ভারতে ধর্ষণ সমস্যা এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া, উত্তরপ্রদেশের উন্নাও এবং গুজরাতের সুরাতে তিন ছোট্ট শিশু ধর্ষণ এবং খুন হলে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়; এমনকি দেশের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সুদূর ব্রিটেন সফরেও প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়, তার সফরকালে লন্ডনে ভারতের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।
দেশের ভিতরে এবং বাইরে ধর্ষণকে কেন্দ্র করে তুমুল বিক্ষোভ সামলাতে মোদী সরকার তড়িঘড়ি করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে যাতে বলা হয়, কেউ ১২ বছর বয়সের নিচে কোনো শিশু বা কিশোরীকে ধর্ষণ করে দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে ফাঁসি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্সটিতে সিলমোহর লাগানোর পর ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দও তাতে সই করে তার আইনি পথ প্রশস্ত করেন।
শাস্তি প্রকট করে কতটা কাজের কাজ হবে?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধুমাত্র ফাঁসির আইন বলবৎ করে কতটা নির্মূল হবে ধর্ষণের সমস্যা? এর আগে ২০১২ সালের এক ডিসেম্বরের রাতে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে একটি চলন্ত বাসে নৃশংসভাবে গণধর্ষণ করা হয় এক তরুণীকে। ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে তার মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার জেরে তোলপাড় হয় দেশ; আনা হয় আরও কঠোর আইন; কিন্তু বাস্তবের চিত্র বিশেষ বদলায়নি। ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি, বরং বৃদ্ধা-মাতা-মেয়ে-শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই সামাজিক ব্যাধির বর্বরতার হাত থেকে। মিডিয়াতে অহোরাত্র ধর্ষণের খবর দেখে সাধারণ মানুষ খেপে উঠছে আর তাদের শান্ত করতে সরকার ‘এই দেখ কত কঠোর শাস্তি এনেছি’ বলে একই কুমিরছানা বারবার দেখাচ্ছে। একই চক্রবর্তে ঘুরে চলেছি আমরা, কিন্তু অন্ধকার কাটছে না।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিকতম আইনও ধর্ষণ বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ সফল হবে এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, উল্টো তা ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশু-কিশোরীদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেবে। কারণ, এমনও হতে পারে যে এই আইন আসার পরে ধর্ষক তাদের শিকারকে প্রাণে মারতে পিছপা হবে না প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায়।
তাছাড়া, শিশুদের শ্লীলতাহানি এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় যে অপরাধী তাদের চেনা লোক- এমনকি নিজের বাবা, জ্যাঠা বা বড় ভাই পর্যন্ত ঘটিয়েছে এই নির্মমতা। সেক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যেই এমন অপরাধ ঘটলে তা আদালত পর্যন্ত হয়তো গড়াতে দেবে না খোদ পরিবারই। কারণ, প্রথমত, সম্মানহানির ভয় এবং দ্বিতীয়ত, সেই অপরাধী যদি হয় বাড়ির অন্যতম কর্মক্ষম সদস্য, তাহলে তার শাস্তি হওয়া মানে সেই পরিবারের আর্থিক সর্বনাশ। আর তাছাড়া, সম্পর্কের আবেগের ব্যাপারটিও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের এও অভিমত যে, আইনে শাস্তির কথা কিছু কম বলা নেই। পকসো অথবা প্রটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সচুয়াল অফেন্সেস এক্ট ২০১২ এও অপরাধীদের ন্যূনতম ১০ বছরের জেল হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু শুধু শাস্তির ব্যাপ্তি না বাড়িয়ে প্রত্যেকটি ধর্ষণের ক্ষেত্রেই যাতে অপরাধীরা দ্রুত শাস্তি পায়, তার দিকেই প্রধানত নজর দিতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর হিসেবে বলছে, পকসোর অন্তর্গত যত মামলা রুজু হয়েছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশ এখনও অমীমাংসিত! পাশাপাশি, ভারতে ধর্ষণমূলক অপরাধের ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ২৯ শতাংশ! বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বিচারকমণ্ডলী বা বিশেষ আদালত সর্বোচ্চ সাজার থেকে কমই প্রদান করে অপরাধীকে। অতএব, শাস্তি আরও না বাড়িয়ে দরকার আইনের ব্যাপ্তিকে বাড়ানো, যাতে কোনো অপরাধী বিন্দুমাত্র ছাড় না পায়।
এটা সত্যি যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষেরই মতামত, সোজা ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দাও বা খোঁজা করে দাও। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, মধ্যযুগীয় আইন বলবৎ করেও ধর্ষণের সমস্যা কমানো আদৌ কি সম্ভব?
