মধ্যমাঠের প্রায় সীমানা থেকে ড্যানি ব্লিন্ডের বাড়ানো বলকে পাখির চোখে করে এগিয়ে গেলেন রবিন ফন পার্সি। আকাশে ভেসে আসা বল দেখে সামান্য এগিয়ে গিয়েও থমকে গেলেন ইকার ক্যাসিয়াস। রবিন ফন পার্সি সম্ভবত ভেবেছিলেন কীভাবে এ বলটিকে জালে জড়াবেন! ইকার ক্যাসিয়াস সহ সবাইকে হতভম্ব করে ডাচদের স্ট্রাইকার উড়লেন আকাশে। নিজেকে শূন্যে তুলে হেডে করলেন অতিমানবীয় এক গোল। হল্যান্ড স্পেনের মতো পরাশক্তিকে হারালো ৫-১ গোলের বিরাট ব্যবধানে। পরবর্তী ব্রাজিল বিশ্বকাপে সেমি ফাইনালেও পৌঁছেছিলো হল্যান্ড। লুই ফন গালের স্পর্শে মধ্যম মানের দল সেবার পরিণত হয়েছিলো শক্তিশালী দলে। কিন্ত ব্রাজিল বিশ্বকাপ শেষে কে ভেবেছিলো রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হারাবে সম্ভাবনাময় এ ডাচ দলটি।
হল্যান্ড খেলছে না রাশিয়া বিশ্বকাপে। কারণ বাছাইপর্বে তারা নিজেদের স্থান দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া বিশ্বকাপে না খেলার ব্যর্থতা ডাচদের অবশ্যই ভোগাচ্ছে। কিন্ত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার বেদনায় যে তারা সবসময় পুড়বে সেটা এককথায় নিশ্চিত। ১৯৭৪, ১৯৭৮ এবং ২০১০ সালে বিশ্বকাপে ফাইনালে পৌঁছেছিলো দলটি। কিন্ত সবথেকে বেশিবার ফাইনালে গিয়ে একবারও দলটি চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। অধরা শিরোপা তো কখনো ধরা দেয়নি, বরং বেরসিক ভাগ্য এবার ডাচদের মূলমঞ্চ থেকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
১৯৭০ বিশ্বকাপ
দশম বিশ্বকাপ পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হবার আগে ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। তিনবার বিশ্বকাপ জেতায় ১৯৭০ সালে চিরতরে ‘জুলেরিমে ট্রফি’ দিয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিল দলকে। তাই ১০ম বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে নতুন ট্রফি তৈরির প্রয়োজন পড়ে। ফিফা একটি নতুন ট্রফি তৈরি করে নাম ঘোষণা করে ‘ফিফা কাপ’। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ আয়োজন করে পশ্চিম জার্মানি। নিজেদের দেশে সেবার পশ্চিম জার্মানিই ছিলো ফেবারিট। আর সেসময় হল্যান্ড মাত্র পুরো বিশ্বকে জানান দিচ্ছে তাদের উত্থানের খবর।
আসলে ডাচদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেবার দুর্দান্ত একটি দল নিয়ে বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিলো। রব রেনসেনব্রিঙ্ক, ইয়োহান নিসকিনস, রেনে ফন ডি কিরকফ ছিলেন দলের ভরসা। আর ইয়োহান ক্রুয়েফকে নিয়ে নেদারল্যান্ডের কোচ রিনাস মিশেল ফুটবলের ইতিহাস ‘টোটাল ফুটবল’ নামে নতুন এক কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন। পুরো দলকে একইসঙ্গে আক্রমণ ও রক্ষণে সহায়তা করার দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করার কৌশলই হলো টোটাল ফুটবল।
জার্মানির বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও হল্যান্ড বিশ্বকাপে বেশ ভালোভাবে সূচনা করে। কোনো ম্যাচ না হেরে ডাচরা হয়েছিলো গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। তারা ফাইনালে এসেছিলো টোটাল ফুটবলের সাহায্যে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে। ইয়োহান ক্রুয়েফ করেছিলেন জোড়া গোল। পরাশক্তি ব্রাজিলকেও তারা সেবার হারিয়েছিলো ২-০ গোলের ব্যবধানে। ফাইনালে নেদারল্যান্ডের মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানি।
