একটা কথা আছে, ক্লাসের প্রথম বেঞ্চের ছাত্ররা নাকি কখনো ভালো শিক্ষক হতে পারে না। কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা, নাকি নেহায়েত মনগড়া কথা, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিভিন্নজন হয়তো বিভিন্নভাবে এটা ব্যাখ্যা করবে, তাই সেদিকে না যাওয়াই ভালো। তবে এতটুকু হলফ করতে বলে ফেলা যায়, সফল ক্রিকেটার না হয়েও সফল কোচ হওয়া যায়। সাদামাটা ক্রিকেট ক্যারিয়ার, অথচ সেই একই ব্যক্তি কোচিং ক্যারিয়ারে তার ক্রিকেটার সত্ত্বাকে ছাপিয়ে গেছেন। ক্রিকেটে এমনটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বৈকি। তাই এই ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপারটাই তথ্য, উপাত্ত,এবং যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবো আজকের এই লেখায়। চলুন তাহলে, ঘটনার অন্দরমহলে ঢোকা যাক।
ট্রেভর বেলিস
পুরো নাম ট্রেভর হার্লি ভেলিস। জন্ম অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে। প্রত্যেক ক্রিকেটারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। কিন্তু স্বপ্ন তো সবসময় বাস্তবে রূপ নেয় না। ট্রেভর বেলিসের স্বপ্নও বাস্তবে রূপ নেয়নি। ক্রিকেট ক্যারিয়ার তাই প্রথম শ্রেণীর গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। ১৯৮৫- ৯৭ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে খেলেছেন। স্বপ্নের হলুদ জার্সিটার গন্ধও কখনো নেওয়া হয়নি বেলিসের।
ক্রিকেটকে গুডবাই জানানোর পর আবারও ক্রিকেটেই ফিরে আসেন বেলিস, তবে এবার চরিত্র বদলে। আগে অন দ্য ফিল্ড সামলেছেন, এবার অফ দ্য ফিল্ড সামলানোর পালা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচ হিসেবে নাম লেখালেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমে নিজের খেলা দল নিউ সাউথ ওয়েলসের কোচ হিসেবে মনোনীত হন। কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই সফল, নিউ সাউথ ওয়েলসকে শিরোপা এনে দেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
এরপর ২০০৭-১১ সাল পর্যন্ত সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনে-মুরালিধরনদের তালিম দেন। তারই অধীনে ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল এবং ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু দুবারের একবারও দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি। তবে আইপিএলে তার অধীনেই ২০১২ এবং ২০১৪ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয় শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্স। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল টানা তিন বছর কেকেআরের ড্রেসিংরুম সামলেছেন। একইসাথে অস্ট্রেলিয়ান ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ বিগ ব্যাশেও দায়িত্ব সামলিয়েছেন। তার অধীনেই বিগ ব্যাশে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছিল সিডনি সিক্সার্স। ২০১১-১৫ মাঝের এই সময়টাও ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলোর সাথেই কাজ করেছেন।
২০১৫ সালে তাসমান পাড়ে বসেছিল বিশ্বকাপ আসর। সেবার গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল ক্রিকেটখেলুড়ে দেশগুলোর কুলীনতম সদস্য ইংল্যান্ড। ছন্নছাড়া এক দলকে তিলে তিলে গড়ে তোলেন তিনি।
২০১৯ বিশ্বকাপের আয়োজক দল এবার ইংল্যান্ড। ক্রিকেটের জন্ম যে দেশে, সেখানেই বসে ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার আসর। উল্লেখ্য, প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপের তিনটিতেই সেমিফাইনাল এবং দু’টিতে ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। সর্বশেষ ২৭ বছর আগে ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছিল গ্রাহাম গুচের দল। ফাইনালে ইমরান খানের পাকিস্তানের কাছে হেরেছিল ইংলিশরা।
ঘরের মাঠে ২০১৯ বিশ্বকাপে ফেভারিটের তকমা নিয়েই টুর্নামেন্ট শুরু করে ট্রেভর বেলিসের শিষ্যরা। প্রথম ম্যাচেই প্রোটিয়াদের উড়িয়ে দেয় ট্রেভরের ছাত্ররা। বড় দিয়ে শুরু, এরপর গ্রুপপর্বে পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারলেও ফাইনালে ওঠার পথে সেটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
১৪ জুলাই ‘ক্রিকেটের মক্কা’-খ্যাত লর্ডসে শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ম্যাচ দেখেছিল ক্রিকেট দুনিয়া। সেই ম্যাচের জয়ী দলের নাম ইংল্যান্ড। নেপথ্যের নায়ক একজন ট্রেভর বেলিস, যিনি কখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি, তারই অধীনে একটা দল কি না বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! ভাঙাচোরা একটা দলের নিয়েছিলেন, দায়িত্ব ছাড়ার সময় সে দলকে বিশ্বসেরার তকমা দিয়েছেন। ট্রেভর বেলিস তাই ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন ইংলিশদের ক্রিকেট সেলুলয়েডে।
ডেভ হোয়াটমোর
নামটির সাথে পাঠককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। এই ভদ্রলোকও তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেননি। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৮০ সাল মাঝের এই এক বছরেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে দাঁড়ি পড়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সাত টেস্ট এবং একটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ডেভ। এরপর ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন তিনি।
এবার কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারের সাবেক এই অজি ক্রিকেটার। দুই মেয়াদে শ্রীলঙ্কা দলকে সার্ভিস দেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আন্ডারডগ দল ছিল শ্রীলঙ্কা। তারাই কি না হয়ে বসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! ডেভ হোয়াটমোরের গেমপ্ল্যানের বদৌলতেই বড় বড় ক্রিকেট পরাশক্তিও সেই বিশ্বকাপে নাস্তানাবুদ হয়েছে আনকোরা লঙ্কানদের সামনে। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রথম শ্রেণীর দল ল্যাঙ্কাশায়ারকেও জাতীয় লিগে শিরোপা জেতান।
যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে দেশের ক্রিকেটের আশীর্বাদ হয়ে আসেন ডেভ হোয়াটমোর। মহসীন কামাল-ট্রেভর চ্যাপেলদের প্রহসন শেষে বাংলাদেশ তখন দিকভ্রান্ত, আত্মবিশ্বাস তলানিতে থাকা একটি দল।
সেই পরিস্থিতি থেকে তিনিই আমাদের জিততে শিখিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট ভিত্তির প্রতিটি গাঁথুনিতে লেখা আছে ডেভ হোয়াটমোরের নাম। তার অধীনেই ২০০৫ সালে সাদা পোশাকে প্রথম জয় পেয়েছিল টিম বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের ক্যারিবীয় বিশ্বকাপের তার হাত ধরেই সামর্থ্যের প্রমাণ দেয় টাইগাররা। শক্তিশালী ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেবার বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠেছিল হাবিবুল বাশারের দল। বিশ্বকাপের চুক্তি মেয়াদ শেষ হলে দায়িত্ব ছাড়েন আফতাব-আশরাফুল-মাশরাফি-বাশারদের প্রিয় শিক্ষক। এর মাঝে দু’হাত ভরে দিয়ে গেছেন। অথচ একটা আনুষ্ঠানিক বিদায় পর্যন্ত পাননি বিসিবির পক্ষ থেকে।
২০১২ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় দলের সাথে কাজ করেছেন। ২০১২ সালে এশিয়া কাপ জেতান। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোচ হিসেবে জিম্বাবুয়ে দলের দায়িত্ব পালন করেন। ইন্টারন্যাশনাল কোচিং ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ২০০৯-১১ পর্যন্ত কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ ছিলেন ডেভ হোয়াইটমোর।
জন বুকানন
পুরো নাম জন মার্শাল বুকানন, ‘দ্য সিম্পসনস’ নামের একটি টিভি সিরিজের একটি চরিত্রের সাথে চেহারাগতভাবে অদ্ভুতরকম মিলের বদৌলতে যার ডাকনাম ‘নেড ফ্ল্যান্ডার্স’ হয়ে গিয়েছে।
জন্ম অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে। প্রথম শ্রেণীর সাত ম্যাচ আর লিস্ট-এ ক্রিকেটে একটি মাত্র ম্যাচ খেলার মধ্য দিয়েই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেষ দেখেছেন। জাতীয় দলে কখনো না খেলা এই মানুষটাকে মনে রাখার কোনো কারণই আপনার ছিল না।
কিন্তু তিনি সেটা চাইলেন না। আর চাইলেন না বলেই কি না তিনি ‘মাইটি অস্ট্রেলিয়া’র বিশ্বকাপ জয়ে হয়ে উঠেছিলেন নেপথ্যের নায়ক। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা কোচদের একজন হিসেবেও বিবেচনা করা হয় বুকাননকে। ইতিহাসের দ্বিতীয় কোচ হিসেবে দুবার কোনো দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। উল্লেখ্য, ক্লাইড ওয়ালকট ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে প্রথম দুবার বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন।
রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়াহ, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ এবং কিংবদন্তি ক্রিকেটারদেরকে দীক্ষা দেওয়া একজন কোচ একটিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি, ভাবা যায়! সেই মানুষটিই আবার ১৯৯৯ এবং ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। একবার নয়, দুই-দুইবার!
চ্যাম্পিয়ন দলের চ্যাম্পিয়ন কোচ এই জন বুকানন। টিম অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুম সামলেছেন লম্বা সময় ধরে। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও জেতান বুকানন। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের পর ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগে নিজেকে জড়ান। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ২০১০-১১ সালে অ্যাশেজ চলাকালে এই অভিজ্ঞ মাস্টার ট্যাকটিশিয়ানকে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় ইংল্যান্ড। কাজ করেছেন নিউ জিল্যান্ড দলের সাথেও। ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের পরিচালক হিসেবে ছিলেন।
উপরে উল্লেখিত তিনজন কোচই বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ ছিলেন। এর মধ্যে জন বুকানন এবং ট্রেভর বেলিস কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি। বাকি রইলেন ডেভ হোয়াটমোর, তিনি খেলেছেন সব মিলিয়ে মাত্র নয় ম্যাচ।
অর্থাৎ, ক্রিকেটার হিসেবে তিনজনের কেউই সফল নন, এটা পরিসংখ্যান দেখেই বলে দেওয়া যায়। তবে তাদের ক্রিকেটীয় মেধা আর অভিজ্ঞতাটুকু তারা কাজে লাগিয়েছেন তাদের কোচিং ক্যারিয়ারে। সেখানে তারা শুধু সফলই নন, বরং রীতিমতো কিংবদন্তি। ‘ক্রিকেটার’ পরিচয় ছাপিয়ে ক্রিকেটবিশ্ব তাদের চিনেছে নামজাদা কোচ হিসেবে। ওহ, মজার ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন তো? তারা তিনজনই কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান! কাকতালমাত্র?