ধর্ষণ সামাজিক স্তরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমস্যা
ধর্ষণ একটি সামাজিক সমস্যা। নারীর খোলামেলা পোশাক পরা উচিত কি অনুচিত সেই তর্ক এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর। শিশু-কিশোরদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না, যদি পোশাকটাই সব সমস্যার মূলে থাকত। ধর্ষণ আসলে একটি ক্ষয়িষ্ণু পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফসল। এই সমাজে মানুষ হিসাবে নারীকে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেওয়া হয় না। এখানে বাইরে নারীকে দেবতারূপে বন্দনা করলেও, আসলে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। শুধুমাত্র পেশিশক্তির উপরে নির্ভর করে লিঙ্গবিন্যাস করা হয় এই সমাজে। ক্ষমতাকাঠামোতে নারীকে ধরে নেওয়া হয় পুরুষের সম্পত্তি হিসাবে; তাকে ভাবা হয় পণ্য বা দুর্বল টার্গেট হিসাবে। এসবই হচ্ছে এই ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ব্যবস্থার পরিচায়ক।
আর সমস্যা আরও বাড়িয়েছে ভারতের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপরে একটি আকস্মিক উদারবাদের তকমা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি। একটি বদ্ধ-অপরিণত সমাজজীবনের কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ উদারীকরণ সমস্যা আনবেই। যেকোনো উন্নয়নশীল সমাজেই এই সমস্যা হয়, হবে।
এই উদারীকরণের ফলে বাজারের ব্যাপ্তি বেড়েছে হু হু করে, তা শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রাম্য-শহুরে, চাকুরীজীবি-বেকারের মধ্যেকার সীমানা ঘুঁচিয়ে দিয়েছে; আর সেই পরিমণ্ডলে লিঙ্গের সংঘাত ঘটছে অনেক বেশি। মেয়েদের যেহেতু অগ্রসর নাগরিকদের চোখে এখনও সার্বিকভাবে দেখার অনীহা রয়েছে, তাই তাদের উন্নতি, উদারবাদী জীবনযাত্রা সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না এখনও। বর্বরতার শিকার হলেও অনেক ক্ষেত্রেই দোষ দেখা হচ্ছে নারীরই- তার পোশাকের, জীবনযাত্রার রীতিনীতির।
বিপদ আছে পরিবারের মধ্যেও। বাড়ির মেয়েরাই অনেক সময়ে শিকার হচ্ছে বাড়ির পুরুষেরই বিকৃত কামনার, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েটিকেই দাবিয়ে রাখা হচ্ছে। এর কারণ আগেই বলেছি- সামাজিক সম্মানহানি বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ভয়। গ্রামাঞ্চলে যেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেখানে একটি ধর্ষণের ঘটনার গুরুত্ব অনেক বৃহৎ আকার ধারণ করতে পারে নিমেষে।
রাষ্ট্র কী করবে আইন আনা ছাড়া?
