Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইকুমেন: যে জাপানি পুরুষেরা বাচ্চা সামলাচ্ছে, ঘরের কাজও করছে

আজকাল যদি আমরা জাপানি সংবাদপত্র, ফ্যাশন ম্যাগাজিন কিংবা মাঙ্গা স্টোরিগুলোর দিকে চোখ বুলাই, এক নতুন ঘরানার সুপারহিরোদের আবিষ্কার করবো। এই সুপারহিরোরা একাধারে যেমন প্রচন্ড সুদর্শন, তেমনি সদা হাস্যোজ্জ্বল। এবং তারা তাদের সন্তানদের নিয়ে কোনো একটা মজার খেলায় মত্ত, কিংবা বাইকে চেপে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি সন্তানের পোশাকের সাথে মিল রেখে তাদেরকেও বাহারি রঙের পোশাক পরে থাকতে দেখতে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুপারহিরোরা অসীম ধৈর্যের অধিকারী। সন্তানের ভালোমন্দের দিকে তাদের সর্বদা সজাগ দৃষ্টি। এবং সন্তানের জন্য ভালোমন্দ রান্না করা থেকে শুরু করে ঘরের ছোটখাট সব কাজ করা, সবেতেই রয়েছে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

ভাবছেন, এ আর এমন কী কাজ যে তাদেরকে সুপারহিরো বলা হচ্ছে! তারা এজন্যই সুপারহিরো, কারণ সুপারহিরোদের কাজকর্মের কথা যেমন শুধু কল্পনাই করা যায়, পুরুষরাও ঘরদোর ও বাচ্চা সামলানোর এমন সব কাজ করছে, এই বিষয়টি অধিকাংশ সমাজেই আকাশ-কুসুম কল্পনার সামিল। সেখানে কোনো দেশের পুরুষরা যদি সেই আপাত অসম্ভব কাজটিই করে চলে, তাদেরকে সুপারহিরো বলা ছাড়া আর উপায় কী!

কিংবা কথাটাকে আমরা আরেকটু সহজ ভাষায় বলতে পারি। চিরদিন বাচ্চা সামলানোর কঠিন কাজটি নারীরাই করে এসেছে। পুরুষেরা বরাবরই এই কাজকে ভয় পেয়েছে। সেখানে যখন কিছু পুরুষ সাহস করে এই দুরূহতম কাজটি করতে এগিয়ে আসছে, তাদেরকে তো সুপারহিরো উপাধি দেয়াই যায়। 

Imafe Courtesy: Reuters

এই সুপারহিরোদের একটি প্রাতিষ্ঠানিক নামও রয়েছে। তারা হলো ইকুমেন। দুটি জাপানি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই শব্দটি। একটি শব্দ হলো ইকুজি, যার অর্থ বাচ্চার দেখভাল করা। আর অপর শব্দটি হলো ইকেমেন, যার অর্থ আকর্ষণীয় পুরুষ। অর্থাৎ যেসব আকর্ষণীয় পুরুষেরা ‘মাতৃস্নেহে’ বাচ্চার যত্নআত্তি করে, তারাই ইকুমেন।

প্রচলন

এই শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রথম এক জাপানি সেলসম্যান ইকুমেন টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন। এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাপানের স্বাস্থ্য, কর্ম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ইকুমেন প্রজেক্ট নামে একটি জাতীয় প্রকল্পের সূচনা করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল পুরুষদেরকে সন্তান লালন-পালন ও পারিবারিক জীবনে অধিকতর সম্পৃক্ত করা।

অনেকের কাছেই প্রকল্পটিকে অদ্ভুতুড়ে মনে হতে পারে। এবং জাপানের প্রেক্ষাপটেও প্রকল্পটি প্রচন্ড রকমের অস্বাভাবিক ছিল। কেননা অন্যান্য অধিকাংশ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতো জাপানেও যুগ যুগ ধরে পুরুষদেরকে খাদ্যের জোগানদাতা আর নারীদেরকে ঘরের কাজ সামলানোর প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাই সেখানকার পুরুষেরা হঠাৎ করেই তাদের চিরাচরিত ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে, নারীদের মতো বাচ্চা সামলাতে শুরু করবে, এমন চিন্তা করাটা বাড়াবাড়িই ছিল বৈকি।

Image Courtesy: Getty Images

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জাপানের অনেক মানুষ ঠিকই এই ধারণাটিকে গ্রহণ করেছে। ফলে ইকুমেন ধারণাটি এখন জাপানি পপুলার কালচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। অনেকেই মনে করছে, এই ধারণার মাধ্যমে পুরুষরা পারিবারিক জীবনে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক সক্রিয়ই শুধু হয়নি, পাশাপাশি সমাজে নারী-পুরুষের সাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জাতীয় প্রকল্পটি কী বলছে?

সরকার সমর্থিত এই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে নিজেদের পেশাদারী কাজ ও সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে এর আশা, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে পিতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং দেশের অন্তত ১৩% পিতা এই সুযোগটি গ্রহণ করবে। এমনকি, প্রকল্পটি যেন সফল হয়, সেজন্য সরকার চাকরিদাতাদের জন্য বিশেষ পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান সেখানে কর্মরত পুরুষদের পিতৃত্বকালীন ছুটি গ্রহণের সুযোগ করে দেবে, সরকার সেসব প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করবে। ওইসিডির মতে, জাপানে পুরুষদেরকে ৫২ সপ্তাহ পর্যন্ত পিতৃত্বকালীন ছুটি গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়েছে।

পেছনের ইতিহাস

১৯৯২ সালে জাপান সরকার প্রথম পুরুষদের জন্য সন্তানের পরিচর্যায় ছুটি গ্রহণের আইনটি প্রণয়ন করে। এরপর ২০০২ সালে তারা একটি এজেন্ডাও নির্ধারণ করে যে পিতৃত্বকালীন ছুটি গ্রহণের হার অন্তত ১০% বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি তারা এই আইনও প্রণয়ন করে যেন কোম্পানিগুলোতে এমন ব্যবস্থা থাকে যে, পুরুষেরা চাইলেই পিতৃত্বকালীন ছুটি নিতে পারবে।

২০০০ সালে এ প্রসঙ্গে একটি জনমত জরিপ চালানো হয়েছিল। সেখানে ৭০% পরিবারই বলেছিল, তারা সন্তানের লালন-পালনে পিতার অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজি আছে। কিন্তু মাত্র ১০% পুরুষই সরাসরি জানিয়েছিল যে, হ্যাঁ, তারা নিজেরাই তাদের সন্তানের যাবতীয় দেখভাল করতে প্রস্তুত। বেশিরভাগ পুরুষেরই মতামত ছিল যে, হ্যাঁ, আমি আমার বাচ্চার যত্ন নিতে চাই বটে, কিন্তু আগে আমি আমার কাজে মনোনিবেশ করতে চাই, কিংবা সন্তানের যত্ন নেয়া তো মায়েদের দায়িত্ব!

Image Courtesy: Getty Images

ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এই প্রকল্পের জনপ্রিয়তা

বলাই বাহুল্য, রাতারাতি এই প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখেনি। ২০১২ সালে মাত্র ১.৯% পুরুষ বাবা হওয়ার পর পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিল। তবে ক্রমশ জাপানি পুরুষদের মধ্যে এই প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৫ সালে প্রায় ৩% বাবা এই সুযোগ গ্রহণ করেছিল। আর ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭%-এ।

এখনও লম্বা পথ পাড়ি দেয়া বাকি

সম্প্রতি প্রকাশিত এক হিসাব বলছে, পরিপূর্ণ লিঙ্গ সমতা স্থাপিত হলে তার ফলে জাপানের জিডিপিতে অতিরিক্ত ৫৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যোগ করতে পারে। তবে সেজন্য জাপানকে এখনও বেশ দীর্ঘ একটি পথই পাড়ি দিতে হবে।

বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতার সূচকে শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ হলো সুইডেন। সেখানে বাবারা পিতৃত্বকালীন ছুটির এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করছে (সন্তান জন্মগ্রহণের পর সেখানকার বাবারা ৪৮০ দিন পর্যন্ত ছুটি নিতে পারে)। অপরদিকে ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গ ব্যবধান প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৪৪টি দেশের মধ্যে জাপানের অবস্থান ১১৪তম।

রয়েছে বিরোধিতাও

অনেক পুরুষই ইকুমেন ধারণাটিকে সাদরে গ্রহণ করেছে, এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এখনও জাপানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষই এই ধারণার পক্ষপাতি নয়। নিউজ পোস্ট সেভেনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বসই ইকুমেন ধারণাটিকে স্রেফ অর্থহীন বলে মনে করে। তাদের মতে, পিতৃত্বকালীন ছুটি গ্রহণ পুরুষদেরকে যেমন স্বার্থপর করে তোলে, তেমনি এতে তাদের স্ত্রীদের স্বভাবও নষ্ট করে দেয়া হয়!

