রুটিনটা বছর দুয়েক ধরে একই আছে।
প্রতি দু’সপ্তাহ বা এরকম কিছুটা সময় পর পর, এক উঠতি ফুটবলার লম্বার্ডি থেকে রওনা দিয়ে পিডমন্টের আঞ্চলিক সীমানা পেরোয়। যেখানে ঘুরে নোভারায় যাবার কথা, সেখান থেকে গাড়ি পশ্চিমদিকে এগোয় আরও ১০০ মাইল, তারপর খুঁজে পায় তুরিন।
এই পথের কোনো এক বাঁকে, সে খুঁজে পায় প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক ফুটবলারকে, যে ইতালির উত্তর দিককার আরেক শিল্পনগরীর দলে খেলে।
মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে তাদের দু’জনার টেবিলে উপস্থিতি দাঁড়ায় তিনজনে। এমন একজন আসে, যার সেখানে থাকতে আরও লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আসতে হয়।
মিলান থেকে পূর্ব দিকে এক ঘণ্টা সফর করলে বার্গেমোতে পৌছাবেন আপনি। কিন্তু সেটা মার্টিন ডি রুনের গায়ে লাগে না। সে ইতালিকে ভালোবাসে বটে, তবে এটাও বোঝে যে আত্মার শান্তির জন্য নিজ দেশের বন্ধুদের দেখা পাওয়া প্রয়োজন। কিশোর হিসেবে সে ফেইনুর্দের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছিল, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন স্টেফান ডে ভ্রি। দুজনেই বড় হয়েছেন নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণে, দু’জনের বাড়ির মাঝে দূরত্বটা মাত্র আধ ঘণ্টার।
যদিও ৩০ বছর বয়সী ডি রুন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আটালান্টার মিডফিল্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এবং ২৯ বছর বয়সে এসে ডি ভ্রাই ইন্টার মিলানের লিগ জেতানো রক্ষণে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, এবারের গ্রীষ্মে সবচেয়ে বেশি চাপ তাদের দু’জনের কারও ওপরই থাকছে না। থাকছে তাদের তিনজনের ছোট্ট দলটার তৃতীয় ও কনিষ্ঠতম সদস্যের ওপর, যার নাম ম্যাথায়াস ডি লিট।
ডি লিটকে জুভেন্টাস প্রায় বিশ্বের সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার হিসেবেই কিনেছিল ২০১৯ এর জুলাইয়ে। সবচেয়ে দামী ডিফেন্ডার- সে তকমাটা অবশ্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হ্যারি ম্যাগুয়ারকে কেনার আগে ছিল ডি লিটেরই স্বদেশী ভার্জিল ভ্যান ডাইকের, যিনি অক্টোবরে জর্ডান পিকফোর্ডের ট্যাকলে পাওয়া হাঁটুর চোটের কারণে এবারের ইউরো খেলতে পারছেন না।
অধিনায়ক ও সেরা ডিফেন্ডারকে ছাড়া নেদারল্যান্ডসকে ইউরো জয়ের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য ডি লিট ও ডি ভ্রাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ২১ বছর বয়সী ডি লিটের ওপরই চাপটা বেশি, কেননা ভ্যান ডাইক থাকলেও তার ওপর আশা থাকত পর্বতপ্রমাণ। যদিও সম্প্রতি এটি বলা হয়েছে যে, পারফরম্যান্স অনুসারে জুভেন্টাসের অধিনায়ক হিসেবে জর্জিও কিয়েল্লিনির উত্তরসূরি হওয়ার পথেই তিনি আছেন, তবুও ২০২০-২১ মৌসুমটা তুরিনের বুড়িদের জন্য হতাশারই হয়ে থাকবে। ৯ বছর পর ইন্টারের কাছে লিগ শিরোপা খুইয়েছে তারা। মৌসুমের শুরুটা ডি লিট কাঁধের চোটে মাঠের বাইরে কাটানোর পর মৌসুম শেষ করেছেন দলকে নিয়ে কোনোমতে আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করে।
ধুঁকতে থাকা দলে থেকে নিজের ফিটনেস আর ফর্ম খুঁজে পাওয়াটা ডি লিটের জন্য ছিল নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে এসব তার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন প্রেমিকার সঙ্গে আল্পসের স্পা ঘুরে এসে। আমস্টারডাম ছেড়ে তুরিনে আসার সময় সে নিজের দু’টি কুকুর নিয়ে এসেছিল, তাদের নিয়ে তিনি হাঁটতে বেরোন ঠিক শহরের বাইরের বনে।
