টাইলিশ ও ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞতম এই আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হঠাৎ করেই ইনজুরিতে পড়েন। একিলিস টেন্ডনের এই ইনজুরি তাকে বিশ্বকাপের দল থেকে ছিটকে দেয়।
২০০৬ সালের দিকে অনেকটাই পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন বেকহ্যাম। কিন্তু সেসময় ফ্যাবিও ক্যাপেলো আবার তাকে দলে ডাকেন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিনি হয়ে ওঠেন দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। তখন আবার বেকহ্যাম আরেকটি বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় ইনজুরিতে।
ফ্রাঙ্ক রিবেরি (ফ্রান্স, ২০১৪)
বায়ার্ন মিউনিখের উইঙ্গার রিবেরি ফ্রান্সের বাছাইপর্বে ছিলেন তুখোড় ফর্মে। তার ৫ গোলে ভর করেই স্পেনের পেছনে থেকে ২০১৪ বিশ্বকাপে যায় ফ্রান্স। ১৯৯৮ চ্যাম্পিয়নরা আরও ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখছিলো তখন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বকাপের মাত্র কয়েক দিন আগে পিঠের ইনজুরিতে পড়েন রিবেরি। তাকে ছাড়াই ব্রাজিলে যেতে হয় ফ্রান্সকে।
দানি আলভেজ (ব্রাজিল, ২০১৮)
আলবেজ ব্রাজিলের হয়ে ১০৪টি ম্যাচ খেলেছেন। ব্রাজিলের ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন কেবল কাফু ও রবার্তো কার্লোস। ক্যারিয়ারের এই শেষ দিকে এলেও ব্রাজিল দলে তার গুরুত্ব এখন আগে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তিনি সম্প্রতি তিতের অধীনে অধিকাংশ ম্যাচে শুরুর একাদশে থাকছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য তো বলে কয়ে আসে না। সদ্য শেষ হওয়া কুপে ডে ফ্রান্সের ফাইনালে লিগামেন্টের ইনজুরিতে পড়েন তিনি। শেষ হয়ে যায় দানি আলভেজের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
সার্জিও রোমেরো (আর্জেন্টিনা, ২০১৮)
রোমেরো বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের একজন নন। কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য দারুন মূল্যবান এই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলরক্ষক। সর্বশেষ প্রায় এক দশক ধরে আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের নিচে তিনি নির্ভরতার প্রতীক। গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার অন্যতম নায়ক ছিলেন এই রোমেরো।
এবারও আর্জেন্টিনা তাকে দলে ভেবেই রণকৌশল সাজাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ মুহুর্তের এক হাঁটুর ইনজুরি শেষ করে দিয়েছে তার স্বপ্ন।