Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুয়েজ খালে এভার গিভেনের ছয় দিন || পর্ব ৪

(পর্ব ৩-এর পর) 

জভেন্ডসন দ্রুতই উপলব্ধি করতে পারলেন এভার গিভেনের দুর্ঘটনা কোনো সাধারণ বিষয় নয় এবং এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। গাড়ি নির্মাণ ও সুপার মার্কেটে বণ্টন ব্যবস্থার মতো আধুনিক কার্গো শিপিং ব্যবসাও ঠিক সময়মতো পরিচালনা করতে হয়। মালপত্র প্রয়োজন অনুযায়ি সুনির্দিষ্ট সময়ের মতো সরবরাহ করতে হয়।

সত্তরের দশকে কন্টেইনার ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করার আগে বড় জাহাজগুলো খালি ও পূর্ণ করতে এক সপ্তাহ সময় লেগে যেত। বর্তমানে ১০ হাজার বা তার চেয়ে বেশি কন্টেইনার বহনকারী জাহাজকে বন্দরে খালি করতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। এগুলো করা হয় অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ক্রেনের মাধ্যমে। এটা কার্যকরী মডেল কিন্তু একইসাথে ঠুনকো। এতে সাপ্লাই চেনে শুধুমাত্র একটা সমস্যাই পুরো ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে।

সুয়েজ খালে যানজটের কারণে এপিএম টার্মিনালের মতো কোম্পানিগুলোতে জাহাজ নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারছিল না; Image Source: APM Terminals

সুয়েজ খাল দীর্ঘ সময় ধরে অচল থাকলে কয়েক স্তরের বাণিজ্যে বিলম্ব ঘটতে পারে, যার প্রভাবে লাখ লাখ মানুষের কয়েক মাস ধরে দৈনিক বাণিজ্যে ক্ষতি হবে। নিউ জার্সিতে থাকা এপিএমটির টার্মিনালে নির্ধারিত জাহাজ না পৌঁছানোর কারণে শুধু কার্গোর জন্য অপেক্ষা করে থাকা আমেরিকান কোম্পানিগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এতে রপ্তানির জন্য বাইরের দেশে পাঠানো কন্টেইনারগুলো পৌঁছে দিতেও দেরি হবে। কয়েক সপ্তাহ পর একই জাহাজ দিয়ে চীন ও মালয়েশিয়ার কারখানাগুলোর পণ্য বহন করার ক্ষেত্রে তাদেরকে বিকল্প উপায় খুঁজে নিতে হবে। এই বিপর্যয়ের মধ্যে হয়তো কোনো বিকল্পের অস্তিত্বই নেই।

এপিএমটির ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টিম তখন একত্রিত হয়ে বিভিন্ন দৃশ্যকল্প অনুযায়ী পরিকল্পনা করা শুরু করলেন। খাল যদি ২৪ ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে, সেক্ষেত্রে বন্দরগুলোর কী হবে? তিন দিন? দুই সপ্তাহ? বিলম্বিত সময় যত দীর্ঘ হবে, অপেক্ষমান জাহাজ ও কার্গোর সংখ্যাও বাড়তে থাকবে যদি না তারা কয়েক হাজার নটিকেল মাইল পথ ঘুরে আসে।

জভেন্ডসন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের কাজ ছিল আমরা কখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাব সেটা বের করা।” ম্যানেজমেন্ট টিম সিদ্ধান্তে আসে দুই সপ্তাহ হবে বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য দুর্যোগ। এক সপ্তাহের কম হলে বিপর্যয় সামাল দেওয়া যাবে। জভেন্ডসন কেবল আশা করতে পারেন কেউ একজন এভার গিভেনকে তার আগেই সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে দিক।

সে ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তরমুখী বহরে এভার গিভেনের ঠিক পেছনে থাকা মায়েরস্ক শিপের এক প্রকৌশলী জাহাজের এক ছবি ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দিয়ে বলেন, “মনে হচ্ছে আমাদের এখানে আটকা পড়তে হচ্ছে।”

সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে ২৪ ঘণ্টা সময় নেয়। তারা জানায় এভার গিভেন বাজে আবহাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। এভারগ্রিনের নির্বাহীরা কোনো সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। তাদের পক্ষ থেকে দায় চাপানো হয় ‘সন্দেহজনক আচমকা দমকা বাতাস’কে। স্থানীয় সামুদ্রিক এজেন্টরা একে ‘ব্ল্যাকআউট’ বলে অবিহিত করেন।

এভার গিভেন আটকে থাকায় খালে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমান সারিতে জমতে থাকছিল পণ্যবাহী জাহাজগুলো; Image Source: Cnes 2021, Distribution Airbus

২৪ মার্চ দিনের শেষে ১৮৫টি জাহাজ জমা হয় খাল পার হওয়ার লাইনে অপেক্ষা করার জন্য। এগুলো বহন করছিল ইলেকট্রনিক পণ্য, সিমেন্ট, পানি, লক্ষ লক্ষ গ্যালন তেল, এবং কয়েক হাজার জীবিত প্রাণী। এক শিপিং জার্নাল হিসেব করে প্রতিদিন ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামুদ্রিক যানবাহন জড়ো হচ্ছিল সেখানে।