‘এটাও আমাকে দায়িত্বশীলতা শেখায়,’ মে এর শুরুতে ডাচ পত্রিকা ভক্সক্রান্টকে বলেছিলেন ডি লিট।
একই ইন্টারভিউয়ে ডি লিট স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তিনি প্রতিনিয়তই খুঁজে ফেরেন যশ-প্রতিপত্তি এনে দেয়া ফুটবলের বাইরের পৃথিবীটার অস্তিত্ব।
‘আপনাকে মাঝেমধ্যে ফুটবলকে দূরে সরিয়েও রাখতে হবে, আপনাকে সেটা আরও ভালো ফুটবলার বানাবে’ – বলেন ডি লিট। সেজন্যই করোনাভাইরাস মহামারীর আগে তিনি ডি রুন ও ডা ভ্রাই’র সঙ্গে ইতালিয়ান ক্ল্যাসিকাল পিয়ানোবাদক লুডোভিকো এনৌদির কনসার্টে গিয়েছিলেন। ডি লিট বলেন,
‘ওই দুই বা তিন ঘণ্টার প্রশান্তি আমাকে আরও ভালো করে তোলে। কিন্তু সেটাও আমাকে নিজে নিজেই শিখতে হয়েছে।’
মাত্র ১৬ বছর বয়সে কোনো ফুটবলারের পেশাদার অভিষেক হওয়ার ১৮ মাসের ভেতর যখন ছোটবেলার ‘ড্রিম ক্লাব’-এর অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়ে যান, এবং যখন কিশোর থাকতেই জুভেন্টাস তাকে দলে নিয়ে নেয়, আপন মনে ধরে নেওয়াই যায়, সব কিছুই ভালো যাচ্ছে তার।
ডি লিট তরুণ বিস্ময় ছিলেন বটে, কিন্তু খেলা কিংবা খেলার বাইরের পৃথিবীর বাস্তবতার কষাঘাত থেকে দূরে থাকতে পারেননি তিনিও।
আয়াক্সের বয়সভিত্তিক দলগুলোয় তার বন্ধু আবদেলহাক নুরির পরিণতির জন্যই যেমন তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, সেটা সম্ভবও ছিল না। চার বছর আগে প্রি-সিজনের এক ম্যাচে লুটিয়ে পড়েছিলেন নুরি, এক মুহূর্তেই লেখা হয়ে গিয়েছিল তার ক্যারিয়ারের এপিটাফ; মাঠ ছেড়ে ঠিকানা বদলে গিয়েছিল বিছানায়।
কোনো কিছুই তাকে তার সাবেক এজেন্টের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করতে পারতো না। এমনকি তার জাতীয় দলে অভিষেক ম্যাচের জন্যও না, যেখানে তার ভুলে বুলগেরিয়ার কাছে প্রথমার্ধেই দুই গোল খেয়ে বসে নেদারল্যান্ডস, তাকে উঠিয়ে নেয়া হয় প্রথমার্ধ শেষেই; বুলগেরিয়ার কাছে সেই হারে শেষ হয়ে যায় ডাচদের ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
এমন সব ঘটনাই প্রমাণ করে, ডি লিটকে সব নিজে নিজেই শিখতে হয়েছে। এ বছরের শুরুতেই যেমন বলেছিলেন,
‘আমি অনেকের সঙ্গেই কথা বলি কিন্তু নিজেই খুঁজে বের করি কোনটি আমার জন্য সেরা। …সৌভাগ্যবশত, আমি যেকোনো কিছু মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। আমি নেতিবাচক ব্যাপারগুলোয় আটকে থাকি না।’
এমন স্বাধীনতার শুরুটা আয়াক্সে, যে ক্লাব থেকে রেকর্ড ট্রান্সফারে তিনি চলে গিয়েছিলেন অন্য ক্লাবে। এমন এক ট্রান্সফারে, যা ওরকম অল্প বয়সে খেলোয়াড়রা কেবল স্বপ্নই দেখতে পারে। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, ডি লিট যে বয়সে জুভেন্টাসে পাড়ি জমিয়েছেন, ভ্যান ডাইকের সে বয়সে পেশাদার অভিষেক হয়েছে মাত্র।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে ডি লিট নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে বড় ক্লাবের অধিনায়কের দায়িত্ব সামলেছেন, আয়াক্স সতীর্থদের মতে ড্রেসিংরুম চালিয়েছেন ২৮ বছর বয়সী কোনো অভিজ্ঞ ফুটবলারের মতো করে। আর ডাচ সাংবাদিকরা আপনাকে বলবে, তিনি সাক্ষাৎকার দিতেন এমনভাবে যেন তার বয়স ৩৮ এবং নেদারল্যান্ডস স্টক এক্সচেঞ্জে থাকা কোনো কোম্পানি চালাচ্ছেন তিনি।
সেরা খেলোয়াড়রা নাকি অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়। ডি লিটও ব্যতিক্রম নন।
নয় বছর বয়সে ডি লিটের ডাক নাম যা ছিল, সেটি বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মোটকু’। আয়াক্সের স্কাউটরা তার নাম দিয়েছিল ‘ম্যাকডোনাল্ড’স ফুটবলার’ – কারণ স্রেফ অবিস্মরণীয় প্রতিভার জোরেই তারা আয়াক্সের কঠোর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় টিকে গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে যখন তাকে ছোটবেলার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, ডি লিট বলেন, ‘আমি একটু মোটা বাচ্চা ছিলাম।’
আয়াক্সে থাকা পুষ্টিবিদরা তাকে বোঝান, লম্বা মৌসুমজুড়ে ভালো খেলার জন্য তার খাবারে ভারসাম্য আনা দরকার। রোনাল্ড কোম্যানের থেকেও উপদেশ মিলে যায়, যিনি নিজেও ছোটবেলায় একই সমস্যায় ভুগেছিলেন। উপদেশ নিয়েছিলেন বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচ মাইকেল রেইজিগার ও উইন্সটন বোগার্দের থেকে, যারা ছিলেন ক্ষিপ্র ডিফেন্ডার। ডি লিটের মতে, ইতালিতে আসার পর বিকেলে অতিরিক্ত শারীরিক অনুশীলনের কারণে তিনি ‘আরও দ্রুতগতির, শক্তিশালী এবং পেশীবহুল’ হয়েছেন।
ডি লিট শারীরিক কাঠামোটা পেয়েছেন তার বাবা ফ্র্যাঙ্কের থেকে। ফ্র্যাঙ্ক ছিলেন টেনিসভক্ত, প্রতিযোগিতামূলক হকিও খেলতেন। বাবা-মা থেকে ফুটবল বিষয়ক কোনো নির্দেশনা পাননি ডি লিট। ফ্র্যাঙ্কের মনে পড়ে, যখন ডি লিটের বয়স পাঁচ, তখন তার এক শিক্ষক এসে ফ্র্যাঙ্ককে বলেছিলেন যে তার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে ফুটবল খেলার সুযোগ থাকলেও খেলতে নামেনি। ডি লিট প্রথমবার হকির চেয়ে ফুটবলের দিকে বেশি টানটা বুঝতে পারেন আমস্টারডামের দক্ষিণের আবকুদে স্পোর্টস ক্লাবে যাওয়ার পর। পরবর্তীতে ডি লিট সেটিকে বলেছিলেন তার জীবনের প্রথম ট্রান্সফার।
ডেনিস বার্গক্যাম্প, যিনি পরে ডি লিটকে আয়াক্সে কোচিং করিয়েছিলেন, ছিলেন তার হাই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। এই ব্যাপারটি ডি লিটকে সাহায্য করেছিল বেশ। কারণ, বার্গক্যাম্পের আয়াক্সের হয়ে শিরোপা জেতার ছবি তার স্কুলের হলগুলোয় ছিল সেই ১৯৮৭ সাল থেকে, যা ডি লিটকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
ডি লিটের বয়স যখন তিন, তার পরিবার তখন আমস্টারডমের আরও কাছে চলে আসে। তাদের বাড়ির পেছনেই রোনাল্ড ডি বোরের নামে একটি মাঠ ছিল, যা নিশ্চিত করেছিল ডি লিট, তার ভাই ওউটার ও বোন ফ্ল্যেরের জন্য খেলার জায়গা।
ছয় বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব এফসি আবকুদে’তে যোগ দেন ডি লিট, যেখানে তিনি ছিলেন তিন বছর। সেখানে তার কোচ ছিলেন ডেভ ভ্যান নিলেন। তিনি ২০১৬ সালে বলেছিলেন,
‘আপনি ওকে দেখলেই এটা ভাববেন না, ‘কী দারুণ প্রতিভা!’ কিন্তু সে তার সাধারণ টেকনিক, পাসিং ও নিখুঁত শটে বাকিদের থেকে আলাদা ছিল। সে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত খেলোয়াড় ছিল।’
ভ্যান নিলেন বিশ্বাস করতেন, ডি লিটের প্রবল কৌতূহল আর উদ্দীপনাই তাকে বাকি ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রাখত। সবার আগে অনুশীলনে আসতেন, কোচকে প্রশ্ন করতেন। ডেভ ভ্যান নিলেনের ভাই ক্লাবটির আরেকটু বয়স্ক বয়সভিত্তিক দলের দায়িত্বে ছিলেন, এবং বিশ্বাস করেছিলেন ডি লিট আরেকটু অভিজ্ঞ দলে খেলতে সক্ষম। কিন্তু তা আর হয়নি, কারণ সমীকরণে ততদিনে আয়াক্স চলে এসেছে।
ভ্যান নিলেনের এক বন্ধু ক্যাসিমির ওয়েস্টারভেল্ড ছিলেন আয়াক্সের একটি যুব দলের কোচ। এবং ডি লিট তার দলের চেয়ে ভালো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সবার চেয়ে ভালো খেললেও, আয়াক্স তাকে নিয়ে সন্দিহান ছিল। কারণ? ওই যে, ডি লিট একটু মোটা!
সে যাই হোক, তবুও তারা ভ্যান নিলেনের দলে ডি লিটকে দেখছিলেন, যখন একই ক্লাবের আরও বয়স্ক দলের বিপক্ষে খেলছিলেন তারা। এক পর্যায়ে হাফওয়ে লাইনের কাছে বল পেয়ে পুরো মাঝমাঠকে পেরিয়ে গিয়ে ডি লিট নিখুঁতভাবে খুঁজে নিলেন গোলের এক কোণা। টাচলাইনে দাঁড়িয়ে সেটি দেখে আয়াক্সের স্কাউট হেনরি ডি রেট ভ্যান নিলেনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন,
“হি উইল বি দ্য ওয়ান!”
আয়াক্সকে রাজি করাতে ডি লিট নেন মাত্র পাঁচটি ট্রেনিং সেশন। ভ্যান নিলেনকে কল দিয়ে ডি রেট জানালেন, আয়াক্স তাকে দলে ভেড়াতে চায়। আবকুদের অন্য কোচরা ভ্যান নিলেনকে বললেন,
‘ম্যাথায়াস যদি আয়াক্সে সফল না হয়, তাহলে আমরা কিছু জানি না।’
শারীরিক গঠন বাদেও ডি লিটকে নিয়ে সন্দেহের জায়গা ছিল আরও একটি, তার মানসিকতা। আবকুদেতে তিনি খেলতেন আমস্টারডমের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ছেলেদের সঙ্গে- স্ট্রিট ফুটবল খেলা ছেলেরা, যাদের মানসিকতা ও খেলা, দুটোতেই ছিল দারুণ জাঁকজমক। সেদিক থেকে ডি লিট ছিলেন চুপচাপ এবং আত্মবিশ্বাসী, যা আয়াক্সের সংস্কৃতির পরিপন্থী। ভ্যান নিলেন তার মধ্যে থেকে আরও বেশি কিছু বের করার জন্য তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। মাঠে অবশ্য সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিতেন, থাকতেন পুরোপুরি মনোযোগী, ছোট ছোট ঘটনার তোয়াক্কা করতেন না একদমই।
২০১৬ সালে ফ্র্যাঙ্ক ডি লিট স্মৃতিচারণ করে জানান, ছয় বছর বয়স থেকেই তিনি তার দাদার সঙ্গে দাবা খেলতেন। তার ফোন প্রায় ব্যবহারই করতেনই না, বরং সময় পেলে আয়াক্স সতীর্থদের তাস খেলতে চ্যালেঞ্জ জানানোটাই তার বেশি পছন্দ ছিল। বাসায় ব্যায়াম করতেন এবং স্কুলের পর ফিটনেস বাড়াতে গ্রামের মধ্যে দৌড়াতেন।
জবাবদিহিতা কখনোই পছন্দ করতেন না, এবং যদি কেউ তাকে এটা জিজ্ঞাসা করত যে তিনি অতিরিক্ত চেষ্টা করছেন কি না, ডি লিট বেশ রেগে যেতেন।
১৬ বছর বয়সে আয়াক্সের মূল দলে জায়গা করে নিলেও ডি লিট তখনও গাড়ি চালানো শেখেননি। বরং ট্রেনিংয়ে যেতেন বাইসাইকেলে করে। বাস বা ট্রেন ব্যবহার করতে পারতেন না, পাছে তাকে কেউ চিনে ফেলে; ট্রেনিংয়ে দেরি করিয়ে দিতে পারতো এমন কোনো ঘটনা, কেননা ডি লিটের স্বভাবই ছিল থেমে কথা বলা। সে ঝুঁকি নেবেন কেন!