Image Courtesy: EPA

পক্ষ-বিপক্ষের অনুপাত

এক জরিপের মাধ্যমে দেখা গেছে, বিগত প্রজন্মই এই ধারণার বিরোধিতা করছে সবচেয়ে বেশি। সারাজীবন যেসব পুরুষ বাইরের কাজ করে এসেছে আর ঘরের কাজ ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব স্ত্রীদের উপরই চাপিয়ে দিয়ে এসেছে, তারা এই আকস্মিক পরিবর্তন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। এই ধারণার যৌক্তিকতাও তাদের কাছে ঠিক বোধগম্য নয়। তবে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সানন্দেই এই ধারণাটিকে গ্রহণ করছে। তবে কারও কারও এই ধারণার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণের নেপথ্যে এই ভয়ও কাজ করছে যে, তারা যদি পিতৃত্বকালীন ছুটি গ্রহণ না করে, তাহলে হয়তো তারা সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট অবসরকালীন ভাতা পাবে না।

ইকুমেন প্রজেক্ট কি সফল হয়েছে?

ইকুমেন ধারণার প্রচলনের উদ্দেশ্যই হলো সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে সমতা স্থাপন করা। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এই ধারণা কতটুকু সফল? আসলেই কি নারী-পুরুষের সমতা স্থাপিত হচ্ছে?

এমন প্রশ্নের সদুত্তর পেতে আমাদেরকে আগে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একজন পুরুষ যেকোনো কর্মদিবসে তার সন্তানের সাথে গড়ে মাত্র ৪০ মিনিট সময় কাটাতে পারত, এবং তা-ও সেই সময়ে, যখন পরিবারের সকলে মিলে খেতে বসা হতো। এমনকি কিছু প্রতিবেদন এটাও বলছে, তখনকার দিনে অনেক পুরুষ নাকি চা পর্যন্ত বানাতে পারতো না। অফিসে যাওয়ার প্রাক্কালে জুতা বা টাই খুঁজে পেতেও তাদেরকে স্ত্রীর সাহায্য নিতে হতো। এবং সন্তানের সাথে তাদের সম্পর্কে ছিল হাজার মাইলের দূরত্ব। জাপানে তো একটি কথাই প্রচলিত ছিল এমন যে, চারটি জিনিসকে ভয় পেতে হবে- জিশিন, কামিনারি, কাজি ও ওয়াজি, অর্থাৎ ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আগুন ও বাবা!

Image Courtesy: Getty Images

বলা বাহুল্য, এমন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে কর্মজীবী নারীদের জীবন একদমই সহজ ছিল না। যদি কোনো নারী কাজ করতে ইচ্ছুকও হতো, তবু সন্তান জন্মদানের পর তাদের মধ্যে অনেকেই বাধ্য হতো কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘরে বসে সন্তানের দেখভালে ব্রতী হতে। আর এজন্য অনেক জাপানি নারীর মনে তো বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির উপরই বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল। অনেক নারীই দেরি করে বিয়ে করতো। অনেকে তো আবার বিয়ে করতোই না। এর প্রভাব পড়েছিল জাপানে শিশুর জন্মহারেও। অপরদিকে যেসব নারী কর্মজীবী ছিল, তাদের সন্তানেরা যেহেতু বাবা-মা কাউকেই কাছে পেত না, তাই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এসব অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর বলতেই হবে, জাপানের অবস্থার অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে। এখন আর বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্কে অত বেশি দূরত্ব নেই, সন্তানেরা যথেষ্ট সময় তাদের বাবাকে কাছে পাচ্ছে। ফলে পর্যাপ্ত অভিভাবকত্বের অভাবে সন্তানদের আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে। অন্যদিকে নারীরাও এখন আর বিয়ে করতে নিরুৎসাহী নয়। বিয়ের আগেই তারা হবু স্বামীর সাথে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারছে যে, সন্তানের লালন-পালনে দুজনেরই সমান ভূমিকা থাকবে, তাই সন্তান জন্মের পর তাদেরকে বাধ্য হয়ে কর্মজীবনকে বিদায় বলতে হবে না। আর এর ফলে জাপানে শিশুর জন্মহারও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।

Image Courtesy: Reuters

এবং সামগ্রিকভাবে যদি জানতে চাওয়া হয়, জাপানে এখন নারী-পুরুষের সমতা বিধান হয়েছে কি না, সেক্ষেত্রে বলতে হবে, পুরোপুরি সমতা বিধান এখনও না হলেও, উন্নতিটা চোখে পড়ার মতোই। ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯২ সালে যখন জানতে চাওয়া হয়েছিল, পুরুষদের দায়িত্ব কাজ করে অর্থ উপার্জন করা আর নারীদের দায়িত্ব ঘর সামলানো- এমন দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে তারা একমত কি না, তখন জাপানের ৬০% মানুষ তাতে সম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে যখন অভিন্ন প্রশ্ন করা হয়, তখন সম্মতি প্রদান করে মাত্র ৪৫% মানুষ।

সুতরাং ইকুমেন প্রজেক্টটি পুরোপুরি সফল না হলেও, জাপানের মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে ঠিকই।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This Bangla article is on how Japanese men, called Ikumen, are changing the traditional way of parenting. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Getty Images

Related Articles