বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড। ২০১৯ সালের মার্চে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক বিভাগ ফিনল্যান্ডকে দিয়েছে এ খেতাব। গত বছরও এ সম্মান ছিল ফিনল্যান্ডের দখলেই। এছাড়া ফিনল্যান্ডের তিন নর্ডিক প্রতিবেশী- নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং আইসল্যান্ডও রয়েছে পরের তিনটি অবস্থানে।
তবে অন্য তিন নর্ডিক দেশের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা যতটা না আশ্চর্যের বিষয়, তারচেয়ে বহুগুণ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ফিনল্যান্ডের বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন।
দেশটির উত্তরাঞ্চলে বছরের প্রায় ২০০ দিনই শীত থাকে। মাঝেমধ্যে শীত এত চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাপমাত্রা এমনকি -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যায়। দিনের পর দিন সূর্যের আলোর অভাবে অন্ধকার হয়ে থাকে দেশটি। আর বলাই বাহুল্য, শীত ও অন্ধকারাচ্ছন্নতার সাথে বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা প্রবণতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। তাই তো ১৯৯০ সালের আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফিনল্যান্ড ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। তাদের অবস্থান ছিল কেবল হাঙ্গেরির পেছনে।
এখন অবশ্য ফিনল্যান্ডে আত্মহত্যার প্রবণতা ১৯৯০ সালের তুলনায় কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যা প্রবণতায় ২২তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। তারপরও সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে দেশটির আবহাওয়া বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট বৈরী। প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৬.৪ জনই নিজের জীবন নিজে কেড়ে নেয় সেখানে।
এদিকে জন্মহারও ক্রমশ কমছে দেশটিতে। গড়ে একজন নারী জন্ম দিচ্ছে ১.৬টি শিশুর। সব মিলিয়ে পরিসংখ্যানগুলো একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। কিন্তু তারপরও কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড?
অনেকেই ভাবতে পারেন, ফিনিশরা হয়তো জন্মগতভাবেই সুখী। অর্থাৎ তাদের জিনে সুখের প্রবণতা বেশি। কিন্তু আসলে তা নয়, দাবি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অর্থনীতির অধ্যাপক জন হেলিওয়েলের।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে গত বছর ফিনরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের চেয়ে বেশি সুখী ছিল। কিন্তু সে দেশের অভিবাসীরাও কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিবাসীদের চেয়ে বেশি সুখী ছিল। সুতরাং, সুখী হওয়াটা তাদের জিনগত কোনো ব্যাপার নয়। সার্বিক জীবনযাত্রার ধরনই তাদের সুখী করে তুলেছে।
জীবনযাত্রার ধরনের বিশেষ ছয়টি চলকের উপর ভিত্তি করে কোনো দেশের সুখের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সেগুলো হলো উপার্জন, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, স্বাস্থ্যসম্মত গড় আয়ুষ্কাল, সামাজিক সমর্থন এবং মহানুভবতা। এছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশের মানুষের আবেগিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও।
এবং এগুলোতেই নিহিত রয়েছে ফিনল্যান্ডের মানুষের সুখের রহস্য। হেলিওয়েলের মতে,
ফিনরা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোটা অংকের কর প্রদান করে, তারা তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচে, এবং তারা একে অন্যের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন করে, সবার কথা চিন্তা করে। এরকম জায়গাতেই তো মানুষ বাস করতে চায়।
ফিনিশদের এমন জীবনযাত্রায় অবদান রয়েছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থারও। শুধু ফিনল্যান্ডই নয়, প্রায় সকল নর্ডিক দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই বাকি বিশ্বের থেকে আলাদা। অন্যান্য দেশের মতো তাদের শিশুরা ৬ বছর বয়সে গ্রেড ওয়ান বা প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয় না। তারা তাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করে ৭ বছর বয়সে, এবং ১৬ বছর পর্যন্ত তারা এই প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণই চালিয়ে যায়। ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থীরা হাই স্কুলে পড়াশোনা করে ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সে।
তাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি ঈর্ষণীয় দিক হলো, ১৬ বছরের আগে সেখানে শিক্ষার্থীদের উপর আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়া হয় না। এর আগপর্যন্ত বরং শিক্ষার্থীদের উপর তাদের শিক্ষকদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থাকে, তারাই নির্ধারণ করেন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় থাকবে। শিক্ষার্থীদেরকে কোনো বাড়ির কাজও দেয়া হয় না। তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয় নিজেদের স্বপ্নপূরণের ব্যাপারে আশাবাদী হতে এবং আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণে।
ফিনল্যান্ডের প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্টের গড় স্কোর ৫২৩, যেখানে অন্যান্য ওইসিডিভুক্ত (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) দেশসমূহের গড় স্কোর মাত্র ৪৮৬।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশই মাধ্যমিক পরবর্তী পর্যায়েও শিক্ষাগ্রহণ করে, এবং ৬৯ শতাংশ বেতনভুক্ত চাকরি করে থাকে। সামগ্রিকভাবে ওইসিডির সদস্য দেশগুলোতে এই দুইয়ের হার যথাক্রমে মাত্র ৭৪ ও ৬৭ শতাংশ।
