
পাহাড়ের কোলে ছবির মতো একটা রাস্তা।
রাস্তার ধারে ছোট্ট একটা গ্রাম মদ্রিচি। এই গ্রামের বাড়িগুলো একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে দূরে। মূলত পশু পালনই এখানকার লোকের জীবিকা। শান্ত, সৌম্য এই গ্রামের মানুষ ঠিক জানতোও না যে, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
আর দশ দিনের মতো সেদিন সকালেও গরুর পাল নিয়ে চরাতে বের হয়েছিলেন প্রবীন লুকা মদ্রিচ। খানিক পরই রেডিওতে শোনা গেলো এক ঘোষণা, ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন হয়ে গেছে। তারা আর যুগোস্লাভিয়ার অধীনে নেই। এই ঘোষণা গ্রামটির লোকদের খুব উৎসবের কারণ হতে পারতো। কিন্তু উৎসব করার সুযোগ তারা পেলো না। তার আগেই এই গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো স্থানীয় সার্ব অধিবাসীরা এবং যুগোস্লাভিয়ার সেনাবাহিনী। নির্বিচারে ক্রোয়াটদের হত্যা করতে থাকলো।
গরুর পাল নিয়ে তখন বাড়ি ফিরছিলেন লুকা মদ্রিচ। সেই ফেরার পথে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো মানুষটিকে।
লুকা মদ্রিচের ছয় বছর বয়সী নাতি এসবের কিছুই জানে না। সে তখন বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলছিলো। কেউ একজন তাকে ডেকে বললো, ‘তোর দাদা মারা গেছেন।’
ছোট্ট ছেলেটি দৌড়ে বাড়ি গেলো। তার বাবা তখন বাড়িতে নেই। মা বললেন,
‘এখনই পালাতে হবে।’

পালাতে শুরু করলো তারা, পালাতে শুরু করলো ছোট্ট ছেলেটি। পালিয়ে চলে এলো তারা ৪০ কিলোমিটার দূরের জাদার শহরে। কিছুই বুঝে ওঠার আগে উদ্বাস্তু হয়ে গেলো ছেলেটি। চোখ বড় বড় করে চারপাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো, কী হচ্ছে? কী হবে এখন তার?
জীবনের চরম অনিশ্চয়তায় দাড়িয়ে তখন ছয় বছরের লুকা মদ্রিচ জুনিয়র। হ্যাঁ, দাদার নামে নাম আজকের এই লুকা মদ্রিচ। আজকের ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক, রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠের সেনাপতি, বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ তখন জীবনকে চিনতে শুরু করলো।
ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান দলটিতে তারকার অভাব নেই। ইভান রাকিটিচ আছেন, ইভান পেরিসিচ আছেন, মারিও মানজুকিচও আছেন। এমনকি গোলরক্ষক সুবাসিচও দারুণ পারফর্ম করছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে ইতিহাস গড়ার পেছনের একজন নায়ক বেছে নিতে বললে লুকা মদ্রিচের কথাই আসবে।
মাঠ মাতাতে থাকা এই লুকা মদ্রিচকে দেখে অবশ্য কল্পনা করার উপায় নেই যে শৈশবে তিনি কী দুর্বিসহ এক জীবন কাটিয়ে এসেছেন। কিংবা এখনও মাঠের বাইরে কত জটিলতা পোহাতে হচ্ছে তাকে। এই যে ক্রোয়েশিয়ার দলনেতা হিসেবে দলকে ফাইনালে তুলে নিয়ে এলেন, তারপরও দেশবাসীর কাছে তিনি ‘নায়ক’ নন; দেশের ফুটবল সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেই তিনি একজন খলনায়ক।
কেন!
