
২০১৮ সালে ফুটবল বিশ্ব একগাদা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে প্রীতি ম্যাচের ব্যাপারটি একদম গৌণ হয়ে ওঠা। সে বছর উয়েফা একটি নতুন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারা সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে এই প্রীতি ম্যাচগুলোকে সরিয়ে ফেলে। ‘উয়েফা নেশন্স লিগ’ নামের নতুন এই প্রতিযোগিতাটি শুরু হয়। দলগুলোকে একটি প্রতিযোগিতার ভেতরে রেখে পরবর্তী ইউরো ও বিশ্বকাপের জন্য তাদের সঠিক বিকাশ ও উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় দলগুলোও এতে আগ্রহী ছিল।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর যখন ক্লাবগুলোর খেলার বিরতির মাঝে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় আসে, আমরা তখন দেখেছিলাম ইউরোপের দলগুলো এই প্রীতি ম্যাচের পরিবর্তে নেশন্স লিগে অংশ নিচ্ছে। আসলে এই নেশন্স লিগটির আবির্ভাবই হয়েছিল এই প্রীতি ম্যাচগুলোর পরিবর্তে, যাতে করে এই ম্যাচগুলো আরো বেশি জমজমাট হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো মাঠে গড়ায় এটি, যার সেমিফাইনাল ও ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পর্তুগালে। ইউরোপের ফুটবল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা উয়েফার অধীনে পরিচালিত এই দ্বিবার্ষিক প্রতিযোগিতাটি এই পর্যন্ত দু’বার অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম আসরে বিজয়ী হয়েছিল পর্তুগাল, দ্বিতীয়বার ফ্রান্স।

কীভাবে এলো নেশন্স লিগ?
উয়েফার অধীনে থাকা জাতীয় দলগুলো সাধারণত ২টি পূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। একটি হলো বিশ্বকাপ, অন্যটি ইউরো। এর মাঝে তারা বিশ্বকাপ বাছাই ও ইউরোর বাছাইপর্ব খেলত। এর বাইরে যে সময়টা থাকত, তাতে তারা নিজেদের মধ্যে প্রীতি ম্যাচ খেলত। কিন্তু এইসব ‘গুরুত্বহীন’ খেলাগুলোকে দলগুলোও হালকাভাবে নিত। তাদের মূল খেলোয়াড়দের বাইরে রেখে বিভিন্ন পরীক্ষা চালাতো তারা। আর জমজমাট ক্লাব মৌসুম চলার মাঝে এই ‘ম্যাড়ম্যাড়ে’ আন্তর্জাতিক বিরতি থেকে দর্শকরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল দলগুলোর এই হালকাভাবে খেলার কারণে। তাদের প্রচারসহ অন্যান্য স্পন্সরে যারা ছিলেন, তাদেরও দিন দিন লাভের পরিমাণ কমছিল।
উয়েফা যে মূল দুইটি প্রতিযোগিতার বাইরে আরো একটি প্রতিযোগিতার কথা ভাবছে, তা প্রথম নিশ্চিত করেন নরওয়েজিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইংভ হ্যালেন।
নেশন্স লিগ কীভাবে চলবে, তার ধারণাও চলে আসে সে সময়। উয়েফার অধীনে যে ৫৫টি দেশ রয়েছে, তারা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হবে তাদের সাম্প্রতিক সময়ের পারফরম্যান্সের র্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে। সেখানে থাকবে প্রমোশন ও রেলিগেশন। বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জন্য যে সময় বরাদ্দ থাকত, ওই সময়েই তার পরিবর্তে চলবে এই নেশন্স লিগ।

