Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বাদে বিশ্বকাপে আসা লাতিন দলগুলোর খুঁটিনাটি

লাতিন আমেরিকার কথা আসলেই শুরুতেই চলে আসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কথা। এই দিয়েই শুরু, এই দিয়েই শেষ। লাতিন আমেরিকার শৌর্য-সৌন্দর্য হয়তোবা এখন অতীত, কিন্তু বাকি দলগুলো তো একেবারেই মিইয়ে যায়নি। এখনো প্রতিভার জন্য ইউরোপের ক্লাবগুলো লাতিন দলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকের এই লেখায় আমরা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইরে বাকি তিন লাতিন দল নিয়ে আলোচনা করবো।

উরুগুয়ে

অস্কার তাবারেজ উরুগুয়েতে খুব জনপ্রিয় লোক। ৭১ বছরের এই বুড়ো এক যুগ ধরে উরুগুয়েকে সামলাচ্ছেন। দুরারোগ্য বিরল রোগে আক্রান্ত, প্রায়ই সাময়িক প্যারালাইজড হয়ে যায় তার দেহের নিম্নাংশ। ক্র্যাচে ভর করে ট্রেনিং করান আর বলেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার মাথা অবশ হয় না।” তাঁর হাত ধরেই উরুগুয়ে ২০১০-১২ সালে গোল্ডেন সময় কাটিয়েছে, কোপা আমেরিকা জয়, বিশ্বকাপ সেমিতে উঠে আসা- এসব তাঁরই হাত ধরে। এই দলের তিনজন খেলোয়াড় বাদে আর সবার অভিষেক তাঁরই দেয়া।

দীর্ঘকাল উরুগুয়েকে কোচিং করানো তাবারেজ; Source:FIFA.Com

খুব ভালোভাবে চলতে থাকা বাছাইপর্বে আচমকা তিন ম্যাচ হার ও এক ম্যাচ ড্র-তে টালমাটাল হয়ে যায় উরুগুয়ে। সেই পর্যন্ত উরুগুয়ের নীতি ছিল রক্ষণে প্রচন্ড মনোযোগ দেয়া। মাঝমাঠেও এমন খেলোয়াড় বাছাই করা হতো যাদের মূল কাজই থাকতো রক্ষণে সাহায্য করা। এরপর বিশ্বকাপে উঠতে না পারা দুই দল ইতালি ও আয়ারল্যান্ডের সাথে শোচনীয় খেলা তাবারেজের মন বদলে দেয়। বয়স্ক, রক্ষণাত্মক মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের বদলে নিয়ে আসেন প্রচন্ড প্রতিভাবান, বল পায়ে দক্ষ তরুণ রিয়াল মাদ্রিদের সেনসেশন ফেদে ভাল্ভার্দে, জুভেন্টাসের বেন্তানচুর ও ইন্টারের ভেসিনোকে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। দ্বিতীয় হয়েই উঠে যায় বিশ্বকাপে।

উরুগুয়ের শক্তি

উরুগুয়ের শক্তি তাদের যুব একাডেমি থেকে উঠে আসা একঝাঁক প্রচন্ড প্রতিভাবান খেলোয়াড়। এত এত তরুণ প্রতিভাবান লাতিন আমেরিকায় খুব কম দেশেরই আছে। উরুগুয়ের সেন্টার ডিফেন্সের দুই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের খেলোয়াড় জিমেনেজ-গডিন জুটি বিশ্বের যেকোনো বড় দলের সমতুল্য। উরুগুয়ের রক্ষণভাগ অনেক বড় দলের চেয়েও বেশি শক্ত, রিজার্ভ বেঞ্চেও আছে একঝাঁক প্রতিভা। ৪-৪-২ ফর্মেশনে দুই স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন সুয়ারেজ ও কাভানি। তাদের নিয়ে বিশেষ কি কিছু বলার আছে? ফ্রান্স ও স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নদের দলের মূল স্ট্রাইকার তারা, ইউরোপের আকাঙ্ক্ষিত দুই ফরোয়ার্ড নিজেদের সেরা ফর্মে যেকোনো দলের জন্যই ত্রাস। কী দেখলেন পাঠক? উরুগুয়ের রক্ষণ ও আক্রমণ কিন্তু ফেলনা কিছু না!