ডি লিটের বাবার তাকে গাড়ি চালানো শেখার জন্য জোর করতে হয়েছিল। কিন্তু সম্ভাবনা ছিল, সেটিও ট্রেনিংয়ে বাধা দেবে; তাই ডি লিটকে অনেক বুঝাতে হয়েছিল। ফ্র্যাঙ্ক বলছিলেন,
‘তার কাছে সব কিছু একই থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাকে সব সময়ই নতুন জিনিসে অভ্যস্ত হতে হয়। সে যদি নতুন কোনো পজিশন বা নতুন কোনো কোচের অধীনে খেলে, সে প্রথম এক মাস খুব সাবধান থাকবে।’
আয়াক্সের জুনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে ডি লিট প্রথম বছরে স্পেন ও চেক রিপাবলিকে টুর্নামেন্টে সাফল্য পেয়েছিল। দেশের বাইরে থাকাটা তাকে খোলস থেকে বের হতে সাহায্য করেছিল। সে বছর তার সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন জাস্টিন ক্লাইভার্ট, ডনিয়েল মালেন ও ববি আদেকানিয়ে। আয়াক্সের হয়ে দারুণ খেলার পর ২০১৮ সালে তাকে দলে ভেড়ায় রোমা। মালেন আর্সেনালের জন্য আয়াক্স ছেড়েছিলেন ১৫ বছর বয়সে, কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসেন নেদারল্যান্ডসে, যেখানে নাম কামিয়েছেন পিএসভি আইন্দহোফেন ও জাতীয় দলের হয়ে। আদেকানিয়ে আয়াক্স থেকে ঘুরেছেন বার্সেলোনা, পিএসভি, লিভারপুল ও ল্যাজিও; শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তার পেশাদার অভিষেক হয় ইতালিয়ান ক্লাবটিতে।
দারুণ পারফরম্যান্সে আরেকটু বয়স্ক দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ডি লিট, কিন্তু এক বছর পরেই আবার তাকে ফিরতে হয়েছিল নিজ বয়সের দলে। এই পিছিয়ে পড়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ মানেন ডি লিট নিজেও। তার মতে, তার ওপর থাকা সবার প্রত্যাশার কারণেই ভুগছিলেন তিনি। কারণ, তার মতে কোচ, খেলোয়াড় এবং সব অভিভাবক ধরেই নিয়েছিলেন, ডি লিটই হবেন মাঠের সেরা খেলোয়াড়।
বয়ঃসন্ধিকালের প্রভাবে ডি লিটের শারীরিক গঠন আরও শক্তিশালী হয়েছিল, এবং সবাই ভেবেই নিয়েছিল ম্যাচজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করবেন তিনি। সেটি ডি লিটের হাই স্কুলেও প্রথম বছর ছিল, যেখানে পরিবেশ ছিল অপরিচিত। মৌসুমের শেষ ম্যাচে ডি লিটের গোলে ফেইনুর্দের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে জাতীয় শিরোপা জিতে নেয় আয়াক্স। এই অর্জনে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান ডি লিট।
১৪ বছর বয়সে ডি লিট ছিলেন আয়াক্সের সেরা যুব দলের অধিনায়ক।
পিএসভির বিপক্ষে একটি কাপ ফাইনালে তার সামনে আসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। দলের অধিনায়ক ও সেন্টারব্যাক নাভাজো বাকবুর্দ চোটের কারণে ছিটকে যান। তখন ডি লিট খেলেন মাঝমাঠে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তিনি সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলবেন এবং সঙ্গে তাকে দেয়া হয় অধিনায়কত্বের দায়িত্বও।
অনেক নাটকের পর সেবার শিরোপা জেতে আয়াক্স। দলের একজন লাল কার্ড দেখার পর ফেইনুর্দের বিপক্ষে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল তারা। কোনোমতে সমতায় ফিরতে পারলেও লাল কার্ড দেখেন আরেকজন। ডি লিট খেলছিলেন ক্র্যাম্প নিয়ে, সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে,
‘মনে হচ্ছিল জীবন নিয়ে দৌড়াচ্ছি।’
নিজের শক্তির শেষটুকু নিংড়ে দিয়ে পেনাল্টি জিতে নেন ডি লিট, যেখান থেকে গোল করে আয়াক্সের শিরোপা নিশ্চিত করেন এক সতীর্থ।
‘আমার যুব ক্যারিয়ারের সেরা ও সবচেয়ে সফল মুহূর্ত ছিল সেটি’ – ২০১৮ সালে বলেন ডি লিট।
এই ঘটনার পর প্রথম পেশাদার চুক্তি সাক্ষর করেন ডি লিট। উইম জঙ্ক, সাবেক শেফিল্ড ওয়েডনেসডে ও নেদারল্যান্ডস মিডফিল্ডার ডি লিটকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে,
