
লিওনেল মেসিকে নিয়ে ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার ও প্রখ্যাত ফুটবলবোদ্ধা গ্যারি লিনেকারের এই বিশেষ কলামটি প্রকাশিত হয়েছে বিবিসিতে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে সাড়া জাগানো কলামটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ।
লিওনেল মেসি একজন খেলোয়াড়, যে অনুভূতির আলোড়ন তোলে এমনভাবে, যা আর কেউ পারে না। সে খেলাকে রূপান্তরিত করে শিল্পে।
প্রত্যেকবার যখন আমি তাকে দেখি, এমনকি তার বাজে দিনগুলোতেও, কিছু মুহূর্ত আসে যখন ভাবতে হয়, “কীভাবে এটা করল?” এরকম কিছু কাণ্ড একটি খেলায় সে তিন থেকে চারবার ঘটায়, যা হয়তো আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে একবারও পারিনি। সে এমন সব কাজ করে, যা আর কেউই পারে না।
সম্প্রতি আমার ঠিক একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মাইকেল জর্ডানকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘দ্য লাস্ট ডান্স’ দেখতে বসে। আমি বাস্কেটবল খেলার ভক্ত নই, এবং কখনো খেলাটিকে সেভাবে অনুসরণও করিনি, তবু আমার সিরিজটি দারুণ লেগেছে, এবং আপনি নিজেও দেখতে পাবেন সেখানে জর্ডানের মহত্ত্ব কতটা ভাস্বর হয়ে উঠেছে।
জর্ডান একেবারে ভিন্ন একজন ব্যক্তিত্ব, এবং অনেক বেশি বহির্মুখী, এটা সত্যি। কিন্তু আপনি মেসিকেও অভিন্নভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন এমন একজন আইকন হিসেবে, যার প্রভাব ও সক্ষমতা তার নিজের খেলাকেও অতিক্রম করে গেছে। জর্ডানকে ভালোবাসতে যেমন আপনার বাস্কেটবলকেও ভালোবাসা জরুরি নয়, তেমনই মেসিকে দেখার মাধ্যমে খাঁটি আনন্দের নির্যাস পেতে আপনাকে ফুটবলপ্রেমীও হতে হবে না।
জর্ডানের মতোই সে এই খেলাটির শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড় ঠিক এই কারণেই।

লোকে বলতে পারে, অন্য খেলোয়াড়রাও মেসির চেয়ে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় শ্রেয় – উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কথা, যে নাকি একজন অপেক্ষাকৃত ভালো গোলস্কোরার। আমি এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করব বটে, তবে আমি অন্তত এই তর্কটিকে বুঝতে পারি, কারণ সংখ্যার দিক দিয়ে তাদের মাঝে খুব বেশি কিছু তফাৎ নেই, মোটামুটি খেলাপ্রতি একটির মতো গোল।
কিন্তু এটি শুধু মেসির গোল করার বিস্ময়কর পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ নয়। আরো অনেক জিনিসের এক অসাধারণ সংমিশ্রণই তাকে পরিণত করেছে একজন অনন্য খেলোয়াড় রূপে।
সর্বকালের সেরা ড্রিবলার হিসেবেও ডিয়েগো ম্যারাডোনার সাথে এক কাতারে অবস্থান করবেন মেসি, কেননা তাদের উভয়েরই রয়েছে ট্যাকল সামলানো এবং চারদিক থেকে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা ঘিরে ধরার অবিশ্বাস্য কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার সক্ষমতা।
আর এই সবকিছুকে ছাপিয়ে সে একদম নিশ্চিতভাবেই এ খেলায় আমাদের দেখা সেরা পাসার – সে এমন সব দৃশ্য দেখতে পায়, যা সাধারণ মানুষদের দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। মনে হয় যেন খেলা চলাকালীন সে একই সাথে মাঠে খেলছে, আবার উপর থেকে খেলাটি দেখছে। তবে এই স্তুতিও তার মহত্ত্বের প্রতি পূর্ণ সুবিচার করতে যথেষ্ট নয়।
চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনার খেলা কভার করতে গিয়ে ন্যু ক্যাম্পে তার অনেক খেলাই আমি দেখেছি, এবং অনেক সময়ই এটি হয়েছে যে সে এমন সব নিখুঁত পাস দিয়েছে, যেগুলো আমি বা আমার পাশের অন্য কেউ খেয়ালই করেনি, অথচ উপর থেকে দেখতে থাকায় আমাদের পক্ষেই কাজটি অনেক সহজ হবার কথা ছিল।
অন্য আর সবকিছু যদি বাদও দিই, এই ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি ও সচেতনতাই হলো প্রধানতম বিষয়, যা তাকে একজন খেলোয়াড় হিসেবে অতুলনীয় এবং প্রতিভা হিসেবে অকল্পনীয় করে তোলে। হ্যাঁ, সে একজন চমৎকার ফিনিশারও বটে, এবং নিয়মিতই সে নিজে জালের উপর দিকটায় বল জড়িয়ে দেয়। তবু যদি কখনো পাস দেয়ার সুযোগ থাকে, এবং সেটি করা তার কর্তব্য হয়ে থাকে, তবে ঠিকই সে তা করবে।
সে কেবল নিঃস্বার্থই নয়, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতাও ব্যতিক্রমী। সে যা করে, যেভাবে করে, কেউ সেটা আজও করে না, আগেও কেউ করেনি কোনোদিন।

তার কল্পনাশক্তি ও নৈপুণ্য পুরোপুরি স্বতন্ত্র ধারার, সত্যি। তবে আরো অনেক কারণ রয়েছে, যেগুলোর জন্য আমাদের উচিৎ যতদিন পারা যায় মেসিকে উপভোগ করে যাওয়া। আর সেটাই তাকে করে তুলেছে অনুসরণীয় এক অসামান্য দৃষ্টান্ত।
মেসি ফুটবলের ময়দানে আনন্দ নিয়ে আসে – সে অভিনয় বা ভান করে না, ডাইভ দেয় না, এবং সচরাচর সে রেফারির সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় না, কিংবা নিজের সাথে হওয়া কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয় না।
তবে অবশ্যই সে কিছু সুবিধা পায়, কিছুকাল আগে হওয়া নীতিমালা পরিবর্তনের কল্যাণে। এগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে দুরন্ত সব খেলোয়াড়দেরকে অন্যের প্রতিহিংসা থেকে বাঁচাতে, কেননা ইতঃপূর্বে ম্যারাডোনার মতো অনেককেই এসবের শিকার হতে হয়েছে।
তারপরও যে পরিমাণ ম্যাচ মেসি খেলেছেন, এবং এত কম ইনজুরিতে পড়েছে, তা বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য। এই বিষয়টি বিবেচনা করলে সে এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দু’জনই চমকপ্রদ সৃষ্টি।
তার অর্থ হলো, দীর্ঘস্থায়িত্বও লিওনেল মেসির কিংবদন্তির আরেকটি অংশ, কেননা উপরে বলা সবকিছুই সে তার কিশোর বয়স থেকে করে চলেছে, এবং এই জুনে তার ৩৩ বছর পূর্ণ হবে।
আমাদের আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে এত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে এত ভালো করতে দেখে, আর সেটার পেছনে রয়েছে খেলাটির প্রতি তার ভালোবাসা, তার চরিত্র, এবং এই খেলার শীর্ষাসনে অনড় থাকতে চাওয়ার তাড়না।
সম্ভবত রোনালদোর গ্রেটনেসও এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছে, কেননা অবশ্যই তারা বছরের পর বছর ধরে একে অন্যকে ক্রমাগত ঠেলে দিয়েছে উচ্চতর মাত্রায়। কিন্তু তবু, কখনোই মাঠের বাইরের কোনো ইস্যু মেসিকে তার লক্ষ্য থেকে বিচলিত করতে পারেনি। অথচ এর বিপরীত ঘটনাই ঘটেছিল নিজের সেরা সময়ে থাকা ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে, যা থেকে আরো একবার সেই মিথেরই সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল যে মহানদের ভুলভ্রান্তি থাকবেই।
মেসিও ইন্টারেস্টিং ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তবে অবশ্যই একদম ভিন্নভাবে, এ কারণেই যে সে প্রচণ্ড অন্তর্মুখী। শুধু এই একটি কারণেই আমাদের দেখা অন্য প্রায় সব ফুটবল মহাতারকাদের থেকে সে ব্যতিক্রম, কিন্তু তার এই বৈশিষ্ট্য কখনোই তাকে খেলার মাঠে নিজের সেরাটা উজাড় করে দেয়া থেকে আটকাতে পারেনি।
আমি মেসিকে খেলতে দেখেছি অজস্রবার, কিন্তু বলার মতো সাক্ষাৎ হয়েছে মাত্র একবার। এ কাজে আমাকে সাহায্য করেছিল আমার বন্ধু এবং বার্সেলোনার সাবেক সতীর্থ লোবো কারাসকো। সেটি কয়েক বছর আগের ঘটনা, যখন বার্সা লন্ডনে চেলসির বিপক্ষে খেলেছিল।
খেলার আগের দিন রাতে আমি আমার ছেলেদের নিয়ে তার হোটেলে গিয়েছিলাম, এবং সে ছিল সত্যিই দারুণ অমায়িক। আমার ছেলেদের সাথে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছিল সে, তাদের বিভিন্ন জিনিসে সইও করে দিচ্ছিল। সে ছিল খুবই আন্তরিক ও নিরহংকার। এর চেয়ে ভালো কিছু হওয়াটা বোধহয় সম্ভব নয়।

প্রকৃতপক্ষে আমি এর আগেও তার সাথে দুটো বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছিলাম, কিন্তু তখন তার সাথে দেখা করতে পারিনি, কেননা সে ছিল খুবই লাজুক, এবং নিজের মতো থাকতেই সে পছন্দ করত। কেবল একটি গ্রিন স্ক্রিনের বদৌলতেই সেবার ফিল্মে একসাথে হওয়ার সুযোগটা হয়েছিল।
তো, তার সাথে দেখা করতে পারাটা অনেক সুন্দর ছিল, যদিও তার স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। এবং সত্যি কথা বলতে কী, আমি খানিকটা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। জানেন তো, স্বয়ং ফুটবলারদেরও মাঝেমধ্যে অন্য কোনো ফুটবলারকে দেখে এই অনুভূতি হতে পারে – ঠিক এমন অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল ডিয়েগোর সাথে সাক্ষাতকালেও।
যখন আমি একজন খেলোয়াড় ছিলাম তখনো আমি ম্যারাডোনার অসামান্য প্রতিভার কারণে তাকে নিয়ে মোহগ্রস্থ ছিলাম। তার ওই প্রতিভাটাই তাকে আমাদের আর সবার থেকে আলাদা করে দিত। মেসির মধ্যেও নিঃসন্দেহে ওই একই প্রভাব বিদ্যমান।
আমি নিজে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলেছি। কিন্তু তারপরও এমন কিছু খেলোয়াড় থাকে, যারা একদম ভিন্ন মাত্রার। আপনাকে অবাক হয়ে ভাবতে হয়, এগুলো কীভাবে সম্ভব!
মেসির আগমনের পূর্বে, ম্যারাডোনাই ছিল আমাদের দেখা নিকটতম খেলোয়াড়, যাকে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ বলা যেতে পারে। পেলে অনেক বেশি গোলস্কোরার ছিল, এবং সম্ভবত তার তুলনা চলতে পারে রোনালদোর সাথে।
আমি কখনোই ভাবিনি, ম্যারাডোনার চেয়েও ভালো কোনো খেলোয়াড়ের দেখা পাবো। কিন্তু যখন আমি মেসির দিকে তাকাই, দেখতে পাই সে সবকিছু করছে। এমনকি ডিয়েগো যা করতে পারত, তার চেয়েও বেশি!
শুধু একটি জায়গাতেই ম্যারাডোনা মেসির চেয়ে এগিয়ে রয়েছে, সেটি হলো বিশ্বকাপ বিজয়ীর মেডেল প্রাপ্তিতে। কিন্তু আপনি কি আসলেই একজন ফুটবলারের গ্রেটনেস ওই একটি বিষয়ের নিরিখে নির্ধারণ করতে পারেন?
