গত পর্বে আলোচনা করা হয়েছিলো, বিগত শতাব্দীর সেরার তালিকায় কোন খেলোয়াড়দের রাখা হয়েছিল, তাদের তালিকায় রাখার ক্রাইটেরিয়া এবং বিশ্বকাপের গুরুত্ব। আজকের পর্বে আলোচনা করা হবে এদের পরবর্তী যে খেলোয়াড়গুলো তালিকায় আসতে পারে তাদের বিষয়ে।
আলোচনার প্রথমে যে সমস্ত খেলোয়াড়েরা এই তালিকায় আসতে পারে তাদের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা যাক:
-
রোনালদো লিমা
-
জিনেদিন জিদান
-
লিওনেল মেসি
-
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
এই চারজন খেলোয়াড় তাদের ক্লাব দলের সাথে সাথে জাতীয় দলেও সফল। এদের কেউ হয়তো ক্লাবে একটু বেশি সফল, কেউ হয়তো জাতীয় দলে একটু বেশি। প্রথমে এই কয়েকজন খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
আচ্ছা, বিশ্বকাপে কোনো খেলোয়াড়ের পারফর্মেন্স কেমন সেটা আমরা কীভাবে বের করতে পারি? এই পর্যন্ত বিশ্বকাপ হয়েছে ২০টি। তাহলে ২০ বারের সেরা খেলোয়াড় প্রথম ২০ জন, তারপর দ্বিতীয় সেরা পরের ২০ জন, আর ৩য় সেরা তার পরের ২০ জন – এভাবে করলেই তো হিসেব সহজ হয়ে যায়। তবে এরপরও সেরা ২০ জনের মাঝে আবার কে সেরা, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
তবে সত্যি কথা হচ্ছে, বিচার আসলে এভাবে হয় না। আগের পর্বেই বলা হয়েছে, একই সময়ে অনেক লিজেন্ড এসে পড়লে কিংবা কখনো শূন্যতা দেখা দিলে এক সময়ের ৩য় সেরা খেলোয়াড়রও আরেক সময়ের সেরা খেলোয়াড়ের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারে। কাজেই এজন্য সম্মিলিত কিছু রেজাল্ট দেখা জরুরী।
বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকা খুঁজতে গেলে খুব বেশি তালিকা পাওয়া যায় না। ফিফা দ্বারা কোনো তালিকা হয়নি, তবে ২০১৪ সালে ২০তম বিশ্বকাপ শুরুর আগে গার্ডিয়ান পত্রিকা দ্বারা একটা তালিকা করা হয়। সেখানে তিন ধরনের বিশেষজ্ঞ (বিশ্বকাপ লিজেন্ড, গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক আর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ) মিলিয়ে মোট ৪০ জন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এদের মাঝে জিকো, লোথার ম্যাথাউসের মতো লিজেন্ডরাও ছিলেন। এছাড়া ২০১০ সালে ব্লিচার এবং ইংলিশ পত্রিকা ডেইলি মেইলের উদ্যোগেও এরকম কিছু নির্বাচন করা হয়েছিল।
এরকমই কিছু তালিকার দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
গার্ডিয়ান পত্রিকার নির্বাচিত ২০১০ সাল পর্যন্ত পারফর্মেন্স বিবেচনায় বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ২৫ জন খেলোয়াড়ের তালিকাটি ক্রমানুসারে দেখা যাক:
২০১০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিবেচনায় ব্লিচার রিপোর্টের একটি তালিকার দিকেও একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:
২০১৪ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বিবেচনা করে ফোর ফোর টু পত্রিকা একটা তালিকা প্রকাশ করেছে। সেটার দিকেও একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক:
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেসব তালিকায় জিদান এবং রোনালদো লিমা সেরা ৬ এ থাকলেও সেরা ২৫-য়েও লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জায়গা হয়নি। এছাড়া আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, প্রায় সব তালিকার প্রথম দশে এক বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জেতা খেলোয়াড় ডিয়াগো ফোরলান না থাকলেও কখনোই সেরার তালিকায় সেরা তিনে না আসা প্লাতিনি চলে এসেছেন।
এ থেকে বোঝা যায়, এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে ভালো করাটাই সম্মিলিত সেরা’র তালিকায় থাকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। এমনকি চারটি করে বিশ্বকাপ খেলে ফেললেও কোনো বিশ্বকাপেরই অলস্টার দলে এই দুই খেলোয়াড় জায়গা পাননি। তাহলে সম্মিলিত সেরায় থাকতে হলে ঠিক কোন কাজটা করতে হবে?
