ইতিহাসে যে ক’জন খলনায়ককে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই যার নাম উঠে আসে তিনি ‘হিটলার’; পুরো নাম অ্যাডলফ হিটলার। তিনি জার্মান নাৎসি বাহিনীর নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীতে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬ মিলিয়নেরও বেশি ইহুদিসহ অগণিত মানুষ হত্যার মূল হোতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে নিন্দিত। হিটলার তার জীবদ্দশায় বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বই ‘মাইন ক্যাম্ফ’।
১৯২৪ সালে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মিউনিখের গণআদালতের বিচারে হিটলারের পাঁচ বছরের জেল হয়, কিন্তু শেষমেষ তাকে ল্যাণ্ডসবার্গ দুর্গে কারাবন্দী অবস্থায় থাকতে হয় মাত্র নয় মাস। হিটলার এই নয় মাসে ল্যাণ্ডসবার্গ দুর্গে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইটি লেখেন। ‘মাইন ক্যাম্ফ’ শব্দদ্বয়ের অর্থ হচ্ছে ‘আমার লড়াই’ বা ‘আমার সংগ্রাম’। বইতে হিটলার তার ছেলেবেলা, বিশ্বাস, স্বপ্ন, আদর্শ এবং জার্মান রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে নিজস্ব মতামত ও বিশ্লেষণ করেছেন। ভিয়েনায় থাকার সময়ে হিটলারকে অভাবের সাথে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিদিন। সেই লড়াইয়ের গল্প খুঁজে পাওয়া যায় এই বইতে। কিন্তু এই বইতে হিটলার তার লড়াইয়ের গল্পের চেয়ে নিজ বিশ্বাস, স্বপ্ন এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়েই বেশি আলাপ করেছেন। ‘মাইন ক্যাম্ফ’ প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে।
হিটলারের জন্ম অস্ট্রিয়ার ব্রানাউ গ্রামে। ছেলেবেলায় তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে একজন সরকারি চাকুরিজীবী হোক, তবে হিটলার তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন শিল্পী হতে। কিন্তু ভিয়েনার একাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। ভিয়েনায় আসার আগে ভিয়েনাকে নিয়ে হিটলারের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ছিল, মা মারা যাওয়ার পর ভিয়েনায় এসে তা খুব তাড়াতাড়িই উবে যায়। তিনি আবিষ্কার করেন যে, ভিয়েনা দেখতে যতই সুন্দর হোক না কেন, তার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ততোধিক যন্ত্রণা।
ছোটবেলা থেকেই হিটলারের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ভিয়েনায় থাকাকালে তিনি প্রচুর বই পড়েছেন। তার বই পড়া কেবল স্রেফ বই পড়াই ছিল না, তিনি ছিলেন বইয়ের সিরিয়াস পাঠক। বই পড়া নিয়ে তিনি বলেছেন,
আমি এমন অনেককে জানি যারা বইয়ের পর বই, পাতার পর পাতা পড়ে চলে, তবু আমি তাদের পাঠক বলি না। হয়তো বা তারা অনেক পড়েছে। কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা কোথায়, যা তারা পড়েছে বা পড়ছে?… তাদের অবস্থা আগেরটা পড়ে তো পরেরটা ভোলে; তারপর আবার সেটা পড়ে। আর নইলে সমস্ত ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয় মাল বোঝাই জাহাজের মতো মাথা ভারী করে।
ইতিহাস নিয়ে লেখাপড়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
ইতিহাসের অর্থ হলো কোনো বিশেষ ঘটনা কেন এবং কীভাবে একটা জাতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেটা জানা। আর ইতিহাস পড়া উচিত– বিশেষত দরকারি জিনিস মনে রাখা, অদরকারি বিষয় ভুলে যাওয়া।
একজন স্বৈরাচারী জনবিচ্ছিন্ন শাসকের নির্মম পতন যে অবশ্যম্ভাবী তার উল্লেখ করতেও ভোলেননি তিনি; যদিও ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করা হিটলার সমস্ত ফ্যাসিজমের পতাকাবাহীর মতো নিজেই ইতিহাসের সেই শিক্ষা ভুলে গিয়েছিলেন।
হিটলার উগ্র-জাতীয়তাবাদী ছিলেন, এটি তার রাজনৈতিক আদর্শের মূল বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত জার্মান সেনাদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন হিটলার। তার এই বইটিও উৎসর্গ করা হয়েছে কয়েকজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জার্মানকে। ছোটবেলা থেকেই জার্মানির ইতিহাস পড়তে ভালোবাসতেন হিটলার। আজীবন সমগ্র জার্মান জাতিকে এক পতাকাতলে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প ছিল না তার কাছে। ‘জার্মান’ বলতে হিটলার কেবল জার্মানির মূল ভূখণ্ডের জনগণকেই বোঝাননি, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যত জার্মান রয়েছেন তাদের সবাইকে এক জাতি এবং এক রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে কল্পনা করেছেন তিনি। এই এক ও অদ্বিতীয় জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্ন দেখতেন হিটলার।
