“বল যদি গায়ের মধ্যেই না মারতে পারলাম, তাহলে আর কীসের ফাস্ট বোলার!”
কৌতুক করে এই কথা বলেছিলেন আবাহনী লিমিটেডের সাবেক ক্রিকেটার, ম্যানেজার ও বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস। এই কৌতুক ঢাকার লিগের স্মৃতিকে ঘিরে। নব্বই দশকে লিগের যে ঝাঁজ ছিলো, তা এখন কেবল চুলে পাক ধরাদের মনেই গেঁথে আছে। হাল আমলে বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে বাড়ির ছাদে দেখা মেলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানির বিশাল বিশাল পতাকা। কিন্তু পুরনো দিনে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের মৌসুমে ছাদে উড়তো আবাহনী, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, বিমান, ভিক্টোরিয়ার পতাকা। ঢাকার ক্রিকেটের এসব স্মৃতি সেসময়ের মানুষদের আজীবন শিহরিত করবে। একই সঙ্গে দুঃস্মৃতিও বিলাবে। এই ঢাকা লিগে খেলতে গিয়েই মারা গিয়েছিলেন ‘ঢাকার জনপ্রিয়’ ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বা। আজ যখন দুনিয়া জুড়ে ক্রিকেটের মাঠে মৃত্যুবরণ করা ক্রিকেটারদের নিয়ে গল্প খুঁজতে হয়, তখন সবার আগে নাম আসে রমন লাম্বার। আরও একটি নাম ঠোঁটের সামনে আসে, তিনি অস্ট্রেলিয়ান ফিল হিউজ।
ক্রিকেট ইতিহাসের ঝলমলে দুনিয়ার উল্টোপিঠে লুকিয়ে থাকা এমন কিছু মৃত্যুর গল্প নিয়েই এই আয়োজন।
রমন লাম্বা (ভারত)
রমন লাম্বাকে দিয়েই লেখাটি এগিয়ে নেয়া যাক। ভারতীয় ক্রিকেটার হলেও তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন ঢাকার মানুষের কাছে। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে আবাহনী লিমিটের হয়ে খেলতে প্রথম ঢাকায় পা রাখলেন। অভিষেক টুর্নামেন্টেই জিতে নিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার! এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে খেলেন জিএমসিসি ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়নে। সব জায়গায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত ছিলেন এই ব্যাটসম্যান। ঢাকায় ক্যারিয়ারের শুরুটা যেমন আবাহনীকে দিয়ে করেছিলেন, শেষটাও হলো সেই ক্লাবেই।
১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, স্থান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে শর্টে ফিল্ডিং করছিলেন রমন লাম্বা। ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন অপি। উইকেটরক্ষক ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। তিনি লাম্বাকে হেলমেট নিতে বলেছিলেন। কথা শোনেননি লাম্বা। ওভারের শেষ বল মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আরে ভাই, একটি বলই তো!”
সেই একটি বলই কাল হলো তার। অপির করা পুল শটে বল গিয়ে সরাসরি লাগলো লাম্বার মাথায়। সেই বল মাটিতে পড়ার আগেই গ্লাভসবন্দী করলেন পাইলট। আউট হলেন অপি, অন্যদিকে ভূপাতিত হলেন রমন লাম্বা। সাথে সাথে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো তাকে। কিন্তু আর ফেরা হয়নি তার। ঘটনার তিনদিনের মাথায় ২৩ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। সমর্থকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটারদের মুখে এখনও ঘুরে ফেরে রমন লাম্বার নাম। হয়তো ক্রিকেট মাঠে এখনও তারা খুঁজে ফেরে কৌতুক, হাসিমাখা আর মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুলের রমন লাম্বাকে।
ফিল হিউজ (অস্ট্রেলিয়া)
ফিল হিউজের মৃত্যু পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। অস্ট্রেলিয়ান এই ব্যাটসম্যানের অকাল প্রয়াণের পর ক্রিকেটে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও কড়া হয়েছে। উন্নতমানের হেলমেট, গার্ড এমনকি আম্পায়ারদের জন্যও সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণীর ঘরোয়া টুর্মামেন্ট শেফিল্ড শিল্ডে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট করছিলেন হিউজ। প্রতিপক্ষ সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ১৬১ বলে ৬৩ রানে অপরাজিত ছিলেন। এমন সময় ফাস্ট বোলার শন অ্যাবোটের একটি বাউন্সার সরাসরি গিয়ে হিউজের বাম কাঁধের উপরে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে গড়িয়ে পড়েন হিউজ। হেলমেটের নিচে কানের পিছনের দিকে বল লাগে। রক্ত সঞ্চালনকারী শিরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তখনই নিশ্চিত মৃত্যুর পথে হেঁটেছিলেন ফিল হিউজ। ঘটনার প্রায় ২০ মিনিট দেরিতে অ্যাম্বুলেন্স মাঠে আসে, সেক্ষেত্রে হাসপাতালেও নিতে দেরি হয়। দু’দিন পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় হিউজকে।
