ভারতে এখন পেস বোলারের অভাব নেই। খুব দ্রুত গতির বোলার আছেন তাদের দলে। আছে বল সুইং করিয়ে কন্ডিশনের ফায়দা নেওয়ার মতো পেস বোলারও। এর মধ্যে হঠাৎ করে ভারতীয় জাতীয় দলে চলে এলো এক তরুণ ফাস্ট বোলার। এশিয়া কাপের দলে চোখে পড়লো সবার এক নতুন নাম- খলিল আহমেদ।
বাইরের বিশ্বে তো বটেই, খোদ ভারতেও লোকেদের চোখ বিষ্ময়ে বড় হয়ে গেছে। সবারই যেন জিজ্ঞাসা, কে এই খলিল আহমেদ?
অনেক প্রশ্ন এখন- কত জোরে বল করতে পারে খলিল? সে কি বল সুইং করাতে পারে? পুরনো বলে বল করতে পারে? তার অ্যাকশনটা দেখতে কেমন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুজছে ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকরা।
খলিলের উঠে আসা নিয়ে একটু বলা দরকার। মাত্র একটা ঘরোয়া মৌসুম ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। কদিন আগেও রাজস্থানের টংক শহরে টেনিস বলের ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন তিনি। এখন অবধি মাত্র দুটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলতে পেরেছেন। কিন্তু এতেই নিজেকে যা দেখিয়ে ফেলেছেন, তাতে ভারতীয় নির্বাচকরা মনে করেছেন, এই তরুণ ফাস্ট বোলারকে আর আটকে রাখা যাবে না।
খলিল প্রথম নজরে পড়েন সানরাইজার্স হায়দারাবাদের স্কোয়াডে। সেখানে খেলার সুযোগ তেমন না হলেও নেটে তাকে দেখে ভারতের অনেক কর্তাব্যক্তিই মুগ্ধ হয়েছেন। তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ‘এ’ দলের স্কোয়াডে। ‘এ’ দলের সাথে ইংল্যান্ড সফর করে এসেছেন। এরপর ভারতে অনুষ্ঠিত ‘এ’ দলের চার দলীয় টুর্নামেন্টে খেলেছেন। গত ৯ ম্যাচে ‘এ’ দলের হয়ে কোনো খেলাতেই উইকেটশূন্য ছিলেন না। এই সময়ে তুলে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আসলেই থাকতে এসেছেন।
খলিলের মূল সম্পদ হলো যেকোনো উইকেটে, এমনকি উপমহাদেশের মরা উইকেটেও দূরন্ত গতি এবং বাউন্সের খেলা দেখাতে পারেন। আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া কাপে খলিলের এই ক্ষমতাটা খুব কাজের জিনিস হবে বলে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট মনে করছে।
বানারস নদীর তীরে টংক শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা খলিলের। রাজস্থানের এই শহরেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। আর দশটা মফস্বলের ছেলের মতো টেনিস বলের ক্রিকেট দিয়েই চলছিল খলিলের জীবন। এ ধরনের ক্রিকেটে মাটির উইকেটে ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে বোলারদের আত্মরক্ষা করা খুব কঠিন। এখানে খেলাটাই যেন হয় চার আর ছক্কার জন্য। ফলে বোলারকে টিকে থাকতে হলে বাড়তি কিছু একটা করতে হয়। খলিলের জন্য সেই বাড়তি ব্যাপারটা ছিল গতি।
গতি দিয়েই তিনি এতদিন ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করতে চেয়েছেন। তবে সময়ের সাথে সাথে সেই টেপ টেনিসের গতিপ্রেমী খলিল একটু ধীরে ধীরে বদলেছেন নিজেকে। গতি ও বাউন্সের সাথে মেশাতে পেরেছেন একটু সুইং এবং হয়ে উঠছেন একজন পূর্ণ ফাস্ট বোলার।
খলিল অবশ্য বাংলাদেশে খুব অপরিচিত নাম নন। এই দেশে ২০১৬ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে গেছেন। সে সময় মূলত তার অস্ত্র ছিল বলের গতি। গত দুই মৌসুম ধরে খলিল তার বলকে আরো উন্নত করে যাচ্ছেন। নিজেকে পূর্ণ ফাস্ট বোলার হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা খলিল শুরু করেছেন আরেক অভিজ্ঞ বোলার জহির খানের মারফত।
২০১৬ ও ২০১৭ মৌসুমে খলিল ছিলেন দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের স্কোয়াডে। একটা ম্যাচও খেলার সুযোগ পাননি তখন। কিন্তু সে দলের নেটেই পেয়ে গেলেন অমূল্য এক পরামর্শক জহির খানকে। তখন জহির ছিলেন দলটির অধিনায়ক। জহির খলিলকে বলতেন, কল্পনায় নিজের জন্য ফিল্ডিং সাজাও। কীভাবে বোলিং করলে আউট করতে পারবে ব্যাটসম্যানকে, সেটা কল্পনা করো। জহিরের অবদান বলতে গিয়ে খলিল বলছিলেন,