ইউরোপ থেকে তখন সাহায্য আসা শুরু হচ্ছিল। ডাচ মেরিন কংলোমারেট রয়েল বস্কালিস ওয়েস্টমিনিস্টার এনভি এর অধীনস্থ কোম্পানি এসএমআইটি স্যালভেজের একটা দল আসছিল, যাদের ভাড়া করেছিলেন জাপানে থাকা এভার গিভেনের মালিকরা। তাদের কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমুদ্রে সার্বক্ষণিক উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা। যখন কোনো ক্রুজ লাইনার ডোবা শুরু করে অথবা তেলের ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয় স্যালভেজ ক্রুরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেখানকার মানুষ, কার্গো ও যন্ত্রপাতি উদ্ধার করে থাকে।

এটা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি এড্রেনালিন ক্ষরণ করা পেশাগুলোর একটি। স্যালভেজ কর্মীরা তাদের কাজ করার জন্য থান্ডারবার্ড ঘরানার সকল যানবাহন ব্যবহার করে থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে হেলিকপ্টার এবং উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টাগ বোট সি স্ট্যালিয়ন ও নরডিক জায়ান্ট। এই ব্যবসা খুবই লাভজনক। ক্রুরা চুক্তি অনুযায়ী যতটুক মূল্যের সম্পদ উদ্ধার করতে পারে তার একটা অংশ নিয়ে থাকে। এতে সম্ভাব্য দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করার সুযোগ থাকে। যদি ব্যর্থ হয়, তারা কিছু পায় না।

এসএমআইট স্যালভেজ কর্মীরা সমুদ্রে বিপর্যয়ে পড়া জাহাজগুলো উদ্ধার করে থাকেন; Image Source: SMIT

২৫ মার্চ এসএমআইটি টিম সেখানে পৌঁছার পর এর সদস্যরা এভার গিভেনকে জরিপ করলেন। তারপর এলসাইদ ও তার সহকর্মীদের সাথে জাহাজের বোর্ডে দেখা করলেন। এসএমআইটি সেখানে পরামর্শ দিতে এসেছিল, কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার তাদের ছিল না। কারণ সেখানে সুয়েজে উদ্ধার কার্যক্রমের এখতিয়ার শুধু খাল কর্তৃপক্ষের। তবে ডাচ বিশেষজ্ঞদের একটা পরিকল্পনা ছিল। যদি জাহাজ টানার কার্যক্রম সফল না হয়, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে জাহাজকে হালকা করা। তারা ইতোমধ্যে একটা ক্রেন শনাক্ত করেছিল যেটা এভার গিভেনের ডেক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। এটা প্রতি ঘণ্টায় পাঁচটি কন্টেইনার স্থানান্তর করতে সক্ষম। এই কষ্টসাধ্য কাজটি করতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত জাহাজটি ১০ হাজার টন হালকা হয়। ক্রেন সেখানে পরের সপ্তাহে চলে আসতে পারবে। তাদের শুধু এখন একটা জাহাজের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন ক্রেনটাকে এখানে আনার জন্য।   

এলসাইদ প্রশ্ন করেন, “আপনারা কন্টেইনারগুলো রাখবেন কোথায়?” এসএমআইটির এক নির্বাহী বলেন তারা এগুলোকে তুলনামূলক ছোট বোটে স্থানান্তর করবেন, যেগুলো খালের কয়েক মাইল দূরে এক হ্রদে নিয়ে যাবে। তারপর ক্রেন থেকে আরেকটি বোটে কন্টেইনার স্থানান্তর করা হবে। এলসাইদ চিন্তা করলেন এভাবে কাজ করতে গেলে অন্তত তিন মাস সময় লেগে যাবে। তিনি জানান- আমাদের কাছে এত সময় নেই। এসএমআইটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এটা হবে একটা বিচক্ষণীয় বিকল্প ব্যবস্থা। অবশেষে সবাই একমত হলেন যে, বিশাল ক্রেন না আসা পর্যন্ত তারা গর্ত খনন আর জাহাজ টানতে থাকবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত জাহাজ তার স্থান পরিবর্তন না করলে মালপত্র খালি করা শুরু করা হবে।

এভার গিভেনে প্রায় বিশ হাজার কন্টেইনার ছিল; Image Source: Samuel Mohsen/picture-alliance/dpa/AP

এসএমআইটি তখন তাদের সহযোগী কোম্পানি ও কন্ট্রাক্টরদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করে শক্তিশালী টাগ বোটের জন্য। প্রাপ্ত বোটগুলোর একটি ছিল ইতালীয় মালিকানাধীন কার্লো মাগনো, যা ইতোমধ্যে লোহিত সাগর থেকে মিসরের পথে কয়েক দিন দূরের পথে ছিল। ২৮০ টন টানার ক্ষমতা সম্পন্ন ডাচ আল্প গার্ডও কয়েক দিনের দূরত্বে ছিল।    

এলসাইদ তখন এভার গিভেনে থাকা শুরু করেন। ড্রেজারে থাকা রাবির সাথে তিনি রেডিওতে যোগাযোগের মাধ্যমেই বেশিরভাগ সময় কাটান। তিনি চেষ্টা করছিলেন ক্রুদের উদ্যোম ধরে রাখার জন্য। খালের পাশে স্থাপন করা আর্মি ক্যাম্পে কর্তৃপক্ষের নাবিক, প্রকৌশলী, চালকরা কেউই রাতে খুব একটা ঘুমাতে পারেননি। সারাদিন ধরে কঠোর পরিশ্রমের খনন আর টানাটানির পর তারা হয়তো দেখতে পেতেন এভার গিভেন মাত্র এক মিটার স্থান পরিবর্তন করেছে। এলসাইদ তাদেরকে বলতেন, “এটা ভালো লক্ষণ। নড়া শুরু করেছে। আগামীকাল আরো সরে আসবে।”  

(বাকি অংশ পর্ব ৫-এ) 

Related Articles