উরুগুয়ের রক্ষণ প্রাচীর গডিন; Source:ThoughtCo

কিন্তু যে জিনিসটা বিশ্বকাপ জেতায় তা হলো মাঝমাঠ। এই মাঝমাঠেই তাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা, অতীতমুখী নাকি ভবিষ্যৎগামী? সম্ভবত তাবারেজ বেন্তাচুর, ভেসিনো, ভালভার্দের মধ্যে যেকোনো দুই তরুণের সাথে গ্যাস্টন রামিরেজ ও রড্রিগেজের মতো দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে নিয়ে মাঝমাঠ সাজাবেন।

গ্রুপ: রাশিয়া, সৌদি আরব, মিশর

মূল তারকা: সুয়ারেজ, কাভানি, গডিন

নতুন সম্ভাব্য তারকা: বেন্তাচুর

সম্ভাব্য নক আউট প্রতিপক্ষ: উরুগুয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে শেষ ষোলোয় দেখা হবে পর্তুগালের সাথে আর কোয়ার্টারে স্পেনের সাথে। গ্রুপ রানার আপ হলে শেষ ষোলোয় মুখোমুখি হবে স্পেনের সাথে! অতএব খুব একটা নাটকীয় কিছু না হলে উরুগুয়ের যাত্রা শেষ ষোলোয় থেমে যেতে পারে।

পেরু

পেরুর বাছাইপর্বের শুরুটা ছিল ভুলে যাওয়ার মতো। প্রথম চার ম্যাচে কোনো জয় নেই। সাত ম্যাচ পর গারেকাকে কোচ করে আনা হয়। গারেকারও বেশ সময় লাগছিল ফলাফল এনে দিতে। ফেডারেশন সময় দিল। গারেকাও বেছে বেছে তরুণ রক্ত নিয়ে এলেন। দলের রক্ষণকেই শক্তি বানালেন। আক্রমণভাগে লাতিন আমেরিকার পরীক্ষিত স্ট্রাইকার গুরেরো আর ফারফানের ভরসায় ফলাফল পেতে শুরু করে। ২০১৬ তে ব্রাজিলের কাছে ২-০ তে হারের পর আর কোনো ম্যাচ হারেনি। উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা তাদের রক্ষণ দেয়ালে মাথা ঠেকে ফিরেছে। প্লে অফ খেলে নিশ্চিত হয় তাদের বিশ্বকাপ।

৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে তুলে আনায় পেরুবাসীর কাছে কোচ গারেকা এখন নায়ক; Source:Télam

শক্তি ও দুর্বলতা

পেরুর শক্তিই তার রক্ষণভাগ। কোচের দর্শনই হলো গোল কম হজম করে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের উপর চাপ কমানো। লুজ বলে বেশ গতিশীল পেরু। সবচেয়ে বড় ব্যাপার দলের সদস্যরা ড্রেসিংরুমে একপ্রকার পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। যার ফলে যেকোনো খেলোয়াড় তাঁর সহ খেলোয়াড়ের ভুল ঢাকতে মাঠে সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত থাকে।

আর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তাদের অভিজ্ঞতার অভাব। ৩৫ বছর পর বিশ্বকাপে এলো পেরু। খেলোয়াড় বা কোচ কারোরই বড় পর্বে খেলার অভিজ্ঞতা নেই। দলের মূল তারকা পাবলো গুরেরোর ড্রাগজনিত নিষেধাজ্ঞাও পেরুর জন্য বিশাল ধাক্কা।

পেরুর সবচেয়ে বড় তারকা গুরেরোর না থাকা পেরুর জন্য বড় ধাক্কা; Source:Mundo D – La Voz

গ্রুপ: ফ্রান্স, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া

তারকা খেলোয়াড়:&ফারফান

সম্ভাব্য নক আউট প্রতিপক্ষ:সত্যিকার অর্থে পেরুর গ্রুপপর্ব পার হওয়াও এখনো নিশ্চিত না। নিশ্চিতভাবেই ফ্রান্স গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইয়ে ফেভারিট। যদি ডেনমার্ককে হারাতে পারে পেরু, তবে শেষ ষোলোয় যেতে পারবে। সেক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার সাথে দেখা হবে পেরুর।

