মানবসভ্যতার ইতিহাসে হাতেগোনা খুব কম সংখ্যক খেলাই সহস্রাব্দ ধরে টিকেছে, এবং যুগপৎভাবে দর্শকের মন জুগিয়ে চলেছে। এই তালিকায় দাবা নিঃসন্দেহে একেবারে শুরুর দিকে চলে আসবে। প্রারম্ভের কাল থেকে নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেলেও কিছু মৌলিক নিয়ম-কানুন একই থেকেছে দাবার। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চৌষট্টি খোপের এই খেলাটি ক্রিকেট, ফুটবলের মতো ততটা জনপ্রিয় না হলেও সারা বিশ্বে কিন্তু ধুন্ধুমার হৈচৈ একে নিয়ে। কোভিড আমলে দারুণ সাড়া ফেলেছে দাবা, স্ট্রিমিং জগৎ বা ই-স্পোর্টসের দুনিয়ার নতুন রাজা হিসেবে দাবা শক্ত আসন করে নিয়েছে।
“He who says he doesn’t enjoy chess, either doesn’t know the rules or he’s lying for some reason.”
উল্লেখিত উক্তিটি ইউটিউবে সবথেকে বড় দাবার চ্যানেল Agadmator-এর, সম্প্রতি ইতিহাসের প্রথম কোনো দাবার চ্যানেল হিসেবে তিনি ইউটিউবে এক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অর্জন করেছেন
জেনে অবাক হয়ে যাবেন, সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষের এই পৃথিবীতে প্রায় পৌনে এক বিলিয়নেরও বেশি লোক দাবায় বুঁদ, পেশাদার-অপেশাদার মিলিয়ে পরিসংখ্যান এটি। কিন্তু হুট করে একদিনে তো অবশ্যই আজকের এই অবস্থানে আসেনি দাবা। তাহলে নিশ্চয়ই কিছু যুগান্তকারী ঘটনার ফলস্বরূপ দাবা হালের বৈশ্বিক পর্যায়ে এসেছে। সেগুলোই আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।
ভারতবর্ষ থেকে চতুরঙ্গ কবে আরব দুনিয়ায় শতরঞ্জ হয়ে বাকি বিশ্বে পরিচিতি পেল, সেই থেকে অধুনা ম্যাগনাসের রাজত্ব শুরু হওয়া পর্যন্ত দেখবো আমরা। আরব্য রজনীর হারুন-অর-রশিদও কিন্তু দাবা খেলতেন, এবং প্রচারণাও করে গেছেন বলে জানা যায় (বব্রিক, ২০১২)। এমনকি বারাকাত গ্যালারির দাবি অনুসারে খলিফার আমলের একটি ব্রোঞ্জের দাবার ঘুঁটি পাওয়া গেছে, সেটি নাকি আবার স্বয়ং হারুনের প্রতিমূর্তি! ইতিহাসের পাতায় দাবার স্রোতে অবগাহনে আপনাকে জানাই স্বাগত!
১০. দাবার বিশ্বায়নের সূচনা, চতুরঙ্গ থেকে শতরঞ্জ – আনুমানিক সপ্তম খ্রিস্টাব্দ
দাবার বর্তমান সিস্টেমের সাথে মিলসম্পন্ন ৮X৮ বোর্ডে ৩২ ঘুঁটির সমন্বয়ে আরব বা পারস্যে শতরঞ্জ চালু হয় আনুমানিক ৬০০ অব্দের দিকে। ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষের চতুরঙ্গ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল শতরঞ্জ। আজকের মতো তখনকার দিনেও বোড়ে ছিল, ছিল ঘোড়া, তবে বিশপের থেকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন হাতি ছিল, একটা ঘুঁটি ছিল নাম কাউন্সেলর যার ক্ষমতা ছিল আজকের দিনের কুইনের থেকে কম, আর সাথে অতি অবশ্যই ছিল শাহ্ (কিং বা রাজা)। কিস্তিমাতের মাধ্যমে খেলা শেষ হতো, আবার শাহ্ বাদে সব ঘুঁটি শেষ হয়ে গেলেও সে হেরে যেত।
৯. দ্য ম্যাড কুইন – আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ
ততদিনে দাবা প্রায় আধুনিক হয়ে গেছে, আদি শতরঞ্জ থেকে বেরিয়েই এসেছে বলা যায়। বোড়েগুলো শুরুতে একবারে দুই ঘর যাবার অনুমতি পেয়ে গেছে, চেকার বোর্ডের মতো সাদা কালো খোপে সুবিন্যস্তভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে দাবাবোর্ড। কিন্তু ১৪৫০ এর আগপর্যন্ত কুইনের ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত; এখনকার রাজার মতো, পাশাপাশি বা কোণাকুণি শুধু এক ঘর যেতে পারত। কিন্তু খেলায় গতি আনয়নের স্বার্থে কিছু দাবাড়ু স্বত্বঃপ্রণোদিত হয়ে এই নিয়মে পরিবর্তন আনলেন, কুইনকে দিলেন অবাধ স্বাধীনতা। বোর্ডের যেকোনো দিকে (সোজাসুজি এবং কোণাকুণি) যত ঘর খুশি যেতে পারবে এখন থেকে কুইন। অর্থাৎ বিশপ আর রুকের সম্মিলিত ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হল কুইনকে। এই নিয়ম খেলার গতি এতটাই বাড়াল যে, ফরাসিরা এই সংশোধিত দাবাকে বলতে লাগলো, ésches de la dame enragée” অর্থাৎ “chess of the enraged lady — the ‘mad queen’.”
