Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ধোনি-রায়না জুটির ‘কেমিস্ট্রি’

পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চির দেহটায় সাদা চোখে নিতান্তই এক সাধারণ মানুষের আবহে ঢাকা। এই সাধারণে আবদ্ধ মানুষটাকে প্রথম দেখায় মনে হবে সাক্ষাৎ এক দার্শনিক। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে চলনেবলনে তাকে দার্শনিক বলে ঠাহর হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সবাই যেখানে দৃশ্যপটের শেষাংশ দেখেন, মহেন্দ্র সিং ধোনির চিন্তার প্রসারণ ঠিক সেখান থেকেই যেন ডানা মেলে।

বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করার নিমিত্তে চলুন ১৯২৯ সংখ্যাটার সাহায্য নেওয়া যাক। সংখ্যাটা দেখে সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের কোনো অধ্যায়ে পড়া কোনো ইতিহাসের কথা মনে পড়ছে কি? ওয়াল স্ট্রিট ক্রাশ? কিংবা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ধ্বসের কথা? মনে পড়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এই লেখাটা পড়ার পর যদি সংখ্যাটার সাথে ৯১ বছর পেরিয়ে ১৫ই আগস্ট, ২০২০ দিনটা মিলিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়, আসলে দোষ দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। আরেকটু গুলিয়ে গেল বুঝি? আর অপেক্ষায় রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। চলুন, শুরু করা যাক।

১৫ই আগস্ট, ঘড়ির কাঁটায় ১৯:২৯। মার্টিন গাপটিলের বুলেট গতির এক থ্রোতে আক্ষরিক অর্থেই ভারতের ২০১৯ বিশ্বকাপ শিরোপা স্বপ্নের শেষ পালকটা যে মুহূর্তে ছিটকে পড়ে, তখনও ঘড়ির কাঁটায় ১৯:২৯। পার্থক্য, ধোনি তখনও ভারতীয় দলের একজন। ১৫ই আগস্ট ২০২০ থেকে নামটার সঙ্গে জুড়ে যায় ‘সাবেক’ শব্দটা। অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্নের স্থলে দাড়ি টেনে দিয়ে ভক্তদের হৃদয়ে ঝড় তোলে অবসরের ঘোষণা দেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।

ক্রিকেটকে ধর্ম হিসেবে মেনে আসা ভারতকে তিনটি বৈশ্বিক শিরোপা উপহার দেওয়া এক অধিনায়কের অবসরের ঘোষণা, তাও সামান্য এক ইনস্টাগ্রাম বার্তায়। সেখানেও স্ট্যাটাসের প্রতিটি শব্দে, গানের প্রতিটি লাইনে মাঠ এবং মাঠের বাইরের সদা বিচক্ষণ দার্শনিক মানুষটাকে দেখতে পাবেন আপনি।

ধোনির পদচিহ্ন অনুসরণ করে শেষের গল্প লিখবেন বলে অবসরের ঘোষণা দিতে সময় নেন না ক্যারিয়ারজুড়ে ধোনির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক সুরেশ রায়নাও। মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের অন্যতম রূপকার। 

প্রথমজনের জার্সি নাম্বার সাত, পরেরজনের তিন। দুইয়ে মিলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৭৩। ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার ৭৩ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটাকে মনে-আনমনে এভাবেই বিদায়ের দিন হিসেবে বেছে নেন দুই বন্ধু। 

Image Credit: Phil Walter/Getty Images

বন্ধুত্বের কথা বলছিলাম। চরিত্রের দিক থেকে চনমনে-চঞ্চল রায়নার তখনও আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়নি। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের শান্ত-সভ্য ধোনি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম বছর পার করছেন। তখন থেকেই রুম শেয়ারিং করছেন দু’জন। খাটে শোবার অনভ্যস্ততার কারণে ফ্লোরিং করে ঘুমান রায়না। ধোনিও তখন বলেন, ‘আমারও খাটে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।’ 

এভাবেই বন্ধুত্বের শুরু। ২০০৫ সালে প্রথমবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দু’জনকে ভারতীয় দলে একসাথে দেখা যায়। নীল জার্সিটা গায়ে জড়িয়ে সেটা ধোনির দশম ম্যাচ হলেও রায়নার অভিষেক ম্যাচ মাত্র। কাকতালীয় ব্যাপার, দু’জনেই সে ম্যাচে গোল্ডেন ডাক পান। ওয়ানডেতে প্রথমবার ওপেনিংয়ে খেলতে নেমে শূন্য রানে ফেরেন ধোনি। অপরদিকে ছয় নাম্বার পজিশনে খেলতে নেমে শূন্যতে ফেরেন রায়নাও। 

শ্রীলঙ্কা ফিরতি সফর করতে আসে ভারতে। দারুণ সব জুটিতে দু’জনে অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারত এবং আইপিএল দল চেন্নাই সুপার কিংসকে। তবে পুনেতে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দু’জনের জুটি থেকে ‘প্রথম’ জয় পায় ভারত। ২৬১ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৭৬/৩ থেকে ১৮০/৬ এ পরিণত হয়ে হারের শঙ্কায় পড়ে স্বাগতিকরা। সেখান থেকে অপরাজিত ৮২ রানের জুটিতে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন দু’জন। ধোনি অপরাজিত থাকেন ৪৫ রানে, রায়না অপরাজিত থাকেন ৩৯ রানে।

তবে শুরুর বন্ধুত্বটা খুব বেশী দূর আগায়নি। আগায়নি ভারতীয় দলে রায়না থিতু হতে না পারার ব্যর্থতায়। ২০০৮-এর আইপিএল থেকে ক্রিকেটের নতুন যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে দু’জনের বন্ধুত্ব জমে ক্ষীর হতে শুরু করে। প্রথম মৌসুমে চেন্নাইয়ের হয়ে ১৪২.২২ গড়ে ৪২১ রান করে টি-টোয়েন্টির পর ওয়ানডে আর টেস্ট অধিনায়কত্ব পাওয়া ধোনির আস্থাভাজন পরিণত হন রায়না। ধোনি-যুগে ভারতের অবিস্মরণীয় পথচলায় ধোনি যদি হন ব্যাটম্যান, সুরেশ রায়না এই অধ্যায়ের রবিন। ব্যাটম্যান-রবিন মিলে ভারতের ত্রাণকর্তা হয়েছেন অসংখ্যবার। ওয়ানডেতে ৭৩ বার জুটি বেঁধেছেন দু’জন; এর মধ্যে ২১ বারই ব্যাট করতে এসেছেন এমন সময়ে, দল যখন ১০০ রানের নিচে তিন বা তার অধিক উইকেট হারিয়ে ফেলেছে, স্কোরবোর্ড দিচ্ছে বিপদের বার্তা। এদিকে আপনি জানেন, উদ্ধারকারী হিসেবে আছেন তারা। পরিসংখ্যানও বলছে, দলের এহেন বিপদের সময়ে ৫৬.৮৪ গড়ে ১,০৮০ রান করে পরিস্থিতির দাবি মিটিয়েছেন তারা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ১০১ ইনিংসে ৪৮.৩৮ গড়ে এই জুটির রানসংখ্যা ৪,৩৫৪।

তিন ফরম্যাটে এই জুটির পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা যাক। ওয়ানডেতে ৭৩ ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে এই জুটির সংগ্রহ ৩,৫৮৫ রান। গড় ৫৬.৯০। অমীমাংসিত থেকে শেষ করেছেন ১০ বার। টি টোয়েন্টিতে ২১ ইনিংসে ২৭.৪৫ গড়ে এই জুটির সংগ্রহ ৫৪৯ রান। সাদা বলের তুলনায় লাল বলের ক্রিকেটে অবশ্য জুটির রং কিছুটা বিবর্ণ। এখানে সাত ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে ৩১.৪৩ গড়ে করেছেন ২২০ রান।

২০১৮ সালে হেডিংলিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রায়না ভারতের হয়ে শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন। দল থেকে বাদ পড়ার আগ পর্যন্ত ধোনির সঙ্গে জুটিতে দলের মিডল-অর্ডার সামলেছেন দারুণ দক্ষতায়। টপ-অর্ডার দ্রুত সাজঘরে ফিরে গেছে, দলের ইনিংস গড়ে তোলার পুরো দায়িত্বটা এসে ঠেকেছে চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ উইকেট জুটির ব্যাটসম্যানদ্বয়ের উপর। পরিসংখ্যান বলছে, ওয়ানডেতে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ৯ ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে ৮৩.৫০ গড়ে ৬৬৮ রান করেছেন ধোনি-রায়না জুটি। এই জুটির ৬৮ শতাংশ রানই এসেছে পঞ্চম উইকেট জুটি থেকে। পঞ্চম উইকেটে ৫৪ ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে জুটির রান ২,৪২১; গড় ৫১.৫১। ষষ্ঠ উইকেটে ৭ ইনিংসে একসঙ্গে ব্যাট করে ৫২.১৭ গড়ে করেছেন ৩১৩ রান।

২৯৭ ওয়ানডে ইনিংসে ধোনি জুটি গড়েছেন ৬১ জন ব্যাটসম্যানের সাথে। সেখানে ১৯৪ ইনিংসে রায়না জুটি বেঁধেছেন ৩১ জন ব্যাটসম্যানের সঙ্গে। এক্ষেত্রে ৫৬.৯০ গড়ে ৩,৫৮৫ রান নিয়ে ধোনি-রায়না জুটির অবস্থান সবার উপরে। ধোনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩,১০৫ রান করেছেন যুবরাজ সিংয়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে; গড় ৫১.৭৫। রায়না দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২,২৩৮ রানের জুটি গড়েছেন ভিরাট কোহলির সঙ্গে। এক্ষেত্রে ৫৮.৮৯ গড় অবশ্য সবার উপরে। ধোনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের সেরা ফিনিশার এ বিষয়ে আদতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে যে তথ্যটা একটু হলেও অবাক করবে, ওয়ানডেতে সুরেশ রায়না যে ৩৫ ইনিংসে অপরাজিত থেকে শেষ করেছেন, ৩৩ ম্যাচেই জয়ী দলের নাম ভারত। অবশিষ্ট দুই ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়েছে। ওয়ানডেতে রায়নার সেঞ্চুরি পাঁচটি, এটা অবশ্য জানা তথ্য। তবে যেটা জানানো যায়, পাঁচ সেঞ্চুরির তিনটাই এসেছে ধোনির সঙ্গে জুটিতে। 

Image Credit:  IDI via Getty Images

ওয়ানডেতে ধোনি-রায়না জুটি ভারতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। “ঘরে বাঘ, বাইরে বিড়াল” – এই অপবাদ সময়ে-অসময়ে দল হিসেবে ভারতকে শুনতে হয়েছে অসংখ্যবার। ধোনি-রায়না জুটির ক্ষেত্রেও কি একই কথা খাটে?

আপনার উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। পরিসংখ্যানের মজাটা আসলে এখানেই। ক্রিকেটেরও নয় কি?

সে যাই হোক, দু’জনের জুটির হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে রেকর্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশের মাটিতে ৪৫ ইনিংসে এই জুটি রান করেছে ২,৩৬৩; গড় ৬৩.৮৬। দু’জনের জুটিতে ২৪ জয়ের বিপরীতে দল হারের মুখ দেখেছে ১৭ ম্যাচে, দুই ম্যাচ টাই এবং দুই ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে; জয়ের পার্সেন্টেজ ৫৩%। সেখানে ঘরের মাঠে ২৮ ইনিংসে ৪৭ গড়ে এই জুটির রানসংখ্যা ১,২২২। ১৬ জয়ের বিপরীতে দল হেরেছে ১২ ম্যাচে, জয়ের পার্সেন্টেজ ৫৭%।

যেহেতু দু’জনেই মিডল-অর্ডারে সবচেয়ে বেশি ব্যাট করেছেন, জুটি ভাঙার পর ইনিংস মেরামতের গুরুদায়িত্ব নিতে হয়েছে দু’জনকে। দল প্রথমে ব্যাট করেছে, এমন ম্যাচে পঞ্চম উইকেটে দুইজন সবচেয়ে বেশি রান করেছেন। পঞ্চম উইকেটে ২৫ ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে ৫৫.১৩ গড়ে যোগ করেছেন ১,৩২৩ রান। ২৫ জুটির ১৩টিতে জয়ী দলের নাম ভারত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চতুর্থ উইকেটে সাত ইনিংসে ৯২.৯৩ গড়ে করেছেন ৫৫৭ রান, এর ৬টিতেই ম্যাচ জিতেছে ভারত। দল দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করেছে, এমন ম্যাচে, অর্থাৎ রান তাড়ায় পঞ্চম উইকেটে ২৯ ইনিংসে ৪৭.৭৪ গড়ে ১,০৯৮ রান করেছেন। এর ১৩টিতেই ম্যাচ জিতেছে ভারত। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৭ রান করেছেন ষষ্ঠ উইকেটে। দুই ম্যাচের দু’টিতেই জয়ী দলের নাম ভারত।

ধোনি-রায়না জুটি সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ইংলিশদের। ইংলিশদের বিপক্ষে ১৮ ইনিংসে ৫৬.৬১ গড়ে এই জুটি করেছে ১,০৬১ রান। মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। এই জুটি সবচেয়ে বেশি ভুগেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সাত ইনিংসে ২১.১৪ গড়ে মাত্র ১৪৮ রান করতে পেরেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ইংলিশরা চাইলে প্রোটিয়াদের শরণাপন্ন হতেই পারতেন! 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অগোচরেই চিরবিদায় জানিয়েছেন একসাথে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে দু’জনের এমন অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো এমনই অগোচরে ঘটেছে। ২০১৪ সালে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজের তৃতীয় টেস্ট শেষে মহেন্দ্র সিং ধোনির আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণা আসে বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে। সিডনি টেস্ট, অর্থাৎ সিরিজের শেষ টেস্ট তখনও বাকি। এমন করে বিদায়ের ঘোষণা আসছে, সাথে থেকেও টের পায়নি কেউই!

তবে একজন জানতেন, তিনি সুরেশ রায়না। মেলবোর্ন টেস্টের শেষ দিনের প্রাক্কালে ধোনি নিজের জার্সিতে সিগনেচার করে উপহার দেন প্রিয় বন্ধু রায়নাকে। রায়না তখনই বুঝেছিলেন। সিডনি টেস্টে বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় বন্ধুরই জার্সিতে বন্ধুর টেস্ট ক্যাপ নাম্বার ‘২৫১’ পড়ে খেলতে দেখা গেছে রায়নাকে। নিয়তির কী অদ্ভুত চাওয়া, সিডনি টেস্টটাই রায়নার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট হয়ে আছে।

The article is in Bangla language. It is about the chemistry between MS Dhoni and Suresh Raina.

Featured Image: Getty Images

Related Articles