কথিত আছে, আগেকার দিনে কেউ যখন কোনো রাজ্য আক্রমণ করতো, তখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলে, পরাজিত রাজ্যের সহায়-সম্পদ লুট করার পাশাপাশি তাদের জ্ঞানার্জনের উপাদান তথা বই-পত্র ও গ্রন্থাগারে আগুন লাগিয়ে দিতো। ইতিহাসের বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, আধুনিক যুগে এসেও এমন বর্বরতা বন্ধ হয়নি। আইএস এর হাতে ইরাক পদানত হলে, দেশটির কমপক্ষে তিনিটি গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে মসুল বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, আনবার প্রদেশের প্রাদেশিক গণগ্রন্থাগার, মসুলের জাতীয় গণগ্রন্থাগার ‘সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি ইন নিনওয়া’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বলে রাখা ভালো, ইরাক ছিল মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ফলে এসব গ্রন্থাগারে অসংখ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও দলীল সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবী নিমিশেই তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হারিয়ে ফেলেছে।
শুধু ইরাক নয়, ২০১৪ সালের শুরুর দিকে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে অবস্থিত সােহ লাইব্রেরিতে কারা যেন আগুন লাগিয়ে দেয়। গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ৮০,০০০ বই সংরক্ষিত ছিল। একই বছর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার জাতীয় গ্রন্থাগার ‘সার্জাভো ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে’ আগুন লাগিয়ে অসংখ্য ঐতিহাসিক দলীলপত্র ও বই ধ্বংস করে ফেলা হয়। খেয়াল করলে দেখা যায়, যে সকল অঞ্চলের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংস করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। ২০১১ সালের কথা। সিরিয়ায় তীব্র আসাদ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে। ঠিক এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাজপথে পারস্পারিকভাবে পরিচিত হলেন তিন বন্ধু। দেশটির রাজধানী দামেস্কের নিকটবর্তী দাড়ায়া শহরে তাদের বসবাস। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে তারা অনুমান করলেন, আসন্ন দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কট তাদের জ্ঞানার্জনের অন্যতম উৎস গ্রন্থসমূহকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। এজন্য তারা গ্রন্থ সংরক্ষণের কোনো উপায় খুঁজতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে তাদের মাথায় দারুণ একটি আইডিয়া আসলো। তারা একটি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রন্থাগার’ গড়ে তোলার চিন্তা করলেন। সেই অনুসারে, তারা বই সংগ্রহ শুরু করলেন। তাদের কার্যক্রম ধীরে ধীরে আগাচ্ছিল।
২০১৪ সালের কথা, দাড়ায়া শহর তখন বিদ্রোহীদের দখলে। বিদ্রোহীদের দমনে আসাদ বাহিনী তখন পাল্টা হামলা চালতে শুরু করলো। হামলায় অসংখ্য বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়ে যেতে থাকলো। তিন বন্ধু এই সময়কে বই সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় মনে করলেন। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন ভবনের মাদরাসা, মসজিদ, স্কুল, কলেজ, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তিগত লাইব্রেরিতে থাকা অবশিষ্ট বই উদ্ধার কাজ শুরু করলেন। তখনো দাড়ায়া শহরে আসাদ বাহিনীর কড়া নজরদারি। এর মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এ কাজ করতে থাকলেন।
ক্রমশ তাদের গ্রন্থভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকলো। বিভিন্ন বিষয়ের প্রায় ১৫,০০০ বই সংগ্রহ করে ফেললেন তারা। ২০১৬ সালের দিকে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যেতে থাকলো। মাথার উপর অবিরত বোমা আছড়ে পড়ছে। চারিদিকে মানুষের আহাজারি ও রক্তের স্রোত। যদিও এর আগে সাধারণ মানুষকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এলাকা ত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছিল, কিন্তু নানা বাস্তবতায় দাড়ায়ার ৮০,০০০ মানুষের মধ্যে মাত্র ৮,০০০ মানুষ এলাকা ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিন বন্ধু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রন্থাগার বিনির্মাণের স্বপ্নে এলাকা ত্যাগ করেননি। এ সময় আসাদ বাহিনীর নির্মম হামলায় প্রায় ২,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়।
পরিস্থিতি যখন খুব ঘোলাটে। আকাশে আসাদ বাহিনীর জঙ্গি বিমান, মূহুর্মূহু বোমা হামলা, তখনো তিন বন্ধু ও তাদের সাথে যোগ দেওয়া স্বেচ্ছাসেবকরা ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে বই উদ্ধার করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আসাদ বাহিনীর হামলায় তিন বন্ধুর অন্যতম ওমর আবু আনাস নিহত হয়; যদিও সত্যিকার অর্থেই আনাস আসাদ বিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। এর ফলে গ্রন্থাগারটি কিছু দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু কিছুদিন পরই আরেক বন্ধু আনাস আহমাদের উদ্যোগে গ্রন্থাগারটি পুনরায় চালু হয়। তারপরও তারা তাদের বই সংগ্রহের লড়াই অব্যহত রাখেন। এ সময় অনেকে স্বেচ্ছায় বই দান করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু এই বই উদ্ধারের ঘটনা মোটেও সহজ ছিল না। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আনাস আহমাদ বলেন-