সে সময়টায় জহির খানের অধীনে থাকাটাই একজন ক্রিকেটার হিসেবে আমাকে অনেক উন্নত করে তুলেছে। আমি এর আগে শুধু জোরে বল করতেই অভ্যস্থ ছিলাম, কৌশলগত দিকগুলো নিয়ে তেমন ভাবতাম না। কিন্তু জহির আমার নন-বোলিং হাত ও কবজির অবস্থান নিয়ে কাজ করলেন। তখন আমার সিম পজিশন উল্টাপাল্টা হয়ে যেত। কারণ আমার কবজিতে কিছু সমস্যা ছিল এবং আমার বুড়ো আঙুলটা তার অবস্থান থেকে সরে গিয়েছিল। আমি এখন তার পরামর্শে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ভেতরের দিকেও বল ঢোকাতে পারি।
২০১৭-১৮ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফিতে খলিল সেভাবে মুগ্ধ করতে পারলেন না। ৯০.০০ গড়ে মাত্র ২টি উইকেট নিতে সক্ষম হলেন। কিন্তু সে তুলনায় ঝলসে উঠলেন সৈয়দ মুশতাক আলী টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। ১৫.৫২ গড়ে ১৭ উইকেট তুলে নিলেন। মাত্র ৬.৭৬ করে রান খরচ করলেন টুর্নামেন্টে। টি-টোয়েন্টির প্রেক্ষাপটে এটি যথেষ্ট ভালো। রাজস্থান সেই টুর্নামেন্টে রানার্স-আপ হয়েছিল। ফাইনালে খলিল তুলে নিয়েছিলেন রিশভ পান্ট ও হাফ সেঞ্চুরিয়ান উন্মুক্ত চাঁদের উইকেট।
২০১৮ আইপিএল নিলামে সানরাইজার্স হায়দারাবাদ খলিলকে নিয়ে রীতিমতো টানাটানি করলো কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ও দিল্লীর সাথে। শেষ অবধি ৩ কোটি রূপিতে খলিলকে কিনে তারা। সানরাইজার্সের দলে বেশ কিছু দারুণ পেসার ছিল- ভুবনেশ্বর কুমার, সন্দীপ শর্মা, সিদ্ধার্থ কাউল, বাসিল থাম্পি। তারপরও তারা খলিলকে নিয়েছে মূলত বেঞ্চ শক্তিশালী করার জন্য। শেষ অবধি এই দলের হয়ে একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।
খলিল যখন আইপিএলের জন্য হায়দারাবাদের সাথে চুক্তি করেন, তখন অবধি তিনি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলতে পারেননি। কিন্তু আইপিএল শেষেই তার লিস্ট-এ অভিষেক হয়। আর এখানে খুব দ্রুত নিজেকে চিনিয়ে নেন। বিজয় হাজারে ট্রফিতে ৬টি ৫০ ওভারের ম্যাচে ২৩.৪০ গড়ে ১০ উইকেট তুলেন। সেই টুর্নামেন্টে তার ইকোনমি রেট ছিল ৪.৭৭ করে। আর ওখানকার পারফরম্যান্সের ফলেই মৌসুম শেষে দেওধার ট্রফিতে সুযোগ পেয়ে যান তিনি।
দেওধর ট্রফির ফাইনালে ধ্বংসাত্মক এক স্পেল বোলিং করেন। কর্নাটকের টপ অর্ডার একাই গুড়িয়ে দেন বলা যায়। প্রথম ৫ ব্যাটসম্যানের মধ্যে ৩ জনের উইকেটই তুলে নেন তিনি। ৫০ ওভারের এই ঘরোয়া টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। খলিল বলছিলেন, এই টুর্নামেন্টগুলো তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে,
এসব ম্যাচে পারফর্ম করাটা আমাকে খুব আত্মবিশ্বাসী করেছে। এর আগে অনুর্ধ্ব-১৯ খেলার সময় রাহুল দ্রাবিড় স্যার আমাদের বলতেন, কীভাবে আমাদের আরো সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং কীভাবে আমাদের পরবর্তী ধাপে মানিয়ে নিতে হবে। ফলে এই সময় আমার বদলটা খুব মসৃণ হয়েছে। কারণ আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম।
আইপিএলে সেভাবে খেলার সুযোগ না পাওয়াটা একটা হতাশা মনে হতে পারে। তবে সেই সময়টাকেও কাজে লাগিয়েছেন তিনি। হায়দারাবাদ দলে বসে থাকা এই সময়টায় যতটা সম্ভব তিনি সময় কাটিয়েছেন ভুবনেশ্বর কুমারের সাথে। প্রায়শ তার সাথে সকালের নাস্তা করতেন এবং সিনেমা দেখতে যেতেন। খলিল বলছেন, তার মূল উদ্দেশ্যটা ছিল শেখা,
সানরাইজার্সে ভুবনেশ্বর কুমারের কাছ থেকে আমি ডেথ বোলিং নিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। উনি কীভাবে নেটে প্র্যাকটিস করেন, কীভাবে ইয়র্কার প্র্যাকটিস করেন এবং কীভাবে লক্ষ্য ঠিক করে প্র্যাকটিস করেন; এগুলো দেখেছি। উনি খুব সরল একজন মানুষ। সবসময় পরামর্শ দিতে প্রস্তু থাকেন।
সেই শিখতে থাকা খলিল এখন দ্রুত উঠে এসেছেন। এবার আর আইপিএল দল বা দেওধর ট্রফি নয়, খোদ ভারতীয় দলের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পালা, নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই নিজের পরিচয়টা ঘোষণা করার পালা।
ফিচার ছবি- Delhi Daredevils