এখন বর্তমান শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়দের মাঝে প্রথম দুইজনের ফুটবলে অবদান নিয়ে অল্প কথায় কিছু বলা যাক।
রোনালদো লিমা
১৯৯৮ বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সবচেয়ে বড় স্টার ছিলেন রোনালদো লিমা। দুইবার ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কার পাওয়ার সাথে সাথে তাকে তুলনা করা হচ্ছিলো পেলে আর ম্যারাডোনার সাথে। কিন্তু বিশ্বকাপ শেষে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সমালোচিত তারকা হন তিনি। অথচ সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়, নকআউট স্টেজে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল… কী না করেছেন! কিন্তু ফাইনালে একেবারেই ব্যর্থ ছিলেন। সেই সময় পত্রিকায় আসে অসুস্থ থাকার কারণে প্রথমে ফাইনাল খেলার কথা ছিল না কিন্তু স্পনসরের চাপে খেলানো হয়। এই এক ম্যাচের জন্যেই তাকে সমালোচনায় যখন ভাসিয়ে ফেলা হয়, তখন বোঝা যায়, মানুষ তার কাছে কী আশা করে।
‘৯৮ এর দুঃখ ভোলার জন্য বেছে নিলেন ২০০২ এর বিশ্বকাপ। অথচ ইনজুরির জন্য তাতেও জায়গা পাবার কথা ছিল না তার। কিন্তু সুযোগ পেয়ে তৈরি করলেন ইতিহাস। ৮ গোল করে গোল্ডেন বল জেতার সাথে সাথে জিতে নিলেন বিশ্বকাপ। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জ্বলে উঠার জন্য রোনালদো লিমা’র মতো ধারাবাহিক খেলোয়াড় আমি কখনো দেখিনি। ১৯৯৭ আর ১৯৯৯ এর দুই কোপার ফাইনালেই গোল করেছেন, ১৯৯৭ সালের কোপা’র সেরা খেলোয়াড় আর ১৯৯৯ সালের কোপা’র সর্বোচ্চ গোলদাতা। কনফেডারেশনস কাপের ফাইনালেও হ্যাটট্রিক করেছেন। রোনালদোর ৪টি আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতার সাথে সাথে ১ বার রানার্সআপ, ২ বার টুর্নামেন্ট সেরার খেতাব, ২ বার সর্বোচ্চ গোলদাতা। যে চারটি ফাইনাল জিতেছেন, তার প্রতিটাতেই গোল করেছেন। জাতীয় দলের হয়ে এতটা সফলতা শুধু পেলে ছাড়া আর কারো কি আছে?
ক্লাবের হয়েও কিন্তু রোনালদো ব্যর্থ নন। ক্যারিয়ারে অনেক বড় বড় ক্লাবেই খেলেছেন। ‘মিলান ডার্বি’তে রোনালদো কয়েক দফায় ইন্টার মিলান ও এসি মিলান উভয় দলের পক্ষে অংশ নিয়ে দু’দলেই গোল করেন (ইন্টার মিলানে ৯৮-৯৯ মৌসুমে, এবং এসি মিলানে ২০০৬-০৭ মৌসুমে)। এই বিরল সৌভাগ্যে অন্যজন হলেন সুইডিশ লেজেন্ড ইব্রাহিমোভিচ। রিয়াল-বার্সার দুই দলের হয়েই খেলেছেন রোনালদো। বার্সার হয়ে ১-০ গোলে উয়েফা কাপ জেতা ম্যাচেও গোল করেছিলেন। একটাই অতৃপ্তি, কখনো চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতা হয়নি। সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলেন ২০০৩ সালে। আগের বছরের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল দল হিসেবেও দুর্দান্ত ছিল। কোয়ার্টারে লিমার হ্যাটট্রিকেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বাদ পড়ে। কিন্তু সেমি’তে জুভেন্টাসের কাছে হেরে যায় রিয়াল। ঘরের মাঠে জুভেন্টাসের সাথে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচেও গোল করেছিলেন। কিন্তু অ্যাওয়ে ম্যাচে হেরে যায় ৩-১ গোলে। ফিগো পেনাল্টি মিস না করলে অ্যাওয়ে গোল বেশি থাকার কারণে রিয়ালই ফাইনাল খেলতো। তাহলে হয়তো লিমার আক্ষেপ কিছুটা ঘুচতো।
জিনেদিন জিদান
ফুটবলের মতো দলীয় খেলাও যে শুধুমাত্র একজনের উপর নির্ভরশীল হতে পারে, তার একটা বড় উদাহরণ জিদান। ভালো দলের হয়ে ভালো খেলা তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে গত ৩০ বছরে সাধারণ কোনো দলকে এককভাবে অসাধারণ বানানোর ক্রেডিট মাত্র দু’জন খেলোয়াড়ের, জিদান আর ম্যারাডোনা। ফ্রান্স সবসময়ই সমীহ করার মতো একটি দল ছিল। তবে প্লাতিনির মতো সুপারস্টার থাকা সত্ত্বেও কখনো বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে জিদানের গোলেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ফ্রান্স। তবে সেটা অনেকটাই দলীয় পারফর্মেন্স ছিল। এরপর ২০০০ ইউরোতে জিদান আরেকবার নিজেকে চেনান। সেই ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমি’তে জিদান গোল করেন। সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হন জিদান। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলে স্ট্রাইকার ছিলেন তিনজন; থিয়েরি অঁরি ছিলেন সেই সিজনে ইংলিশ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ডেভিড ত্রেজেগে ছিলেন ইতালিয়ান লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, আর সিসে ছিলেন ফ্রেঞ্চ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ফেভারিট ফ্রান্স মূল পর্বে একটিও গোল করতে না পেরে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। এর মূল কারণ ধরা হয় ইনজুরির জন্য জিদানের সেই বিশ্বকাপে খেলতে না পারা। সেই বিশ্বাসকে আরো পাকাপোক্ত করে ফেলে ২০০৬ বিশ্বকাপে ভাঙাচোরা একটা দল নিয়ে ফাইনালে পৌঁছে।
২০০৪ সালের ইউরোর পরপরই জিদান আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ফ্রান্স যখন চূড়ান্ত পর্বে উঠতেও হিমশিম খাচ্ছিলো, ২০০৫ সালের ৩রা আগস্ট জিদান আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেন, এবং ফ্রান্স জাতীয় দলের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে জিদানের হেড যদি অবিশ্বাস্যভাবে বুফন সেভ না করতেন, তাহলে ফুটবলের ইতিহাসে পেলে ম্যারাডোনার আগে হয়তো জিদানের নাম এসে পড়তো বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে ( ৩৪ বছর ১৭ দিন) জেতেন বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল। ফ্রান্স দলে জিদানকে একটা যুগ হিসেবে ধরা যায়। প্লাতিনি যাবার পর ফ্রান্স ১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০২ বিশ্বকাপে আবার জিদানবিহীন ফ্রান্স গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে। ২০০৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খাবি খেতে থাকা ফ্রান্সকে মুল পর্বে উঠান। অবসর ভেঙে ফেরার পরে জিদান সম্পর্কে অঁরির মন্তব্য ছিল,
‘ফ্রান্সের সবাই বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর আছেন, এবং উনি ফ্রান্স জাতীয় দলে ফিরে এসেছেন।’
সেই বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে ফাইনালে তোলেন জিদান, এবং বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হন। ২০১০ বিশ্বকাপে আবার প্রথম পর্ব থেকে ফ্রান্স বাদ পড়ে। ক্লাবের হয়েও সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন । ২০১১ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গত ২০ বছরের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন।
এখন আগের তালিকায় থাকা খেলোয়াড়েরা পুরো ক্যারিয়ারে অন্যান্য গ্রেটদের চেয়ে কেমনভাবে আলাদা ছিলেন, সেটা একটু বলা যাক।
পেলে
ব্রাজিল জাতীয় দল সবসময়ই বিশ্বকাপে ফেভারিট ছিল। কিন্তু পেলে আসার আগ পর্যন্ত ২৮ বছর বিশ্বকাপ পায়নি, পেলে অবসর নেওয়ার পর আবার বিশ্বকাপ পায় ২৪ বছর পর। চারটি বিশ্বকাপে ১৪টি ম্যাচ খেলে ১২টি গোল আর ১০টি অ্যাসিস্ট, চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড, দু’টি ফাইনালে গোল করার রেকর্ড। ক্লাবের হয়ে একটু লক্ষ্য করুন। ইউরোপের জন্য যেমন চ্যাম্পিয়নস লিগ, ঠিক তেমনই লাতিনের জন্য কোপা লিবার্তোদোরেস। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টে সান্তোস শিরোপা জেতে ১৯৬২ আর ১৯৬৩ সালে। পেলে-পরবর্তী যুগে আবার শিরোপা পায় ৫৮ বছর পর, ২০১১ সালে। বর্তমানে ক্লাব বিশ্বকাপ একসময় ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ’ নামে পরিচিত ছিল। সান্তোস এই শিরোপা পায় ১৯৬২ আর ১৯৬৩ সালে, দুইবারই পেলে থাকার সময়।
ম্যারাডোনা
বিশ্বকাপে যত দল জিতেছে, তার মাঝে সবচেয়ে ‘দুর্বল’ দল ছিল সম্ভবত ১৯৮৬ এর আর্জেন্টিনা। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা বোঝার উপায় কী?
