রূপ-লাবণ্যে ভরা আমাদের এই পৃথিবী, সৃষ্টিকর্তা সূচারুরুপে ঢেলে সাজিয়েছেনে এই ধরণী। এর পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নৈসর্গিক নিদর্শন। এসব নিদর্শনের মধ্য থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২২৫ সালে গ্রিক দার্শনিক ফিলো সাতটি বিস্ময়ের তালিকা করার প্রয়াস পান। এ কাজে সহায়তা করেন গ্রিসের ঐতিহাসিক হেরোডোটাস, ক্যালিমেকাস এবং এনিপেটার। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পৃথিবীতে এত আশ্চর্য সৃষ্টি থাকতে ’সপ্তাশ্চর্য’ কেন বিবেচ্য? সাত সংখ্যার কি কোনো মাহাত্ম্য আছে? হ্যাঁ, তা তো আছেই। গ্রিকরা ‘সাত’ সংখ্যাকে মনে করত মঙ্গলের প্রতীক, যা সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্য বয়ে আনে।
কালের আবর্তে ঝড়-ঝঞ্চা ও জলোচ্ছ্বাসে গিজার গ্রেট পিরামিড ব্যতীত কোনোটিরই আর অস্তিত্ব নেই। নতুন করে তালিকা প্রণয়নের তাগিদ অনুভব করে উদ্যোগ নেয় নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। প্রায় একশো কোটি মানুষ ভোট দেয় এতে। সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে ২০০৭ সালে নির্বাচিত হয় সাতটি স্থান, যা বর্তমান বা আধুনিক পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য নামে পরিচিত। তবে এদের কোনো ক্রমবিন্যাস প্রকাশ করেনি আয়োজক সংগঠন, প্রত্যেকটিরই রয়েছে সমমর্যাদা।
১. চিচেন ইত্জা
বর্তমান সময়ের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র চিচেন ইৎজা মেক্সিকোর ইয়ুকাতান উপদ্বীপে অবস্থিত, যা মায়ান সভ্যতার বিখ্যাত শহর। ৬ষ্ঠ থেকে ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত এটি তাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল। ইউরোপীয়রা উপনিবেশ গড়ার পূর্বে মায়ানরা বর্তমান মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা শাসন করেছিল। এল ক্যাসিলো পিরামিড এই শহরের বিখ্যাত স্থাপনা, সৌর বছরের অনুকরণে যার ৩৬৫ সিড়ি জ্যোতির্বিজ্ঞানে মায়ানদের উৎকর্ষের সাক্ষ্য দেয়। সূর্যালোকের প্রভাবে সিড়িগুলো যে বিস্ময়কর সর্পিল বর্ণ ধারণ করে তা দেখতে শরৎ ও বসন্তে অগণিত পর্যটক ভিড় জমান। ইৎজার সবুজ মাঠ ছিল তৎকালীন স্থানীয়দের জনপ্রিয় ‘লাচলি’র (বল দিয়ে একপ্রকার খেলা) প্রাণকেন্দ্র। এটি ঘোষিত ’ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’।
২. মাচুপিচু
পেরুর কাসকোতে অবস্থিত এ শহর। ১৫ শতাব্দীতে রাজা পাচাকুতেক এ নগর গড়ে তোলেন। ১৬ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা দখল করার পর শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তাই, মাচুপিচুকে ইনকা সিটি বা ইনকাদের হারানো শহরও বলা হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা অঞ্চলটিতে চাষাবাদ করলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষজন একে বিধ্বস্ত জনপদ হিসেবেই জানতো। ১৯১১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক হিরাম বিংহাম এ অঞ্চলে ভ্রমণে এসে বিশ্ববাসীর কাছে বৈচিত্র্যময় এ শহরের নান্দনিকতার জানান দেন। স্প্যানিশ আক্রমণের পূর্বে মাচুপিচু ছিল ইনকাদের তীর্থস্থান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তাদের রাজকীয় ব্যক্তিবর্গ, অভিজাত লোকজন ও তীর্থযাত্রীরা পাহাড়ের উঁচুতে অবস্থিত সেখানকার সরাইখানাগুলোতে সময় কাটাতো। আন্দিজ পর্বতের উত্তর পাদদেশে অবস্থিত এই সাইটে পর্যটকরা পায়ে হেঁটেও পৌঁছাতে পারেন, তবে তা কষ্টসাধ্য।
৩. ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের সুবাদে আমরা প্রায় সবাই দেখেছি সুগঠিত পর্বত আর স্বচ্ছ নীল জলরাশিতে ঘেরা অত্যন্ত সুন্দর এই ভাষ্কর্যটি। রিও ডি জেনেইরো শহরে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম যিশু খ্রিস্টের এই মূর্তিটি ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যচু অব লিবার্টির ন্যায় ব্রাজিলের প্রতীকী তাত্পর্য বহন করে। কর্কভাদো পাহাড়ের চূড়ায় মূর্তিটি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন যিশু তার দু’হাত প্রসারিত করে পুরো শহরকে আলিঙ্গন করছেন। মূলত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রাজিলিয়ান ক্যাথলিকরা যিশুর মূর্তি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পরে তাদের প্রচেষ্টায় ও তহবিল যোগাড় করার মাধ্যমে কাজ অনেকখানি এগিয়ে যায়। ভাষ্কর পল ল্যান্ডোস্কি এর নকশায় এটি ১৯২৬-৩১ সালে নির্মিত হয়। ৯৮ ফুট উঁচু (৩০ ফুট বেদী ব্যতীত) মূর্তিটি কনক্রিট এবং অসংখ্য টাইলসের সমন্বয়ে তৈরি।
