Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.
ঘরের মাঠে সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে বার্সেলোনার মৌসুমের প্রথম ম্যাচ। ইনজুরির প্রকোপে মেসি, সুয়ারেজ থেকে দেম্বেলে পর্যন্ত মাঠের বাইরে। আক্রমণভাগ সাজানোর মতো পর্যাপ্ত খেলোয়াড় নেই কাতালান কোচ ভালভার্দের হাতে। তাই গ্রিজমান ও মিডফিল্ডার রাফিনহার পাশাপাশি সুযোগ করে দিলেন বার্সেলোনা ‘বি’ দলের ফরোয়ার্ড কার্লোস পেরেজকে। তবে সেদিনের চমক তখনও বাকি। কারণ ঘরের মাঠে ভালভার্দে ডেকেছিলেন লা মাসিয়ার ১৬ বছর বয়সী কিশোর আনসু ফাতিকে। বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে সে ম্যাচে অভিষেকও হয় তার।
ঘরের মাঠে সেল্টা ভিগোকে ৫-২ গোলে উড়িয়ে দেয় সেদিন ভালভার্দের শিষ্যরা। ম্যাচশেষে অভিষিক্ত ফাতিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন বার্সেলোনার প্রাণভোমরা লিওনেল মেসি। কানে কানে কী গোলমন্ত্র শিখিয়েছিলেন, কে জানে! পরের ম্যাচে ফাতি প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গেলেন। লা লিগায় পরের সপ্তাহের ম্যাচে ৫১ মিনিটে দুর্দান্ত এক হেডে গোল করেন তিনি। সে গোলেই বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম তুলেছেন ১৬ বছর বয়সী আনসু ফাতি।
ওসাসুনার বিপক্ষে এই চমৎকার গোলের পর আনসু ফাতির জীবনে পরের প্রত্যেকটি সপ্তাহ আলোর বেগে ছুটে চলতে শুরু করে। লা লিগায় অভিষেকের পর বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে তার চ্যাম্পিয়নস লিগেও অভিষেক হয়। জার্মানির সিগনাল ইদুনা পার্কে ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে শুরু থেকে একাদশে ছিলেন তিনি। কম বয়সে যারা নজর কেড়ে তাদের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, সেই পেলে ও মেসির সাথে তুলনা হচ্ছে তার নাম। যদিও বর্তমানে পুরো ইউরোপিয়ান ফুটবলে সব থেকে বিস্ময়ের নাম আনসু ফাতি। কারণ, তার ক্লাব-সতীর্থ লিওনেল মেসির লা লিগায় প্রথম গোল পেতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ নয় ম্যাচ; আনসু ফাতি তা সম্ভব করেছেন দ্বিতীয় ম্যাচেই।
শুধু গোল করেই নয়, আনসু ফাতি নজর কেড়েছেন তার মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে খেলা ৬০ মিনিট এখনও বার্সা সমর্থকদের চোখে লেগে আছে। দুর্দান্ত গতি, কাট-ইন করে উইং দিয়ে আক্রমণে যাওয়ার মতো কারুকাজের পসরা বসিয়েছিলেন পুরো ম্যাচজুড়ে। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা ভ্যালেন্সিয়ার ডিফেন্ডার এজেকিয়েল গ্যারেকে ঘোল খাইয়ে ডি ইয়ংকে চোখ-ধাঁধানো অ্যাসিস্ট করেছিলেন ফাতি। বার্সেলোনায় যে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়েছে, ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ৬০ মিনিট ও ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ৪৫ মিনিটে তার পারফরম্যান্সই তা প্রমাণ করে।
এল প্যারিস সংবাদপত্রিকার সাংবাদিক রামোস বেসা তার সম্পর্কে বলেছেন,
“আনসু ফাতি খুবই সরল ধরনের একজন ফরোয়ার্ড, যিনি ডান অথবা বাম উইং ধরে আক্রমণে খেলতে পারেন, আবার সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবেও। তার খেলার ধরন যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। হয়তো এখনও তার ধারাবাহিকতার ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু একজন খেলোয়াড় হিসেবে সে সবসময় আক্রমণ তৈরিতে মনোযোগী। দারুণ ফুটবলীয় বুদ্ধিমত্তা থাকার পাশাপাশি ফাতি একজন প্রাণোচ্ছ্বল তরুণও।”
বিগত দুই মৌসুমজুড়ে বার্সেলোনার কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে ভয়াবহভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন লা মাসিয়া থেকে তরুণ ফুটবলারদের সুযোগ না দেওয়ার জন্য। কিন্তু আনসু ফাতিকে তিনি বার্সেলোনা ‘বি’ দল উপেক্ষা করে সরাসরি মূল দলে নিয়ে আসার সাহসিকতা দেখিয়েছেন। তবে শুধু ফাতি নয়, বার্সেলোনার ইনজুরির সমস্যার কারণে আক্রমণে সুযোগ পেয়েছিলে বার্সেলোনা ‘বি’ দলের ফরোয়ার্ড কার্লোস পেরেজও। পেরেজ আর ফাতিকে হুট করে এভাবে ব্যবহার করায় কাতালান সমর্থকদের তাদের কোচ সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেছে।
তবে ফাতির কিন্তু হুট করে এভাবে মূল দলে আসার কথা নয়। বার্সেলোনার অনূর্ধ্ব-১৮ দলের কোচ দারমিয়া’র মুখে প্রশংসা শুনেছিলেন ভালভার্দে। তাই প্রাক-মৌসুমের অনুশীলনে তিনি ফাতিকে ডাকেন। সেই অনুশীলনে তিনি প্রথমবার ফাতিকে দেখে বিস্মিত হন।
আনসু ফাতি জন্মেছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনি বিসাউতে। গিনি বিসাউ বিশ্বের প্রথম ১০টি গরীব দেশগুলোর একটি। তবে তিনি সেখানে বেশি সময় থাকেননি, ছয় বছর বয়সে তার পরিবারের সাথে ফাতি স্পেনে চলে আসেন। স্পেনের মাটিতে আসার পর প্রথমে সেভিয়ার ‘হেরেরা’ নামক শহরে পরিবারের সাথে বাস করতে শুরু করেন। সেখান থেকেই সেভিয়ার অ্যাকাডেমি উপেক্ষা করে ফাতি আসেন লা মাসিয়ার দ্বারে।
অস্কার হার্নান্দেজ, যিনি প্রায় এক দশক ধরে বার্সেলোনার লা মাসিয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ফাতিকে একদম প্রথম থেকে দেখে আসছেন। তার উন্নতি ও অধ্যবসায় সবই লক্ষ্য করেছেন তিনি। তাই আনসু ফাতিকে বিশ্লেষণ করতে তিনি সেল্টিক ক্লাবের আরেক তরুণ তুর্কি কারামোকা দেম্বেলের সাথে তুলনা করেন। তার ভাষ্যমতে,
“বার্সেলোনার হয়ে যখন আমি কাজ করতাম, সেল্টিকের কারামোকা দেম্বেলে আমাকে বিস্মিত করেছিল। তারও বয়স ফাতির মতোই ১৬ বছর। তার মতো দেম্বেলেও খুব দ্রুত সেল্টিকের মূল দলের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিল। দুর্দান্ত প্রতিভাবান একজন খেলোয়াড় সে। তার ভেতর কোনো জড়তা নেই, কিন্তু ক্ষিপ্রতা প্রবল। তাই একজন উইঙ্গার হিসেবে ফাতির মতোই সে-ও হাই প্রেসিং ফুটবলের জন্য অতুলনীয়।”
“যখন খেলোয়াড়দের বয়স খুব অল্প, ১২ অথবা ১৩, তারা ভবিষ্যতে তারকা খেলোয়াড় হতে যাচ্ছে এটা বলে আপনি বাজি ধরতেই পারেন। কিন্তু ১৬ বছর বয়সী একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে তা করা অসম্ভব। কারণ, ক্রমাগত উন্নতি করা একজন কিশোর যখন আসলেই ফুটবলের বড় মঞ্চে পা দেবে, তখন সে কেমন খেলবে, তা বলা মুশকিল। অনেক বিবেচনার পরে কারামোকা দেম্বেলের সাথেই আমি আনসু ফাতিকে তুলনা করতে ও তাদের পক্ষে বাজি ধরতে পারি। আমার মতে, আনসু ফাতি বাদে লা মাসিয়ায় আর কোনো খেলোয়াড় নেই, যে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বার্সেলোনার মতো ক্লাবের মূল দলে খেলার যোগ্য।”
তরুণ তুর্কিদের মূল দলে স্থায়ী করা বার্সেলোনার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। তবে পেপ গার্দিওলার দেওয়া সুযোগে সার্জিও বুসকেটস নিজেকে সেরাদের কাতারে নেবার পর বার্সেলোনার আর তেমন কোনো উদাহরণ নেই। কারণ, প্রতিভাধর হলেও সবাই বার্সেলোনার মতো ক্লাবে খেলার মানসিক চাপ সামলাতে পারেন না। বুসকেটসের পর এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে। তবে হার্নান্দেজ মনে করেন না, এত অল্প বয়সে ক্লাবের মূল দলে খেলাটা ফাতির জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন,