প্রতিটা বিশ্বকাপ-শেষে একটা অল স্টার দল ঘোষণা করা হয়। সাধারণত রানার্সআপ আর চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়েরাই এই ধরণের দলে বেশি সুযোগ পান। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দল থেকে কেবল ম্যারাডোনাই সুযোগ পান। তার মানে, আর্জেন্টিনার বাকি কোনো খেলোয়াড়ই সেই টুর্নামেন্টে তার নিজ পজিশনে সেরা খেলোয়াড় ছিলেন না। এরকম একটা একাদশে কেবল একজনের সুযোগ পাওয়াটা একটা রেকর্ড। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ফাইনালে ‘রেফারি কেলেঙ্কারি’ না ঘটলে অন্য কিছু ঘটতেই পারতো। ক্লাবের হয়েও অবিশ্বাস্য কিছু ঘটনার সাক্ষী ম্যারাডোনা। ১৯৮৬-৮৭ আর ১৯৮৯-৯০ এর মৌসুমে নাপোলিকে ইতালিয়ান লিগ চ্যাম্পিয়ন করান ম্যারাডোনা। প্লেমেকার হয়েও ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে সিরি আ’র সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এছাড়া ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়া, ১৯৮৯ সালে উয়েফা কাপ এবং ১৯৯০ সালে ইতালিয়ান সুপার কোপা জিতেন। লিগ শিরোপা, কোপা ইতালিয়া, উয়েফা কাপ, ইতালিয়ান সুপার কোপা – এই প্রতিটা শিরোপা ম্যারাডোনার আগে-পরে নাপোলি কখনো জিততে পারেনি, এই একটা তথ্যই মনে হয় তার গ্রেটনেস প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
ক্রুইফ
পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক খেলোয়াড় আছে, যাদের উপস্থিতিই দলের জন্য একটা টনিক। মাঝারি সারির কোনো কোনো দল একজন খেলোয়াড়ের জন্য অনেক উঁচু লেভেলে উঠে যায়, আবার সেই বড় বড় দলগুলোই আবার নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের অভাবে ভেঙে পড়ে। আয়াক্সের জন্য ক্রুইফ ছিলেন এমন একজন খেলোয়াড়। আয়াক্স নেদারল্যান্ডের লিগে সবসময়েই প্রথম সারির দল ছিল, কিন্তু ক্রুইফ আসার আগে কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেনি। রাইনাস মিশেলকে নিয়ে তিনি টোটাল ফুটবল দর্শনের সূচনা করেন। তার দর্শনে আয়াক্স তৎকালীন বিশ্বসেরা দলে পরিণত হয়। ১৯৭০-৭১, ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটান। ক্রুইফ আয়াক্সের জন্য কতটা জরুরী ছিলেন, তা পরের মৌসুমেই বোঝা যায়। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রেকর্ড ট্রান্সফারে ক্রুইফ বার্সেলোনায় যোগ দিলে আয়াক্স চ্যম্পিয়নস লিগ হারানোর সাথে সাথে ঘরোয়া লিগের শিরোপাও হারায়। বার্সার হয়ে ১৪ বছর পর লা লিগা জেতেন। ১৯৬০ সালের পর প্রথমবারের মতো সেই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদকে তাদের ঘরের মাঠে গিয়ে ৫-০ গোলে হারায়।
ক্যারিয়ারের শেষভাগে (১৯৮১-৮৩) আবার আয়াক্সে ফিরে আসেন, এবং ঘরোয়া লিগ জেতেন। কিন্তু ১৯৮৩ সালের শেষ মৌসুমে আয়াক্স ক্রুইফের সাথে চুক্তি নবায়ন করতে গড়িমসি করায় ক্রুইফ অপমানিত বোধ করেন এবং ফেইনুর্দ ক্লাবে যোগ দেন। সেখানে এক মৌসুম খেলে খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শেষ করেন। অবাক করা বিষয় হলো, সেই মৌসুমেই দশ বছর পর ফেইনুর্দ লিগ শিরোপা জয় করে। পরবর্তী শিরোপা ফেইনুর্দ জেতে আরো দশ বছর পর। তার নেতৃত্বেই নেদারল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে ১৯৭৪ সালে।
বিষয়টাকে এত সহজভাবে দেখলে বোধহয় ক্রুইফকে বোঝা যাবে না। ভালোভাবে বোঝার জন্য একটু ইতিহাসের সাহায্য নিই।
