![](https://assets.roar.media/assets/E2FSAIK11mcaA7a2_73356.jpg?w=1200)
কুমারা সাঙ্গাকারার সঙ্গে ইনজামাম-উল-হক মনে হয় কখনো বসে একটু সময় কাটাতে পারেননি। যদি বসতেন, তাহলে তাদের আলাপচারিতা সম্ভবত শুরু হতো এভাবে, সাঙ্গাকারাকে ইনজামাম বলছেন, ‘তোর কপালে আমার কপালটা একটু ঘষতে চাই!’
কথাগুলো যে স্রেফ রসিকতা, তা পাঠক মাত্রই ধরে ফেলেছেন। তবে কথাগুলোর আড়ালে ইনজির যে হাহাকার লুকিয়ে আছে, তা কতজন ধরতে পেরেছেন?
ঘটনা খুলেই বলা যাক। বিশ্বকাপের মঞ্চে কুমারা সাঙ্গাকারার চার সেঞ্চুরির ঘটনা তো আপনার জানাই আছে, সাঙ্গাকারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন গত বিশ্বকাপেই। যে কারণে সাঙ্গাকারার সঙ্গে মুলতানের সুলতানের কথাও এলো, বিশ্বকাপের মঞ্চে ইনজামাম-উল-হকের কোনো সেঞ্চুরি নেই।
![](https://assets.roar.media/assets/R4asoE5nlBv5Ar44_kumar-sangakkara3_1b4v-%281%29.jpg)
অবশ্য ইনজামাম-উল হকের নিজেকে একা ভাবার কোনো কারণ নেই। অ্যালান বোর্ডার, অর্জুনা রানাতুঙ্গা ক্রিকেটবিশ্বে নমস্য নাম হলেও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তাদেরও কোনো সেঞ্চুরি নেই।
লেখার বিষয়টা এতক্ষণে তাহলে বুঝেই গিয়েছেন। বিশ্বকাপে পঞ্চাশ পেরিয়েছেন, অথচ শতকে পৌঁছাননি, এমন পাঁচ ক্রিকেটার নিয়েই আজকের আয়োজন।
১. ইনজামাম-উল-হক (৩৫ ম্যাচ)
১৯৯২ থেকে ২০০৭ অব্দি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন পাঁচটি, সর্বসাকুল্যে ৩৫ ম্যাচ। এই ৩৫ ম্যাচে চারবার অর্ধশতকের দেখা পেলেও শতকের দেখা পাননি, নব্বইয়ের ঘরেই তো কখনো পৌঁছুতেই পারেননি।
সর্বোচ্চ ৮১ রানের ইনিংসটা খেলেছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৩১ মিনিট স্থায়ী সেই ইনিংসে চারের মার ছিলো ছয়টি, সাথে ছিলো গ্লেন ম্যাকগ্রাকে হুক করে মারা দর্শনীয় ছয়।
সেই ম্যাচের আগে সেই বিশ্বকাপে ১৪টি ম্যাচ পেরিয়ে গেলেও সেঞ্চুরি হয়নি একটিও। ইনজামামের সামনে তাই সুযোগ ছিলো নিজের প্রথম সেঞ্চুরির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকাপেরও প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হবার। কিন্তু ক্যারিয়ারের সমার্থক হয়ে যাওয়া রানআউটে কাটা পড়ে সেই সুযোগ করলেন হাতছাড়া, একই সময়ে অন্য মাঠে হওয়া কেনিয়া-ভারত ম্যাচে শতক হাঁকিয়ে সেই কৃতিত্ব অর্জন করলেন শচীন।
![](https://assets.roar.media/assets/OyM15kGziLZDsSH2_252187.jpg)
সেঞ্চুরি করার সুযোগ পেয়েছিলেন পরের ম্যাচেও, প্রতিপক্ষ ছিলো আরেক তাসমান সাগরপাড়ের দেশ নিউ জিল্যান্ড, সেই ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন ৭৩ রানে। এর আগে পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন আরও দুবার, নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে সেই ইনিংসের পরে আর একবারও না।
অবশ্য ৩৩ ইনিংস ব্যাট করতে নেমে যে ব্যাটসম্যান ৯ বার রান আউটের ফাঁদে পড়েন, তার জন্যে হাফ সেঞ্চুরিই বিশাল কিছু।
২. অর্জুনা রানাতুঙ্গা (৩০ ম্যাচ)
এই তালিকায় থাকা ক্রিকেটারদের মাঝে সেঞ্চুরির আক্ষেপটা সবচেয়ে বেশি থাকতে পারে অর্জুনা রানাতুঙ্গার। কোনো সেঞ্চুরি ছাড়াই বিশ্বকাপ গড়টা যখন ৪৬.১৪, তখন রানাতুঙ্গা ভাবতেই পারেন, ‘সেঞ্চুরি করলে কী না কী হয়ে যেতো!’
আফসোসটা আরও শক্ত ভিত্তি পাবে, যখন জানবেন, বিশ্বকাপে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলা সাত ম্যাচের পাঁচটিতেই অপরাজিত ছিলেন এই শ্রীলংকান। কোনোদিন ওভার শেষ হয়ে যাওয়ায়, কোনোদিন ম্যাচই শেষ হয়ে যাওয়ায় আর পৌঁছানো হয়নি তিন অংকের ম্যাজিক্যাল ফিগারে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ১৯৮৭ বিশ্বকাপে যেমন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২৩৬ রানের জবাবে ব্রেন্ডন কুরুপ্পু খেলেছিলেন ইতিহাসের ধীরতম ইনিংসগুলোর একটি, মাঝে নেমে অর্জুনা রানাতুঙ্গা খেলেছিলেন ঠিক ১০০ বল, রান করেছিলেন ৮৬। ম্যাচ জিতিয়ে ফিরতে পারেননি তবুও। কুরুপ্পুর ৮২ বলে ৩৩ রানের পরে শ্রীলংকার ইনিংসের ৩য় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন যে ‘মিস্টার এক্সট্রা’। শ্রীলংকা থেমেছিলো ২১১ রানে।
পরের ম্যাচেও পেয়েছিলেন ফিফটি, অর্ধশতকের দেখা পেয়েছিলেন এর পরের ম্যাচেও, সেবারেও ছিলেন অপরাজিত। তবে রানাতুঙ্গা যতক্ষণে ৮৮ রানে পৌঁছেছিলেন, ততক্ষণে শ্রীলংকা জয়ের বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলো। সাতবার পঞ্চাশ পেরোলেও তাই আর শতকের দেখা পাওয়া হয়নি শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জয়ী এই অধিনায়কের।
![](https://assets.roar.media/assets/FCRlX5NexkfAKADi_280476.4.jpg)
৩. মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন (৩০ ম্যাচ)
১৬ বছরের ক্রিকেট জীবনকে ক্যারিয়ার বলার চেয়ে সিনেমা বলাই ভালো। ক্যারিয়ারে এত বেশি উত্থান-পতনের গল্প লিখেছেন যে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি নেই, এটা তার খুব বেশি গায়ে লাগবার কথা না। ৯৯ টেস্টে ক্যারিয়ার থমকে যাবার চেয়ে এই আফসোস তো খুব বড় নয়।
ফিক্সিংয়ের অভিযোগে হঠাৎই ক্যারিয়ার থমকে যাবার আগে বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলেছিলেন ৩০টি। প্রথম ম্যাচ উপমহাদেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে। প্রথম ফিফটিটা সেই বিশ্বকাপেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এরপরে বিশ্বকাপে ফিফটি পেয়েছিলেন আরও সাতবার।
![](https://assets.roar.media/assets/ryx9trCqTgBkyv7A_005169.jpg)
এর মাঝে একবার আউট হয়েছিলেন ৯৩ রানে। প্রতিপক্ষ ছিলো সেই অস্ট্রেলিয়া, ভেন্যুও ছিলো অস্ট্রেলিয়াতেই। অস্ট্রেলিয়ার ২৩৭ রান বৃষ্টির কারণে হয়ে গিয়েছিলো ২৩৫, ভারতের সামনে পরিবর্তিত লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছিলো ২৩৬। ডিন জোন্সের নব্বই রানের জবাবে নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছেছিলেন আজহারউদ্দীনও। কিন্তু বিধাতা যার ভাগ্যে সেঞ্চুরি লেখেননি, তিনি কী করে নব্বইকে শতকে পরিণত করবেন! ইনিংসের ৪৮ বল বাকি থাকতে তিনি যখন বোর্ডারের থ্রোতে রান আউট হয়ে ফিরলেন, শতক থেকে তিনি মাত্র ৭ রান দূরত্বে দাঁড়িয়ে।
ভারত দাঁড়িয়ে ছিলো জয় থেকে ৪২ রান দূরে। পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে আজহারউদ্দীন আউট হতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিলো ভারতের ইনিংস। শেষ ওভারে দরকার ছিলো ১৩ রান, কিরণ মোরের দুই চারেও ভারত পারেনি লক্ষ্যে পৌঁছাতে। ম্যাচ শেষ হয়েছিলো আরেকটি রান আউটে।
আজহারউদ্দীন নিজের ক্যারিয়ারের সেরা বিশ্বকাপ কাটিয়েছিলেন সেই ‘৯২ বিশ্বকাপেই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐ ইনিংসের পর দুই ম্যাচ বিরতি দিয়ে টানা তিন ইনিংসে খেলেছিলেন ৬১, ৫৫ আর ৭৯ রানের ইনিংস। তবে সেঞ্চুরিতে পৌঁছানো আর হয়নি।
৪. স্টিভ টিকোলো (২৮ ম্যাচ)
‘ছোট দলের বড় তারকা’ বাক্যের অবতারণা বোধহয় স্টিভ টিকোলোকে বর্ণনা করতে গিয়েই। বিশ্বকাপ ক্যারিয়ার শুরুই করেছিলেন অর্ধশতকে, ভারতের বিপক্ষে। ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির সেই ম্যাচে তার করা ৬৫ রান ছিলো দলের পক্ষে সর্বোচ্চ। ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান যিনি করেছিলেন, তার সঙ্গে টিকোলোর রানের পার্থক্য ছিলো ৩৬। কেনিয়ার জন্যে স্টিভ টিকোলো কী, তা যেন বোঝা হয়ে গিয়েছিলো সেদিনই। সাধে কি আর ক্রিকবাজ তাকে ‘most accomplished batsman ever to emerge from Kenya’ বলে স্বীকৃতি দেয়!
তবে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরেছিলেন দিনকয়েক পরে, উপমহাদেশেরই আরেক দল শ্রীলংকার বিপক্ষে। ইংল্যান্ডের ৩৬৩ টপকে সে ম্যাচেই শ্রীলংকা গড়েছিলো বিশ্বরেকর্ড ৩৯৮ রানের কীর্তি। হারার আগেই হেরে গিয়ে কেনিয়ার ব্যাটসম্যানরা তাই মনোযোগ দিয়েছিলেন পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলার দিকে। সবার ভিড়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন একজন স্টিভ টিকোলো। হিতেশ মোদির সাথে চতুর্থ উইকেটে গড়ে তুলেছিলেন ১৩৭ রানের জুটি। উল্লেখ করার যোগ্য, সেই ম্যাচে মোদি খেলেছিলেন ৪১ রানের ইনিংস, ৮২ বলে। কেনিয়া তুলেছিলো ২৫৪ রান, নন টেস্ট-প্লেয়িং দেশগুলোর মাঝে ৩য় সর্বোচ্চ। পুরো কৃতিত্বই দেয়া লাগে একজন স্টিভ টিকোলোকে, তার ৮ চার আর ৪ ছয়ে সাজানো ৯৫ বলে ৯৬ রানের ইনিংসকে।
টিকোলোকে অবশ্য ৯৬ রান করা ছাপিয়ে ৪ রান না করতে পারাই আক্ষেপে পোড়াবে বেশি। কেননা আর চার রান করলেই সুযোগ ছিলো কেনিয়ার হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান বনে যাওয়ার। মঞ্চটাও তো ছিলো সমস্ত আলো কেড়ে নেওয়ার, বিশ্বকাপ। যে মঞ্চে এর পূর্বে ৫ এবং পরে আরও ২২ ম্যাচ খেলেও পাওয়া হয়নি সেঞ্চুরি।
![](https://assets.roar.media/assets/iPqNbspgU48OPU9f_128690.jpg)
৫. অ্যালান বোর্ডার (২৫ ম্যাচ)
২৭৩ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৭৮ ম্যাচেই ছিলেন ক্যাপ্টেন। আর বিশ্বকাপে খেলা ২৪ ম্যাচের মাঝে ষোলটিতেই। তবে বিশ্বকাপে কখনোই ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্টের’ উদাহরণ হতে পারেননি। ১৮.৮৩ গড়ের একজন ব্যাটসম্যান কী করে দলের বাকিদের সামনে উদাহরণ তৈরি করেন!
সেঞ্চুরি দূরে থাক, বিশ্বকাপে হাফ সেঞ্চুরিই পেরিয়েছিলেন মোটে একবার। সেই হাফ সেঞ্চুরিও এসেছিলো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এছাড়া যে ২৪ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন তাতে ৪০ পার করেছিলেন একবার, সেবারও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই। এরকম যাচ্ছেতাই রেকর্ড নিয়েও কী করে অস্ট্রেলিয়া দলকে টানা দুই বিশ্বকাপে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে গেলেন, সে এক রহস্য বটে!
![](https://assets.roar.media/assets/n1VT41038yIo10PE_Allan-Border-batting-during-the-1st-test-match-against-England-at-Nottingham-June-1981.-.jpg)
বোর্ডার অবশ্য দাবি করবেন, অত রহস্য-টহস্য কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক তো তিনিই।সেই পথে সেঞ্চুরি না পেলেও ক্ষতি কী!