১ জুন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩ টা ৩০ মিনিটে ইংল্যান্ডের ওভালে বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটি দিয়ে পর্দা উঠবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭ এর। কারা উঠবে সেমিফাইনালে? কাদের মধ্যে হতে পারে ফাইনাল ম্যাচ? কে হবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন? দারুণ ফর্মে থাকা বাংলাদেশ কি পারবে এই টুর্নামেন্টে চমক দেখাতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের আরও বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তারপরও মাঠের বাইরের জল্পনা-কল্পনা থেমে নেই। ক্রিকেটবোদ্ধা থেকে শুরু করে ক্রিকেটপ্রেমী সাধারণ মানুষ সবার আলোচনার বিষয়বস্তু এখন শুধু আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আর তা হবেই বা না কেন? এটি যে একধরনের মিনি বিশ্বকাপ।
মাঠের লড়াই শুরু হওয়ার আগে আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই। জেনে নেই পূর্ববর্তী চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিগুলো সম্পর্কে।
আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্ট (১৯৯৮)
আইসিসি টেস্ট খেলুড়ে দলগুলো নিয়ে একটা ছোটখাটো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় যা আসলে অনেকটা মিনি বিশ্বকাপের মতো। ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন একেবারেই অনভিজ্ঞ। আর তাই বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রচারের উদ্দেশ্যেই ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। এই টুর্নামেন্টের সবগুলো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। টেস্ট স্ট্যাটাস না পাওয়ার কারণে স্বাগতিক দেশ হয়েও বাংলাদেশকে পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই দর্শক হয়ে থাকতে হয়েছিলো।
নয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে জিম্বাবুয়ে এবং নিউজিল্যান্ডের র্যাংকিং ছিল শেষ দুইয়ে। এ কারণে তাদের মধ্যে একটি বাছাইপর্বের ম্যাচ হয়। সেখানে নিউজিল্যান্ড জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে চুড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ফাইনালে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চার উইকেটে পরাজিত করে। ওটাই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কোনো আইসিসি ইভেন্টে প্রথম এবং শেষবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনা।
আইসিসি নকআউট টুর্নামেন্ট (২০০০)
এবারের টুর্নামেন্টটি অনুষ্ঠিত হয় কেনিয়ার নাইরোবিতে। আর বাংলাদেশ এতে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে। এছাড়া ছিল স্বাগতিক দেশ কেনিয়া। যদিও বাংলাদেশ প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বে ইংল্যান্ডে কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।
ঐ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় নিউজিল্যান্ড। ফাইনালে তারা ভারতকে চার উইকেটে হারায়। ভারতের করা ২৬৪ রানের জবাবে দুই বল বাকি থাকতেই ৬ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌছে যায় নিউজিল্যান্ড এবং প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০২)
২০০২ এর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অনুষ্ঠিত হয় শ্রীলঙ্কায়। ১২টি দল চারটি পুলে ভাগ হয়ে এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সাথে পুল-এ তে ছিল। এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটিও বাংলাদেশের জন্য তেমন সুখকর ছিল না। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো ম্যাচেই বাংলাদেশ বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। সেমিফাইনালে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকাকে এবং শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে।
কলোম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত ফাইনালে মুখোমুখি হয়। কিন্তু এই ফাইনালে জয়ী হতে পারেনি কেউই। জয় হয় বৃষ্টির। প্রথমবার বৃষ্টির কারণে খেলা পন্ড হলে খেলা চলে যায় রিজার্ভ দিনে। রিজার্ভ ডে-তে শ্রীলঙ্কা আগে ব্যাট করতে নেমে ২২২ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে ভারতের স্কোর যখন ৮ ওভার ৪ বলে ৩৮ রান তখনই আবার শুরু হয় বৃষ্টি। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা এবং ভারত উভয়কেই যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০৪)
২০০২ এর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর বসে ইংল্যান্ডে। মোট ১২টি দল ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে ১৬ দিন ধরে ১৫টি ম্যাচে তিনটি ভেন্যুতে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। এগুলো হলো এজবাস্টন, রোজ বল এবং ওভাল। বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ছিল গ্রুপ বি-তে। এবারও বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে যথাক্রমে ৯ উইকেট এবং ১৩৮ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। চারটি গ্রুপ থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেমিফাইনালে উঠে।
ওভালে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্টেডিয়াম তখন কানায় কানায় পূর্ণ। ফাইনালে টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৯ ওভার ৪ বলে ২১৭ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড। ৭ বল বাকি থাকতেই এই লক্ষ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ টপকে যায় আট উইকেট হারিয়ে। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০৬)
ভারত ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এই পঞ্চম আসরের আয়োজক দেশ। এবার অবশ্য অংশগ্রহণ করে টেস্ট খেলুড়ে দশটি দেশ। কোয়ালিফাই পর্বে বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ গ্রুপ পর্বে খেলার সুযোগ পায়। কিন্তু বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথমবারের মতো কোনো ম্যাচে জয়ের মুখ দেখে। শাহরিয়ার নাফিসের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ভর করে জিম্বাবুয়েকে তারা হারায় ১০১ রানের বিশাল ব্যবধানে। ১২১ রানে অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরীর রেকর্ড গড়েন শাহরিয়ার নাফিস।
গ্রুপ পর্বে আটটি দল নিয়ে দুটি গ্রুপ করা হয়, গ্রুপ এ এবং গ্রুপ বি। গ্রুপ এ থেকে সেমিফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্রুপ বি থেকে সেমিফাইনালে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডকে ৩৪ রানে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে উঠে।
মুম্বাইতে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চরম ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। ৩০ ওভার ৪ বলে তারা অলআউট হয় মাত্র ১৩৮ রানে। এরপর বৃষ্টি শুরু হলে ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট দাঁড়ায় ৩৫ ওভারে ১১৬ রান। ২৮ ওভার ১ বলে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌছে যায়। অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য ওয়াটসন ম্যাচসেরা হন। আর প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিজেদের করে নেয় টিম অস্ট্রেলিয়া।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০০৯)
২০০৯ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হওয়ার কথা ছিল ২০০৮-এ। স্বাগতিক দেশ হিসেবে পাকিস্তানের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল তখন। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে কয়েকটি দেশ পাকিস্তানে যেতে সম্মতি না জানানোয় টুর্নামেন্টটি ১ বছর পিছিয়ে যায়। আর আয়োজক দেশ হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ খেলতে পারেনি এই টুর্নামেন্টে । টপ আটটি দেশ দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয়।
গ্রুপ এ থেকে সেমিফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তান। গ্রুপ বি থেকে সেমিফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে নয় উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। অপরদিকে পাকিস্তানকে পাঁচ উইকেটে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে নিউজিল্যান্ড। দুটো দলের সামনেই তখন দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
কিন্তু ফাইনালে নিউজিল্যান্ড প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে তেমন সুবিধা করে উঠতে পারে নি। পুরো পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করে তারা ৯ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ২০০ রান তুলতে সক্ষম হয়। জবাবে শেন ওয়াটসনের অপরাজিত ১০৫ রানের সুবাদে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে সহজেই লক্ষ্যে পৌছে যায় অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দল হিসেবে দুবারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (২০১৩)
২০১৩ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজক দেশ হয় ইংল্যান্ড। ২০০৯ সালের মতো এবারও আটটি দেশ দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে অংশ নেয় এই টুর্নামেন্টে।
গ্রুপ এ থেকে সেমিফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা। গ্রুপ বি থেকে সেমিফাইনালে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারত। ভারত শ্রীলঙ্কাকে আট উইকেটে এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে ইংল্যান্ড ৭ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে।
এই ফাইনালেও বেরসিক বৃষ্টি বিঘ্ন ঘটায়। খেলা যখন শুরু হয় তখন ৫০ ওভার খেলা পরিণত হয়েছে ২০ ওভারের খেলায়। ২০ ওভার ব্যাট করে ভারত ৭ উইকেট হারিয়ে ১২৯ রান সংগ্রহ করে। বোঝাই যাচ্ছিল স্বল্প ওভারের ওই ম্যাচটিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। ঠিক তাই হলো। ২০ ওভারে ইংল্যান্ড করতে পারলো আট উইকেটে ১২৪ রান। মাত্র পাঁচ রানের ব্যবধানে জিতে ভারত অস্ট্রেলিয়ার পরে দ্বিতীয় দল হিসেবে দুবারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়। আর ম্যাচসেরা হন রবীন্দ্র জাদেজা।
২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যে অনেক চমক অপেক্ষা করছে তা বোঝাই যাচ্ছে। গ্রুপ এ তে বাংলাদেশের সাথে আছে স্বাগতিক ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। আর গ্রুপ বি তে আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। জুনের ১ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত চলবে এই লড়াই। সময়ই বলে দেবে কে হবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন।