Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যখন আজারবাইজান রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছিল || পর্ব–২

[১ম পর্ব পড়ুন]

২০২০ সালের ৯ নভেম্বর আজারবাইজানি সৈন্যরা একটি রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার পরপরই আজারবাইজানি সরকার এটিকে একটি ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা রাশিয়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়, এবং রুশ সরকার তাদের ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ গ্রহণ করে। আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে ঘটনাটি সেখানেই সমাপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কার্যত সেরকম হয়নি।

রুশ ‘মি–২৪’ শুটডাউন সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব

রুশ হেলিকপ্টারটি যখন ভূপাতিত হয়, তখন আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পর্যায়ে ছিল। হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার ঠিক আগের দিনই আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সৈন্যদের পরাজিত করে মূল নাগর্নো–কারাবাখে অবস্থিত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যবহ শুশা শহর দখল করে নেয়। এই পর্যায়ে এসে আর্তসাখে আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছিল, এবং সামরিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছিলেন যে, আজারবাইজানি সৈন্যরা চাইলেই আরো অগ্রসর হয়ে আর্তসাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ত দখল করে নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে নাগর্নো–কারাবাখের সম্পূর্ণ অংশ আজারবাইজানের হস্তগত হতো এবং নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান আজারবাইজানের পক্ষে চলে যেত।

কিন্তু তেমনটি হয়নি। কারণ আজারবাইজানি সৈন্যরা রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি সরকার রুশ মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং পরবর্তী দিন (অর্থাৎ ১০ নভেম্বর) থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ চলাকালে আজারবাইজানিরা যেসব অঞ্চল পুনর্দখল করেছিল, সেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। তদুপরি, ১৯৮৮–৯৪ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় আর্মেনীয়রা নাগর্নো–কারাবাখের আশেপাশের যে ৭টি জেলা দখল করেছিল (এবং সেগুলোর যতটুকু অংশ তখন পর্যন্ত আর্মেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল), সেগুলো তারা আজারবাইজানকে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। সর্বোপরি, আর্মেনীয় সরকার আর্মেনীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড ও নাখচিভানের মধ্যে একটি করিডোর স্থাপনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। অর্থাৎ, যুদ্ধের আগে বিভিন্ন সময়ে রুশরা আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য যেসব পরিকল্পনা পেশ করেছিল, এই চুক্তিটি ছিল বহুলাংশে সেই পরিকল্পনাগুলোরই বাস্তবায়ন।

নাগর্নো–কারাবাখে রুশ শান্তিরক্ষী ও আজারবাইজানি সৈন্যরা; Source: Ministry of Defense of the Russian Federation/Wikimedia Commons

প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি আজারবাইজানের জন্য খুবই লাভজনক ছিল। বস্তুত আজারবাইজানি সরকার সেভাবেই চুক্তিটিকে আজারবাইজানি জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করে এবং এটিকে ‘আর্মেনিয়ার আত্মসমর্পণ’ হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু পরবর্তীতে আজারবাইজানি জনসাধারণের একাংশ প্রশ্ন উত্থাপন করে, আজারবাইজান তো চাইলেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত এবং সামরিক শক্তিবলে পুরো আর্তসাখ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত। সেটা না করে কেন তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে গেল?

তদুপরি, যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে এমন বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল, যেগুলো আজারবাইজানি জনসাধারণের একাংশকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া আর্তসাখে (অর্থাৎ শুশা বাদে নাগর্নো–কারাবাখের অবশিষ্টাংশে) ৫ বছরের জন্য ১,৯৬০ জন শান্তিরক্ষী মোতায়েন করার অধিকার লাভ করে (এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রুশরা আর্তসাখে সৈন্য মোতায়েন করতে শুরু করে)। তদুপরি, এই চুক্তি অনুযায়ী আর্তসাখ ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ‘লাচিন করিডোরে’র নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব রুশ সৈন্যদের ওপর অর্পণ করা হয় এবং আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড ও নাখচিভানের মধ্যে করিডোর স্থাপিত হলে সেই করিডোরটির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও রুশ সীমান্তরক্ষীদের ওপর অর্পিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সর্বোপরি, আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষীদের সেখানে অবস্থানের মেয়াদ ৫ বছর পর আবার বৃদ্ধি করা যাবে, এই শর্তও চুক্তিটিতে উল্লেখ করা হয়।

আজারবাইজানি জনসাধারণ (এবং কার্যত এই যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সিংহভাগ ব্যক্তি) ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধকে একটি রুশ–তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করেছিল, যেখানে রাশিয়ার প্রক্সি ছিল আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ, আর তুরস্কের প্রক্সি ছিল আজারবাইজান। অবশ্য বাস্তবতা ছিল অনেকটাই ভিন্ন। এই যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে ব্যাপক মাত্রায় সামরিক সমর্থন দিয়েছে এবং তুর্কি সৈন্য ও তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মার্সেনারিরা সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু রাশিয়া এই যুদ্ধে কার্যত পুরোপুরি নিরপেক্ষ থেকেছে, উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি স্থাপনের চেষ্টা করেছে, আজারবাইজানের প্রতি তুর্কি সমর্থনকে ‘আইনসঙ্গত’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং কিছু অস্ত্র সরবরাহ ছাড়া আর্মেনিয়াকে কোনো ধরনের বিস্তৃত সহায়তা প্রদান করেনি (যেটি তুরস্ক আজারবাইজানের ক্ষেত্রে করেছে)। সুতরাং এই যুদ্ধটি কার্যত রুশ–তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধ ছিল না, এবং যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল এরচেয়ে অনেক বেশি জটিল।

২০২০ সালের জুলাইয়ে আজারবাইজানের নাখচিভানে তুর্কি–আজারবাইজানি যৌথ সামরিক মহড়া উপলক্ষে আগত একদল তুর্কি সৈন্য; Source: Anadolu Agency/Daily Sabah

কিন্তু আজারবাইজানি জনসাধারণ এত সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে যায়নি। তাদের দৃষ্টিতে, যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজান (অর্থাৎ তুর্কি প্রক্সি) বিজয়ী হয়েছে এবং আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ (অর্থাৎ রুশ প্রক্সিরা) পরাজিত হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রশ্ন উত্থাপন করে, আর্তসাখে কেন রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হলো? কেন সেখানে রুশদের পরিবর্তে তুর্কি শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হলো না?

সহজ ভাষায়, আজারবাইজানি জনসাধারণের প্রশ্ন ছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজানের নিকট রুশ প্রক্সিরা পরাজিত হয়েছে, এরপরও আজারবাইজানি সরকার কেন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাশিয়াকে এত সুযোগ–সুবিধা প্রদান করল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা এর সঙ্গে রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পায়। রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কেন আজারবাইজানি সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হলো, সেটির কারণ হিসেবে আজারবাইজানি জনসাধারণের একাংশ ধারণা করতে শুরু করে যে, আজারবাইজান ‘ভুলক্রমে’ রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার পর নিশ্চয়ই রাশিয়া সরাসরি আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার হুমকি দিয়েছিল এবং এজন্য রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে আজারবাইজানি সরকার দ্রুত রুশ শর্ত মোতাবেক যুদ্ধবিরতি স্থাপন করতে রাজি হয়ে গেছে।

অর্থাৎ, আজারবাইজানি জনসাধারণের একাংশের বিশ্বাস, আজারবাইজান ‘ভুলক্রমে’ রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার পর রাশিয়া আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার একটি ‘যথার্থ কারণ’ (casus belli) খুঁজে পায় এবং রুশ হস্তক্ষেপের হুমকিতে ভীত হয়ে আজারবাইজানি সরকার দ্রুত রুশ শর্তাবলি মেনে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ পত্রিকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে’র সাংবাদিক আন্তন ত্রয়ানোভস্কি ও কার্লোটা গল এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন এবং দাবি করেছেন যে, রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার পর ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে রুশ সরকার আর্তসাখের অভ্যন্তরে আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনীর চলমান অগ্রাভিযান বন্ধ রাখার জন্য আজারবাইজানি সরকারকে বাধ্য করে।

আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীর একদল সৈন্য; Source: Armenia/Twitter

কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার বিষয়ে এটিই কেবল একমাত্র ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ (conspiracy theory) নয়। কিছু কিছু আজারবাইজানি নাগরিকের বিশ্বাস, আজারবাইজানি সৈন্যরা নয়, আর্মেনীয় সৈন্যরা রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করেছিল এবং সেটির দায় আজারবাইজানিদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল! এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের বক্তব্য হচ্ছে, যখন আর্মেনীয়রা বুঝতে পারছিল যে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, তখন যুদ্ধে রাশিয়াকে জড়িত করার উদ্দেশ্যে তারা রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করে এবং এরপর রুশ হস্তক্ষেপের ভয়ে আজারবাইজানি সরকার যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়, যার ফলে আর্তসাখের অবশিষ্টাংশ আর্মেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়।

আজারবাইজানি জনসাধারণের আরেকটি অংশের বিশ্বাস, রুশরা ইচ্ছে করেই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্তে তাদের হেলিকপ্টারটিকে প্রেরণ করেছিল। এই তত্ত্বের বিশ্বাসীদের মতে, রুশরা জানত যে, সন্ধ্যার সময় অন্ধকারে আজারবাইজানি সৈন্যরা হেলিকপ্টারটি কাদের সেটি যাচাই করতে পারবে না এবং যুদ্ধাবস্থার কারণে তারা যাচাই না করেই হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করবে। কার্যত সেটিই ঘটে এবং এরপর সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ভয় দেখিয়ে রুশরা আজারবাইজানি সরকারকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করে। অর্থাৎ, এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী, রুশরা আর্মেনিয়া ও আর্তসাখকে পরিপূর্ণ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য এবং তুর্কি–আজারবাইজানি জোটের বিজয় রোধ করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের একটি হেলিকপ্টার ‘বিসর্জন’ দিয়েছে! এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, আগে যেহেতু কখনো ঐ অঞ্চলে রুশ হেলিকপ্টার দেখা যায়নি, সেহেতু আজারবাইজানিদের শুশা দখলের পরপরই অঞ্চলটিতে রুশ হেলিকপ্টার দেখা যাওয়া কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না!

শুধু তা-ই নয়, এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিও দাবি করেছিল যে, আজারবাইজানিরা যে রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করেছে, সেটির ক্রুরা রুশ ছিল না, বরং তারা ছিল আর্মেনীয়! কিন্তু তাদের এই দাবিটি সত্যি নয়, কারণ হেলিকপ্টারটির ক্রু তিনজনের মধ্যে সকলেই (মেজর ইশ্চুক, সিনিয়র লেফটেন্যান্ট ফেদিনা এবং সিনিয়র লেফটেন্যান্ট গ্রিয়াজিন) ছিলেন রুশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য, আর্মেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর না।

মি–২৪ শুটডাউনের ঘটনায় নিহত মেজর ইউরি ইশ্চুক আর্মেনীয় বিমানবাহিনীর নয়, রুশ বিমানবাহিনীর সদস্য ছিলেন; Source: Donday-Novocherkassk/GTRK Kostroma

আরেকটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ এসেছে রুশ জনসাধারণের একাংশের কাছ থেকে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আজারবাইজানি সৈন্যরা নয়, তুর্কি সৈন্যরা কিংবা তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় মার্সেনারিরা রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করেছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া, যাতে আজারবাইজান পুরোপুরিভাবে তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, নাখচিভানে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল না এবং এজন্য সেখানে আজারবাইজানি সৈন্যরা হঠাৎ করে রুশ হেলিকপ্টারের ওপর আক্রমণ চালাতে যাবে, এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। তদুপরি, নাখচিভানে বহু আগে থেকেই তুর্কিদের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে এই তত্ত্বকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না, কিন্তু এই তত্ত্বেরও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সিরীয় মার্সেনারিদের আর্তসাখের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণের পশ্চাতে তুর্কি ও আজারবাইজানি সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে ‘খরচযোগ্য লোকবল’ (expendable manpower/cannon fodder) হিসেবে ব্যবহার করা এবং এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানিদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সীমিত রাখা। নাখচিভানে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে সেরকম কোনো লড়াই চলছিল না এবং এজন্য সেখানে সিরীয় মার্সেনারিদের মোতায়েন করা হয়েছিল, এই সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম।

সামগ্রিকভাবে, আজারবাইজান কর্তৃক রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক/গুজব/ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে। এগুলো সত্যি, নাকি মিথ্যা, নাকি সত্যি ও মিথ্যার সংমিশ্রণ, সেটা যাচাই করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এগুলোকে নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করা বা বর্জন করা কোনোটাই যুক্তিসঙ্গত নয়।

তদুপরি, আজারবাইজান রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার পর রাশিয়া আজারবাইজানকে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার ‘হুমকি’ দিয়েছিল, এই বক্তব্যের পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো কংক্রিট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বস্তুত আজারবাইজানি সরকার যে শুশা দখলের পর যুদ্ধ বন্ধ করেছিল, সেটির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে এবং সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এজন্য এই বিষয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যৌক্তিক নয়।

পরবর্তী ঘটনাবলি

রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার ঘটনার পরপরই আজারবাইজানি সরকারের ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছিল যে, রাশিয়া ও আজারবাইজান কেউই আর বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু বাস্তবে সেরকম হয়নি। এই ঘটনার পরই রাশিয়ায় নিযুক্ত আজারবাইজানি রাষ্ট্রদূত পোলাদ বুলবুলোগলু রুশ সংবাদ সংস্থা ‘রোসিয়া সেগোদনিয়া’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে রুশ হেলিকপ্টারটির ভূপাতিত হওয়া প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, যুদ্ধের সময় এরকম ঘটনা ঘটেই থাকে। রুশ জনসাধারণ তার এই বক্তব্যকে উক্ত হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার ফলে নিহত রুশ ক্রুদের প্রতি ‘অসম্মান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার এই বক্তব্যের কঠোর নিন্দা জানিয়ে মন্তব্য করে, রাশিয়া যদি ‘যুদ্ধের সময় এরকম ঘটনা ঘটেই থাকে’ এই জাতীয় মনোভাব প্রদর্শন করতে শুরু করে, সেক্ষেত্রে তার পরিণতি (আজারবাইজানের জন্য) ভালো হবে না!

রাশিয়ায় নিযুক্ত আজারবাইজানি রাষ্ট্রদূত পোলাদ বুলবুলোগলু ‘মি–২৪’ শুটডাউন সম্পর্কিত একটি মন্তব্যের কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হন; Source: EnIcmal.az

এবারও আজারবাইজানি সরকার নমনীয় ভাব প্রদর্শন করে এবং আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা হিকমেত হাজিয়েভ এই বিষয়ে মন্তব্য করেন যে, রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার বিষয়ে বুলবুলোগলুর বক্তব্য আজারবাইজানি সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ তার মনোভাব আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আজারবাইজানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলগার ভেলিজাদের ভাষ্যমতে, বুলবুলোগলুর মতো একজন সিনিয়র কূটনীতিবিদ যে কেন এই ধরনের বক্তব্য প্রদান করলেন, সেটি বোধগম্য নয়। অবশ্য রুশ ও আজারবাইজানি সরকার শীঘ্রই এই ঘটনাটি মিটমাট করে ফেলে এবং এর মধ্য দিয়ে বুলবুলোগলুর প্রদত্ত বক্তব্যের ফলে সৃষ্ট সঙ্কটের নিরসন হয়।

এদিকে হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার পরপরই রুশ সশস্ত্রবাহিনী ঘটনাটির তদন্ত করতে শুরু করে এবং এরপর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয়দ্বয়ও উক্ত ঘটনার তদন্ত আরম্ভ করে। কিন্তু তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি। শুধু তাই নয়, আজারবাইজানি সরকার রুশ হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার জন্য দায়ী সৈন্যদেরকে গ্রেপ্তার করেছে কিনা, সেটিও জানা যায়নি। তদুপরি, হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হওয়ার পরপরই আজারবাইজানি সরকার হেলিকপ্টারটির ক্রুদের পরিবার–পরিজনকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এই ক্ষতিপূরণ প্রদান করেনি এবং এই বিষয়ে রুশ সরকারের আর কোনো বক্তব্যও শোনা যায়নি।

বস্তুত বুলবুলোগলুর মন্তব্য নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের পর বেশ কিছুদিন আর প্রচারমাধ্যমে আজারবাইজান কর্তৃক রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে রুশ রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এই সরাসরি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রদান থেকে বিরত থাকেন এবং মন্তব্য করেন যে, রাশিয়া ও আজারবাইজান সকল বিষয়ে নিয়মিত ও গঠনমূলক সংলাপ জারি রেখেছে।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে রুশ সশস্ত্রবাহিনী জানায় যে, তারা রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার ঘটনাটিকে ‘ইচ্ছাকৃত খুন’ হিসেবে বিবেচনা করছে এবং সেই মোতাবেক আইনি প্রক্রিয়া চালানো হবে। এই ধারা মোতাবেক বিচার করলে হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে রুশ সশস্ত্রবাহিনী ও আজারবাইজানি প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় ঘটনাটিকে ‘কর্তব্যের প্রতি অবহেলা’ হিসেবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরবর্তীতে রুশ সশস্ত্রবাহিনী কেন এই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনলো, সেটি স্পষ্ট নয়। তদুপরি, আজারবাইজানি প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় এই ব্যাপারে রুশদের সঙ্গে একমত হয়েছে কিনা, সেটিও জানা যায়নি।

‘মি–২৪’ শুটডাউনের ঘটনায় সিনিয়র লেফটেন্যান্ট ভ্লাদিস্লাভ গ্রিয়াজিন প্রাণে বেঁচে যান এবং রুশ ‘অর্ডার অফ কারেজ’ ও আর্মেনীয় ‘ফর মিলিটারি মেরিট’ পদকে ভূষিত হন; Source: Asatur Yesayants/Sputnik

২০২১ সালের মে মাসে আজারবাইজানি প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় এই মামলার বিষয়ে রুশদের কাছে আইনি সহায়তা প্রার্থনা করে এবং পরবর্তীতে তারা রুশ প্রচারমাধ্যমকে জানায় যে, তারা মামলাটিতে একটি উপসংহারে পৌঁছেছে। কিন্তু সেই উপসংহার কী ছিল, বা মামলায় রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার জন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিনা, সেসব রুশ বা আজারবাইজানি প্রচারমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়নি। এর ফলে বিষয়টি এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে।

বস্তুত আজারবাইজানিদের রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার বিষয়টি নিয়ে রুশ ও আজারবাইজানি সরকার শুরু থেকেই খুব কম তথ্য প্রদান করেছে এবং এর ফলে প্রচারমাধ্যমে বিষয়টির উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। এর অনিবার্য ফল হিসেবে ঘটনাটি নিয়ে নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তত্ত্বগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রতিটি তত্ত্বের পশ্চাতেই কিছু যুক্তি রয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য–প্রমাণের অভাবের কারণে এগুলোর কোনোটিকেই ধ্রুব সত্য হিসেবে ধরে নেয়া যায় না।

‘মি–২৪’ শুটডাউনের ঘটনায় যে দুজন ক্রু নিহত হয়েছেন (মেজর ইশ্চুক ও সিনিয়র লেফটেন্যান্ট ফেদিনা) এবং যে ক্রু জীবিত রয়েছেন (সিনিয়র লেফটেন্যান্ট গ্রিয়াজিন), তাদের প্রত্যেককেই রুশ সরকার মর্যাদাসূচক ‘অর্ডার অফ কারেজ’ (রুশ: Орден Мужества, ‘অর্দেন মুঝেস্তভা’) পদকে ভূষিত করেছে এবং নিহত ক্রুদের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে। অনুরূপভাবে, আর্মেনীয় সরকার রুশ হেলিকপ্টারটির তিনজন ক্রুকে (ইশ্চুক ও ফেদিনার ক্ষেত্রে মরণোত্তর) ‘ফর মিলিটারি মেরিট’ পদকে ভূষিত করেছে এবং নিহত দুইজন ক্রুর স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। কিন্তু ‘মি–২৪’ শুটডাউনের প্রকৃত প্রেক্ষাপট এখনো কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে, এবং বর্তমানে রাশিয়া ও আজারবাইজানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেরকম, তাতে এই বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

Related Articles