হাল আমলের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইনের’ মতো হিটলারও জার্মানদের সারা দুনিয়ার উপর প্রভুত্ব কায়েমের স্বপ্ন দেখতেন এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যত কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে, সেটা ন্যায় বা অন্যায় যা-ই হোক না কেন, তা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অর্থাৎ ছলছাতুরী কিংবা ক্ষমতাবলে, যেকোনো উপায়েই জার্মান জাতির এই পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করার পক্ষে ছিলেন তিনি। তার জাতীয়তাবাদের আদর্শ এত প্রকট ছিল যে, তিনি বইয়ের বেশ কয়েক জায়গায় শান্তিকামী মানবতাবাদীদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি।
বিরোধীমতকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না হিটলার। গণতন্ত্র থেকে শুরু করে মার্কসবাদ– সবকিছুর তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। তার কাছে জার্মানির গৌরব পুনরুদ্ধারের একমাত্র পথ জার্মান জাতির ঐক্য এবং লড়াই৷ মার্কসবাদ এবং বামপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন এই বইয়ে। গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “সংখ্যাধিক্য শুধু অজ্ঞতাই প্রকাশ করে না, কাপুরুষও হয় বটে।” গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, “এটা অকল্পনীয় যে, যারা যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, তারাই আবার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণেও দক্ষ; অবশ্য যদি না এরা প্রতিভাসম্পন্ন হয়।”
হিটলারের কথা বলতে গেলে যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় তা হচ্ছে ইহুদীবিদ্বেষ। জার্মানির অধঃপতনের জন্য তিনি সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে যে ক’টি দিক তুলে ধরেছেন, তার একটি কারণ ইহুদী-সমস্যা। ভিয়েনায় থাকাকালে তিনি লিখেছেন, “এই সময়ে আমি জাতির অস্তিত্বের পক্ষে দুটো বিপদ উপলব্ধি করতে পারি। একটি মার্কসবাদ, আরেকটি জুডাইজম বা ইহুদি ধর্মমত।”
বইয়ের বড় অংশ জুড়ে হিটলার ইহুদিদেরকে তার মতো করে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কোথাও তিনি তাদের ‘পরগাছা’ বলেছেন, কোথাও বা তাদের ‘অ-জার্মান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হিটলারের বেড়ে ওঠার সময়ে জার্মানির সব জায়গায় ইহুদিদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণ থেকে ব্যবসা, মিডিয়া কোনোকিছুই ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ছিল না। যেহেতু সবক্ষেত্রেই ইহুদিদের প্রভাব ছিল, তাই হিটলার জার্মান জাতির সমস্ত অধঃপতনের জন্য অবধারিতভাবেই ইহুদিদের দায়ী করেছেন। হিটলার অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন- এই বই এমন কোনো দলিল পেশ করে না। সুতরাং তার প্রবল ইহুদিবিদ্বেষের ক্ষেত্রে কোন জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে তা জানা যায় না।
হিটলার ভালো চিত্রশিল্পী ছিলেন। চিত্রের প্রতি তার ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায় এই বইয়ের প্রথমদিকেই। ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করলেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হিটলারের আঁকা বেশ কিছু চিত্রও খুঁজেও পাওয়া যাবে। এছাড়া হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধে তার যোগদান এবং যুদ্ধোত্তর সময়কে বিশ্লেষণ করেছেন এই বইয়ে ।
হিটলার কোনো বিচ্ছিন্ন ফ্যাসিস্ট নন, পৃথিবীজুড়ে সমস্ত ফ্যাসিস্টদের চরিত্র প্রায় একই রকম। তাই তার ভাবনা-চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ থেকেও এই বই পড়া যেতে পারে।