সামাজিকতা ও নিজ সম্প্রদায়কে ফিনিশরা সবসময়ই খুব গুরুত্ব দেয়। এক জরিপের ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, ফিনল্যান্ডের ৯৫ শতাংশ মানুষই মনে করে তারা নিজ পরিবারের বাইরেও এমন কাউকে চেনে, যারা বিপদের সময় তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। এছাড়া তারা অন্যান্য সম্প্রদায় গড়ে তোলার ব্যাপারেও অনেক উৎসাহী থাকে, যেমন তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের লাইব্রেরিগুলোকে আরো চাঙ্গা করতে।
ভান্তা শহরে লাইব্রেরিগামী মানুষের সংখ্যা ১৪ শতাংশ বেড়েছে, এবং মানুষ এখন আরো বেশি সময় কাটাচ্ছে লাইব্রেরিতে। যুবসমাজকে আকর্ষণ করতে লাইব্রেরিগুলোও কম খরচে বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করছে। তাই সামগ্রিকভাবে মানুষের লাইব্রেরিতে কাটানো সময়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে পুরো ৩০০ শতাংশ।
২০১৮ সালে ফিনল্যান্ড যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের খেতাব জিতল, তখন ফিনিশ দার্শনিক ফ্রাঙ্ক মার্তেলা দাবি করেছিলেন, এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো ফিনল্যান্ডের নাগরিকদের বিনয়।
মার্তেলার ভাষ্যমতে, ফিনিশ সংস্কৃতি অনুযায়ী মানুষ কখনোই নিজেদের সাফল্য নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি বা বাগাড়ম্বর করে না। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদেরকে নিজেদের ব্যক্তিগত সাফল্য নিয়ে কথা বলতে খুব কমই দেখা যায়। বরং অনলাইন হোক বা অফলাইন, সবখানেই তারা নিজেদের সাফল্যের ব্যাপারে বিনয় প্রদর্শন করে। অনেকেই এমন বিনয়কে লজ্জার বহিঃপ্রকাশ মনে করে, কিন্তু এটিই তাদেরকে সুখী হতে সাহায্য করে।
এর কারণ হলো, মানুষের জীবনের সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক তুলনা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যদি সবাই আপনার চেয়ে ভালো করতে থাকে, তাহলে আপনার পক্ষে নিজের জীবনাবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া কঠিন হবে। এমনকি আপনার অবস্থা যত ভালোই হোক না কেন।
‘দ্য নর্ডিক থিওরি অব এভরিথিং’ বইয়ের রচয়িতা আনু পার্তানেনের মতে, ফিনিশ সমাজব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে মানুষ অন্যের কাছ থেকে সাহায্য পায় বটে, কিন্তু তারপরও তারা মনে করে নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ তাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে।
সব মানুষই এমন একটি জীবন চায়, যেখানে তারা অসুস্থ হলেই স্বাস্থ্যসেবা লাভ করবে, যেখানে তাদের সন্তানেরা ভালোভাবে লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে, যেখানে তারা এমন একটি চাকরি করবি যা তাদের মনে পূর্ণতা এনে দেবে, এবং যেখানে তারা সকল ব্যস্ততার মাঝেও প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে পারবে। বিষয়টি আসলে এমন নয় যে ফিনরা খুব বেশি ধনী হতে ইচ্ছুক। তারা কেবল সুখী, সুন্দর ও সাধারণ একটি জীবন কামনা করে, এবং ফিনল্যান্ড তার অধিবাসীদেরকে বেশ ভালোভাবেই এমন একটি জীবন উপহার দিতে পারছে।
বাস্তবিকই তাই। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের করা ২০১৮ সালের এক জরিপ থেকে জানা গিয়েছিল, ৮৬ শতাংশ ফিনই তাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের মধ্যকার ভারসাম্য নিয়ে সন্তুষ্ট, যেখানে সামগ্রিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত সকল দেশে এ হার ৭৮ শতাংশ।
আর এ কারণেই, ফিনরা অন্যান্য দেশের অধিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি সময় পায় কাজ শেষে পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সাথে প্রকৃতিকে আবিষ্কারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে। তারা উপভোগ করে দেশটির সুবিশাল সব বনভূমি, সাঁতার কাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার হ্রদে।
যদিও আত্মহত্যা এখনো ফিনল্যান্ডের একটি বড় সমস্যা, কিন্তু ধীরে ধীরে এ সমস্যারও সমাধানের পথে এগিয়ে চলেছে দেশটি। প্রাকৃতিক কারণে অনেক ফিনই বিষণ্ণতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয় বটে, কিন্তু সামাজিকভাবে এগুলোকে এখন সহমর্মিতার চোখে দেখা হয়ে থাকে।
পার্তানেন বলেন,
মানসিক অসুস্থতা এখন ফিনল্যান্ডের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিশেষ করে পুরুষরা খুব সহজেই এখন তাদের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে পারছে। যেমন ধরুন, কেউ যদি বিষণ্ণতার শিকার হয়, চাইলেই সে এ বিষয়ে অন্যদের সাথে কথা বলতে পারে। এ কারণে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সেরে ওঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ১০ দেশ
ফিনল্যান্ড
ডেনমার্ক
নরওয়ে
আইসল্যান্ড
নেদারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ড
সুইডেন
নিউজিল্যান্ড
কানাডা
অস্ট্রিয়া
* বাংলাদেশ রয়েছে ১২৫তম অবস্থানে।
বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী ১০ দেশ
দক্ষিণ সুদান
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক
আফগানিস্তান
তানজানিয়া
রুয়ান্ডা
ইয়েমেন
মালাউয়ি
সিরিয়া
বতসোয়ানা
হাইতি
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/