ধর্ষণের মতো একটি জটিল সামাজিক সমস্যা যখন আমাদের অতিষ্ঠ করে তোলে, তখন আর পাঁচটা সমস্যার সমাধান চাওয়ার মতোই আমরা হাত পাতি রাষ্ট্রের কাছে। বিচার চাই। শাস্তি চাই কঠোর। কিন্তু একথা আমাদের না মেনে উপায় নেই যে, শুধুমাত্র কঠোর আইন বানিয়ে অপরাধীদের মনে ভয়ের উদ্রেক করার আশা করা ছাড়া রাষ্ট্রের আর বিশেষ কিছু করার নেই। ধর্ষণ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতিকেন্দ্রিক অপরাধ নয় যে, ব্রিটিশ সরকারের মতো তা আইন করে নিষিদ্ধ করা যাবে। আর নয়তো অষ্টপ্রহর পুলিশি প্রহরার বিধান করতে হবে, যা এককথায় অসম্ভব।
তবু চেষ্টা তো করতেই হয়, আর তার প্রধান দায়ভার নিতে হবে সমাজকেই। প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন বলেন যে, মেয়েদের রক্ষা করতে সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন এবং প্রত্যেক পরিবারকে তাদের পুত্রসন্তানকে শেখাতে হবে আরও দায়িত্বশীল হতে, তখন তার কথাকে সমর্থন করতে হয় বইকি। শুধু আইন করে এই সমস্যার সমাধান হওয়ার নয়।
তাহলে ধর্ষণের প্রতিকার কীভাবে হবে?
ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা না ভেবে আগে আমাদের ধর্ষকের মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার দিকটা বুঝতে হবে। কেউ জন্মেই ধর্ষক হয় না। মানুষের বিকৃত কাম তৈরি হয় তার বড় হওয়ার দিনগুলোতে, আর তার এই মানসিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী তার পরিবার-পরিজনরাই।
ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য এখন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা বাড়ানোর; সম্প্রদায়ভিত্তিক সচেতনতাসূচি তৈরি করে তাতে শামিল করতে হবে শিশু-কিশোরদেরও। হয়তো সেটা তাদের ছোট্ট মনের জন্যে আদর্শ পাঠ নয়, কিন্তু যুগের চাহিদা অনুযায়ী তাদেরকে ছোট বয়স থেকেই তৈরি করতে হবে বিপদকে চিনতে এবং তাকে মোকাবেলা করতে।
পাশাপাশি, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থাকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। আমরা প্রায়ই শুনি, ধর্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের লিঙ্গবিদ্বেষী মন্তব্য; অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদেরকেই অভিযুক্ত হতে দেখা যায় ধর্ষণমূলক অপরাধে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের এইরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা মেনে নেওয়া যায় না, বরং তাদের উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত সর্বাগ্রে।
একইরকমভাবে আধিকারিক, উকিল, পুলিশ এবং বিচারকদেরও তাদের সংবেদনশীলতা এবং সক্রিয়তা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
ধর্ষিত মানুষটি যাতে দ্রুত বিচার পায় তা জরুরিভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আইন আনতে হবে ধর্ষণের সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। বিচারব্যবস্থা দ্রুত হলে আর তার ব্যাপ্তি বড় হলে ধর্ষণের সমস্যা কিছু হলেও কমবে। আর যদি বিচারই বিলম্বিত হয়, তবে ফাঁসির নিয়ম বানিয়েই বা কী হবে?
এছাড়াও ধর্ষণের শিকারদের রক্ষা করতে হবে সামাজিক গ্লানি থেকে- এর জন্যে রিহ্যাবিলিটেশন বা কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন অনেকটাই। ধর্ষণের পরে শিকারকেই লুকিয়ে থাকতে হয়, অপরাধী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়- এই দুর্ভাগ্যজনক চিত্রটা বদলাতেই হবে আর তার জন্যে শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন।
আসলে দার্শনিক মতবাদ শোনালেও আজ সত্যিই সময় হয়েছে সমাজ সংস্কারের। রাষ্ট্রীয় আইন আরও ভালো হোক কিন্তু সামাজিক স্তরে নারীর সম্মান বিস্তারে আমাদের আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তার জন্যে চাই সমাজ, রাষ্ট্রের (হ্যাঁ, সমাজ আগে) এবং ব্যক্তিগত স্তরে যৌথ প্রয়াস এবং সদিচ্ছা। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
Featured Image Source: Jagadeesh NV / EPA / Shutterstock