যদি গঞ্জালো হিগুয়াইন ২০১৪ ফাইনালে তার সুযোগটিকে কাজে লাগাতে পারত, তাহলে হয়তো মেসিরও একটি বিশ্বকাপ মেডেল থাকত। কিন্তু হিগুয়াইন একটা লোপ্পা সুযোগ মিস করেছিল, এবং তার ফল ভোগ করতে হয়েছিল মেসিকে। ১৯৮৬ ফাইনালের সাথে পার্থক্য হলো, ম্যারাডোনা যখন জর্জ বুরুচাগাকে একটি দুর্দান্ত পাস দিয়েছিল, সে সেটি থেকে জয়সূচক গোলটি করতে পেরেছিল।

যদি আর্জেন্টিনা ওই খেলাটিতে হেরে যেত, তাতে কি বলা যেত যে ম্যারাডোনা ওই সময়ে বিশ্বের দেখা শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড় ছিল না? অবশ্যই না, একেবারেই বাজে কথা এটা। তারপরও কিছু লোক তর্ক চালিয়ে যাবে যে মেসিকে একটি বিশ্বকাপ জিততেই হবে সর্বকালের সেরা বিবেচিত হতে, যদিও অন্য আর সবকিছুই সে ইতোমধ্যে জিতে নিয়েছে।
অবশ্যই বিশ্বকাপ একটা বিশাল ব্যাপার। কিন্তু এটি একটি নক-আউট টুর্নামেন্ট, যা প্রতি চার বছর অন্তর খেলা হয়, এবং সেখানে আরো নানা বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে। ম্যারাডোনার আমলে এটিই ছিল একমাত্র উপলক্ষ্য, যখন বিশ্বের সকল খেলোয়াড়কে একই প্রতিযোগিতায় লড়াই করতে দেখা যেত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একদমই ভিন্ন। আপনি প্রতি মৌসুমেই চ্যাম্পিয়নস লিগ দেখতে পান, এবং মেসির কাছে তার চারটি রয়েছে।
অবিশ্বাসীদের ভুল প্রমাণ, দিনের পর দিন
আজকাল ম্যারাডোনার সাথে নয়, রোনালদোর সাথেই বেশিরভাগ মানুষ মেসির তুলনা করে থাকে। জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই এখন মানুষ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়, এবং মেসি বনাম রোনালদোও সেরকমই একটি বিষয়।
প্রায় সময়ই পছন্দটি নেমে আসে একটি প্রশ্নে, আপনি কোন দলের সমর্থন করেন – বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস বা অন্য কোনো দল। এই বিষয়টিও ঠিক আছে, আমি এটি বুঝতে পারি।
আমিও রোনালদোর বিশাল বড় ভক্ত, কিন্তু আপনি যদি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের ব্যাপারে কথা বলেন, তাহলে সেখানে কোনো বিতর্কই থাকা উচিৎ না যে সেটি মেসি। এটি নিছকই আমার ব্যক্তিগত অভিমত, কিন্তু তাতেও মেসির এমনকি কাছাকাছিও কাউকে রাখতে পারি না।
অনেকেই মেসির সঙ্গে রোনালদোর তুলনায় সমান সমান রাখে। কেননা, তার সব অর্জনই এসেছে বার্সার হয়ে। অপরদিকে রোনালদো বিভিন্ন দেশে শিরোপা জিতেছে। কিন্তু আমার কাছে এই ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুতই মনে হয়।

মেসি অবশ্যই তার ক্যারিয়ারে কিছু অসাধারণ দলের সাথে খেলেছে, কিন্তু সে যার পাশেই খেলে থাকুক না কেন, তার ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান কিন্তু সবসময় একই থেকেছে। সে বারবারই অবিশ্বাসীদের ভুল প্রমাণিত করে এসেছে।
এমনকি গত কয়েক মৌসুমেও, যখন বার্সার দলটিকে তাদের অতীতের দলগুলোর তুলনায় কিছুই মনে হচ্ছে না, তখনো কিন্তু তার অবদান এতটুকুও হ্রাস পায়নি। বরং তাকে ছাড়াই বার্সা হয়ে পড়েছে পুরোপুরি ছন্নছাড়া একটি দল।
আজকের দিনে মেসির মতো একটি দলেই থেকে যাওয়ার বিষয়টি বেশ বিরল। আর সে কথা তো ছেড়েই দিন যে তাকে এখানে আসতে হয়েছিল ভিন্ন একটি দেশ থেকে; মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাকে আর্জেন্টিনা থেকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল স্পেনে।
কিন্তু, কোনো কারণে যদি সে বার্সা ছেড়ে যেত, তাহলে মেসির দিকে আঙ্গুল তোলা হতো অবিশ্বস্ত হিসেবে। সহজ কথা, তার জেতার উপায় নেই। কিন্তু কেনই বা সে অন্য কোথাও যেতে চাইত? সে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাবটিতে। বার্সা ছেড়ে যাওয়া মানে হলো রাজপথ ছেড়ে পাশে সরে যাওয়া। এর মাধ্যমে কখনোই আপনার পক্ষে আরো উপরে ওঠা সম্ভব নয়।