কলম্বিয়া: ২০১৪ বিশ্বকাপের চমক

হোসে পেকারম্যান ছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ। সেই আর্জেন্টিনা দলের কথা মনে আছে? রিকেলমে, তেভেজের হাত ধরে আক্রমণ আর হেইঞ্জ, সোরিনদের রক্ষণ মিলিয়ে ২০১৪ র আগে এটাই ছিল বলার মতো এক আর্জেন্টিনা দল। পেকারম্যানের দলগুলো সাধারণত একটু গোছালোই হয়। সাত বছর আগে দায়িত্ব নিয়ে তিনি কলম্বিয়াকেও বদলে দেন। ২০১৪ সালে কলম্বিয়া কাটায় স্বপ্নের এক বিশ্বকাপ। উঠে আসে কোয়ার্টার ফাইনালে। কলম্বিয়া চাইবে একইভাবে আবার সবাইকে চমকে দিতে। কিন্তু এবারের বাস্তবতা একটু আলাদা। রক্ষণভাগ বুড়িয়ে গেছে, আক্রমণভাগে নতুন রক্ত নেই। ২০১৪ সালে পেকারম্যানের হাতে ফর্মে থাকা বাক্কা, মার্টিনেজ, ফ্যালকাওদের মতো একঝাঁক অপশন ছিল। কিন্তু চার বছর পর বলার মতো এমন কেউ উঠে আসেনি, উপরন্তু ফর্ম হারিয়ে নিজেদের খুঁজছেন বাক্কারা।

কলম্বিয়ার সম্ভাব্য রক্ষণ জুটি ইয়েরি মিনা ও সানচেজ হবে এবারের কনিষ্ঠতম রক্ষণ জুটি; Source:Marca

কলম্বিয়ার রক্ষণে বাধ্য হয়ে পেকারম্যান নামাতে পারেন বার্সার নবাগত ইয়েরি মিনা ও টটেনহ্যামের উঠতি তারকা ডেভিনসন সানচেজকে। তাহলে কলম্বিয়ার রক্ষণ জুটিই হবে বিশ্বকাপে সব দলের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি জুটি। তাদের প্রতিভা নিয়ে কারোরই সন্দেহ নেই, কিন্তু এত বড় আসরে তারা কি এমন একটা দলের রক্ষণের দায়িত্ব সামলাতে পারবেন যাদের মূল শক্তিই রক্ষণ?

আশার প্রতীক

কলম্বিয়ার মূল খেলোয়াড় জেমস রদ্রিগেজ। মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ পুরোটাই তার উপর কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। জেমস নিচে নেমে খেলা বিল্ডআপে অংশ নেন, আবার সময় মতো আক্রমণে সঠিক জায়গায় পৌঁছে যান। দলের ফ্রি-কিক, কর্নার সবকিছুই তার উপর ন্যস্ত। জেমসও সেই উত্থানের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশকে প্রায় একাই টেনে যাচ্ছেন। তাকে ফ্রি রোল দিয়ে পেকারম্যান ৪-৩-২-১ এ সাজাবেন। উদ্দেশ্য হবে নতুন রক্ষণ জুটিকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেয়া আর জেমস-ফ্যালকাওদের দ্বারা দ্রুত প্রতি আক্রমণে যাওয়া।

কলম্বিয়ার প্রাণভোমরা বিশ্বনন্দিত মিডফিল্ডার জেমস রদ্রিগেজ; Source:citifmonline.com

গ্রুপ: জাপান, সেনেগাল, পোল্যান্ড

তারকা: হামেস রদ্রিগেজ, ফ্যালকাও

উদীয়মান তারকা:ডেভিনসন সানচেজ ও ইয়েরি মিনা

সম্ভাব্য নক আউট প্রতিপক্ষ:কলম্বিয়ার গ্রুপ বেশ সুষম। তবে কাগজে-কলমে ও অভিজ্ঞতায় কলম্বিয়াকেই সম্ভাব্য গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে হামেসের ক্লাব সতীর্থ লেভানডস্কির পোল্যান্ড। এই ম্যাচই ঠিক করে দেবে কে হবে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে শেষ ষোলোয় দেখা হবে ইংল্যান্ড বা বেলজিয়ামের সাথে আর এরপর জার্মানির সাথে! আর গ্রুপ রানার আপ হলে শেষ ষোলোয় বেলজিয়াম/ইংল্যান্ড ও এই ম্যাচ জিতলে এরপর ব্রাজিলের সাথে! সব দিকেই কিন্তু বিপদ!

এই ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইরে বাকি তিন লাতিন দলের ছোট্ট ফিরিস্তি। উপরের লেখায় একটা জিনিস দেখেছেন পাঠক, তিন দলেরই মূল শক্তি রক্ষণ! অথচ একসময় লাতিন ফুটবল মানেই ছিল শৈল্পিক আক্রমণ। স্পষ্টতই লাতিন ফুটবল তার জৌলুশ হারিয়েছে। পেরু, কলম্বিয়া বা উরুগুয়ে কারো পক্ষেই বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরা সম্ভব না, কিন্তু নিজেদের দিনে এদের প্রত্যেকেই, বিশেষ করে উরুগুয়ে, হয়ে উঠতে পারে ‘জায়ান্ট কিলার’।

ফিচার্ড ইমেজ: The National

Related Articles