যেকোনো খেলাতেই স্বাগতিক দেশ কিছুটা বাড়তি সুবিধা পায়। খেলাধুলায় দর্শক সমর্থন সবসময়ই খেলোয়াড়দের বাড়তি উদ্দীপনা দেয় আর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দেরকে দেয় ভড়কে। তবে অন্যান্য যেকোনো খেলার চেয়ে তুলনামূলকভাবে ফুটবলে স্বাগতিক দল বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়দের মাঝে বোঝাপড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের মাঠে প্র্যাকটিস সেশনে এই বোঝাপড়া করার সময়টা একটু বেশিই পায় স্বাগতিক দল। এছাড়া অনেক সময়েই বাইরের অচেনা পরিবেশে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারে না অনেক মানুষ। এসব ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বেশ ভালো প্রভাব ফেলে খেলোয়াড়দের পারফর্মেন্সে।
ঠিক এসব কারণেই দুই লেগের খেলায় অ্যাওয়ে গোলকে বাড়তি মূল্যায়ন দেওয়া হয়। তাছাড়া ফলাফল দেখলেও বোঝা যায় যে, অনেক ছোট দলও স্বাগতিক হবার সুবিধাটা বেশ ভালোভাবে কাজে লাগায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাগতিক হবার এই সুবিধা একটি দল তখনই কাজে লাগাতে পারে যখন দুটি দলের মাঝে শক্তির পার্থক্য খুবই সামান্য থাকে।
একইসাথে আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, স্বাগতিক হবার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু কেবলই টুর্নামেন্টে ভালো খেলা নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক বাণিজ্যিক বিষয়। যে দেশে টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় সেই দেশ বাণিজ্যিকভাবে বেশ লাভবান হয়। এছাড়া বিশ্ব দরবারে নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পারাটাও স্বাগতিক হবার একটি বড় সুবিধা।
কোপা আমেরিকার ৪৪টি আসরের মাঝে স্বাগতিক দলের একুশবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াই প্রমাণ করে যে, চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য স্বাগতিক হতে পারাটা একটি বাড়তি সুবিধাই। চলুন, চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক কোপা আমেরিকায় স্বাগতিক দেশগুলোর পারফর্মেন্সের দিকে।
আর্জেন্টিনা
কোপা আমেরিকা সর্বপ্রথম আয়োজন করেছিল আর্জেন্টিনা, এ পর্যন্ত সবচাইতে বেশি স্বাগতিক হয়েছে আর্জেন্টিনাই। মোট নয়বার তারা নিজেদের মাঠে কোপার আয়োজন করে। প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও পরবর্তীতে ছ’বারই (১৯২১, ১৯২৫, ১৯২৯, ১৯৩৭, ১৯৪৬ ও ১৯৫৯) তারা চ্যাম্পিয়ন হয়।
সর্বাধিক নয়বার স্বাগতিক হয়ে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হবার পাশাপাশি রানার্স আপ (১৯১৬) হয় একবার। বাকি দুবারের মাঝে একবার (১৯৮৭) ৪র্থ হয় আর একবার (২০১১) গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ে।
উরুগুয়ে
কোপা আমেরিকার সবচেয়ে সফল দল উরুগুয়ে। পনেরবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে এখন পর্যন্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে তারা। স্বাগতিক হিসেবেও সবচাইতে সফল দল তারা।
সাতবার (১৯১৭, ১৯২৩, ১৯২৪, ১৯৪২, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৯৫) কোপা আয়োজন করে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা।
চিলি
উরুগুয়ের মতো চিলিও কোপা আয়োজন করেছে সাতবার, তবে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে মাত্র একবার (২০১৫)। এটা অবশ্য চিলির ব্যর্থতা নয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ের মতো শক্তিশালী ফুটবল ঐতিহ্য নেই তাদের। স্বাগতিক হয়ে একবার রানার্স আপ (১৯৫৫), চারবার তৃতীয় (১৯২৬, ১৯৪১, ১৯৪৫ ও ১৯৯১) এবং একবার চতুর্থ (১৯২০) হওয়াকে তাই সফলতাই বলা যায় চিলির মতো দলের সামর্থ্য বিবেচনায়।
পেরু
১৯১৬ থেকে ১৯২৬, প্রথম দশটি কোপা আমেরিকায় অংশগ্রহণ করেনি পেরু। ১৯২৭ সালের কোপায় প্রথমবারের মতো তারা অংশ নেয়, সেটাও স্বাগতিক হিসেবে। প্রথমবারই তৃতীয় হয়ে চমকে দেয় সবাইকে। এক আসর পরেই ১৯৩৫ সালে আবারও স্বাগতিক হয়ে তৃতীয় হয় পেরু। মাঝের আরেক আসর বাদ দিয়ে তৃতীয়বারের মতো ১৯৩৯ সালে স্বাগতিক হয় পেরু। তবে এবার আর আগের দুবারের মতো ভুল করেনি তারা। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় তারা আর কোপাও পায় একটা নতুন চ্যাম্পিয়ন দেশ।
সেবারের পর আরো তিনবার আয়োজক হয়েছিল পেরু। কিন্তু একবার গ্রুপ পর্ব (১৯৫৩), একবার চতুর্থ (১৯৫৭) আর একবার কোয়ার্টার ফাইনাল (২০০৪) খেলাটাই ছিল তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য।
ব্রাজিল
বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সর্বাধিক পাঁচবার। এছাড়া বিশ্ব ফুটবলেও ব্রাজিল প্রথম সারির দলের মাঝেই পড়ে। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের সাফল্য খুবই কম। উরুগুয়ের পনেরবার এবং আর্জেন্টিনার চৌদ্দবার চ্যাম্পিয়ন হবার পাশাপাশি ব্রাজিলের মাত্র আটবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যেকোনো বিচারেই বিস্ময় জাগানিয়া।
তবে একটা সময় পর্যন্ত কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টটাকে খুব বেশি মূল্যায়ন করতো না ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন। এই কারণে পেলের মতো খেলোয়াড়ও মাত্র একবার কোপার দলে সুযোগ পেয়েছিলেন।
তবে স্বাগতিক হিসেবে ব্রাজিল বেশ সফল। চারবার (১৯১৯, ১৯২২, ১৯৪৯ ও ১৯৮৯) টুর্নামেন্ট আয়োজন করে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। ব্রাজিলের আটবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রথম চারবারই স্বাগতিক হিসেবে অর্জিত।
ইকুয়েডর
১৯৪৭ সালের কোপায় প্রথমবারের মতো স্বাগতিক হয় ইকুয়েডর। প্রথমবার গ্রুপপর্ব থেকে ছিটকে গেলেও পরের দুবার (১৯৫৯ ও ১৯৯৩) তারা চতুর্থ হয়, যা কি না কোপা আমেরিকায় এই পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য।
বলিভিয়া
বলিভিয়া মাত্র দুবার আয়োজক হয়েছে। এর মাঝে প্রথমবার (১৯৬৩) স্বাগতিক হয়েই তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। পরবর্তীতে আরেকবার (১৯৯৭) স্বাগতিক হয়েও তারা রানার্স আপ হবার গৌরব অর্জন করে। স্বাগতিক বাদে কোপা আমেরিকায় বলিভিয়ার সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯২৭ ও ১৯৪৯ সালে চতুর্থ হওয়া।
কলম্বিয়া
বিশ্ব ফুটবলে অ্যাসপ্রিলা, ভালদেরামা, হামেস রদ্রিগেজ, রামাদেল ফ্যালকাওদের মতো কিংবদন্তী ফুটবলার উপহার দিলেও সেই অনুযায়ী ফুটবল ইতিহাসে তাদের সাফল্য কম। কোপা আমেরিকাতে মাত্র একবার (২০০১) তারা চ্যাম্পিয়ন হয়, সেটাও আয়োজক হিসেবে।
এর বাইরে কোপা আমেরিকাতে কলম্বিয়ার সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ১৯৭৫ এর আসরে রানার্স আপ হওয়া।
প্যারাগুয়ে
প্যারাগুয়ে আয়োজক হয়েছিল মাত্র একবার (১৯৯৯)। গ্রুপপর্বে সেবার বেশ ভালোই খেলেছিল তারা। পেরু, বলিভিয়া আর জাপানের গ্রুপ থেকে দুই জয় আর এক ড্র নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের পর্বে ওঠে তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে প্রথমে গোল করে এগিয়েও যায়, কিন্তু পরবর্তীতে উরুগুয়ে গোল করে ম্যাচে ফিরে আসে এবং শেষপর্যন্ত টাইব্রেকারে প্যারাগুয়ে পরাজিত হয়।
ভেনিজুয়েলা
ভেনিজুয়েলা স্বাগতিক হয়েছিল একবার (২০০৭)। সেবার তাদের গ্রুপের অন্য তিনটি দল ছিল পেরু, বলিভিয়া এবং উরুগুয়ে। এই গ্রুপ থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের পর্বে যেতে পারাটাই ভেনিজুয়েলার জন্য এক বিশাল অর্জন। তবে ভেনিজুয়েলার সফর শেষ হয়ে যায় পরের পর্ব অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালেই।
যুক্তরাজ্য
কোপা আমেরিকার শতবর্ষী টুর্নামেন্ট আয়োজন করে অতিথি দেশ যুক্তরাজ্য। চারবার টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তাদের সর্বোচ্চ সফলতা আসে এই টুর্নামেন্টেই। এই টুর্নামেন্টে চতুর্থ হয়েছিল যুক্তরাজ্য।
অন্যান্য
১৯৭৫, ১৯৭৯ ও ১৯৮৩ সালের কোপা আমেরিকার ফরম্যাট একটু ভিন্নধর্মী ছিল। সেই তিনটি টুর্নামেন্টে নির্দিষ্ট কোনো স্বাগতিক দল ছিল না। প্রতিটি দলই হোম এবং অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে খেলে। ১৯৭৯ ও ১৯৮৩ সালের ফাইনাল ম্যাচও দুই লেগের হয়েছিল।
পরিশিষ্ট
২০১৯ সালের কোপা আমেরিকার স্বাগতিক দেশ ব্রাজিল। এর আগে চারবার কোপার স্বাগতিক হয়ে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন হলেও এবার টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই দলের সেরা তারকা নেইমারের ইনজুরিতে বেশ বড় ধরনের ধাক্কাই খেয়েছে তারা। সেই ধাক্কা সামলে তারা চ্যম্পিয়ন হতে পারে কি না সেটা দেখার জন্য ৭ জুলাইয়ের ফাইনাল ম্যাচ পর্যন্ত আপাতত দর্শকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।