একদিকে অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও তার শক্তিশালী দল, অপরদিকে ইয়োহান ক্রুয়েফ ও টোটাল ফুটবল। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি বনাম হল্যান্ডের ম্যাচটি ছিলো উত্তেজনায় ঠাসা। ম্যাচের প্রথমদিকেই এগিয়ে গিয়েছিলো ক্রুয়েফের দল। পশ্চিম জার্মানি ক্রুয়েফকে ফাউল করলে ইয়োহান নিসকেনস হল্যান্ডকে দ্বিতীয় মিনিটে এগিয়ে নেন। কিন্ত শেষরক্ষা হয়নি। ক্রুয়েফ স্পর্শ করতে পারেননি বিশ্বকাপ শিরোপা। ব্রিয়েটেইনার ও জার্ড মুলারের গোলে সেবার ফিফা কাপ উঠেছিলো ক্রুয়েফের সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ বেকেনবাওয়ারের হাতে।
১৯৭৮ বিশ্বকাপ
পরের বছর ১৯৭৮ বিশ্বকাপ আয়োজন করে আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনায় জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় বিশ্বকাপ বয়কট করে সেসময়ের সেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুয়েফ। দলের সেরা খেলোয়াড়কে বাদ দিয়েই আর্জেন্টিনার অস্থির সময়ে বিশ্বকাপে যোগ দেয় হল্যান্ডসহ বাকি দেশগুলো। ১৮৭৪ বিশ্বকাপে হল্যান্ড তাদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে প্রথম জানান দিয়েছিলো। আর ১৯৭৮ বিশ্বকাপে নিজেদের তুলে ধরে পরাশক্তি দল হিসেবে। গ্রুপ ডি তে পেরু, স্কটল্যান্ড ও ইরানের সাথে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে হল্যান্ড।
স্কটল্যান্ডের কাছে আকস্মিক হেরে যাওয়ায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় কোনো ম্যাচ না হারা পেরু। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে ইয়োনি রেপের জোড়া গোলে নেদারল্যান্ড অষ্ট্রিয়াকে হারায় এবং অপর ম্যাচে জার্মানির সাথে ২-২ গোলে ড্র করে। গ্রুপের অন্য ম্যাচে ইতালি অষ্ট্রিয়ার সাথে ১-০ গোলে জয় লাভ করে। এমতাবস্থায় সমীকরণ দাঁড়ায়, জার্মানি হেরে গেলেই ডাচদের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত। দ্বিতীয় পর্বের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় অষ্ট্রিয়া এবং তখনকার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। অষ্ট্রিয়া ৩-২ গোলে হারায় জার্মানিকে এবং একইসাথে ডাচরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত করে।
টানা দ্বিতীয়বারের ফাইনালে হল্যান্ডের প্রতিপক্ষে স্বাগতিক আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ৪৮ বছরের স্বপ্নপূরণ আর হল্যান্ড চায় ১৯৭৪ সালের ফাইনালের দুঃখ ঘোচাতে। শুধু ফাইনাল নয়, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে ফেবারিট ছিলো হল্যান্ডই। আর্জেন্টিনার ভরসা বলতে শুধু ড্যানিয়েল প্যাসারেল্লা ও মারিও কেম্পেস। কিন্ত হল্যান্ড ছিলো ১১ জনের পূর্ণাঙ্গ আত্মবিশ্বাসী দল।
১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবথেকে বিতর্কিত বিশ্বকাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার এ বিশ্বকাপ ফাইনালকে বিতর্কিত বললেও ভুল হবে না। আর্জেন্টিনার জান্তা সরকার তখন চেয়েছিলো, যেভাবে হোক আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতবে। ফাইনালে হল্যান্ড দলকে বুয়েন্স আয়ার্সে আনা হয় অনেক পথ ঘুরিয়ে। হল্যান্ড যখন মাঠে পৌঁছায়নি, আর্জেন্টিনা দল তখন ড্রেসিংরুমে। হল্যান্ড দল পৌঁছানোর পর পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সামনে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয় দুয়ো খাওয়ানোর জন্য।
মানসিক ও শারীরিকভাবে নুয়ে পড়া দল ফাইনাল শুরু করার ৩৮ মিনিটে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন মারিও কেম্পেস। ৮২ মিনিটে নানিঙ্গা গোল করে সমতায় আনলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৪ মিনিটে আবার কেম্পেস ও ১১৫ মিনিটে বার্তেনি গোল করলে হল্যান্ডের সকল স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। বিতর্কিত বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা জিতে নিলেও হল্যান্ডের চিরদিন আক্ষেপ থেকে যাবে, তাদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে তারা দুটো ফাইনালের একটিতেও জিততে পারেনি।
১৯৭৪ ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপের সময়ে হল্যান্ড দল যেন প্রথমবারের মতো বড় দল হিসেবে ফুটবল মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলো। ইয়োহান ক্রুয়েফ এবং টোটাল ফুটবলের স্পর্শে হল্যান্ড জেগে উঠেছিলো নতুন শক্তিতে। আর্জেন্টিনার সাথে ফাইনাল হারার পরে হল্যান্ড এমনভাবে হারিয়ে যেতে শুরু করলো যে, পরে টানা তিন বিশ্বকাপ হল্যান্ড মূলপর্বে জায়গাও করে নিতে পারেনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তারা হয়েছিলো ৪র্থ। কিন্ত ২০১০ আরো একবার বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ এসেছিলো ডাচদের সামনে।
২০১০ বিশ্বকাপ
২০১০ বিশ্বকাপে ফেবারিট ছিলো স্পেন, ব্রাজিল, জার্মানি বা ইতালির মতো শক্তিশালী দলগুলো। সেবার হল্যান্ডও ফেবারিট দল হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলো। বিশেষ করে ডাচদের আক্রমণভাগ ছিলো অনন্য। রবিন ফন পার্সি, আরিয়েন রোবেন, হুন্টেলার, স্নাইডার ছিলেন তারকা ফুটবলার। ভরসা করার মতো ছিলেন নাইজেল ডি লং, মার্ক ফন বুমেলের মতো খেলোয়াড়রা। ডেনমার্ককে হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে শুভসূচনা করেছিলো হল্যান্ড। ব্রাজিল এবং উরুগুয়ের মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিলো দলটি।
ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো জার্মানি ও প্যারাগুয়ের মতো দলকে হারিয়ে আসা স্পেন। ভূমধ্যসাগরের স্পেন ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে ব্যবধান ১২ কিলোমিটার। একসময় আফ্রিকার তিউনিসিয়া ও মরক্কোর মুসলমানরা শাসন করতো স্পেনকে। সেই স্পেন এখন স্বাধীন। তাদের ফুটবল ইতিহাসে কখনো বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতেনি স্প্যানিশরা, কখনো জেতেনি ডাচরাও। তাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে, দক্ষিণ অাফ্রিকা দেখা পাচ্ছে নতুন চ্যাম্পিয়নের।
ফাস্ট ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক স্টেডিয়ামে ফাইনালের লড়াই ছিলো আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের। উভয় দল যেমন আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছিলো, তেমনি বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে চীনের প্রাচীর হয়ে যাচ্ছিলো। ম্যাচের ৯০ মিনিটেও কোনো দল গোল না করতে পারায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। হলুদ কার্ডের ছড়াছড়ি ম্যাচে ১০৯ তম মিনিটে লাল কার্ড দেখেন ডাচ ডিফেন্ডার ইয়োন হেইটিংগা। ১১৬ মিনিটে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা করেন ঐতিহাসিক গোল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয় স্পেন। হল্যান্ড পায় তৃতীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল হারার তিক্ত স্বাদ।
ব্রাজিল বিশ্বকাপেও হল্যান্ড পুনরায় ডাচদের আশা জাগাচ্ছিল। কিন্ত সেমি ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে পেনাল্টি শুটআউটে সেই আশাও নিভে যায়। ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব উতরে যেতে পারেনি হল্যান্ড। তাই রাশিয়া দেখা পাবে না ডাচ দলের। তবে নতুন কোচ রোনাল্ড কোম্যানের নেতৃত্বে হল্যান্ডের সুদিন আবারো ফিরছে। মেম্ফিস ডিপাই, ডেভি প্রোপার, জাস্টিন কুইভার্ট, ভার্জিল ফন ডাইক, স্টেফেন ডি ভ্রাই এবং মাথিজিস ডি লিটের মতো তরুণেরা ভবিষ্যত হল্যান্ডের ভার নিতে প্রস্তুত। হয়তো সফলতার সময় খুব শীঘ্রই ফিরবে। কিন্তু তিনটি ফাইনালের হার আর এত বছরের আক্ষেপের স্মৃতি ডাচরা আদৌ কি খুব দ্রুত মুছতে পারবে?