এরকম সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু রাজনীতিকে বলা হয় অসম্ভবকে সম্ভব করার কলা। আর ঠিক সেটাই করে দেখালেন পাকিস্তানের বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, গত ১১ মে তারিখে। পাকিস্তানের নামকরা সংবাদমাধ্যম ‘ডন’কে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে শরিফ আফসোসের সুরে বলেন, পাকিস্তানের উচিত ছিল সীমানা টপকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইতে যে উগ্রপন্থীরা ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায়, তাদের আটকানো।
পাশাপাশি, তিনি এও আক্ষেপ করে বলেন যে, ওই সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে পাকিস্তান তার বিচারপ্রক্রিয়াকেও শেষ করে উঠতে পারেনি। তিনি বলেন, এই ব্যর্থতাগুলিই পাকিস্তানের সার্বিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ার মুখ্য কারণ।
“সারা দুনিয়াতে আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছি। আমরাও কম বলিদান দেইনি, কিন্তু আজকে আফগানিস্তানের মতো দেশের কথা লোকে শোনে। আমাদেরটা শোনে না। আমাদের এই নিয়ে ভাবা উচিত।” এভাবেই নিজের মনোভাব তুলে ধরেন নওয়াজ। তিনি এও যোগ করেন যে, পাকিস্তানের বন্ধু দেশ, যেমন- চীন বা রাশিয়াও এই নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে একই সঙ্গে অনেকগুলো সরকার চলছে, যেখানে দরকার মাত্র একটি- যেটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ।
শরিফের এই আত্মসমালোচনা স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের মধ্যে আলোড়ন ফেলেছে। তার এই মন্তব্যের দরুন ভারতের রাজনৈতিক এবং সংবাদমাধ্যমের মহলে আলাপ শুরু হলে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো বটেই (এমনকি তার দল পিএমএল-এন-এর নানা নেতাও), সেই সাথে সেদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীও নড়েচড়ে বসেছে। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির সঙ্গেও তাদের এই বিষয়ে বৈঠক হওয়ার কথা।
নওয়াজ শরিফ এখন নানা সমস্যায় জেরবার
প্রশ্ন হচ্ছে, শরিফ এখন এই কথা বললেন কেন? গত বছর জুলাই মাসে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দুর্নীতির অভিযোগে তার প্রধানমন্ত্রীত্ব খারিজ করে দেওয়ার পরে ৬৮ বছর বয়সী শরিফের অবস্থা বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে সেদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে। অদূর ভবিষ্যতে তাকে হয়তো জেলেও যেতে হতে পারে। তার স্ত্রী কুলসুম এই মুহূর্তে একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং নওয়াজের পরে দলের হোতা কে হবেন, সেই নিয়েও শরিফ পরিবারে চলছে চাপা দ্বন্দ্ব।
নওয়াজ চাইছেন তার মেয়ে মরিয়ম ভবিষ্যতে হাল ধরুক, কিন্তু তার ভাই শাহবাজ, যিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের প্রশাসক হিসেবে যথেষ্ঠ সুনাম অর্জন করেছেন এবং তার ছেলে হামজা সেই পথের কাঁটা হয়ে উঠতে পারেন। নওয়াজের বিতাড়নের পরেও শাহবাজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি এবং অনেকের মতে, তার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীরই।
দলের অবস্থাও যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। নওয়াজের সাথে সাথে পিএমএল-এন সরকারের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী (বিদেশ) বরখাস্ত হয়েছেন; দুর্নীতির অভিযোগের সামনে পড়ে কয়েকমাস আগে দেশত্যাগ করেছেন দেশের অর্থমন্ত্রী। গৃহমন্ত্রী আবার দিনকয়েক আগে এক প্রাণঘাতী হামলার মুখোমুখি হয়েছেন। ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা পিএমএল-এন বারো মাস আগেও আরও একটি নির্বাচন জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু গত এক বছরে একের পর এক ধাক্কায় তাদের গণেশের প্রায় উল্টে পড়ার অবস্থা।
আর এসবের পাশাপাশি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের চিরকালীন শত্রু- সেনাবাহিনী, আদালত এবং শরিফের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বৈরী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই তো রয়েছেই। এই এতগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে শরিফকে কিছু একটা অভিনব করতে হতোই, আর তিনি তা-ই করেছেন। বিশেষ করে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন যখন আর বেশি দূরে নয়।
নির্বাচনের আগে একজন পাকিস্তানী নেতার গলায় ভারত-বান্ধব সুর অভূতপূর্ব
তবে শরিফের এই অভিনবত্বের আরও অভিনব দিকটি হলো পরোক্ষে ভারতের হয়ে কথা বলা। “পাকিস্তানের উচিত ছিল উগ্রপন্থীদের আটকানো”- এই মন্তব্যটি করে তিনি এক ঝটকায় নিজের দেশের সন্ত্রাসবাদী-তোষণের নীতি যেমন প্রকট করলেন, অন্যদিকে গত এক দশক ধরে বিষয়টিকে নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের খেদকেও দিলেন বৈধতা। পাকিস্তানের ইতিহাসে যেখানে ভারত-বিরোধিতা চিরকালই সেখানকার নেতৃত্বের (সে অসামরিক হোক বা সামরিক) প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে, সেখানে শরিফের এমন ভারত-বান্ধব অবস্থান অবাক করেছে অনেক মহলকেই। শরিফ এও বলেছেন যে, পাকিস্তানের উন্নয়নের ধারা সাত শতাংশ পর্যন্ত হতে পারত, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
শরিফের ‘রাষ্ট্রনায়কোচিত’ আচরণ
আসলে শরিফের এই কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার একটি মরিয়া চেষ্টা। পাকিস্তানের চিরাচরিত প্রথা ভেঙে তিনি যে নির্বাচনের কাছাকাছি এসে ঘুরিয়ে ভারতের সমর্থনে কথা বলছেন বা পাকিস্তানের উন্নয়নের অভাব নিয়ে আক্ষেপ করছেন, সেটা একদিকে যেমন তার ঘরের শত্রুদের ঘায়েল করার একটি চেষ্টা, তেমনই পাকিস্তানের গণতন্ত্রে যে গত এক দশক নিরবচ্ছিন্ন শাসনের পরে সেখানকার অসামরিক শাসকরা একটু হলেও আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন, তার একটি পরিচায়কও বটে।
নওয়াজ শরিফ যে ‘আর সমঝোতা নয়’ অবস্থান নিয়েছেন এবং তার সাক্ষাৎকারের পর প্রতিক্রিয়ার রোল উঠলেও বলেছেন যে, তিনি কিছু ভুল কিছু করেননি, তা পাকিস্তানের গণতন্ত্রের একটি ইতিবাচক দিক হিসাবে দেখা যেতে পারে। যেখানে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা হলো প্রধান মাপকাঠি, লাগামহীন জাতীয়তাবাদী জিগির নয়।
এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে যে, ২০১৬ সালের শেষের দিকেও শরীফ সরকার একবার সামনাসামনি সেনাবাহিনীকে বলেছিল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে, নচেৎ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে আরও একঘরে হয়ে পড়বে। শরীফ সেই লড়াইতে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরেও যেভাবে জ্বলে উঠেছেন, তাতে ‘শরিফ মরিয়া প্রমাণ করিলেন যে তিনি মরেন নাই’ বললে অত্যুক্তি হয় না।
এই নব্য গণতন্ত্র যেমন একদিকে শরিফকে সাহস জুগিয়েছে প্রকাশ্যে সত্য কথা বলতে এবং তার ঘরোয়া শত্রু, বিশেষ করে সেনাবাহিনীকে জনসমক্ষে যে-আব্রু করতে, তেমন অন্যদিকে এই রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা পালন করে তিনি আসন্ন নির্বাচনের আগে লড়াইতে ফেরার একটা অন্তিম চেষ্টা করছেন, অন্তত নৈতিকভাবে।
দুই দশকেরও বেশি সময়ে আগে পাকিস্তানের করাচিতে এক সময়ে দায়িত্ব সামলেছিলেন ভারতীয় কূটনীতিবিদ রাজীব ডোগরা। তিনি পরে তার একটি বইতে লিখেন যে, একবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতি তাকে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে বলেন, ১৯৯৩ সালে মুম্বাইতে ঘটা ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পরিকল্পনায় যেমন শরিফের সম্মতি ছিল, তেমনই ১৯৯৯ সালে যখন শরিফ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে ঐতিহাসিক মোলাকাত করছেন, তখনও তিনি জানতেন যে, কার্গিলে আর কয়েক মাসের মধ্যে কী হতে চলেছে।
বৈরী দেশে রক্তপাত আর সন্ত্রাসের পরিকল্পনায় যিনি বারবার নিজ কপালে সিলমোহর লাগিয়েছেন অতীতে, আজকে হঠাৎ তার এই পরিবর্তন দেখে অবাকই হতে হয়।
ঘরোয়া দুশমনদের মরণ কামড় দিতে চান নওয়াজ শরিফ
কিন্তু শরিফের এই নয়া অবতারের প্রধান লক্ষ্য তার দুই দুর্ধর্ষ ঘরোয়া দুশমন- পাকিস্তানী সেনা এবং বিচারব্যবস্থাকে হারানো। শরিফকে তার রাজত্বকালে হার মানতে হয়েছে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছেই (১৯৯৯ সালে পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী তাকে সরাসরি অভুত্থ্যানে ক্ষমতাচ্যুত করে আর ২০১৭ সালে সেই কাজটি করে বিচারব্যবস্থা। যদিও বলা হয় দ্বিতীয়বারেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল, তবে সেটা পরোক্ষে)।
বারবার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে এইভাবে হেনস্থা হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ গর্জে উঠেছেন সদ্য সাবেক ‘রাষ্ট্রনায়ক’ নওয়াজ শরিফ- তার আশা দেশের সাধারণ নির্বাচকগণ অর্থাৎ মানুষ এবং সুশীল সমাজ তার কথার মূল্য বুঝে রুখে দাঁড়াবেন শাসনকার্যে এই প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। শরিফের নিজের হারানোর আর বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু যদি তার আহ্বানের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের চিরাচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আসে, তবে তাতেই তার নৈতিক জয়। এখন এটাই দেখার যে, শরিফের এই আবেদন পাকিস্তানী সমাজের বিবেককে ধাক্কা দেয় কিনা।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নতুন কিছু নয়, কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, সেনারা আগের মতো প্রত্যক্ষ দাপট দেখাতে রাজি নয়; বরং পিছন থেকে সুতো টানতেই তাদের আগ্রহ বেশি। কারণ আর কিছু নয়, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত ক্ষেত্রগুলিতে এই সময়ে টালমাটাল অবস্থা। সরাসরি ক্ষমতাগ্রহণ করা মানে সেনাদের উপরে নানা দিক থেকে বাড়তি চাপ এসে পড়বে, আশঙ্কা রয়েছে বহির্বিশ্বের তরফে নিষেধাজ্ঞা আরোপেও। তাই সরাসরি গদি না দখল করে ঘুরপথে সরকারের কাজে প্রভাব খাটানোই এখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মূল উদ্দেশ্য।
২০১৮ সালের নির্বাচনটি সেদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদি ফের একটি মজবুত অসামরিক সরকার এবছর ক্ষমতায় এসে একটি পূর্ণ মেয়াদ টিকতে পারে, তবে সেনাবাহিনী নামক অতি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কী হতে চলেছে ভবিষ্যতে, সেটাই দেখার থাকবে।
Featured Image Source: Foreign Brief