“আমার মনে হয় না, লা মাসিয়া থেকে যারা বার্সেলোনার মূল দলে খেলার সুযোগ পায়, তারা বেশি মানসিক চাপে ভোগে। বাইরে থেকে আসা খেলোয়াড়দের সমস্যা হবার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, লা মাসিয়াতে থাকতে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের রক্তে বার্সেলোনার ঐতিহ্য বইতে শুরু করে। তারাই সব থেকে ভালো জানে, এ ক্লাবের খেলার ধরন ও চলন।”
“বর্তমানে বার্সেলোনা নিজেদের খেলোয়াড় ফেলে বাইরে থেকে আসা খেলোয়াড়দের বেশি মূল্য দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কার্লোস অ্যালেনা। তাকে কিন্তু খুব বেশি ম্যাচে ডাকা হয় না। তবে এই ক্লাবের দর্শন বোঝা তার জন্য কিন্তু বেশি সহজ। ইউরোপের অন্য ক্লাব থেকে ৫০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনা কোনো নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে এই মনোভাব কিন্তু দ্রুত গড়ে উঠবে না। আর অনেকের সেটাও শেষমেশ যে হয় না, তারও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আমরা দেখেছি।”
হার্নান্দেজের কথা ও ইঙ্গিতের সাথে ফাতিকে মেলালে আশাব্যঞ্জক কিছুর দেখা মেলে। কারণ, বার্সেলোনায় কয়েক ম্যাচে তার খেলা দেখে মনে হয়নি, মানসিক চাপ তাকে স্পর্শ করতে পেরেছে। উল্টে মনে হচ্ছে, ইউরোপের অন্যতম বড় ক্লাব ক্যাম্প ন্যু ফাতিকে এবং ফাতি ক্যাম্প ন্যুকে প্রতি ম্যাচে উপভোগ করে যাচ্ছে।
অনেক বড় ও নামকরা খেলোয়াড়ের জন্য ন্যু ক্যাম্প এক বিভীষিকা। গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে খেলা তাদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ। আন্দ্রে গোমেজ, পাকো আলকাসার বা ফিলিপে কৌতিনহোর ব্যর্থতা কাতালান সমর্থকেরা কখনও সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের বিরক্ত ফুটে উঠে ন্যু ক্যাম্পেই। কিন্তু আনসু ফাতির জন্য ব্যাপারটা তেমন হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সবসময়ই বার্সেলোনা সমর্থকেরা লা মাসিয়ানদের সমীহ করে চলে। তাই ক্যাম্প ন্যু সবসময়ই ফাতির সাথে থাকবে। মূল দলের হয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ট্যাকটিকস বা দলের সমর্থকদের জন্য তাকে কখনোই ভুগতে হবে না।
মেসি, ইনিয়েস্তা, জাভি ও বুসকেটসের মতো খেলোয়াড়ের জন্ম দেওয়া লা মাসিয়া থেকে পরবর্তীতে আরও অনেক তরুণ সুযোগ পেয়েছিল মূল দলে। তবে সব পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে থাকলেও প্রতিভার সদ্ব্যবহার কিন্তু হয়নি। তাই বোয়ান, মুনির, স্যান্দ্রো, স্যাম্পারসহ আরও অনেকে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছেন। এদের পর লম্বা একটি বিরতি পার করে বার্সেলোনা মেতেছে আনসু ফাতি’তে, যিনি সবার থেকে একটু ভিন্ন, কম বয়সে তুলনামূলক অধিক পরিপক্ব। শুধু একটাই ভয়, ধারাবাহিকতায় যেন ছেদ না পড়ে। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মানোর পর একজন ১৬ বছর বয়সী তরুণ ফুটবলারকে তার সংকল্পের কাছে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র ধারাবাহিকতা ও অধ্যবসায়। আর বার্সেলোনাও চায় না, মেসিবিহীন যুগে ফাতির মতো প্রতিভার অপচয় করতে। তাই এখন শুধুমাত্র অপেক্ষা ও ধৈর্য্যের পালা।