তার মৃত্যুতে পুরো অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি যে অ্যাবোটের বলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিলো হিউজের, তিনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ক্রিকেট ছেড়ে দেবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। পরে সতীর্থদের সহায়তায় ফিরে আসেন।
ড্যারিন র্যান্ডাল (দক্ষিণ আফ্রিকা)
হিউজের মতো র্যান্ডালও ব্যাট করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে এই ঘটনা ঘটে। সাবেক এই প্রোটিয়া উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান প্রতিপক্ষের বল পুল করতে গিয়ে মাথার একপাশে আঘাত পান। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো তাকে। কিন্তু জ্ঞান আর ফেরেনি। সেভাবেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন র্যান্ডাল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা গিয়েছিলো, আঘাতের পর মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। সে কারণেই মৃত্যু হয় তার। ৩২ বছর বয়সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আগ পর্যন্ত ৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ ও ৪টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি।
জুলফিকার ভাট্টি (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের ২২ বছর বয়সী জুলফিকার ভাট্টির মৃত্যু হয়েছিলো ড্যারিন র্যান্ডালের মতোই পুল করতে গিয়ে। তবে মাথায় নয়, জুলফিকার বুকে আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে একটি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটেছিলো। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যু হয় তার। সিন্ধুর ক্রিকেটপ্রেমী সাধারণ মানুষের বিশাল একটি অংশ তার জানাজায় অংশ নিয়েছিলো।
রিচার্ড বিউমন্ট (ইংল্যান্ড)
ব্যাটিং কিংবা বোলিং নয়, ফিল্ডিং করার সময় মৃত্যুবরণ করেন রিচার্ড বিউমন্ট। ২০১২ সালে ওয়েস্টশায়ার লিগে পেডমোর ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলছিলেন তিনি। যে ম্যাচে মৃত্যুবরণ করেন, সেই ম্যাচে বল হাতে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। এরপর উইকেটের কাছে ফিল্ডিং করতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এই ইংলিশ ফাস্ট বোলার। বিমানযোগে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই মৃত্যু হয় বিউমন্টের। মূলত বোলিং করার পর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো তার। যে ম্যাচ খেলতে গিয়ে ঘটনা ঘটেছিলো সেটি পরে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
ইয়ান ফলি (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন ইয়ান ফলি। বাধ সাধলো বাম হাতের ইনজুরি। খেলা থেকেই অবসর নিয়েছিলেন। সেই অবসর ভেঙে ফিরেছিলেন ১৯৯১ সালে। দুই বছরের মধ্যে এই ক্রিকেটই তার জীবননাশের কারণ হলো। ঘরোয়া লিগে ওয়ার্কিংটনের বিপক্ষে ডার্বিশায়ারের হয়ে ব্যাট করছিলেন ফলি। এমন সময় প্রতিপক্ষের বল এসে লাগে তার চোখে। খুব ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছিলেন এই বাঁহাতি স্পিনার। হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। অজ্ঞান অবস্থাতেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তার।
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে মোট ১৪০টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন ফলি; রান করেছেন ১৪৮৫, উইকেট নিয়েছেন ২৮৭টি। ৪৩ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলে ৮৮ রান করেছেন, উইকেট নিয়েছেন ৩৫টি।
জর্জ সামার্স (ইংল্যান্ড)
সেবার লর্ডসে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছিলো, উইকেটের অবস্থা ভালো নয়। পেসাররা যেন খুব জোরে না বল করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। জন প্লাটস ইচ্ছে করেই শর্ট বল দিলেন নটিংহামশায়ারের সামার্সকে। সেটা গিয়ে লাগলো মাথায়। শুরুতে খুব বেশি কিছু মনে হয়নি। ঠিকই হয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার কথা উঠলেও নিজেই রাজি হননি। নটিংহাম থেকে বাড়ি ফিরলেন ট্রেনে চেপে।
কিন্তু অঘটন যা হওয়ার হয়েই গেছে। আঘাত পাওয়ার চার দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সামার্স। চিকিৎসকদের মতে, সেদিন যদি না মাঠ থেকে হাসপাতালে নেওয়া হতো তাহলে হয়তো বাঁচানো যেতো সামার্সকে। কিন্তু নিজের অবহেলাই তার মৃত্যুর কারণ হলো।
ফিচার ইমেজ: Chicago Tribune