‘সে একজন আধুনিক ডিফেন্ডার। দুই পায়েই খেলতে পারে, ভালো পাস দেয়, এবং পরিস্থিতি দ্রুত পড়তে পারে। সে একজন জাত নেতা হতে পারে, যে ইতিবাচক মানসিকতা দিয়ে তার সতীর্থদের সাহায্য করতে পারে।’
ডি লিট তার পরিবারকে নিয়ে যেত আবকুদেতে তার প্রিয় রেস্তোরা ডি ইইনড্রাখটে, যেখানে সে হয় অমলেট অথবা বাছুরের মাংস অর্ডার করত। যখনই যেত, সে চাইত মানুষের চোখ থেকে দূরে একদম পিছনের দিকে বসতে। কিন্তু সে দেখত, তাকে দিন দিন আরও বেশি মানুষ দেখছে কারণ সব জায়গায় তার নাম অনেক বেশি বলা হচ্ছে।
২০১৬-১৭ মৌসুম ডি লিট শুরু করেছিলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সঙ্গে, কিন্তু দ্রুতই তাকে আয়াক্সের রিজার্ভ দল থেকে তাকে ডাকা হয় মূল দলে। মৌসুম শেষে আয়াক্সের কোচ পিটার বশ বলছলেন,
‘ম্যাথায়াস ডিফেন্সকে খুব ভালোভাবে সংগঠিত করে এবং বল পায়ে থাকলে উদ্যোগ নেয় খেলা সামনে বাড়ানোর।’
বশ ডি লিটকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। মূল দলের অধিনায়ক হিসেবে ডি লিটের প্রথম ম্যাচ ছিল ২০১৮ সালের মার্চে, প্রতিপক্ষে ছিল হিরেনভিন। ডি লিট যখন তার বোন ফ্ল্যেরকে বলেছিলেন যে পরের দিন তিনিই অধিনায়কত্ব করবেন, বোন সেটা একদমই বিশ্বাস করেননি।
‘আর্মব্যান্ড পড়ে ও মাঠে নামার আগ পর্যন্ত আমি মনে করেছিলেন যে ও মজা করছে,’ ২০১৯ সালে ডাচ পত্রিকা হেট পারুলকে বলেন ফ্ল্যের।
ফ্ল্যের, যিনি কি না অ্যামেচার ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বুইটেনভেলডার্টের হয়ে খেলেন, তার ভাইয়ের সব ম্যাচে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রশংসা করতেন যে কীভাবে ডি লিট কিছু পরিস্থিতির সমাধান করেছেন। কিন্তু এটা বলার ইচ্ছাটা সংবরণ করতেন যে কোথায় ডি লিট আরও ভালো করতে পারতেন।
দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পরও সময়টা ডি লিটের জন্য সহজ ছিল না। তার একটি ভুল পাসের জন্য এক্সেলসিয়োরের বিপক্ষে গোল খায় আয়াক্স, সঙ্গে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে তার নেদারল্যান্ডস অভিষেক ছিলই, যেখানে তার ভুলে দুই গোল খেয়ে বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি ডাচরা।
তখনকার ডাচ জাতীয় দলের কোচ ড্যানি ব্লিন্ড সমালোচিত হয়েছিলেন কেবল বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়ায় নয়, বরং সেটি করার পথে তরুণ প্রতিভাবান এক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারকে হুমকির মুখে ফেলার জন্যও।
“আমার অভিষেকের পর আমি জাতীয় আলোচনার বিষয় হয়ে যাই, এবং সেটি ছিল অদ্ভুত।” হেট পারুলকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন ডি লিট।
“সৌভাগ্যবশত, আমি এসব ব্যাপার আমার মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। সমালোচনা এবং টেনশন নিয়ে বেঁচে থাকাটা আপনার শিখতে হবে। আমি আর নার্ভাস হই না। আমি মাঠে নামি আমার সেরাটা দিতে এবং আমার পক্ষে এর চেয়ে ভালো করা সম্ভব নয়। এই মানসিকতা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাকে শান্ত থাকতে হয়।” বলেন এ তরুণ ডাচ ডিফেন্ডার।
এমন মানসিকতা ডি লিটকে তুলে এনেছে রেকর্ডের পাতায়। ২০১৭ সালের মে মাসে সর্বকনিষ্ঠ ডাচ খেলোয়াড় হিসেবে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের ফাইনাল খেলেন। এর আগের সেপ্টেম্বরে আয়াক্সের হয়ে অভিষেকে গোল করে ক্ল্যারেন্স সিডর্ফের পর ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে যান ডি লিট। সঙ্গে ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচেই গোল করে নিজের নাম তোলেন অনন্য এক তালিকায়, যেখানে অন্যান্য নামগুলো হলো – ইয়োহান ক্রুইফ, মার্কো ভ্যান বাস্তেন, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড ও প্যাট্রিক ক্লাইভার্ট।
মাসপাঁচেক পর তিনি বনে যান ডাচ লিগে গোল করা দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম আয়াক্স খেলোয়াড় – ভ্যান বাস্তেনের পরে কিন্তু ক্রুইফের আগে।
“এই পরিসংখ্যানগুলো আমার আর না-ও থাকতে পারে, কিন্তু সেটি পরের ব্যাপার।” ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ইউরোপা লিগ ফাইনাল খেলার আগে বলেন তিনি। বয়সে কিশোর হলেও ডি লিট তখন পুরোপুরি আয়াক্সের; এমন একজন যে শুধু জিততে চায় না, জিততে চায় দারুণ ভঙ্গিতে। ম্যাথায়াস সেই বিষয়ে বলেন, ‘একমাত্র ওটাই আসল।’
২০১৪ সালে ডি লিটের এজেন্ট ব্যারি হালশফ তাকে আয়াক্সের সোনালি প্রজন্ম নিয়ে একটি বই দেন। সেই বই ছিল ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত খেলা সর্বজয়ী আয়াক্সকে নিয়ে, যারা ক্রুইফের অসাধারণত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ ও ছয়টি লিগ শিরোপা জেতে। হালশফ ছিলেন সেই দলের ডিফেন্ডার, পরে আয়াক্সে কোচিং শুরু করে আরও সাতটি দলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কোচিংয়ের ল্যাটা চুকিয়ে হয়েছিলেন এজেন্ট। ডি লিটের বাবার অনুরোধে তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হালশফ।
‘খুব সম্ভবত সেই দলের খেলোয়াড় এবং ফলাফল সম্পর্কে ম্যাথায়াস আমার চেয়ে বেশি জানে।’ ২০১৭ সালে বলেছিলেন হালশফ।
ডি লিট আয়াক্সকে ভালোবাসতেন। এবং মূল দলে সুযোগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত আয়াক্সের প্রতিটি গোলে বসার ঘরজুড়ে দৌড়াতেন। কৈশোরে ডি লিটের অন্য কোথায় যাওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্নই ছিল না, কিন্তু তার এজেন্ট হওয়ার জন্য অনেকেই লাইন ধরেছিলেন।
আট কিংবা নয়জন ডি লিটদের বাড়িতে পর্যন্ত এসেছিলেন, সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন নেদারল্যান্ডসের বাইরের বড় ক্লাবে খেলার প্রলোভন। হাশলফ তাদের মতো ছিলেন না। তিনি বরং শুনতেন, ডি লিট কী চান।
‘ওর একমাত্র লক্ষ্য ছিল আয়াক্সের মূল দলে জায়গা করে নেয়া’ – স্মৃতিচারণ করেন হালশফ।
হালশফ ডি লিটের জীবনে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠেন। অবশ্য, ডি লিট যেখানে পৌঁছাতে চাইছিলেন, হালশফ ইতোমধ্যেই ছিলেন সে রাস্তাতেই। শৈশবের কোচ ভ্যান নিলেন এফসি আবকুদেতে ডি লিটের প্রথম দিনেই বলেছিলেন, তার ক্ষীপ্রতা নিয়ে কাজ করতে হবে। পরবর্তীতে হালশফ সেটির জন্য ব্যক্তিগত ট্রেনার নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, বাম পায়ে ডি লিটের লং পাস আরও ভালো হওয়া উচিত, সঙ্গে তার ট্যাকল করার টাইমিংও। হালশফ হিসেব করেছিলেন, ডি লিটের ৯০ শতাংশ সিদ্ধান্তই সঠিক। কিন্তু ডি লিটকে এটিও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তার শতভাগ নির্ভুলতার দিকে নজর দেওয়া উচিত, যদিও সেটা আসলে বাস্তবে সম্ভব নয়। হালশফ বারবার বলতেন,
‘আজকের ফুটবলে শারীরিক ও কৌশলগত গুণের সঙ্গে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়াটাও জরুরী।’
তিনি বুঝেছিলেন, ডি লিটের শরীর তার বাস্তব বয়সের চেয়ে তিন বছর এগিয়ে ছিল। এবং এজন্য তিনি প্রতি মাসে ডি লিটের শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ, ওজন ও উচ্চতা মাপতেন। হালশফ জানতেন কখন ম্যাথায়াসকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে, কারণ তাতেই বেশি আত্মবিশ্বাস পেতেন এই ডাচ ডিফেন্ডার।
‘আমরা ওকে যতটুকু সম্ভব সব কিছু নিজে নিজে আয়োজন করতে দিতাম। কারণ ওটা তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য জরুরী ছিল।’ জানিয়েছিলেন হালশফ, যাকে ডি লিট তাকে ‘ফুটবল ফাদার’ বলে মানেন।
ডি লিট ও হাশলফ ফুটবল নিয়ে লম্বা সময় আড্ডা দিতেন। তার মতে, সেই আড্ডাগুলোর জন্যই তিনি সবার প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত এগুতে পেরেছেন।
