Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেভিড গাওয়ার: বাঁহাতি ব্যাটিংয়ের জাদুকর

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। স্বপ্নের মাঝে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকত যে, একসময় পড়াশোনার চেয়েও ক্রিকেটকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল সে। ক্রিকেটের প্রতি ছেলের এই মুগ্ধতা বাবা-মাকেও কম অবাক করেনি। কারণ, পরিবারের কেউ তো আর ক্রিকেটার ছিল না। তাই ছেলের ক্রিকেটের প্রতি এই ভালোবাসা বাবা-মায়ের মনেও আলোড়ন তোলে। তাদের এগিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণা ছেলেকে আরো বড় হতে স্বপ্ন দেখিয়েছে। ভাবতে শিখিয়েছে বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ক্রাডক উলি, নিল হার্ভে, কিংবা নেভিল কার্ডসদের মতো নিজেকেও ক্রিকেটের বাঁ-হাতি সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়। ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়লেও পড়াশোনায় তেমন ফাঁকিবাজি ছিল না তার। তাই খেলাধুলা আর পড়াশোনা সমান গতিতে এগিয়ে চলতে লাগলো। ছেলেটি যেন এক কঠিন সাধনায় রত।

ডেভিড গাওয়ার; Source: thecricketmonthly.com

যে ছেলেটিকে নিয়ে এই গল্প তিনি আর কেউ নন, ইংল্যান্ডের আধুনিক যুগের অন্যতম স্টাইলিশ বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ডেভিড ইভন গাওয়ার। ১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল ইংল্যান্ডের টান ব্রিজ ওয়েলস শহরে গাওয়ারের জন্ম। জায়গাটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ট্যাঙ্গানিকার আওতাধীন ছোট্ট একটি শহর। পিতা রিচার্ড গাওয়ার ট্যাঙ্গানিকার রাজধানী দার এস সালামে ব্রিটিশ সরকারের এক কর্মচারী ছিলেন। ডেভিড গাওয়ার তার শৈশবের ৬ বছর কাটান টান ব্রিজ শহরেই। ট্যাঙ্গানিকা ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে রিচার্ড তার পরিবার সহ চলে আসেন ইংল্যান্ডের কেন্ট শহরে। তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর।

ডেভিডের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় মার্লবরা হাউজ স্কুলে। পরবর্তীতে তিনি ক্যানটারবেরিতে কিং স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটে চলতে থাকে তার নিয়মিত প্রশিক্ষণ। ডেভিডের ইচ্ছে ছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় সেখানেই ভর্তি হয়ে যান তিনি। কলেজে ভর্তির ছয় মাস পরেই তিনি পেশাদার ক্রিকেটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। প্রায় ছয় ফুট ছুঁই ছুঁই দীর্ঘ, মেদহীন ও ঋজু দেহ, সবসময় মুখে যেন লেগে থাকে তার এক মোহনীয় ‍মিষ্টি হাসি। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া সোনালী চুল, আর রয়েছে দুটি মায়াবী চোখের জাদু।

স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ডেভিড গাওয়ার; Source: espncricinfo.com

১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই, লেইস্টারশায়ারের পক্ষে ছিল তার ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম পদার্পণ। কিন্তু পুরো মৌসুমে ডেভিড গাওয়ার তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বলার মতো তেমন কোনো নজরকাড়া সাফল্য দেখাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হন সেই মৌসুমে। কিন্তু পরের মৌসুমটি ছিল তার ঘরোয়া ক্রিকেট ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ৩৫.৮৮ গড়ে রান করেন ৩২৩। শুধু টেস্ট ম্যাচেই নয়, প্রথম শ্রেণীর একদিনের ম্যাচেও তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭৬-৭৮ সাল পর্যন্ত এই তিন মৌসুম জুড়ে তিনি তার অনবদ্য ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। গাওয়ারের এই ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতা নির্বাচকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।

সাতাশ বছরের এই তরুণ বাঁ-হাতি ক্রিকেটারের টেস্ট জীবনের অভিষেক ঘটে ১৯৭৮ সালে স্বদেশের মাটিতে, এজবাস্টন মাঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ওই বছরেই তিনি ইয়ং ক্রিকেটারের সম্মান এবং উইজডেনে ফাইভ ক্রিকেটারস অব দ্য ইয়ার হওয়ার সম্মান পান। এতদিনে ছোট্ট সেই ছেলেটির কঠিন সাধনা পূর্ণতা পেলো। মূলত এই সম্মানই ডেভিড গাওয়ারের টেস্ট ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্তির মূল কারণ। অভিষেক সেই টেস্টে তিনি ৫৮ রানের একটি ঝকঝকে সুন্দর ইনিংস দর্শকদের উপহার দেন।

বাঁহাতি ব্যাটিংয়ের এক অনবদ্য সম্রাট ডেভিড গাওয়ার; Source: telegraph.co.uk

ডেভিড গাওয়ার মোট ১১৭টি টেস্ট খেলেছেন। ২০৪টি ইনিংসে তিনি নক আউট থেকেছেন ১৮ বার, ৪৪.২৫ গড়ে রান করেছেন ৮,২৩১, সেঞ্চুরি ১৮টি, অর্ধশতক ৩৯টি। টেস্টে তার সর্বোচ্চ রান এজবাস্টন মাঠে, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে করেছেন ২১৫। তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি ১১৯টি টেস্টে শূন্য রানে আউট হওয়ার কোনো নজির স্থাপন করেননি; যা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে আজও বলবৎ রয়েছে। একদিনের প্রতিযোগিতায়ও তার ব্যাট ছিল বেশ সাবলীল। ১১৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৭ সেঞ্চুরি সহ ৩,১৭০ রান করেন তিনি, সর্বোচ্চ রান ১৫৮ এবং তা ছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে।

ডেভিড গাওয়ারের টেস্টে ব্যাটিং পরিসংখ্যান; Source: espncricinfo.com

গাওয়ার ৮৪-র ইংলিশ মৌসুমে কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের দল লেইস্টারশায়ারের হয়ে রান পেয়েছেন ৯৯৯, গড় ৩৫.৬৭ রান। তিনি মাঝেমধ্যে দলের প্রয়োজনে অফ ব্রেক বলও করতেন। ১৯৮১-৮২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে কানপুরে ৬ষ্ঠ টেস্টে তিনি একটি উইকেট পান এক রানের বিনিময়ে। ডেভিড গাওয়ার তার নিপুণ হাতে স্কয়ার কাট, ফ্লিক বা ড্রাইভ মারতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কাভার ফিল্ডার হিসেবেও ছিল তার সুনাম।

১৯৮৫ সালের অ্যাশেজ জয়ের পর; Source: thereversesweep.typepad.com

১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞ অধিনায়ক অসুস্থ বব উইলিসের পরিবর্তে ইংল্যান্ড দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পান গাওয়ার। কিন্তু তার জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি সেই টেস্ট। লর্ডস টেস্টে পাকিস্তানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ১০ উইকেটে। কিন্তু বাকি টেস্টগুলো জিতে সিরিজটি করায়ত্ব করতে সক্ষম হন। আশির দশকে ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দেওয়া গাওয়ারের সেরা সাফল্য ‘৮৫তে ঘরের মাঠে অ্যাশেজ জয়। সেবার অস্ট্রেলিয়াকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড।

তিনি দেশের হয়ে ৩২টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য গাওয়ারের, সেই সঙ্গে দেশেরও। দলপতি হিসেবে তেমন কোনো নজরকাড়া সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হন তিনি। ১৯৮৬ সালে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজে দলের পরাজয়ের সাথে সাথে নিজেও ব্যর্থ হন। স্বদেশের মাটিতে লজ্জাজনকভাবে গাওয়ারের দল হেরেছে ০-৫ ব্যবধানে সেই টেস্ট সিরিজে। এতে তার দুর্বল অধিনায়কত্বের প্রমাণ মেলে। এর ফলে তিনি সংক্ষিপ্তকালের জন্যে অধিনায়কত্বও হারান।

অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লয়েডের সাথে টস করতে যাচ্ছেন ইংল্যান্ড দলপতি গাওয়ার; Source: Getty Images

১৯৯২ সালের আগস্টে সেই পাকিস্তানেরই বিপক্ষে খেলেছেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। ১৯৯৩ সালে তিনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর স্কাই স্পোর্টস ও বিবিসির ধারাভাষ্যকার হিসেবে নাম লেখান গাওয়ার। এই পেশাতেও যে তিনি যথেষ্ট সফল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়াও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন ক্রিকেট নিয়ে বেশ কিছু ইলেকট্রনিক গেমসেও। ডেভিড গাওয়ার ১৯৯২ সালে দ্য মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) পদকে ভূষিত হন। ১৬ জুলাই ২০০৯ সালে তিনি আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে ঠাঁই পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ডেভিড শেফার্ড ফাউন্ডেশন এবং ওয়ার্ল্ড ল্যান্ড ট্রাস্টের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।

ধারাভাষ্যকার হিসেবে ডেভিড গাওয়ার; Source: ESPNcricinfo

গাওয়ার শুধু বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, ছিলেন ক্রিকেটের এক নিপুণ জাতশিল্পী। ক্রিকেট বোদ্ধাদের মতে, তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা চিত্তাকর্ষক বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান, ঘুমপাড়ানী ক্রিকেটে যার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। বোলারদের আস্ফালনে যার মাথা নোয়ানোর স্বভাব নয়, যিনি রেকর্ড বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাট করেন না এবং যিনি এমনভাবে খেলতে চান, যাতে মাঠভর্তি দর্শকদের চিত্ত আলোড়িত হয়ে ওঠে। ডেভিড গাওয়ার সম্পর্কে গার্ডিয়ান পত্রিকায় যে উক্তিটি করা হয়েছিল। তা বেশ চমকপ্রদ-

“গাওয়ারের ক্রিজে জমে যাওয়ার পরেই আউট হয়ে যাওয়ার অভ্যাস তার ভক্ত ও নির্বাচকদের হতাশ করতো খুব, কিন্তু তার আউট হওয়ার আগের আধ ঘণ্টার হাইলাইটস দেখে মনে হতো, অ্যালেন বোর্ডার ও একশো জিওফ্রে বয়কটের সম্মিলিত রূপ প্রদর্শিত হচ্ছে মাঠে।”

ফিচার ইমেজ- All Out Cricket

Related Articles