৪. কলোসিয়াম
ল্যান্ড অব মার্বেল বা মার্বেলের শহর খ্যাত ইতালির রোমে এটি অবস্থিত, যা ফ্লাভিয়ান বংশের সম্রাট ভেস্পাসিয়ান ও তার পুত্র সম্রাট তাইতাস ৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। কলোসিয়াম ‘ফ্লাভিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার’ নামেও পরিচিত। এখানে গ্লাডিয়েটরদের মল্লযুদ্ধ ও বন্যপ্রাণীদের লড়াই প্রদর্শিত হত। এছাড়াও মঞ্চস্থ হতো বিনোদনমূলক নৌযুদ্ধ। তখন কলোসিয়ামের পুরো গ্যালারি পানিতে ভেসে যেত। বৃহৎ এই অ্যাম্ফিথিয়েটারের দর্শক ধারণক্ষমতা ছিল ৫০ হাজার এবং সূর্যের খরতাপ থেকে দর্শকদের স্বস্তি দিতে শামিয়ানা টাঙানো হত। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও ভূমিকম্পে এর দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ায় আজ অবধি এর সৌষ্ঠব-সৌন্দর্য লক্ষ্য করা যায়।
৫. তাজমহল
প্রেয়সীর প্রগাঢ় মমতায় তার স্মৃতি অমর করে রাখতে আড়ম্বরপূর্ণ সৌধ নির্মাণের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল।
সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মুমতাজ মহল ১৬৩১ সালে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সময় তীব্র প্রসব বেদনায় ইন্তেকাল করেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর বিরহে শাহজাহান শোকে অনেকটাই মূহ্যমান হয়ে পড়েন। অধিকাংশের মতে, উস্তাদ আহমেদ লাহোরী ছিলেন প্রধান স্থপতি। তার তত্ত্বাবধানে ২০ হাজার লোকের ২২ বছরের পরিশ্রমে সম্পন্ন হয় তাজমহল কমপ্লেক্সের কাজ।
শ্বেতমর্মরের তৈরি সমাধিসৌধ চন্দ্র-সূর্যের আলোয় প্রভাবিত হয়ে দিনের বিভিন্ন সময় বর্ণিল রুপ ধারণ করে, যা কি না আবার প্রতিফলিত হয় সামনের জলাধারটিতে। অপূর্ব নির্মাণকুশলীতে গড়া ৪০০ বছর আগের এই সৌধ বিশ্ববাসীর কাছে আজ বিস্ময়। প্রতিবছর তাই লক্ষাধিক পর্যটক ভিড় করে দৃষ্টিনন্দন তাজমহলের সৌন্দর্য অবলোকন করতে।
৬. গ্রেট ওয়াল অব চায়না
পৃথিবীর প্রাচীনতম এই স্থাপনাটি এযাবত মানুষ নির্মিত সর্ববৃহৎ সীমানা প্রাচীর। শত্রুর আক্রমণ থেকে চীনের উত্তরাঞ্চল সুরক্ষিত রাখতে খ্রিস্টপূর্ব ২২০ সালে সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু হলেও প্রায় ১৮০০ বছর ধরে বিভিন্ন শাসক এর বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করেন। এর বেশিরভাগ ’মিং’ বংশীয় সম্রাটদের। চীনের মহাপ্রাচীর মূলত সমান্তরাল দেয়ালের সীমানা প্রাচীর, মধ্যবর্তীতে গিরিপথ ছাড়াও এতে অন্তর্ভুক্ত আছে দুর্গ, আশ্রয়কেন্দ্র এবং ওয়াচ টাওয়ার। এ প্রাচীর চীনের ইতিহাসে দেশ ও জনগণের সুরক্ষার প্রতীকী তাত্পর্য বহন করে। ৫৫৫০ মাইল দীর্ঘ এ স্থাপনার উত্তরাঞ্চলীয় গানসু প্রদেশ থেকে দক্ষিণের লায়নিং অঞ্চলটি বেশ সুরক্ষিত। সেখানে ভ্রমনপিপাসুদের আনাগোনাও বেশি।
৭. পেত্রা
জর্দানের এক প্রত্নতাত্ত্বিক শহর পেত্রা। মরুর দূর্গম এই অঞ্চলে দূর থেকে বেসিনের মতো পানি এসে পৌঁছাত। মরুভূমির তপ্ত প্রান্তর, যেখানে পানির অভাবে প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত, বসতি গড়ার চিন্তাও মানুষ মাথায় আনে না- এমন পরিবেশে তাদের নগর-পরিকল্পনা ও পানি-ব্যবস্থাপনা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। অপূর্ব নির্মাণকুশলতায় পাথরে খোদাই করে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে সুরম্য অট্টালিকা। এটি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও প্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্যারাভান রুট। তারা বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করত এবং মশলা ও সিল্কে প্রভূত উন্নতিসাধন করেছিল। ৩৬৩ সালে বড় আকারের ভূমিকম্প এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ও সময়ের পরিক্রমায় এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৮১২ সালে অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হলে বৈচিত্র্যময় এ নগরীকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে।