বাংলাদেশের নিজস্ব ঘরোয়া ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমতির দিকে থাকলেও, ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাস্তায় বের হলে বিভিন্ন জনপ্রিয় ক্লাবের জার্সি গায়ে তরুণ-তরুণীদের দেখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। শ্রেনিকক্ষে, রেস্টুরেন্টে, এমনকি ফেইসবুকের বিভিন্ন ফুটবল গ্রুপে ক্লাব ফুটবল নিয়ে সারাক্ষণ তর্ক-বিতর্ক চলে বিভিন্ন ক্লাবের সমর্থকদের মাঝে। তাছাড়া ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, চেলসি, বায়ার্ন মিউনিখ, আর্সেনাল, ম্যানচেস্টার সিটি এসব ক্লাবের বাংলাদেশি সমর্থক গোষ্ঠী অফিসিয়াল স্বীকৃতিও পেয়েছে নিজেদের ক্লাব থেকে।
তবে ফুটবল নিয়ে এই উন্মাদনা একটু বেশিই আকার লাভ করে বিশ্বকাপের সময়। রাস্তার পাশের ছোট চায়ের টং থেকে শুরু করে মাঠে-ময়দানে সর্বত্র এই উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। চার বছর ধরে কোনো ফুটবল ম্যাচ না দেখা মানুষও এক মাসের জন্য ফুটবলপ্রেমী হয়ে ওঠেন। প্রত্যেক দালানের ছাদে উড়তে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের রং-বেরঙের পতাকা। এরকম উন্মাদনাকে চূড়ান্ত রূপ দিতেই দরজায় হাজির বিশ্বকাপ ফুটবলের আরেকটি আসর। আগামী ১৪ জুন থেকে রাশিয়া বনাম সৌদি আরবের মাঝের ম্যাচ দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ এর পসরা।
এবারের বিশ্বকাপ জিতবে কারা? প্রশ্নটির উত্তর বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন রকম। জার্মানি, ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন এদের নাম অনেকের মুখেই উচ্চারিত হবে। বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনার অবস্থা বেশ শোচনীয় হলেও লিওনেল মেসির দলও ফেলনার পাত্র নয়। ইউরো ২০১৬ জয়ী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকেও অনেকে ফেভারিট মনে করেন। ইংলিশ সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধছেন এই ভেবে, ১৯৬৬ সালের পর আরেকটি বিশ্বকাপ তাদের হাতে আসবে।
চিরচেনা এসব বড় মাপের দল বাদেও প্রতি বিশ্বকাপের আসরেই কিছু দল দেখা যায় যারা বেশ চমকের সৃষ্টি দেয়। কম পরিচিত ফুটবলার নিয়ে বিশ্বকাপের বাজিমাত করার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ১৯৯৮ সালের বিশকাপে ক্রোয়েশিয়া, ২০০২ সালের আসরে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও সেনেগাল, ২০১০ সালের আসরে উরুগুয়ে এমন আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছিল তাদের ফুটবল নৈপুণ্য দেখিয়ে। ২০১৪ সালের আসরে কোস্টারিকার কথাই বা বাদ যাবে কেন? ইংল্যান্ড, ইতালি, উরুগুয়ে এই ৩ সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সাথে এক গ্রুপে পড়া সত্ত্বেও তারা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, শেষপর্যন্ত বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে।
এবারের বিশ্বকাপেও কি এমন কোনো চমক আমরা দেখতে পারি? চলুন দেখে আসি এবারের বিশ্বকাপে ডার্ক হর্স কারা হতে পারে।
৫) মিশর
যেভাবে বাছাই : আফ্রিকান বাছাইপর্বের গ্রুপ ই চ্যাম্পিয়ন
ফিফা র্যাঙ্কিং : ৪৬
ম্যানেজার : হেক্টর কুপার
অধিনায়ক : এসসাম আল-হাদারি
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ৩ বার
ফর্মেশন : ৪-২-৩-১
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় : মোহামেদ সালাহ (লিভারপুল), আহমেদ হেগাজি (ওয়েস্টব্রম), মোহামেদ এল-নেনি (আর্সেনাল) ও মাহমুদ হাসান (কাসিমপাসা)।
১৯৯০ সালের পর এবারই প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে মিশর। গোলরক্ষক এসসাম আল হাদারি ৪৫ বছর বয়সে হতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রবীণ ফুটবলার। আর্জেন্টিনিয়ান ম্যানেজার হেক্টর কুপার অবশ্য অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক খেলার জন্য নিজ দেশের মিডিয়ার কাছে বেশ সমালোচিত।