সচরাচর দুর্বল দলগুলোর খেলা দর্শকরা খুব কম দেখে। তার উপর অসম শক্তির দুই দল যখন মুখোমুখি হয়, তখন বেশিরভাগ সময় খেলা হয়ে যায় একপেশে। এতে করে পেছনের সারির দলগুলো দর্শক হারাচ্ছিল, সেই সাথে হারাচ্ছিল সম্প্রচার থেকে তাদের আয়। এখন যেহেতু সবগুলো দেশ একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে, সেখানে সম্প্রচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি হবে সেই প্রতিযোগিতার হর্তাকর্তাদের সাথে, ওই দেশগুলোর সাথে নয়। তখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিশ্চিতভাবেই সকল দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাকাউন্টেই যাবে।
এ সকল দিকের কথা চিন্তা করে ২০১৪ সালের ২৭শে মার্চ কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় উয়েফা কংগ্রেসে উয়েফা নেশন্স লিগের প্রস্তাবনা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তবে ২০১২ সালে উয়েফা আর ইউরোপীয় ক্লাব অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যেখানে তারা ঠিক করে যে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে প্রীতি ম্যাচের সংখ্যা বছরে ১২টি থেকে ৯টিতে কমিয়ে আনা হবে। এভাবে চলতে চলতেই আসলে নেশন্স লিগের উত্থান।
নেশন্স লিগ কীভাবে পরিচালিত হয়?
প্রচলিত অন্যান্য মুখ্য প্রতিযোগিতাগুলোর সাথে এই উয়েফা নেশন্স লিগের পার্থক্যগুলো এটি চালু হওয়ার সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে। যেখানে অন্য ইউরোপীয় প্রতিযোগিতাগুলো শুরু হয় একটি বাছাইপর্ব দিয়ে, সেখানে এই নেশন্স লিগটির খেলাগুলো হয় লিগের মতো কাঠামো দিয়ে, যেখানে রয়েছে উত্তরণ ও অবনমনের সুযোগ।
যখন এই টুর্নামেন্টের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তখন আলাদা করে একটি ফরম্যাট ঠিক করা হয় এর জন্য। উয়েফার সদস্য ৫৫টি দেশই একযোগে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তারা চারটি কোয়ার্টারে ভাগ হয় প্রথমে। এই ভাগটি করা হয় নেশন্স কো-এফিসিয়েন্ট র্যাংকিংয়ে তাদের অবস্থান অনুযায়ী, যেহেতু সে সময় কোনো প্রমোশন-রেলিগেশনের সুযোগ ছিল না। এই কোয়ার্টারগুলোকে বলা হয় লিগ। A, B, C, D – এভাবে চারটি লিগ হয়। A লিগে দল ছিল ১২টি, B লিগে দল ছিল ১২টি, C লিগে দল ছিল ১৫টি, এবং D লিগে দল ছিল ১৬টি করে। এরপর এই লিগে থাকা দলগুলোকে আবার কোয়ার্টারে থাকা দলের সংখ্যা অনুযায়ী ৩-৪টি দলের সমন্বয়ে গ্রুপে ভাগ করা হয়। র্যাংকিংয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা দলগুলো একই গ্রুপে থাকে। গ্রুপগুলোকে Group-1, Group-2… এভাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রথম দুই লিগের প্রতিটি গ্রুপে দল ছিল ৩টি করে, পরের দুই লিগের প্রতি গ্রুপে দল ছিল ৪টি করে, তবে C লিগে কেবল একটি গ্রুপে দল ছিল ৩টি।

গ্রুপের দলগুলো নিজেদের মধ্যে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে খেলে গ্রুপে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেয়। এরপর লিগ A-তে থাকা দলগুলো যার যার গ্রুপে প্রথম হয়ে আবার চার দলের একটি সেমিফাইনাল টুর্নামেন্ট খেলে। সেখানে থেকে আবার দু’টি দল খেলে ফাইনাল, অন্য দু’টি দল খেলে তৃতীয় স্থান নির্ধারনী খেলা। এভাবে এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া লিগ B, C, D-তে যারা নিজ নিজ গ্রুপে সবার উপরে থাকবে, তারা প্রমোশন পাবে উপরের সারির লিগগুলোতে। অন্যদিকে গ্রুপ A, B, C থেকে যারা নিজেদের গ্রুপে সবার নিচে থাকবে, তারা রেলিগেট হয়ে যাবে পরের লিগে।

২০২০-২১ মৌসুম থেকে আবার পরিবর্তন আসে এই ফরমেটে। দ্বিতীয় মৌসুমের জন্য উয়েফা ঠিক করে A, B, ও C লিগে দল থাকবে ১৬টি, এবং D লিগে দল থাকবে মাত্র ৭টি। নতুন এই সিস্টেমে D লিগে গ্রুপ মাত্র দু’টি থাকায়, C লিগ থেকে কারা রেলিগেট হয়ে কোন গ্রুপে যাবে তা নির্ধারিত হবে আবার একটি প্লে-আউট খেলে। D লিগে সুযোগ থাকবে সেরা তৃতীয় দলেরও প্রমোশন পাওয়ার।
বেশ কিছু নিয়মে এককালীন পরিবর্তন আনার সময় এই নিয়মটাও তার মধ্যে চলে আসে। উয়েফার দেশগুলোর প্রীতি ম্যাচের সংখ্যা আরো কমিয়ে নতুন এই ফরমেটে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচের সংখ্যা ১৩৮টি থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হয় ১৬২টিতে।
এটি কি ইউরো এবং বিশ্বকাপ খেলতে পারার সহায়ক হবে?
উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার জন্য একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে এই নেশন্স লিগ। ইউরো খেলতে হয় একটি বাছাইপর্ব পার করে। বাছাইপর্বের ১০টি গ্রুপ থেকে ২০টি দল সরাসরি ইউরোতে খেলতে পারে। অনেক দেশই বাছাইপর্বের গণ্ডি পার হতে পারে না। তারা যদি সরাসরি ইউরোতে কোয়ালিফাই করতে না পারে, তবে তারা যদি নেশন্স লিগে নিজ নিজ গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়, তবে তাদের জন্য সুযোগ থাকবে প্লে-অফ খেলার। এই প্লে-অফ থেকে বাকি চারটি দল কারা হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন যদি আগেই ইউরো খেলার সুযোগ পেয়ে থাকে, তবে গ্রুপে তার পরের দলটি প্লে-অফ খেলার সুযোগ পাবে। এইভাবে চলতে থাকবে। ইউরো ২০২০-এর ২৪টি দল এভাবেই বাছাই করা হয়েছিল। ১২টি আলাদা আলাদা দেশে পুরো টুর্নামেন্ট হওয়া এবারের টুর্নামেন্টে স্বাগতিক দলের জন্য গ্রুপপর্বে নিশ্চিত কোনো স্থান ছিল না।

শুধু ইউরো না, নেশন্স লিগ ইউরোপের দলগুলোকে সাহায্য করবে বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্যও। সচরাচর ইউরোপের দলগুলো ১০টি গ্রুপে ভাগ হয়ে বাছাইপর্ব খেলে, যেখানে শুধু গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়। ঐ ১০টি গ্রুপের ১০টি রানারআপ দেশ আবার একটি প্লে-অফ রাউন্ড খেলে। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের জন্য এই ১০টি দলের সাথে যুক্ত হবে আরো ২টি দল। এই দু’টি দল হবে নেশন্স লিগের নিজ নিজ গ্রুপে শীর্ষে থাকা সেরা দেশগুলোর দুইটি। নেশন্স লিগের ওভারঅল র্যাংকিং বিবেচনায় এই দু’টি দল কারা হবে, তা ঠিক করা হবে। তখন এই ১২টি দল তিন ভাগে ভাগ হয়ে ২ লেগের ২টি সেমিফাইনাল খেলবে। এরপর সেখান থেকে ৩টি ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। যে ৩টি দল এই ফাইনালে জিতবে, তারাই বিশ্বকাপের মূল পর্বে চলে যাবে।
ফুটবল বিশ্বে এই টুর্নামেন্ট নিয়ে প্রতিক্রিয়া কেমন?
এই প্রতিযোগিতাটি যদিও অনেক ক্ষেত্রে দর্শকদের কাছ থেকে পজিটিভ রিভিউই পেয়েছে, তবুও ফুটবল-সংশ্লিষ্ট অনেকেই রয়েছেন যাদের কাছে এই নেশন্স লিগের ব্যাপারটি ভাল লাগেনি। এই সমালোচনাকারীদের মধ্যে রয়েছেন লিভারপুলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তার মতে, এটি ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রতিযোগিতা’। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পরই মাত্র ২ সপ্তাহের বিরতি দিয়ে খেলোয়াড়দের আবার মাঠে নামতে হয়। ক্লাবের খেলার বিরতিতে আন্তর্জাতিক খেলাগুলো হয়। অনেক দেশই তাদের কিছু খেলোয়াড়দের এই প্রীতি ম্যাচগুলোতে ছাড় দেয়। তাতে করে ক্লাবের খেলার মাঝে তারা কিছু সময় বিশ্রাম নিতে পারে। কিন্তু এই নেশন্স লিগ শুরু হওয়ার পর ইউরোপের দেশগুলো তাদের মূল খেলোয়াড়দের কোনোভাবেই বিশ্রাম দিতে চাচ্ছে না। এতে করে সেই খেলোয়াড়কে টানা দেশ ও ক্লাবের হয়ে খেলতে হয়। বিশ্রামের এই অভাব তখন ফুটে উঠে তাদের ফর্ম আর ফিটনেসে। ক্লপের আপত্তি ছিল এখানেই যে তার লিভারপুলের মূল খেলোয়াড়দের বিশ্রাম ছাড়াই আবার জাতীয় দলে খেলতে হচ্ছে।
এ পর্যন্ত নেশন্স লিগের দুইটি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে হওয়া প্রথম টুর্নামেন্টটি জিতে নেয় পর্তুগাল, সেখানে রানারআপ হয় নেদারল্যান্ডস। ইংল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ড যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ হয়। এরপরের ২০২০-২১ মৌসুমের নেশন্স লিগের বিজয়ী হয় ফ্রান্স। ফাইনালে তারা স্পেনকে হারায় ২-১ গোলে। এই মৌসুমে তৃতীয় হয় ইতালি ও চতুর্থ হয় বেলজিয়াম।

নেশন্স লিগের পরবর্তী প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হবে ২০২২-২৩ মৌসুমে। চার লিগের গ্রুপগুলোতে থাকা দলগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন না আসায় তেমন কোনো চমক দেখার সম্ভাবনা তুলনামূলক কম। তবে কাছাকাছি মানের দলগুলোর মধ্যে খেলা হওয়াতে খেলাগুলোতে খুব হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হয়। এতে করে অন্যদের অনুভূতি কেমন তা জানা না গেলেও দর্শকরা যে খুবই উপভোগ করবে, তা আশা করাই যায়। হয়তো সেখানে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে না, তবে দুই সিংহের লড়াই দেখে যে মজা পাওয়া যায়, তা কি কোনো সিংহের সাথে শেয়ালের লড়াই দেখে পাওয়া যাবে? দর্শকদের কাছে তো বিনোদনটাই মুখ্য!