
কোনো সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও মানসিক বিকাশের উপর টেলিভিশনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রভাবটা ইতিবাচক হবে নাকি নেতিবাচক হবে, তা নির্ভর করে টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোর কন্টেন্টের উপর। বিষয়টা বেশ বিতর্কিত। একদিকে টেলিভিশনকে জনসচেতনতা সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়, অন্যদিকে এই টেলিভিশনকেই সামাজিক অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার যোগসূত্র ধরা হয়। এ বিতর্কের কোনো শেষ নেই। তবে আজকের লেখার মূল বিষয়বস্তু হলো, কীভাবে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত নাটক বা প্রোগ্রাম কোনো সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতে পারে।
সত্তরের দশক থেকে ব্রাজিলে ‘সোপ অপেরা’ বা টেলিভিশন নাটক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার বা মোট উর্বরতার হার কমানোর ক্ষেত্রে সহয়তা করে। সোপ অপেরার মাধ্যমে সৃষ্ট জনসচেতনতার দরুন মাত্র তিন দশক তথা ত্রিশ বছরের মধ্যে মোট উর্বরতার হার কমে ৬০ শতাংশ বা তার থেকেও অধিক হারে।

টেলিভিশন বা নাটকের কারণে ব্রাজিলের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে পরিবর্তন আসে, সেই বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং প্রমাণের কাজ করেন এলিয়ানা লা ফেরারা, অ্যালবার্টো চং এবং সুস্যান ডুরিয়া- এই তিনজন অর্থনীতিবিদ। তারা তাদের ‘সোপ অপেরাস অ্যান্ড ফার্টিলিটি: এভিডেন্স ফ্রম ব্রাজিল’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এসব তথ্য তুলে ধরেন।

ব্রাজিলে টেলিভিশনের ভূমিকা
দেখা যায়, ব্রাজিলে টেলিভিশন মূলত ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিয়ে ও পরিবার সম্পর্কে নারীদের ধারণা উন্নত করার পাশাপাশি শিক্ষার হার বাড়ানো, গর্ভনিরোধক পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা ছড়ানো এবং সরকারি নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবগত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। ১৯৬৪ সালে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা টেলিভিশনকে দেশের উন্নয়ন, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা, বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং রাজনৈতিক তথ্য সঠিকভাবে পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। সামরিক সরকার টেলিভিশনের ব্যবহার বৃদ্ধির তাগিদে টেলিভিশন সেটের বিক্রির ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া এবং একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্ককে প্রোগ্রাম বা নাটক পরিচালনায় আর্থিক ও আরো বিভিন্নভাবে সহায়তা করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আর এই নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কটি ছিলো রেডে গ্লোবো। ১৯৬৫ সালে রেডে গ্লোবোর কার্যক্রম শুরু হয়। খুব অল্প সময়েই এটি ব্রাজিলের প্রধান জাতীয় নেটওয়ার্ক হয়ে দাঁড়ায়।

উল্লিখিত গবেষণাপত্র অনুসারে, ব্রাজিলে ‘নভেলা’ বা নাটকের দর্শক রয়েছে সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ লাখ (২০০৮)। গ্লোবোর নোভেলা বা নাটকগুলো এত স্বীকৃতি বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, দর্শকরা সহজে নাটকে দেখানো স্থানগুলো চিনতে পারে বা স্বদেশী ভাব থাকে বলে নাটক আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে তাদের জন্য। দ্বিতীয়ত, গ্লোবো নেটওয়ার্ক নাটকগুলো সকলের বোধগম্য করার জন্য চলিত ভাষা, একটি সুপরিচিত মধ্যবিত্ত পরিবার ব্যবস্থা অর্থাৎ ব্রাজিলের জনগণের জন্য চেনা-জানা সমাজ ব্যবস্থা এবং বাস্তব সময়ে নাটকেও বিভিন্ন জাতীয় উৎসব উদযাপন করা দেখানোর হয়। তৃতীয়ত, গ্লোবো নেটওয়ার্ক তাদের নাটকগুলো সুন্দর করার জন্য এবং ভালো মানের প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য প্রচুর অর্থও খরচ করে।
সেসময়ে গ্লোবোর নোভেলার একটি পর্ব নির্মাণে ১ লক্ষ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার খরচ হতো; যা একই সময়ে লাতিন আমেরিকার অন্য কোনো নভেলা বা নাটকের একটি পর্ব নির্মাণের খরচের ১৫ গুণ ছিল। এসকল শর্ত পূরণ করলে তো এখনো একটি নাটক খ্যাতি লাভ করতে পারে, আর তখন তো এরকম নাটক ব্রাজিলে ছিল দুর্লভ। তাই অল্প সময়েই মানুষের মন জয় করে গ্লোবোর নাটকগুলো।
রেডে গ্লোবো
রেডে গ্লোবো বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক। এবিসির পরই রেডে গ্লোবোর অবস্থান। লাতিন আমেরিকায় এটি বৃহত্তম নেটওয়ার্ক এবং ‘টেলিনভেলা’ নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে এই নেটওয়ার্কটি। রেডে গ্লোবো মূলত তিন ধরনের নভেলা বা নাটক দেখাতো। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ‘নভেলাস ডাস সেইস’, যা দাসত্বের ঐতিহাসিক গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এ ধরনের নাটকের দর্শক অন্যান্য নাটকের তুলনায় কম ছিল। এরপর ৭টায় সম্প্রচারিত ‘নোভেলাস ডাস সেতে’ ছিল বিনোদনমূলক এবং হিংসা ও ষড়যন্ত্রের গল্প নিয়ে। আর রাত ৮টার (বা ৯টার) ‘নোভেলাস ডাস ওইতো’ নাটকের কাহিনী ছিলো বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে। এ ধরনের নাটকের দর্শকই সবচেয়ে বেশি ছিল।
ব্রাজিলে টেলিভিশন প্রোগ্রাম নির্মাণ বা সম্প্রচারের ক্ষেত্রে রেডে গ্লোবো চ্যানেল অনেকটা একচেটিয়াভাবে কাজ করত বা এখনো করে বলা যায়। ১৯৬৫ থকে ১৯৯৯ সালে গ্লোবোতে প্রায় ১১৫টি নাটক সম্প্রচারিত হয়। এসব নাটকের মধ্যে ৭২ শতাংশ নাটকের মূল নারী চরিত্রগুলোর (৫০ বা এর কম বয়সের) কোনো সন্তান ছিল না, আর ২১ শতাংশ নাটকে একটিমাত্র সন্তান ছিলো। এ ধরনের পরিবার বা ধারণা ব্রাজিলের প্রচলিত পরিবার ব্যবস্থা এবং ধারণায় অভ্যস্ত জনগণের জন্য ছিল একদম নতুন কিছু। গ্লোবোর নভেলা বা নাটক পরিচালনার উদ্যোগের কয়েক বছর পর থেকে, অর্থাৎ ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে মোট উর্বরতার হার প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়।
গ্লোবোতে সম্প্রচারিত এসব নাটকের মূল দর্শক ছিল নারীরা। তবে বয়স সাপেক্ষে পরিবর্তন কম-বেশি হয়। ১৫-২৪ বছরের নারীদের ওপর এসব নাটকের প্রভাব তৎক্ষণাৎ দেখা যায় না। ২৫-৩৪ বছরের নারীদের চিন্তা-ভাবনার যে পরিবর্তন হয়, তার প্রমাণ হলো এ বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের হার ১১ শতাংশ কমে যায়। আর ৩৪-৪৪ বছরের নারীদের ক্ষেত্রে এ হার কমে ৮ শতাংশ। ১৫-২৪ বছরের নারীদের চিন্তাধারা যে প্রভাবিত হয়, তার প্রমাণ পরের বছরগুলোতেই বোঝা যায়।