গোলরক্ষক এসসাম আল হাদারির সামনে থাকবেন প্রিমিয়ার লিগে খেলা আহমেদ হেগাজি, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে থাকবেন আর্সেনাল দলের মোহামেদ এল-নেনি, আর সামনে পাস বাড়ানোর দায়িত্বে আছেন আব্দাল্লাহ এল-সাইদ। কাউন্টার অ্যাটাকিং স্টাইলে অভ্যস্ত মিশরের উইংয়ের একপ্রান্তে থাকবেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহামেদ সালাহ, যিনি ব্যালন ডি’অর জেতার প্রতিযোগিতায় লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ভালো টেক্কা দিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। উইংয়ের অন্য প্রান্তে থাকবেন “মিশরের ত্রেজগুয়েট” নামে খ্যাত মাহমুদ হাসান। মিশরের এই জমাটবদ্ধ ডিফেন্স তাদের গ্রুপ সঙ্গী উরুগুয়ে, সৌদি আরব আর রাশিয়া ভাংতে পারে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
৪) ইরান
যেভাবে বাছাই : এশিয়ান বাছাইপর্বের গ্রুপ এ চ্যাম্পিয়ন
ফিফা র্যাঙ্কিং : ৩৬
ম্যানেজার : কার্লোস কুইরোজ
অধিনায়ক : আশকান দেজাগাহ
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ৫ বার
ফর্মেশন : ৪-২-৩-১
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় : সার্দার আজমৌ (রুবিন কাজান), সামান ঘোদ্দোস (ওস্তোরেসান্দ), রেজা ঘোচান্নেজাদ (হিরেনভিন) ও আলিরেজা জাহানবাকশ (এজি আল্কেমার)।
কার্লোস কুইরোজের দল প্রথম এশিয়ান দল হিসেবে এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। মিশরের মতো কুইরোজের ফুটবলীয় কৌশলও একই, একেবারে নিচে নেমে ডিফেন্স করো, আর বল পেলে দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাক করো। ইরানের ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, বাছাইপর্বে শেষ রাউন্ডে টানা ৯ ম্যাচে কোনো গোল খায়নি ইরান, যা তাদের অসাধারণ রক্ষণভাগের পরিচয় দেয়। মিশরের ম্যানেজার হেক্টর কুপার যেদিকে অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক খেলার জন্য তার নিজ দেশের মিডিয়ার কাছে সমালোচিত, কার্লোস কুইরোজ অন্যদিকে ইরানীদের জাতীয় নায়ক।
মোহামেদ সালাহর মতো কোনো তারকা ফুটবলার ইরানের নেই, তবে রাশিয়ান দল রুবিন কাজানের স্ট্রাইকার সার্দার আজমৌর জাতীয় দলের হয়ে রেকর্ড বেশ ঈর্ষনীয়, মাত্র ৩০ ম্যাচে করেছেন ২২ গোল। ২৩ বছর বয়সেই তিনি হয়ে উঠেছেন ইরানীদের আশার প্রতীক।
৩) আইসল্যান্ড
যেভাবে বাছাই : ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বের গ্রুপ আই চ্যাম্পিয়ন
ফিফা র্যাঙ্কিং : ২২
ম্যানেজার : হেইমির হালগ্রিমসন
অধিনায়ক : অ্যারন গুনারসন
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ১ বার
ফর্মেশন : ৪-৪-২ / ৪-৫-১
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় : গিলফি সিগুর্ডসন (এভারটন), হোরদুর বিয়োর্গভিন ম্যাগনাসন (ব্রিস্টল সিটি), র্যাগনার সিগুর্ডসন (এফসি রোস্তভ) ও অ্যারন গুনারসন (কার্ডিফ সিটি)।
ফুটবল বিশ্বে আইসল্যান্ডের উত্থান বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জার ব্যাপার হতে পারে। মাত্র ৩ লক্ষ ৩২ হাজার জনসংখ্যার এই দেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছিল গত ইউরোতে। ইউরোপিয়ান দলগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গিয়েছিল তারা, হারিয়েছিল ২য় রাউন্ডে ইংল্যান্ডের মতো দলকে। এবার বিশ্বকাপেও চমক দেখানো অসম্ভব কিছু নয় তাদের পক্ষে, গ্রুপপর্বে আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া বা ক্রোয়েশিয়ার মতো দলকে হারানোর যোগ্যতা রাখে তারা।
তবে দুশ্চিন্তারও কিছু ব্যাপার আছে। তারকা স্ট্রাইকার কলবেইন সিগথ্রোসন দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে থাকার ফলে দলেই জায়গা পাননি। দলের সেরা খেলোয়াড় গিলফি সিগুর্ডসন বিশাল অঙ্কের বিনিময়ে এসেছিলেন এই মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল এভারটনে। কিন্তু প্রতিশ্রুতির বিন্দুমাত্রও পূরণ করতে পারেননি তিনি। নতুন ক্লাবের হয়ে এই মৌসুমে তার ফর্মের অবস্থা যাচ্ছেতাই। তবে নতুন ম্যানেজার হেইমির হালগ্রিমসন আগের ম্যানেজার লারস লাগেরবাক থেকে রণকৌশল সাজাতে আরও বেশি পটু। ৪-৪-২ অথবা ৪-৫-১, দুই ফর্মেশনেই তিনি দলকে খেলাতে পারেন। আইসল্যান্ড দলের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ভাতৃত্ববোধ, যা অপ্রতিরোধ্য।
২) পোল্যান্ড
যেভাবে বাছাই : ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বের গ্রুপ ই চ্যাম্পিয়ন
ফিফা র্যাঙ্কিং : ১০
ম্যানেজার : আদাম নাওালকা
অধিনায়ক : রবার্ট লেভান্দওস্কি
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ৮ বার
ফর্মেশন : ৪-২-৩-১
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় : রবার্ট লেভান্দওস্কি (বায়ার্ন মিউনিখ), পিওতর জিয়েলিন্সকি (নাপোলি), লুকাজ ফেবিআন্সকি (সোয়ানসি সিটি) ও কামিল গিল্ক (মোনাকো)।
পোল্যান্ড তাদের ইতিহাসের হয়তো সেরা দল নিয়ে হাজির হয়েছে রাশিয়ার বিশ্বকাপে। ইউরো ২০১৬ এ তারা কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুট-আউটে হেরে বিদায় হলেও পুরো বিশ্বের কাছে নিজেদের শক্তিশালী এক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রবার্ট লেভান্দওস্কি আছেন সেরা ফর্মে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে। জাতীয় দলের হয়েও তিনি কম যান না। এই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে করেছেন রেকর্ড সংখ্যক ১৬টি গোল।
তবে তাদের রক্ষণভাগ দুশ্চিন্তার বিষয়, কারণ বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচে পোল্যান্ড খেয়েছে ১৪ গোল। এর মধ্যে আছে ডেনমার্কের কাছে লজ্জাজনক ৪-০ গোলের পরাজয়। ম্যানেজার আদাম নাওয়ালকার হাতে বেশি সময় নেই এই রক্ষণভাগকে ঠিক করার। লুকাজ ফেবিআন্সকি-কামিল গিল্ক-পিওতর জিয়েলিন্সকি-ইয়াকুব ব্লেশজকোওস্কি-রবার্ট লেভান্দওস্কির মতো এত ভালো খেলোয়াড় বিশ্বকাপে খুব কম দলের কাছেই আছে। বাম প্রান্তে উইংয়ে আছেন হালসিটির কামিল গ্রোসিকি, যিনি তার গতি দিয়ে প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগকে বিপদে ফেলতে পারেন।
১) বেলজিয়াম
যেভাবে বাছাই : ইউরোপিয়ান বাছাইপর্বের গ্রুপ এইচ চ্যাম্পিয়ন
ফিফা র্যাংকিং : ৩
ম্যানেজার : রবার্টো মার্টিনেজ
অধিনায়ক : এডেন হ্যাজারড
বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণ : ১৩ বার
ফর্মেশন : ৩-৪-২-১
গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় : এডেন হ্যাজার্ড (চেলসি), কেভিন ডি ব্রুনা (ম্যানচেস্টার সিটি), থিবো করতোওয়া (চেলসি), ইয়ান ভার্টোনগেন (টটেনহাম স্পারস), টোবি আলডারভেরালড (টটেনহাম স্পারস), ভিন্সেন্ট কম্পানি (ম্যানচেস্টার সিটি) ও রোমেলো লুকাকু (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)।
বেলজিয়াম দলে তারকা সংখ্যা গুনতে গেলে শেষ হবে না। যে ফুটবলাররা অন্য অনেক দলের সেরা খেলোয়াড়র হবার যোগ্যতা রাখেন, তারা বেলজিয়াম দলের প্রধান একাদশেই সুযোগই পাবেন না। বেলজিয়ামের দাপট খুব ভালোমত বোঝা গিয়েছে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে- ১০ ম্যাচে ২৮ পয়েন্ট, ৪৩ গোল!
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু হয়েছেন বেলজিয়ামের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বেশি গোলদাতা। এডেন হ্যাজার্ডকে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার বললেও ভুল হবে না। আর এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতার পেছনে কেভিন ডি ব্রুনার রয়েছে সুবিশাল কৃতিত্ব। অনেকেই মনে করেন, মোহামেদ সালাহর পরিবর্তে কেভিন ডি ব্রুনার উচিত ছিল এই ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া।
তবে স্প্যানিশ ম্যানেজার রবার্টো মার্টিনেজ পুরোপুরিভাবে দলের সাথে গুছিয়ে উঠতে পারেননি। বেলজিয়ামের রক্ষণভাগে ঐক্যবদ্ধতার যথেষ্ঠ অভাবে রয়েছে; যদিও তার দলে রয়েছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা ৩ সেন্টারব্যাক টোবি আলডারভেরালড, ভিন্সেন্ট কম্পানি, ইয়ান ভার্টোনগেন, একইসাথে উদীয়মান ফুলব্যাক পিএসজির থমাস মিউনিয়ার।