৮. ইতিহাসের প্রথম দাবার টুর্নামেন্ট – ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ
বর্তমানে চেস টুর্নামেন্ট ডাল-ভাত হয়ে গেছে, কিন্তু এর শুরুটা হয়েছিল সেই ষোড়শ শতকে। ইতিহাসের এই প্রথম ইনফরমাল চেস টুর্নামেন্ট স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে, ১৫৭৫ সালে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কোর্টে আয়োজিত হয়। এতে অংশ নেন, দুই ইতালিয়ান জিওভান্নি লিওনার্দো, পাওলো বয় এবং দুই ফরাসি রুয় লোপেজ আর আলফন্সো সেরন। হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই ধরেছেন, এই রুয় লোপেজের নামেই বিখ্যাত রুয় লোপেজ ওপেনিং প্রচলিত আজ অবধি! রুয় লোপেজ এই দুই ফরাসিকেই আগেও হারিয়েছেন, এই টুর্নামেন্টেও প্রথম দুই গেমে হারান। কিন্তু পরের তিন গেমে হেরে শীর্ষস্থানচ্যুত হন তিনি। পুরো টুর্নামেন্ট শেষে ফলাফল দেখা যায়, লিওনার্দো প্রথম হন, বয় হন দ্বিতীয়। রুয় লোপেজ তৃতীয় হন আর চতুর্থ স্থান অর্জন করেন সেরন। তবে প্রথম ফরমাল চেস টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয় ১৮৫১ সালে লন্ডনে, সেটি জয় করেন অ্যাডলফ অ্যান্ডারসেন।
৭. মোহনীয় এক বিস্ময়, দ্য মেকানিক্যাল টার্ক – ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ
আজকের দুনিয়ার চেস মেশিন বা চেস ইঞ্জিনের পূর্বসূরি ছিল এই টার্ক, যদিও এটি ছিল নিছকই মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি। ১৭৭০ সালে হাঙ্গেরীয় উদ্ভাবক উলফগাঙ্ক ভন কেম্পেলেন, টার্ক তৈরি করেন। প্রাথমিকভাবে কেম্পেলেনের এই টার্ক বানানোর উদ্দেশ্য ছিল এক অস্ট্রীয় সম্রাজ্ঞীকে মুগ্ধ করা, যদিও পরে তিনি এটি সবাইকে প্রদর্শন করতে শুরু করেন। সবাই এর গিয়ার আর যন্ত্রাংশ দেখে অবাক হতে থাকে। ৮৪ বছর ধরে টার্ক তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখায়, একের পর এক প্রতিপক্ষকে হারাতে থাকে। বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এবং বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনও ছিলেন এই পরাজিতদের দলে!
তবে এই টার্ক কিন্তু আদতে দর্শকের বিনোদনের খোরাক দেয়ার জন্য কারসাজি ছাড়া আর কিছু ছিল না, কারণ এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু হত না। বাক্স আকৃতির যন্ত্রটির মাঝে ঢুঁকে থাকত মানুষ, তারাই চাল দিত। বেশ শক্তিশালী মাস্টাররা এর ভেতর থেকে চুম্বকের সাহায্যে দান দিতেন। দশকের পর দশক ধরে এভাবেই টার্ক দাবার জগতে রাজত্ব করে, তবে এর মাধ্যমে আর যা-ই হোক, দাবার প্রসার ঘটেছিল।
৬. স্টন্টনের ঘুঁটি – ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ
ঊনবিংশ শতকের চল্লিশের দশকে হাওয়ার্ড স্টন্টন দাবার দুনিয়ায় বলতে গেলে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন তুখোড় দাবাড়ু, সাথে দাবার প্রচারণাও করতেন তিনি সাধ্যমতো। তিনি নাথানিয়েল কুকের ডিজাইন করা এক বিশেষ শৈলীর চেস পিস ব্যবহার করা শুরু করলেন, এবং উৎসাহ দিতে লাগলেন। এই ডিজাইন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং স্টন্টন স্টাইল হিসেবে খ্যাতি পেল। নান্দনিক সৌন্দর্য এবং ব্যবহারে সুবিধার কারণে স্টন্টন পিস আজও দাবার জগতে একক কর্তৃত্ব করছে। নজরকাড়া ঘুঁটিগুলো যে-কারও দাবার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সহায়ক। বর্তমানে হাউজ অফ স্টন্টন-এর সাইটে এখনও সেই পিসগুলো পাওয়া যায়, যদিও দামে অসম্ভব রকম চড়া।
দাবার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দশটি ঘটনা জানাবার অভিপ্রায়ে এই দুই পর্বের মিনি-সিরিজ। প্রথম পর্বে আমরা ১০ থেকে ৬, তথা অতীত থেকে পাঁচটি নিয়ে কথা বললাম। আগামী পর্বে থাকছে, ৫ থেকে ১, অর্থাৎ হাল আমলের তাৎপর্যপূর্ণ পাঁচ ঘটনা। সেখানে থাকবে, কবে চেস ক্লক আবিষ্কার হলো, প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্টেইনিজই বা কবে তার মুকুট অর্জন করলেন; আরও কথা হবে ঐতিহাসিক ফিশার-স্পাস্কি দ্বৈরথ, এছাড়াও ‘৯৭ এ ক্যাসপারভের সেই হার, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো যন্ত্রের কাছে যেবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হেরে যান, এবং অতি অবশ্যই অধুনা দাবা নিয়ে বলতে গেলে যাকে না স্মরণ করলে পাপ হবে, তিনি রাজাধিরাজ ম্যাগনাস কার্লসেন, তাকে নিয়েও আলাপ হবে। সামনের পর্বে ম্যাগনাস যুগের সূচনা পর্যন্ত আলোচনা করবো আমরা, অপেক্ষায় থাকুন!