আগের ৯টি বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড শুধুমাত্র ১৯৩৪ আর ১৯৩৮ বিশ্বকাপে খেলে। ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপে ১৬ দলের মাঝে হয় ৯ম, ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে ১৫ দলের মাঝে হয় ১৪তম। এর পরের দু’টি বিশ্বকাপ খেলা হয়নি, তার পরের চারটি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগই পায়নি নেদারল্যান্ড। এরকম একটা দলকে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী দলদের হারিয়ে ফাইনালে ওঠা আসলে কতটা মর্যাদাসম্পন্ন, সেটা এখনকার দিনে গ্যারেথ বেল যদি কোয়ার্টারে ব্রাজিল আর সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে, তাহলে সেটার সাথে কিছুটা মিলে যায়। ক্রুইফ জাতীয় দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন? জাতীয় দলের হয়ে ক্রুইফ ৪৮টি ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৩৩টি। ক্রুইফ গোল করেছেন, এমন কোনো ম্যাচে নেদারল্যান্ড কখনো হারেনি।
ডি স্টেফানো
ইদানিং তো অনেকেই রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে অনেক গর্ব করে। অথচ অনেকেই হয়তো জানে না, এই গর্ব করার মূল ক্রেডিট যাবে ডি স্টেফানোর কাঁধে। ডি স্টেফানো আসার আগে লা লিগায় শিরোপা দৌঁড়ে বার্সার চেয়ে পিছিয়ে ছিল রিয়াল। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া লা লিগায় স্টেফানো আসার আগ পর্যন্ত রিয়াল শিরোপা জেতে মাত্র ২ বার, তাদের রাউভাল বার্সা জেতে ৬ বার। ১৯৫৩ সালে রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬৪ অবধি আটবার লা লিগা জেতেন, সম্ভাব্য ১১ বারের মাঝে ৮ বার। নতুন শুরু হওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন টানা পাঁচবার। প্রতিটা ফাইনালে গোল করেছেন, সর্বশেষ ফাইনালে করেছেন হ্যাটট্রিক।
এছাড়া ১৯৬২ আর ১৯৬৪ সালে রানার্সআপ হয়েছেন। সম্ভাব্য ৯ বারের মাঝে ৭টি ফাইনাল, তার মাঝে ৫ বার চ্যম্পিয়ন। মনে করুন, সেই সময়ে স্টেফানো যদি বার্সায় যোগ দিতেন (প্রথমে সেটাই হবার কথা ছিল), তাহলে রিয়াল মাদ্রিদ আজ কোথায় থাকতে পারতো? তাদের গর্বের ১৩টা চ্যাম্পিয়নস লিগের ৫টাই যে স্টেফানোর এনে দেওয়া!
প্লাতিনি
জুভেন্টাসকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতান, ফাইনালে তার একমাত্র গোলেই ‘ওল্ড লেডি’রা জিতে নেয় চ্যাম্পিয়নস লিগ। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে জেতেন টানা তিনটি ব্যালন ডি’অর। তবে সেরার তালিকায় আসতেন মূলত জিদান আসার আগ পর্যন্ত দেশের হয়ে একমাত্র শিরোপা জয়ের নায়ক থাকার কারণে। এখন নিশ্চিতভাবেই তালিকায় কিছুটা পেছনেই থাকবেন।
এবং মেসি-রোনালদো
এখন মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কেবলমাত্র বিশ্বকাপে পিছিয়ে থাকার কারণেই কি সেরার তালিকায় অনেক পিছিয়ে পড়বেন? তারা দু’জন কি সেরার ক্রাইটেরিয়াগুলো কোনোভাবেই পূরণ করতে পারেননি? প্রথমে মেসিকে দিয়ে আরম্ভ করা যাক।
অনেকেই মেসিকে জাতীয় দলে অসফল বলেন। জাতীয় দলের হয়েও মেসি কিন্তু যথেষ্টই সফল। তবে তালিকায় যারা উপরের দিকে আছেন, তাদের সাথে তুলনা করলে কিছুটা ব্যর্থই বলা যায়। অনেক মেসি ফ্যানদের মন্তব্য হচ্ছে, মেসি বার্সার হয়ে যতটা সমর্থন পান, আর্জেন্টিনার হয়ে ঠিক ততটা পান না। সেই সমর্থন পেলে মেসি আজ অন্য অবস্থানে থাকতেন। কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যা নয়। তবে মেসির মতো তালিকার কোনো গ্রেট খেলোয়াড় বার্সার মতো তাদের সময়ের সেরা দল কি পেয়েছেন? সেটাই একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
মেসির স্কিল নিয়ে কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। কথা হচ্ছে, বিচার করার সময় শুধু স্কিল আসে না, আপনি আপনার স্কিল কতটুকু ব্যবহার করতে পেরেছেন এবং সেটা দলের জন্য কতটা কার্যকর হয়েছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বড় দলে খেললে আপনি কিছুটা সুবিধা পাবেন। এখন বড় দল কিংবা ছোট দল বলতে কী বুঝায়, সেটা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
‘বড় দল’ কিংবা ‘ভালো’ আসলে কাকে বলে? আপনি ইন্টারনেটে সার্চ করলে বিভিন্ন সময়ের সেরা দলের তালিকা পাবেন। কোনোটাকেই নিখুঁত বলা উচিত হবে না, কারণ এগুলো বিভিন্ন সাইটের করা, ফিফার দ্বারা নয়। তবুও আপনি এর থেকে একটা ধারণা পেতে পারেন। এখানে Onefootball-এর করা একটা র্যাঙ্কিং দেওয়া হলো।
-
আয়াক্স – ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩
-
ব্রাজিল – ১৯৭০
-
মিলান – ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১
-
রিয়াল মাদ্রিদ – ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০
-
বার্সেলোনা – ২০০৮ থেকে ২০১১
-
লিভারপুল – ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৪
-
স্পেন – ২০০৭ থেকে ২০১২
-
ইন্টার – ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭
-
সান্তোস – ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৮
-
হাঙ্গেরি – ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভালো দল আসলে কাকে বলে? আপনি ভালো দলে খেলেছেন। নাকি একটা মোটামুটি ভালো দলকে গ্রেট দলে পরিণত করেছেন, সেটাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। ফিগো পর্তুগালের সোনালি প্রজন্ম পেয়েছিলেন। এক বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন, থামতে হয় আরেক গ্রেট জিদানের ফ্রান্সের কাছে। দু’টো ইউরো পেয়েছিলেন, ২০০০ ইউরোতে পর্তুগাল হারে সেমিতে ফ্রান্সের কাছে, ২০০৪ ইউরোর ফাইনালে হারে গ্রিসের রূপকথার কাছে। বেলজিয়াম কিছুদিন আগেও অসাধারণ দল ছিল, কিন্তু সফলতা পায়নি বলে তাদের নাম আজ থেকে ৫০ বছর পর কেউ মনে রাখবে না। ক্রুইফের কথা ভাবুন। যে দলেই গিয়েছেন, সেখানেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন, সেটা আয়াক্স হোক কিংবা নেদারল্যান্ড, বার্সা হোক বা ফেইনুর্দ। পেলে কিন্তু শুধু ব্রাজিলের হয়ে নয়, সান্তোসের হয়েও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যত গ্রেট দলের নাম আসে, তাতে সান্তোস বাদে আর কোনো লাতিন ক্লাব দল খুঁজে পাওয়া যায় না। এ থেকে আপনি কিছুটা পেলের গ্রেটনেস বুঝতে পারবেন।
এখন কথা হচ্ছে, মেসিও কিন্তু বার্সার হয়ে একটা দলকে গ্রেট দলে পরিণত করেছিলো। তবে বার্সা অতটা পেছনে ছিল না, যতটা পেলের সান্তোস, ক্রুইফের আয়াক্স, স্টেফানোর মাদ্রিদ ছিল। এবং বার্সা ততটা সফলতাও পায়নি, যতটা পেলে সান্তোসকে নিয়ে, ক্রুইফ আয়াক্সকে নিয়ে, কিংবা স্টেফানো মাদ্রিদকে নিয়ে পেয়েছিলেন। তবুও বার্সাকে স্মরণকালের সফলতম দলের ছোট তালিকায় আনা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দলকে সফল করার পেছনে মেসির অবদান কতটুকু? মেসি বাদে বার্সেলোনা এমনটা সফল হতে পারতো না, সেটা নিশ্চিত। তবে এই সফলতার পুরো ক্রেডিট এক মেসিকে দিয়ে দিলেও সমস্যা, জাভি-ইনিয়েস্তাকেও অস্বীকার করা যাবে না একেবারেই।
বিষয়টা এমন যে বার্সার হয়ে মেসির পারফরম্যান্স অসাধারণ, আবার জাভি-ইনিয়েস্তার পারফরম্যান্সও অনবদ্য। এখন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিচার করা যায়, তারা একে অন্যকে ছাড়া কতটুকু সফল হতে পারতেন? ক্লোসা যেমন জাতীয় দলের হয়ে অত্যন্ত সফল, কিন্তু ক্লাবের হয়ে ঠিক ততটা নয়। তার মানে, ক্লোসা খুব ভালো খেলেও জাতীয় দলের উপর নির্ভরশীল।
ঠিক একইভাবে, জাতীয় দলের হয়ে কিছু ক্রুশিয়াল ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়, মেসি হয়তো ক্লাবেও জাভি-ইনিয়েস্তাদের কারণেই সফল (হয়তো বিষয়টা ঠিক নয়)। অন্যদিকে, জাভি-ইনিয়েস্তারা কিন্তু মেসির অভাব ভিয়াকে দিয়ে পূরণ করে ফেলেছিলেন, এবং একটা লম্বা সময় ধরে বিশ্ব ফুটবলে ডমিনেট করে গিয়েছেন।
কিন্তু ক্লাবের হয়ে খুব ভালো খেলা খেলতে থাকা জাতীয় দলের সতীর্থদের নিয়ে মেসি তেমন কিছু করতে পারেননি। এমনকি মেসির জাতীয় দলের সতীর্থদের পারফরম্যান্স জাতীয় দলের হয়েও খুব খারাপ এমন নয়। তাই মেসিকে নিয়ে কিছুটা সন্দেহ আশা স্বাভাবিক যে, মেসি ক্লাবের কারণে সফল কি না।
বার্সার সফলতার পেছনে মেসি অন্যতম একটা ফ্যাক্টর, একমাত্র নয়। মেসি বাদে বার্সা নিশ্চিতভাবেই এত কিছু জিততে পারতো না, তবে সাধারণভাবে মনে হয় মেসিও বার্সা বাদে এত কিছু করতে পারতো না। চারটা উচল জেতা কঠিন হলেও অসম্ভব না। তার মানে, মেসি যা করেছেন, সেটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। মেসি এখন পর্যন্ত বার্সেলোনাকে নিয়ে তেমন কিছু করে ফেলেননি, যা পেলে, ম্যারাডোনা, কিংবা ক্রুইফ করেছেন।
বরং জাভি-ইনিয়েস্তারা কিন্তু মেসি বাদে স্পেনকে নিয়েও সফল দলের তালিকায় এসে পড়েছেন, সেটাও গ্রেট দলগুলোকে হারিয়েই। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, কোপা কিংবা বিশ্বকাপে মেসির প্রতিপক্ষগুলো তুলনামূলকভাবে কিছুটা দুর্বল ছিল। এখন আপনি দুর্বল কিংবা সবল দল কোনটা, সেটা নিয়ে কিছুটা তর্ক করতে পারেন। গত ২০টা বিশ্বকাপ লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, সেখানে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র ৮টি দল। বিশ্বকাপ জিততে ভালো দল, দুর্দান্ত খেলোয়াড় এগুলো তো লাগেই, তবে সবচেয়ে বেশি লাগে বোধহয় ফুটবল ঐতিহ্য। ঐতিহ্য ও রেকর্ড বিবেচনায় একমাত্র নেদারল্যান্ডেরই সেটা পাওয়া হয়নি। এবং আপনি লক্ষ্য করলে অবাক হতে পারেন, ১৯৬২ বিশ্বকাপের পর থেকে এবারেরটা বাদ দিলে বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট এই আট দলের মাঝ থেকেই ছিল। আর্জেন্টিনা ২০১৪ বিশ্বকাপে সেমিতে নেদারল্যান্ডকে পায়, সেটিতেও টাইব্রেকারে জিতে। তবে জার্মানিকে ফাইনালে হারাতে পারলে এসব কিছুই মানুষ মনে রাখতো না।
প্রতিটা সফল দলেরই সফল হবার পেছনে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। এর মাঝে মেসির আর্জেন্টিনার হয়ে বাধাটাই সবচেয়ে কম কঠিন ছিল পেলে, ম্যারাডোনা, ক্রুইফ, কিংবা জিদানদের তুলনায়। মেসিকে নিয়ে চিলি যেমন প্ল্যান করেছে, ঠিক তেমনটা নিশ্চয়ই ক্রুইফকে নিয়ে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল, ম্যারাডোনাকে নিয়ে ইংল্যান্ড, অথবা জিদানকে নিয়ে ব্রাজিল করেছিলো।
আপনি তখনই সফল, যখন আপনার প্রতিপক্ষের ট্যাকটিক্স আপনাকে আটকাতে পারবে না। জাতীয় দলের হয়ে মেসি চারটা ফাইনাল পেয়েছিলেন। এতটা সুযোগ অনেক গ্রেট খেলোয়াড়ও পান না। ফাইনালে আরো অনেক গ্রেটই হেরেছেন। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদান একটা গোল করেন, একটা হেড বুফন সেভ করেন অতিমানবীয়ভাবে। ক্রুইফকে ফাউল করার কারণেই পেনাল্টি পায় নেদারল্যান্ড। সেই ম্যাচ জার্মানি পরে জিতে দুই গোল করে। পুসকাসের কথাই চিন্তা করুন। ১ গোল করে, আর এক গোল করিয়ে ২ গোলে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। পরে আরেকটা গোল করেন, যা বাতিল হয়ে যায় । মেসির পারফরম্যান্স কী এমন ছিল?
হ্যাঁ, কিছু সুযোগ সৃষ্টি তিনি করেছিলেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ দেখেছিলেন? সেখানে দেখবেন, জিদান গোল করার আগে পেটিট অন্তত দুইটি গোল মিস করেছিলেন। একটা তো গোলকিপারকে ওয়ান টু ওয়ান পেয়েও। জিদান গোল করার পর কেউ সেগুলো মনে রাখেনি। মেসির পক্ষে কি সামর্থ্য ছিল না একটা ম্যাচে সলো কিছু করা? ক্লাবে হয়ে কিন্তু এমনটা অনেক সময়েই করেছেন। কোপার দুই ফাইনালে তো আর্জেন্টিনা গোল খায়নি, জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালেও প্রায় শেষ মুহূর্তে গোল খেয়েছে। এমন তো নয় যে, ডিফেন্সের ভুলে অনেক আগেই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিলো। এবং আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, যদি আর্জেন্টিনার হয়ে তিনটা কাপ মেসি জিতে যেত, তাহলে আর্জেন্টিনার এই দলটাও সেরা দলের সংক্ষিপ্ত তালিকায় চলে আসতো এবং তাদের আরো কয়েকজন খেলোয়াড় স্টার হয়ে যেত।
তবে এরপরও মেসিকে সফল বলা যায় জাতীয় দল নিয়ে, তবে সর্বোচ্চ সফলতা পাননি। তিনটা ফাইনাল না খেলে যদি দু’টিতে গ্রুপপর্বে বাদ পড়ে গিয়ে একটিতে চ্যাম্পিয়ন হতো, তাহলেও এখনকার তুলনায় তখন বেশি সফল বলা হতো। এখন এই ব্যর্থতার জন্য আপনি বিভিন্ন কারণ চাইলে দেখাতে পারবেন, কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, দিনশেষে বিচার করার সময় এগুলো কেউ মনে রাখবে না। আর এভাবে বিচার করতে চাইলে আগের অনেক গ্রেটদের ব্যর্থ হবার কারণও বের করতে হবে, যা কিনা এখন পর্যন্ত কোনো বিচারেই করা হয়নি।
কিন্তু কথা হচ্ছে বিচার করার সময় কেউ এটা ভাবে না যে, এরকম দল পেলে এরকম হতো বা সে মিস না করলে অন্যরকম হতে পারতো। যা পেয়েছেন, সেটা নিয়েই বিচার করতে হয়। তাই মেসি যে বার্সা ছাড়া অন্যত্র ব্যর্থ হতেন, সেটা বলাটা উচিত হবে না। কেননা, বার্সা বাদে আমরা তাকে এখনো খেলতে দেখিনি অন্য ক্লাবের হয়ে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, আমরা খুব সম্ভবত মেসির সেরা খেলা দেখার জন্য তার সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ দেখেছি বার্সায়। কিন্তু পেলে, ম্যারাডোনা কিংবা স্টেফানোরা হয়তো এমনটা পায়নি। কীভাবে?
একটা বিষয় আসে যে পেলে কিংবা স্টেফানোদের তুলনায় এখনকার যুগে গোল করা অনেক বেশি কঠিন। সেই কঠিন কাজটা মেসি কিংবা রোনালদো করে চলেছেন। এটাও একটা ফ্যাক্টর, তবে এর সাথে আরেকটা ফ্যাক্টর মাথায় রাখতে হবে। মেসি কিংবা রোনালদো স্কোরার হিসেবে অসাধারণ, তবে শুধু এই একটা কারণেই তাদের গোলসংখ্যা বাড়েনি। এর সাথে আপনি কোন দলে খেলেছেন, আপনার প্রতিপক্ষ কেমন, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো যদি শুধু স্কোরিং অ্যাবিলিটির জন্যই এত গোল পেতেন, তাহলে জাতীয় দলের হয়েও পেতেন। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে ভূমিকার ভিন্নতা, বা যেকোনো কারণেই হোক না কেন, গোল রেশিও অনেক কম। মেসি বা রোনালদো তাদের সময়ের সেরা দলে খেলেছেন। ডমিনেটিং দলে খেললে আপনার গোল এমনিতেও একটু বাড়বে। এখন মেসি বা ক্রিস্টিয়ানোর স্কোরিং অ্যাবিলিটি যেহেতু অসাধারণ, তাই তারা এর ব্যবহারটা খুব ভালোভাবে করতে পেরেছেন। পেলে কিংবা স্টেফানো তাদের সময়ের সবচেয়ে সেরা দলে খেললে গোলসংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই আরো বেশি হবার কথা ছিল। সান্তোসের হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের বিপক্ষে পেলের ১৩০ ম্যাচে গোল ১৪২টি। স্বাভাবিকভাবেই পেলে রিয়াল মাদ্রিদে খেললে গোলসংখ্যা হয়তো আরো বেশি হবার সম্ভাবনা থাকতো।
মেসি-রোনালদোর যুগে যেমন ট্যাকটিক্স কঠিন, ঠিক তেমনি পেলে বা স্টেফানোর যুগে তারা সবচেয়ে সেরা দল পাননি। বরং যে দল পেয়েছে, তাকেই নিজেদের সামর্থ্য দ্বারা সেরা বানিয়েছেন। আবার আগের ডিফেন্ডারদের ট্যাকলও ছিল কসাইদের মতো। এখনকার মতো সুরক্ষা আগের খেলোয়াড়েরা পেতেন না। মাঠও এবড়ো-থেবড়ো ছিল এখনকার তুলনায়। স্বাভাবিক খেলা এতটা সহজ ছিল না।
কাজেই, বিচারের সময় সবকিছুকেই মাথায় নেওয়া উচিত। আপনি কখনোই একসাথে সব সুবিধা পাবেন না। বর্তমান দলের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, এক দলের হয়তো ডিফেন্স খুব ভাল, আবার আরেক দলের অ্যাটাক। আপনার এগিয়ে থাকার বিষয়টা নজর রেখেই আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। সেই পরিকল্পনাটা কি লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সঠিকভাবে করতে পেরেছেন?
সেটাই আলোচনা করা হবে আগামী পর্বে।