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আমরা বোমা কিংবা মটার শেলের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর থেকে বই সংগ্রহ করেছি। এসবের অধিকাংশ জায়গা ছিল ফ্রন্ট লাইনের কাছাকাছি। সুতরাং আমাদের বই সংগ্রহের কাজটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন-
আঘাত প্রাপ্ত ভবন থেকে বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসার সময় আমাদের খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো। স্নাইপারদের হাত থেকে নিজেদের লুকানো ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কেননা প্রায়ই তারা আমাদের অনুসরণ করার চেষ্টা করতো এবং পরবর্তীতে আমরা কী পদক্ষেপ নেই তার উপর নজরদারি রাখতো।
বর্তমানে আনাস আহমাদ ও তার বন্ধুদের উদ্যোগে গঠিত এই গ্রন্থাগারটি দাড়ায়ার অধিবাসীদের জন্য আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তারা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে বই পড়তে আসেন। শুধুমাত্র বই নয়, গ্রন্থাগারটিকে কেন্দ্র করে নানা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এমনকি শিশুদের জন্য খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়।
গ্রন্থাগারটিতে এখন বেশ কয়েকজন যুবক স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। এর মধ্য অন্যতম উদ্যোক্তা আনাস আহমেদ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন; সাদি নামের একজন স্থানীয় সাংবাদিক সবকিছু ডকুমেন্টেশনের দায়িত্বে আছেন এবং হুসাইন নামের এক যুবক পাঠকদের সামগ্রিক বিষয় দেখাশোনা করছেন। আর সবাইকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন আমজাদ নামের এক ১৪ বছর বয়সী বালক। যিনি সহকারী গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে গ্রন্থাগারের সম্মুখ কক্ষে অবস্থান করতেন এবং কেউ অনুসন্ধান বা আক্রমণ করতে আসলে তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফিরিয়ে দিতেন (বয়স কম হওয়ায় এ সুযোগ পেয়েছেন)।
যুদ্ধ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে গ্রন্থাগারটির কাজের পরিধি আরও বৃদ্ধি পায়। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে গ্রন্থাগারটি যেন এখন একটি প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় শোভা বর্ধন করছে। গ্রন্থাগারটি পরিদর্শনে গিয়ে আল জাজিরার বিশিষ্ট সাংবাদিক ডেলপাইন মিনউই লিখেছেন-
আমি সেখানে গিয়ে দেখি প্রায় ৪০ জন যুবক পড়াশোনা করছেন। যুদ্ধ তাদের স্বপ্নকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। তারা সেই ভঙ্গুর স্বপ্ন পুনরায় বিনির্মাণের চেষ্টা করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা খাদ্য উৎপাদনের জন্য পাশের মাঠে একটি সবজির বাগান করেছেন। প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করে জ্বালানী তৈল উৎপাদন করছেন। যেন প্রতিবার ঘুম থেকে উঠে তারা তাদের স্বপ্নকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে গ্রন্থাগারটিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ একত্রিত হচ্ছে। এতে গ্রন্থাগারটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। শিক্ষক, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারগণ তাদের সংশ্লিষ্ট বই অনুসন্ধান করতে গ্রন্থাগারে আসছেন। আনাস আহমাদ বলেন-
অনেকে তাদের একাডেমি সংশ্লিষ্ট বইপত্র অনুসন্ধান করতে গ্রন্থাগারে আসেন। অনেকে আবার শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে এখানে আসেন। এখানে আরব জাহানের প্রায় সকল বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও লেখকদের বই সংরক্ষিত আছে। যেমন বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার আহমাদ শাওকী- যাকে ‘প্রিন্স অফ পোয়েটস’ বলা হয়; সিরিয়ান লেখক আল তানাওভী- যাকে আরব বিশ্বেরর বিদ্রোহী কবি বলা হয়; এছাড়াও অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত লেখদের বই এখানে সংরক্ষিত আছে।
আরব বিশ্বের বাইরেও অনেক বিখ্যাত লেখকদের বই এখানে পাওয়া যায়। অনেক পাঠক বিদেশি বই পাঠ করতেই বেশি আনন্দ পেয়ে থাকেন। যেমন আব্দুল বাসিত আলাহমার নামের এক পাঠক বলেন-
আমি ফ্রেঞ্চ লেখকদের বই বেশি পছন্দ করি। তবে হ্যামলেট আমার কাছে সেরা। সেক্সপিয়ারের লেখার ধরণ অসাধারণ। তিনি প্রত্যেকটি লাইন খুব স্পষ্ট ও বিস্তারিত বিবরণ সহকারে লেখেন। এর ফলে আমি যখন তার বই পড়ি, মনে হয় যেন, আমি সরাসরি কোনো সিনেমা দেখছি। সত্য কথা বলতে, আমি যখন হ্যামলেট পড়া শুরু করেছিলাম, তখন নেশায় পড়ে গিয়েছিলাম। যখন পড়া সমাপ্ত হয়েছিল, তখন মনে হচ্ছিল আমার মাথা যেন পুরোপুরি থমকে আছে!
আনাস আহমাদ বর্তমানে গ্রন্থাগারটি পরিচালনার পাশাপাশি যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার শিক্ষাখাত নিয়ে কাজ করছেন। তিনি সিরিয়ার আরেক শহর ইদলিবের নারী ও শিশুদের জন্য একটি ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন। তার স্বপ্ন এই গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করেই সিরিয়া ফের ঘুরে দাঁড়াবে।