একসময় ইরানে পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেখানে সাধারণ নাগরিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সফল হয়। বর্তমানে ইরান হচ্ছে এমন একটি দেশ, যেটি পরিচালিত হচ্ছে শিয়া মতাদর্শের ধর্মীয় ভিত্তিকে কেন্দ্র করে। যেসব দেশে এখনও ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ইরানের শাসনব্যবস্থা বেশ আগ্রহোদ্দীপক।
ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয় গত শতকের সত্তরের দশকেই। তখনকার ধর্মীয় নেতা ও ইরানি ইসলামিক বিপ্লবের প্রাণপুরুষ আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি ‘ভেলায়েত-ই-ফকিহ’ নামের একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন, যেখানে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের উপর ধর্মীয় যাজকদের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব বজায় থাকবে। শিয়া মতাদর্শের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতির সাথে এটির কিছুটা বিরোধ থাকলেও কেউই সেভাবে তার তত্ত্বকে প্রশ্ন করেননি।
ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হচ্ছেন ‘রাহবার-ই-মোয়াজাম-ই-ইরান’ বা ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। তাকে ‘রাহবার-ই-মোয়াজাম-ই-ইনকিলাব-ই-ইসলাম’ বা ‘ইসলামিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। ইরানের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে দেশটির নতুন সর্বোচ্চ নেতা নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নিয়োগের বিষয়টি দেখভাল করেন ‘মজলিস-ই-খোবরেগান-ই-রাহবারি’ নামের একটি ছোট সংসদ। উল্লেখিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, মৃত্যু কিংবা অসামর্থ্যের জন্য যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার আসন খালি হয়, তবে উপরোক্ত কমিটি অতি দ্রুততার সাথে অধিবেশন ডাকবেন এবং যত দ্রুত সম্ভব, সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করবেন।
১৯৮৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতার আসনে বহাল আছেন আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি, যার পূর্বসুরি হচ্ছেন আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি। ২০১৬ সালে বর্তমান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিকে পঞ্চম মেয়াদে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। তিনি ২০২৪ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ নেতার পদ অলংকৃত করবেন। ধারণা করা হয়, সবকিছু ঠিক থাকলে তার মৃত্যুর আগপর্যন্ত অন্য কেউ সেই পদে আসীন হতে পারবে না। তার বর্তমান বয়স ৮৩ বছর হওয়ায় অনেকে স্বাস্থ্যগত দিকটি বিবেচনা করছেন এবং তার উত্তরসূরি কারা হতে পারেন– তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ইরানের জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ইব্রাহিম রইসি। তিনি ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। ২০২১ সাল থেকে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি যে শহর থেকে উঠে এসেছেন, ইব্রাহিম রইসিও বেড়ে উঠেছেন সেই শহর থেকেই। এছাড়াও তিনি বর্তমান নেতা খোমেনির ছাত্র। একজন সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে তিনি পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন এবং ইসলামি বিপ্লবের নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও পেশাগত দক্ষতার কারণে তার উন্নতি হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইরানের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হাসান রুহানির বিরুদ্ধে নির্বাচনে পরাজিত হলেও ২০২১ সালে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অনেকেই মনে করেন, বর্তমান ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনির উত্তরসুরি হতে যাচ্ছেন তিনি।
ইরানের রাজনীতিতে আরেকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি গোলাম হোসেইন মোহসেনি এজেই। তিনি দীর্ঘ সময় ইরানের বিচার বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সময় তিনি মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন, যদিও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের মতদ্বৈততা ও বেশ কিছু কারণে তাকে সরিয়ে দেন। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় আমেরিকার সরকার তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আমেরিকার অভিযোগ ছিল তিনি আন্দোলনের সময় আন্দোলনাকারীদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আন্দোলনকারীদেরকে গ্রেফতার ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছিল। ২০২১ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি তাকে দেশটির প্রধান বিচারপতির পদে নিয়োগ দান করেন এবং এখনও তিনি ইরানের প্রধান বিচারপতি হিসেবে কর্মরত আছেন। তার বর্তমান বয়স সাতষট্টি বছর। তাকেও অনেকে খোমেনির উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
ইরানের রাজনীতিতে আরেকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সাদেক আমোলি লারিজানি। তার পরিবারের অনেক সদস্যও বিভিন্ন সময়ে ইরানের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে আসীন ছিলেন। তার বাবা ছিলেন ইরানের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ, তার ভাই ইরানের আইনসভায় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বিগত অনেক বছর ধরেই ইরানের বিচার বিভাগে কর্মরত থাকায় বেশ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ১৯৯৯ সালে বর্তমান ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি তাকে ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’ এর সদস্যপদ প্রদান করেন। ইরানের সর্বোচ্চ পরিষদগুলোর মধ্যে গার্ডিয়ান কাউন্সিল অন্যতম। ইরানের জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাদেরকে মনোনয়ন দিয়ে থাকে এই পরিষদ। পেশাগত শুরু থেকে থেকেই ইরানের ধর্মীয় রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি নিজের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে এসেছেন এই জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। তবে তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও উত্থাপিতও হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অনেকের দৃষ্টিতে তিনিও খোমেনির উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হতে গেলে বেশ কিছু যোগ্যতা থাকা জরুরি। যে পরিষদ (মজলিস-ই-খোবরেগান-ই-রাহবারি) দেশটির সর্বোচ্চ নেতাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন, তারা বেশ কিছু দিকে নজর দেন। যেমন- যেসব দেশের সাথে ইরানের বৈরিতা রয়েছে, সেসব দেশের প্রতি সম্ভাব্য নেতার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন– এটি ভালোমতো যাচাই করা হয়। এছাড়াও ইসলামিক বিপ্লবের ফলে ইরানের রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো বহাল রাখতে কতটুকু আগ্রহী– এটিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া হয়। মানুষ মরণশীল। ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিকেও একসময় স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় কিংবা মৃত্যুর কারণে আসন ছেড়ে দিতে হবে। তার উত্তরসূরি কে হবেন– সেটি সময়ই বলে দেবে।