তাছাড়া এই শহরটির সাথেও সে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে। ঠিক কী কারণে, তা হয়তো তার তরফ থেকে আমি জবাব দিতে পারব না, কিন্তু আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে বসবাসের জন্য সেটি একটি দারুণ জায়গা। এবং বোধগম্য কারণেই সেখানে সে মানুষজনের কাছ থেকে প্রচুর ভালোবাসাও পায়।
তাই মনে হয় না, আমরা খুব শীঘ্রই তাকে প্রিমিয়ার লিগে দেখতে পাবো – এবং এমনটিও নয় যে তার এখানে কাউকে কিছু প্রমাণ করার আছে। কিন্তু হাস্যকর বিষয়, কিছু মানুষ আসলেই প্রশ্ন তুলেছে মেসি ইংলিশ ফুটবলে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারত কি না।
আমার কাছে এটিকে একেবারে অযৌক্তিক মনে হয়। আপনাকে স্রেফ যে কাজটি করতে হবে তা হলো চ্যাম্পিয়নস লিগে সেরা ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে তার রেকর্ডের দিকে তাকাতে হবে। এবং সেগুলো এক কথায় অনবদ্য।
সে ৩৪ ম্যাচ থেকে ২৬ গোল পেয়েছে, এবং এখানে তো আপনি ওই বিষয়টিও বিবেচনায় আনছেন না যে কোনো গোল না করেও অনেকবার সে কীভাবে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। ওগুলো ছিল প্রিমিয়ার লিগের সব সেরা দল। তাহলে মানুষজন কি আসলেই ভাবে যে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দল কিংবা পয়েন্ট টেবিলের নিচের অর্ধের দলগুলোর বিপক্ষে তাকে সংগ্রাম করতে হতো? এটি একেবারেই উদ্ভট প্রশ্ন।
সে শারীরিকভাবে মানিয়ে নিতে পারত না বলাটাও আরেকটি কৌতুক। সে অবিশ্বাস্য রকমের শক্ত, দ্রুত ও ক্ষমতাবান। আপনি তাকে ঠেলে ফেলতে পারেন না, তাই এগুলো একেবারেই বাজে গালগল্প। আমার শুধু আফসোস, সে যদি তার এই সামর্থ্য প্রদর্শনের সুযোগটাও পেত!

মেসিকে খেলতে দেখা আমাদের জন্য এক পরম প্রাপ্তি, এবং তার সর্বশেষ ম্যাচটি হবে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখের দিনগুলোর একটি। কোনো ফুটবলারই চিরকাল থাকবে না, এবং আপনিও দেখবেন তার শক্তিমত্তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। আপনি কত ভালো খেলোয়াড়, তাতে কিছুই যায়-আসে না; সময়কে আপনি হারাতে পারবেন না।
মেসির আর সেই বিস্ফোরক বাঁক-বদলের গতি নেই, যা বছরের পর বছর ধরে তার সঙ্গী হয়ে ছিল। এমনটিই ঘটে, যখন আপনার বয়স বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সেই গতি তাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু সেই বাঁক-বদলের গতি ছাড়াও সে এখনো এমন একজন খেলোয়াড়, যে খুবই বিশেষ কিছু উপহার দিতে পারে।
সে প্রয়োজনে মাঠে খানিকটা নিচে নেমে আসতে পারে, এবং সে পাস দিতে পারে, কিংবা নিজের কুশলতাকে কাজে লাগিয়ে একাধিক খেলোয়াড়কে ড্রিবল করে পেছনে ফেলতে পারে। সে এখনো ফ্রি-কিকের মাধ্যমে উপরের কোণা দিয়ে জালে বল জড়াতে পারে।
আশা করা যায়, এই সবকিছুই তাকে আরো কয়েকটা বছর খেলা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের হাতে আর বেশি সময় নেই তাকে খেলোয়াড় হিসেবে দেখতে পাবার। তাই আমাদের উচিৎ অবশিষ্ট প্রতিটি মিনিটই তারিয়ে তারিয়ে তার খেলার রসাস্বাদন করা।
প্রায় দুই মাসেরও বেশি হয়ে গেল আমরা করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য তাকে খেলতে দেখিনি। তবে মনে হচ্ছে, স্পেনে খুব শীঘ্রই লা লিগা শুরু হবে। প্রশ্নাতীতভাবে বলা যায় যে, দর্শকহীন মাঠের খেলার স্বাদ কখনোই পরিপূর্ণতা পাবে না। তারপরও মেসি সম্ভবত তেমনই একজন, যে কারণে ভক্ত-সমর্থক ছাড়াও আমরা ফুটবল খেলাকে উপভোগ করতে পারব।
যদি টিভিতে প্রচারিত হয়, একটুখানি মেসির ঝলকই হয়ে উঠবে অনেকের মনের রসদ। প্রচুর মানুষ সেই অপেক্ষাতেই থাকবে, আর সেই তালিকায় থাকব আমিও।