এই প্রশ্নের জবাব মদ্রিচের রিয়াল মাদ্রিদের চকচকে জীবনে পাওয়া যাবে না। এমনকি ক্রোয়েশিয়া দলের সাফল্যেও মিলবে না এই প্রশ্নের জবাব। সে জন্য আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে মদ্রিদের শৈশবে।
সার্বদের সেই ভয়াবহ আক্রমণ থেকে পালিয়ে জাদার শহরের এক বিশাল হোটেলে এসে উঠলেন মদ্রিচরা। সেই হোটেলটাকে কর্তৃপক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য একটা শিবিরে পরিণত করেছিলো। আর এখানেই মদ্রিচ আশেপাশের লোকদের জানাতে শুরু করলেন নিজের ফুটবল প্রতিভা।

মদ্রিচকে নিয়ে তৈরি এক প্রামাণ্যচিত্রে ওই হোটেলের এক পুরোনো কর্মচারী বলছিলেন, ‘আমাদের হোটেলের যতগুলো জানালা বোমার আঘাতে ভেঙেছে, তার চেয়ে বেশি ভেঙেছে লুকার বলের আঘাতে।’
ফুটবলটা ছিলো এই যুদ্ধকালীন অবস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার জন্য মদ্রিচের একটা আশ্রয়। হোটেলের পার্কিংয়ে, সামনে একটু খোলা জায়গায়; সবখানে পায়ে একটা বল নিয়ে ছোটাছুটি করে বেড়াতো রোগা, টিংটিঙে এই ছেলেটি।
লুকার বাবা ততদিনে নতুন গঠিত ক্রোয়েশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। ফলে মায়ের তত্ত্বাবধায়নে পিচ্চি একটা দূরন্ত ফুটবলার হিসেবে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। এই সময় মদ্রিচকে চোখে পড়ে স্থানীয় ক্লাব এনকে জাদারের। বলা ভালো চোখে পড়েন তিনি তমিস্লাভ বাসিচের। এই লোকটিকে মদ্রিচ বলেন ‘দ্বিতীয় বাবা’। কারণ সংঘর্ষ ভরা সেই সময়ে এই মানুষটিই মদ্রিচকে দেখে রেখেছেন। এই মানুষটিই নিজের ক্লাবে নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছেন তাকে, হাতে ধরে শিখিয়েছেন ফুটবল।
যুদ্ধের সেই সময়ে ফুটবল খেলার ভয়টা নিয়ে বাসিচ বলছিলেন, ‘আমার সবচেয়ে বেশি মনে আছে যে, আমরা খুব ভয় পেতাম সবসময়। শত শত গ্রেনেড পাহাড়ের ওপাশ থেকে ছুড়ে মারা হতো। কখনো কখনো আমাদের ফুটবল মাঠেও এসে পড়তো গ্রেনেড। আমাদের সবসময় একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হতো। আর এর মধ্যে ফুটবল ছিলো এই বাস্তবতা থেকে আমাদের পালানোর একটা উপায়।’
এনকে জাদারের চেয়ারম্যান জোসিপ বাজলো বলছিলেন তার প্রথম মদ্রিচকে দেখার স্মৃতি, ‘একটা ছোট্ট ছেলে ছিলো যে, রাতদিন হোটেল পার্কিংয়ে বলে লাথি মেরে ঘুরে বেড়াতো। খুবই টিংটিঙে ছিলো। আর বয়সের তুলনায় অনেক ছোট ছিলো। তবে ওর দিকে একবার তাকালে আপনি বুঝতে পারতেন যে, এর ভেতরে বিশেষ কিছু আছে। তবে এটা সত্যি যে, আমরা কেউ কখনো কল্পনা করিনি যে, একদিন ও এমন বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হয়ে উঠবে।’

মদ্রিচ শুরুটা করতে চেয়েছিলেন হাজদুক স্পিল্টে। আর দশজন ক্রোয়াটের মতো তার স্বপ্নের দল ছিলো হাজদুক। কিন্তু সেখানে বাছাইয়ে অংশ নিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলেন। মনটা ভেঙে গেলো তার। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য হাজদুকের প্রতিদ্বন্ধী ডায়নামো জারগেবের ট্রায়ালে টিকে গেলেন তিনি। তাকে দলে ভেড়ালেন জ্রাভকো মামিচ। প্রথম দুই বছর ধারে খেললেন বিভিন্ন ক্লাবে। এরপর তার প্রতিভা দেখে মামিচ দশ বছরের জন্য মদ্রিচের সাথে চুক্তি করে ফেললেন।
এই মামিচ লোকটার নাম মনে রাখুন; এই লোকটার কারণেই মদ্রিচ আজ খলনায়ক।
মদ্রিচের কপালটাই এমন। পছন্দ করতেন হাজদুককে, খেলতে হলো শত্রু দল জারগেবের হয়ে। এরপর পছন্দ করতে বার্সেলোনা; খেলছেন এখন রিয়াল মাদ্রিদে। রিয়াল মাদ্রিদে আসার আগে অবশ্য টটেনহাম হস্পার হয়ে এসেছেন মদ্রিচ।
২০০৮ সালে মদ্রিচ যোগ দিলেন টটেনহামে। বিশাল এক অংকে ডায়নামো জারগেবের কাছ থেকে তাকে কিনে নিলো টটেনহাম। এখানে পাঁচটা অসাধারণ মৌসুম কাটিয়ে মোটামুটি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেললেন। এরপর ২০১২ সালে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে দলে ভেড়ায়। সেই থেকে মাদ্রিদের মাঝমাঠের কেন্দ্র হয়ে আছেন এই ক্রোয়াট।
এ অবধি শান্তিতেই কাটছিলো সময়। কিন্তু এই বছরই সেই মামিচের বিরুদ্ধে মামলা ওঠে আদালতে। একের পর এক ফুটবল দুর্নীতির অভিযোগ এই ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলের মহারথীর নামে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ডায়নামো জারগেব থেকে তিনি একাধিক খেলোয়াড় বাইরে বিক্রি করে দিয়ে ক্লাবে দেওয়ার বদলে টাকা নিজের পকেটে পুরেছেন। চুক্তিতে নানারকম ফাঁকি দিয়ে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করেছেন।
আর এর মধ্যেই ছিলো মদ্রিচের চুক্তিটাও।

আদালতে বলা হলো, মদ্রিচকে বিক্রির ক্ষেত্রে চরম অসততা ও অস্বচ্ছতা করেছেন মামিচ। আর এখানে স্বাক্ষী হিসেবে ডাকা হলো মদ্রিচকে। মদ্রিচ অনেকটাই মামিচের পক্ষে স্বাক্ষী দিলেন। বললেন, ‘চুক্তির সেই সময়ের কথা আমার মনে নেই।’
মদ্রিচের সাক্ষ্য বাঁচাতে পারলো না মামিচকে। তার সাড়ে ছয় বছরের জেল হয়ে গেলো। অবশ্য জেলে ঢোকার আগেই মামিচ পালিয়ে গেলেন। সাথে মদ্রিচকেও ফেলে গেলেন জেলের হুমকিতে। যদি প্রমাণিত হয় যে, মদ্রিচ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাহলে তাকেও যেতে হতে পারে জেলে।
তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দেশের ফুটবল সমর্থকদের কাছে মদ্রিচ এই ঘটনার ফলে ‘আবর্জনা’তে পরিণত হলেন। মামিচের মতো লোকের পাশে থাকায় তার নামে দেয়ালে লেখাও হলো, লুকা একটা আবর্জনা।
সেই ‘আবর্জনা’ এখন বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলে ফেলেছে দলকে। এখন তিনি ট্রফি মাথার ওপর তুলে ধরতে প্রস্তুত।
একটা বিশ্বকাপ ট্রফি কি পারবে মদ্রিচকে কলঙ্কমুক্ত করতে?
ফিচার ইমেজ: AP