জগমোহন ডালমিয়ার সাথে জুটি করে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ককে নতুন এক স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তখনকার আইসিসির কোষাধ্যক্ষ এহসান মানি। বিশ্বখ্যাত এই প্রশাসক পরে আইসিসি প্রধান হিসেবেও ছিলেন দারুণ সফল।
সেই এহসান মানি ফিরে এসেছেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে। দায়িত্ব নিয়েই পাকিস্তানের ক্রিকেট ও ভারতের সাথে সম্পর্ক বদলানোর কথা বলেছেন এহসান মানি। তবে সম্পর্ক বাড়াতে গিয়ে মাথা নত করবেন না, সেটাও বলে দিলেন তিনি।
ঘরোয়া ক্রিকেট
ঘরোয়া ক্রিকেট হলো ক্রিকেটারদের লালন-পালনক্ষেত্র। আমাদেরকে স্কুল ও জেলা স্তরের ক্রিকেট নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আর এর ওপরে থাকবে প্রদেশগুলো। আমাদেরকে বিভিন্ন পেশাদার সংস্থাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, তারা ক্রিকেটারদের সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা এবং তারা কাঠামো তৈরি করেছে। আমি ‘প্যাট্রন’-এর (প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান) সাথে দেখা করেছি। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের মান বাড়ানোর জন্য দল কমানো উচিত।
তিনি অস্ট্রেলিয়ান মডেল বিবেচনা করতে বলেছেন। কিন্তু আমাদেরকে একটা পাকিস্তানী মডেল তৈরি করতে হবে। কারণ, আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। কিন্তু আদর্শগতভাবে এটাই সঠিক যে, কেবলমাত্র মানসম্পন্ন দলগুলোই প্রথম শ্রেণীর টুর্নামেন্ট খেলবে। এবং আমাদেরকে ১৬-১৮ জন খেলোয়াড়ের একটা দল সবসময় তৈরি রাখতে হবে। আমরা এই সবকিছুর জন্য একটা টাস্ক ফোর্স করবো। সেই সাথে ক্রিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে, সাবেক ক্রিকেটারদের সাথেও আলোচনা করবো। মূল উদ্দেশ্য হলো, পাকিস্তানের ক্রিকেটকে শক্তিশালী করা।
প্রাদেশিক ক্রিকেট
আঞ্চলিক ক্রিকেটকে শক্তিশালী করতে হবে। কারণ, পৃথিবীর কোথাও ক্রিকেট কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হয় না। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাগুলোকে ক্ষমতাশালী করা। যাতে তারা নিজেরা তহবিল সংগ্রহ করে নিজেদের এলাকার মধ্যে ক্রিকেটের উন্নয়ন করতে পারে। আমাদের স্টেডিয়ামগুলোর অবস্থা করুণ। ক্রিকেট বোর্ডের কাজ স্টেডিয়াম ঠিক করা নয়। আঞ্চলিক সংস্থাগুলো স্টেডিয়াম পরিচালনা করবে। আমাদের অবকাঠামো মানসম্মত হলে ক্রিকেট উন্নত হবে। যেসব দল ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে, যেমন- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ভারত; এদের সবার সুশাসন আছে। একটা ভালো প্রশাসনিক বোর্ড কখনো বাইরের কোনো চাপে চলে না। তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে- একটা পেশাদার দল দিয়ে পেশাদারভাবে বোর্ড চালানো।
পিসিবি সংষ্কার
পিসিবির কাঠামো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কারণ, এটা বছরের পর বছর ধরে বড় হয়ে চলেছে। এখন এখানে ৯০০-এর ওপরে চাকরিজীবি আছে। আমার সন্দেহ আছে যে, পৃথিবীতে কোথাও জনশক্তির বিচারে এত বড় বোর্ড আছে কি না। এর কারণ হলো আমরা সবকিছু কেন্দ্রীয়ভাবে চালাই। আমরা অঞ্চলগুলোকে আরও ক্ষমতা দিয়ে দিলে এটার সমাধান হবে। যে অর্থ বাঁচতে পারতো, সেটা ক্রিকেটে ব্যয় করা হবে। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি, প্রতিটা পয়সা ক্রিকেটে ব্যয় করা হবে। আমরা বোর্ডকে পেশাদার করবো এবং যেকোনো বেসরকারি সংস্থার মতো করে এটা চালানো হবে।
গঠনতন্ত্র সংশোধন
বোর্ডের গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে। কারণ, এখানে স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) আছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এখন একই ব্যক্তি। একজন চেয়ারম্যান বোর্ডের নীতি ও কৌশল পযবেক্ষণ করবেন ও নিশ্চিত করবেন যে, সেগুলো প্রয়োগ হচ্ছে। আর সেটা প্রয়োগ করবেন প্রধান নির্বাহী। একই ব্যক্তি যখন এই দুই দায়িত্বে থাকে, তখন একটা স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়। বোর্ডের কমিটিগুলো গঠনের যে উপায় গঠনতন্ত্রে আছে, তা-ও খুব ভালো অনুশীলন নয়। প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা আবার নিরীক্ষা (অডিট) কমিটির সদস্য। অথচ তারই নিরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
