বাংলাদেশ ক্রিকেটের ন্যূনতম খোঁজখবর রাখলে ড্যারেন স্টিভেন্সকে চিনতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়। প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলে গিয়েছেন দু’মৌসুম। তবে ক্রিকেটীয় কারণ থেকে অক্রিকেটীয় কারণেই বাংলাদেশের মানুষ হয়তো মনে রেখেছে স্টিভেন্সকে।
ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে ২০১৩ সালে বিপিএল খেলার সময় ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব পেয়ে তা গোপন করার অভিযোগ ওঠে স্টিভেন্সের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা প্রমাণিত হয়নি, তবে এই অভিযোগ মাথায় বয়ে বেড়ানো স্টিভেন্সের জন্য ছিল খুব কঠিন। বিচার চলাকালীন আদালতের কাঠগড়ায় একবার দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা৷ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি সেদিন, কান্নায় ভেঙে পড়েন। তবে পুরো সময়টায় তাকে সাহস দেবার কাজটি ভালোভাবেই করেছিলেন তার স্ত্রী ক্যাটি।
স্টিভেন্সের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। পেশাদার ক্রিকেটে হয়তো নাও ফিরতে পারতেন। তবে সেই লড়াইটা জিতে যাবার পর আর কোনো লড়াইকেই হয়তো কঠিন মনে হয়নি তার কাছে।
বরং এই ধাক্কার পর নিজেকে আরো শাণিত করেছেন স্টিভেন্স। ব্যাট হাতে তিন ধরনের ক্রিকেটেই তার সেরা নৈপুণ্য এসেছে এই ঘটনার পর। বল হাতেও পেয়েছেন অভূতপূর্ব সাফল্য। যে বয়সে অন্য ক্রিকেটাররা বুটজোড়া তুলে রাখার কথা ভাবতে থাকেন, সে বয়সেই কি না নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন ড্যারেন স্টিভেন্স। নইলে যে ক্রিকেটার প্রথম আট প্রথম শ্রেণির মৌসুমে নিয়েছিলেন ছয় উইকেট, তিনি কী করে বয়স ৩৫ পেরোনোর পর ২৯ বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেন?
বলা হয়, “You are only as good as your last game”। সে হিসেবে যত দিন যাচ্ছে, স্টিভেন্স নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ২৫ বছরের ক্যারিয়ার, তিন ধরনের ক্রিকেটে সাতাশ হাজার রান, ৮০০ এর উপর উইকেট – জো ডেনলি যে তাকে ‘GOAT’ (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম) বলে ডাকেন, তাতে তাই অবাক হবার কিছু নেই।
কেন্টের সাথে তার চলমান চুক্তি যখন শেষ হবে, ততদিনে বয়সের কাঁটা ৪৫ পেরিয়ে যাবে স্টিভেন্সের। এডি হেমিংসের (১৯৯৫) পর স্টিভেন্স হয়ে যাবেন ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত কাউন্টি ক্রিকেট খেলে যাওয়া প্রথম ক্রিকেটার।
কিন্তু বয়স তো তার কমছে না। তার কাছাকাছি বয়সী যারা ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই-ই খেলছেন কেবল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। কিন্তু স্টিভেন্স খেলছেন চারদিনের ক্রিকেট। তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফিটনেস ধরে রাখার মতো কঠিন কাজটা বছরের পর বছর ধরেই করে যাচ্ছেন তিনি।
স্টিভেন্স যেন ক্রিকেটের ‘পিটার প্যান’। জে.এম. ব্যারির সৃষ্টি করা চরিত্র পিটার প্যান, যার বয়স কখনো বাড়ে না। কথাটা লেখকের নয়, স্টিভেন্সকে পিটার প্যানের সঙ্গে তুলনা করেছেন তার সাবেক সতীর্থ পল নিক্সন। কেন করেছেন, তা আশা করি ইতঃমধ্যে বুঝে গিয়েছেন।
বর্তমানে কেন্টের হয়ে খেললেও স্টিভেন্সের শুরুটা ছিলো লেস্টারশায়ারের হয়ে। ক্লাবটির হয়ে তার সেরা মুহূর্ত ছিল সম্ভবত সাসেক্সের বিপক্ষে ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে নেমে অসাধারণ শতক। সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক কলিন কাউড্রে দেখেছিলেন স্টিভেন্সের সেই ইনিংস। পাঁচ বছর পরে স্টিভেন্সের কেন্টের চলে আসার পেছনে এই ইনিংসের ভূমিকা ছিল বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই।
২০০৪ সালে শেষ হয় স্টিভেন্সের লেস্টার-অধ্যায়। হঠাৎই তিনি পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কেননা অন্য কোনো ক্লাব তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। প্রায় সবগুলো কাউন্টি বরাবরই চিঠি লিখেছিলেন স্টিভেন্স। শুধুমাত্র কেন্ট ছাড়া কেউ ইতিবাচক সাড়া দিল না। কে জানত, যে বয়সে ক্রিকেটাররা ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে কোচিং বা ধারাভাষ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সে বয়সে এসেও স্টিভেন্সই থাকবেন কেন্টের এক নম্বর পারফর্মার!
বলা হয়, সকালের সূর্য নাকি দিনের আভাস দেয়। কথাটা স্টিভেন্সের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য, প্রথম মৌসুমেই ৫০ গড়ে তুলেছিলেন ১,২৭৭ রান। তবে বোলিংয়ে তখনও আজকের স্টিভেন্স হয়ে উঠতে পারেননি। ড্যারেন ম্যাডি তার ব্যাপারে বলেছিলেন,
“ও নেটে বোলিং করতো, আউটসুইংটা পারতো বেশ৷ তবে ধারাবাহিক ছিল না, কেউ তাকে সিরিয়াসলি নিত না।”
২০০৭ সালে কেন্টের কোচ হয়ে আসা জেসন গিলেস্পিও সিরিয়াসলি নেননি স্টিভেন্সের বোলিংকে। এসেই বললেন,
“স্টিভোর বোলিং এই স্তরের ক্রিকেটে চলবে না।”
মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় গিলেস্পি তার কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। ততদিনে রায় দিয়ে দিয়েছেন, স্টিভেন্স তার দেখা সবচাইতে দক্ষ বোলারদের একজন।
স্টিভেন্সকে কেউ আবার ৯০ মাইল/ঘন্টা গতিতে ছোঁড়া ফাস্ট বোলার ভেবে বসবেন না যেন! তার গতিটা এমন যে, উইকেটরক্ষক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভোগেন যে, উইকেটের একদম পেছনে দাঁড়াবেন নাকি দূরে দাঁড়াবেন। জো ডেনলির ভাষায়,
“স্টিভোকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে, তা নিয়ে কাউন্টিগুলোর মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়।”
সব শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে। স্টিভেন্স ১৪ মৌসুম পেরিয়ে এলেও তখনও সর্বসাকুল্যে ১০০ উইকেটও ঝুলিতে নেই তার। চেমসফোর্ডে এসেক্সের বিপক্ষে কেন্ট অধিনায়ক রব কী নতুন বলটা তুলে দিলেন স্টিভেন্সের হাতে, কারণ তার দলে ছিল বোলার সংকট।
বল হাতে শুরুতেই ফেরালেন স্যার অ্যালেস্টার কুককে। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথমবারের মতো তুলে নিলেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট। সেই ম্যাচের পর আর পেছন ফিরে তাকাননি, লাল বলে তুলে নিয়েছেন ৪৫০-এরও বেশি উইকেট।
জেসন গিলেস্পির সংশোধিত বক্তব্যটা ছিল এরকম:
“স্টিভো দেখিয়েছে যে গতিই সব নয়। আপনার সিম পজিশন যদি ঠিক হয়, যদি সঠিক জায়গায় বল ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি যেকোনো ব্যাটসম্যানকে বিপদে ফেলতে পারবেন।”
অথচ স্টিভেন্স যখন কেন্টে আসেন, তখন ছিলেন অফস্পিনার৷ সেখান থেকে এক মৌসুম পর সুইচ করেন মিডিয়াম পেসে। বাকিটা তো ইতিহাসই। নিরীহদর্শন মিডিয়াম পেসে ভুগিয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারার মতো ব্যাটসম্যানকেও।
কিন্তু বয়স তো থেমে থাকে না। দু’বছর আগেই কেন্ট থেকে তাকে জানানো হয়েছিল সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কথা৷ অর্থাৎ স্টিভেন্সকে আর রাখতে চাইছিল না ক্লাবটি। মৌসুমের শুরুটাও ভালো হয়নি তার৷ কিন্তু কে জানত, সেরাটা তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন এই সময়টার জন্য!
নিজে চাপে আছেন, ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ব্যাটিংয়েও এলেন চাপের মুহূর্তে। কেননা স্কোর তখন ৩০ রানে পাঁচ উইকেট। এরপর দু’সেশন পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, স্টিভেন্স তুলে নেন দ্বিশতক। ড্রেসিংরুম থেকে সেই ইনিংস দেখা ড্যানিয়েল বেল-ড্রামন্ড বললেন,
“আমার মনে হয়েছিল ও অতিমানব। সবাইকেই থামতে হয়, কিন্তু স্টিভো জানত, তার সময়টা এখনো আসেনি।”
২০২০ বব উইলিস ট্রফিতে স্টিভেন্স ১৫ গড়ে শিকার করেন ২৯ উইকেট৷ তার অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ উইজডেনের বর্ষসেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, যাদের বেছে নিতে বিবেচনা করা হয়েছিল গত বিলেতি গ্রীষ্মের পারফরম্যান্স। অন্য চারজন হলেন — জ্যাক ক্রলি, জেসন হোল্ডার, ডমিনিক সিবলি ও মোহাম্মদ রিজওয়ান।
সদ্য ইংল্যান্ড দলের নির্বাচক পদ থেকে ইস্তফা দেয়া এড স্মিথের চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় স্টিভেন্স। তার সঙ্গেই উইজডেন বর্ষসেরা হওয়া জ্যাক ক্রলি যখন জন্মগ্রহণ করেন, ততদিনে এক মৌসুম প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে ফেলেছেন স্টিভেন্স। সবচাইতে বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে উইজডেন বর্ষসেরা হবার তালিকায় স্টিভেন্সের নাম শোভা পাচ্ছে চার নম্বরে।
ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্ন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে তার। তবু ক্রিকেটকে ভালোবেসে চালিয়ে যাচ্ছেন খেলা। অস্ট্রেলিয়াতে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেকের ধন্যবাদ পেয়েছেন৷ কেননা চল্লিশ ছুঁইছুঁই ক্রিকেটাররা স্টিভেন্সকে দেখে উৎসাহ পেয়েছেন ক্রিকেট চালিয়ে যেতে।
কিন্তু তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে কতদিন আর এভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন তিনি? উত্তরটা তার মুখেই,
“যতদিন শরীর সায় দেয়, চালিয়ে যেতে ক্ষতি কী?”
ড্যারেন ইয়ান স্টিভেন্সের জন্য ব্যাপারটা ঠিক এতটাই সহজ। চলার পথটা যতদিন বন্ধুর হয়ে না ওঠে, চলুক না তবে এই মুগ্ধতাছড়ানো পথচলা!