গবেষণাপত্রটিতে ব্রাজিলের যেসব অঞ্চলে সারা বছর রেডে গ্লোবোর সিগন্যাল ছিলো বা ‘সোপ অপেরা’, ‘নভেলা’ বা নাটক সম্প্রচার করার সুযোগ ছিল, সেসব অঞ্চলের সাথে অন্যান্য এলাকা- যেখানে এ ধরনের সুযোগ ছিল না, সেগুলোর তুলনা করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যেসব এলাকায় গ্লোবোর সিগন্যাল নেই, সেসব অঞ্চলের তুলনায় সিগন্যাল আছে এমন এলাকায় সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা শতকরা ০.৬ ভাগ কমে যায়। পরীক্ষা করার জন্য বেছে নেওয়া এলাকাগুলোর মধ্যে কিছু এলাকা এরকম ছিল, যেখানে আগের তুলনায় নারীশিক্ষা বাড়ার পরও পরিবার পরিকল্পনায় সচেতনতা বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু গ্লোবোর সম্প্রচারের কারণে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য দেখা যায়।
এমন নয় যে, নভেলা বা নাটকগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলেচনা করা হতো। তাছাড়া সত্তরের দশক শেষ হওয়া অবধি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার নীতি তৈরিতেও গড়িমসি করে ব্রাজিল সরকার। গর্ভনিরোধক পদ্ধতির বিজ্ঞাপনও ছিল নিষিদ্ধ। তারপরও ব্রাজিল সমাজে এসব ক্ষেত্রে আসে তুমুল পরিবর্তন। এর পেছনে অবদান রয়েছে নভেলার সুস্পষ্ট গল্পগুলোর। নিতান্তই বিনোদন ও গল্পের ছলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জনগণের মাথায় গেঁথে দেয়া হয়।
বেশিরভাগ নভেলার মূল চরিত্রের পরিবার থাকত সুস্থ, শহুরে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত একক পরিবার। সুখী পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে একক পরিবারকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এসব নাটকে। সাধারণত নাটকে দর্শকেরা দেখতে পেত রিও ডে জেনেইরো বা সাও পাওলোর একটি শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবার, যেখানে পরিবারের ধরন, মূল্যবোধ, মনোভাব এবং আচরণগত পরিবর্তন নিয়েই কাহিনী অগ্রসর হতে থাকে।

অন্যদিকে, ব্রাজিলিয়ান নাটকের গল্প মূলত চার বা পাঁচটি পরিবারকে নিয়ে হতো। প্রধান চরিত্রগুলো তদারক করার তাগিদে পরিবারগুলো ছোটই দেখানো হতো। গল্প সামলাতে গিয়ে কখনো কখনো ব্রাজিলের প্রেক্ষাপটে অবাস্তবিক পারিবারিক গঠনও দেখানো হতো এই নাটকগুলোতে। যা-ই হোক না কেন, এসব নাটকের ইতিবাচক বার্তাটা মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছিল, আর সেটাই আসল ব্যাপার।
সুখী ও স্বচ্ছল পরিবারের জন্য যেমন একক বা ছোট পরিবারকে দেখানো হতো, তেমনি অস্বচ্ছল কিংবা পারিবারিক খরচ ও দ্বন্দ্ব নিয়ে থাকা পরিবারগুলোকে বড় পরিবার কিংবা অধিক সন্তান-সন্তুতি আছে, এমন পরিবার দেখানো হতো। আর এ ধরনের দৃশ্য জনগণকে নিজেদের বিশ্বাস ও জীবন নিয়ে ভাবাতে শুরু করে।

ব্রাজিলের অধিকাংশ জনগণ মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় দৈনিক খরচ নিয়ে চিন্তিত থাকত। খরচের ভার ও পারিবারিক সমস্যা সামলাতে পরিবার ছোট রাখার সুবিধা নাটকের মাধ্যমে সবার নজরে এলে তা সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে রেডে গ্লোবোর পাশাপাশি অন্য নেটওয়ার্কও নভেলা সম্প্রচার শুরু করে।
ব্রাজিলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ‘সোপ অপেরা’ বা টেলিভিশন নাটকের ইতিবাচক প্রভাব দেখায় যে সুষ্ঠু সমাজ গঠনে টেলিভিশন একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে। এজন্য নাটক বা প্রোগ্রাম পরিচালনা করার সময় অবশ্যই সচেতন হতে হবে।