আমরা যা করি না কেন, সেটা স্বচ্ছ হবে। সব সিদ্ধান্ত ও সব অর্থনৈতিক ব্যাপার স্বচ্ছতার সাথে করা হবে। এটা শুধু সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টদের কাছে দেওয়া হবে, তা-ই নয়, সাধারণ মানুষও যেকোনো সময় এসব দেখতে পাবে। কারণ, তারাই পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী।
পিএসএল পাকিস্তানে
পুরো পিএসএল পাকিস্তানে করা হবে। কারণ, এতে এটার ব্র্যান্ড মূল্য বাড়বে। আগামী পিএসএল আসরের আটটি ম্যাচ পাকিস্তানে হবে। এটা ইতিমধ্যে ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর কাছে কথা দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা এরপর থেকে পাকিস্তানে পিএসএল-এর ম্যাচ বাড়াবো। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের বিশ্বাস তৈরি হয়, এমন ব্যাপারে গত তিন বছরে ছোট ছোট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু লোক থাকবে, যাদের পাকিস্তানে আসার ব্যাপারে আপত্তি থাকবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হলো পাকিস্তানে ক্রিকেটকে ফিরিয়ে আনা। শেষ অবধি আমাদের মূল লক্ষ্য পাকিস্তানের সব ম্যাচ পাকিস্তানেই আয়োজন করা। যদিও এটা ঠিক এখই বলা যাবে না যে, এটা কালকেই হবে, নাকি পাঁচ বছর পর। ১৯৯৮ সালে তেমন কোনো ঘটনা না ঘটার পরও অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানে খেলতে আপত্তি করেছিলো। এই ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাদেরকে সামলাতে হবে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক
ভারতের সাথে আমরা আবার সুসম্পর্ক গড়তে চাই। আমি কখনো বলিনি যে, আইসিসিতে পাকিস্তানের বিসিসিআই এর (ভারতীয় বোর্ড) বিপক্ষে মামলা দুর্বল প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। আমি সবসময় বলেছি, একটা সমস্যা সমাধানের দুটো পথ থাকে। প্রথমটা হলো, একটা টেবিলে বসে আলোচনা করে সমাধান করা। আর দ্বিতীয়টা হলো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ২০০৪ সালে ভারত যখন পাকিস্তানের সাথে খেলছিলো, আমি তখন আইসিসি সভাপতি। আমি তাদের বোর্ড ও সরকারের সাথে কথা বলে তাদের দুশ্চিন্তাটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তারা আমাকে নিজেদের মধ্যে সমাধান করার জন্য এক বছর সময় দিতে বলেছিলো। আমি এক বছর পর তাদের কাছে গেলাম এবং তারা এখানে (পাকিস্তানে) এসেছিলো। আমাদেরকে সেই সম্পর্ক ও বিশ্বাস আবার গড়ে তুলতে হবে।
দেখুন, জগমোহন ডালমিয়ার সময়ে ভারত ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড খুব ঘনিষ্ঠ ছিলো। তখন আমাদের এখানে তৌকির জিয়া, খালিদ মাহমুদ ও আরিফ আব্বাসী ছিলেন। আমাদের চেয়ারম্যানের সাথে ভারতীয় পক্ষের চেয়ারম্যানের সুসম্পর্ক ছিলো। আর সুসম্পর্ক থাকলে এসব ঝগড়া থাকে না। পিএম তার শপথ অনুষ্ঠানে নভোজাত সিং সিধুকে ডেকে একটা বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ভারতকে বলেছেন, তারা যদি এক পা সুসম্পর্কের দিকে এগোয়, পাকিস্তান দুই পা এগোবে। আমরা সেটাই ক্রিকেটেও করতে চাই।
তবে মাথা নত নয়
আমি বলে দিচ্ছি, এর মানে এই নয় যে, আমি ভারতকে আমাদের এখানে খেলার জন্য পীড়াপীড়ি করবো। তাদের নিজস্ব নীতিই পরস্পরবিরোধী। তারা এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপের মতো বহুজাতিক টুর্নামেন্টে আমাদের সাথে খেলতে রাজি। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সফরের প্রশ্ন এলেই তারা আপত্তি করে। ফলে আমি কখনোই তাদের এই অবস্থান ও নীতির ভিত্তিটা বুঝতে পারি না। এমনকি আমি যখন আইসিসিতে ছিলাম, তখনও তারা আইসিসির টুর্নামেন্ট থেকে নিজেদের তুলে নেওয়ার হুমকি দিতো।
আমিও তাদের বলেছিলাম, আমি তাদের সদস্যপদ স্থগিত করে দিতে পারি। কিন্তু আজকের আমার এই অবস্থানে থেকে তো সেটা বলা সম্ভব নয়। সেই সময়ের থেকে আইসিসি অনেকটাই বদলে গেছে। ভারতের প্রভাব এখন অনেক বেশি। কিন্তু আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই লড়াই করবো। পিসিবি-বিসিসিআই আইনী লড়াই যদি এখন প্রাথমিক স্তরে থাকে, আমি বিসিসিআই এর সাথে টেবিলে বসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছে, সেখান থেকে সরে আসা যাবে না। সব কাগজপত্র বিনিময় হয়েছে। ১ অক্টোবর শুনানি আছে। ফলে এই অবস্থায় সরে দাঁড়ালে নিজেদের দুর্বল মনে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি আশাবাদী মাইকেল বেলহফ (আপত্তি নিষ্পত্তি কমিটির প্রধান) একজন শক্ত মানুষ। ওনাকে আইসিসিতে আমার সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। তিনি কোনো চাপে কাজ করবেন না। আইন অনুযায়ী যা হয়, তা-ই সিদ্ধান্ত দেবেন।