আয়াক্স মূল দলে যেবার ডি লিট সুযোগ পান, হাশলফ সেবার পা দিয়েছেন সত্তরের ঘরে। তার ফুটবল জ্ঞান তাকে বলছিল, ডি লিটকে পেতে চাইবে অনেকেই, যার মানে তার ওপরও বাড়বে চাপ। এবং এটি তার মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল, আদৌ এ বয়সে এসে এ চাপ তিনি সামলাতে পারবেন কি না।
সুপার এজেন্ট মিনো রাইওলা যখন প্রথম বার ডি লিটের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হন, হাশলফ ঠিক রাজি ছিলেন না। কিন্তু তিনিও দেখছিলেন, স্পেন, ইতালি ও ইংল্যান্ডের বড় বড় ক্লাবগুলো ডি লিটকে দলে চায়। হাশলফ ও ডি লিটের বিচ্ছেদটা সহজ ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাশলফ মেনে নেন; যা হচ্ছে, তা কেবল তরুণ এই ডাচ ডিফেন্ডারের ভালোর জন্যই হচ্ছে।
এজেন্ট হিসেবে রাইওলার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে তার খেলোয়াড়দের মোটা টাকায় বড় ক্লাবে নেয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু রাইওলা এটুকু বুঝেছিলেন যে, অন্য ক্লাবে যাওয়ার আগে ডি লিটের আরও উন্নতি প্রয়োজন। তাই প্রথমেই নিশ্চিত করেন, আয়াক্সেই আরও দুই মৌসুম কাটাচ্ছেন তিনি। শোনা যায়, এখন রাইওলাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন ডি লিট। এ বছরের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, তার ভবিষ্যতের দেখভাল করার দায়িত্বটা রাইওলার হাতেই।
ডি লিট জুভেন্টাসে যোগ দেয়ার পরপরই রাইওলা তাকে বলেন ইতালিয়ানটা দ্রুত শিখে নিতে। প্রথম বছরেই প্রেস কনফারেন্সগুলো ইতালিয়ানে সামলিয়ে দারুণ জনপ্রিয়তা কামিয়ে নেন ডি লিট। ইতালিয়ান শেখাটা তাকে সাহায্য করেছিল দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও, কারণ ইংরেজি-ভাষী খেলোয়াড় খুব বেশি ছিল না দলে।
প্রথম মৌসুমেই জুভেন্টাসকে সিরি-আ জেতাতে সাহায্য করলেও দু’টি পেনাল্টি দিয়েছিলেন তিনি। ইতালিতে, যেখানে ডিফেন্ডিংকে শিল্প হিসেবেই ধরা হয়, এমন কাজে তার দিকে ধেয়ে এসেছিল সমালোচনার তীর। ডি লিটকে আবারও তার টাইমিংয়ে উন্নতি করতে হয়েছিল, এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে যখন-তখন ট্যাকেল করা যাবে না। আয়াক্সে সব মনোযোগ থাকত স্ট্রাইকারদের ওপর, কিন্তু তুরিনে ব্যাপারটা ছিল একদমই ভিন্ন।
জুভেন্টাসে ডি লিটের প্রথম কোচ মাউরিসিও সারি ব্যবহার করতেন জোনাল মার্কিং। অর্থাৎ, কার পায়ে বল সেটির ওপর নজর না দিয়ে তাকে নজর রাখতে হতো মিডফিল্ড থেকে কোনো খেলোয়াড় ফরোয়ার্ড রান নিচ্ছেন কি না, সেটির দিকে। ডি লিট পরে বলেছিলেন, এই কাজে জর্জিও কিয়েল্লিনির চেয়ে ভালো কেউ নেই।
ডি লিটের প্রায় দ্বিগুণ বয়সী জিয়ানলুইজি বুফন সে মৌসুমে নিয়মিত না খেললেও কিংবদন্তি এই গোলকিপার আরেকটা উদাহরণও দিতেন প্রায়ই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তার শরীরের এতটা খেয়াল রেখেছেন যে ৩৬ বছর বয়সে এসেও সে তার দলের সেরা খেলোয়াড়। ডি লিট তার ড্রেসিংরুমে আশেপাশে দেখেই অনেক কিছু শিখতে পারেন; কিন্তু ডাচ পত্রিকা ভক্সক্রান্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডি লিট জানান,
“তারা দারুণ সাহায্য করেন বটে, তবে সঙ্গে এটাও বলে, ‘ওটাই করো যেটা তোমার জন্য ভালো হয়। অন্য কাউকে অন্ধ অনুকরণ করো না।’ আমি সেটা করিও না।”
ডি লিট নিজেকে ইতালিতে খেলা কিছু খেলোয়াড়ের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখেন, যারা ড্রেসিংরুমে নিজেদের জাকজমক দেখিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। স্যুট পরে ট্রেনিংয়ে আসেন না, এবং সেটির জন্য মাঝেমধ্যে সতীর্থদের হাস্যরসের খোরাকও হন। তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না। ডি লিট আবারও মনে করিয়ে দেন,
‘আমার পেশা ফুটবল খেলা। আমি কেবল মাঠেই তারকা হতে চাই।’