এতদিন ধরে শুধু এটা তার কল্পনাই ছিল। কত রাতেই স্বপ্ন দেখেছেন- অ্যাপোলো মিশনে চাঁদের মাটিতে পা রাখবেন। কত গবেষণাই তো করলেন। সারাটা দিন পৃথিবীতে বসে শুধু চাঁদের কথাটাই ভেবে গেলেন তিনি। আর এখন যখন নাসা চাঁদে মানুষকে পাঠানোর কথা ভাবছে, তখন তিনি নিজেকে কোনোভাবেই সামলে নিতে পারছেন না। রাতের আকাশে এতদিন শুধু জানালার ফাঁক দিয়েই দেখতেন চাঁদের অপরুপ সৌন্দর্য। আর সেই সুন্দরের লীলাভূমি চাঁদেই পা রাখতে যাচ্ছেন তিনি, এ কথা ভাবতেই তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।
হঠাৎই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এতদিনের এত কল্পনা কি মুহূর্তের মধ্যেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে? হাতের চিঠিটির দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। নাসার হেড কোয়ার্টার থেকে আসা এই চিঠিতে লিখা, তিনি আর চাঁদে যেতে পারবেন না, কারণ তিনি এডিসন’স ডিজিজ এ আক্রান্ত। দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রুভেজা চোখে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালের ৩১ জুলাই; দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ ছিল। কিন্তু একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে। লুনার প্রস্পেকটর স্পেসক্রাফট চাঁদের কক্ষপথে অবতরণ করেছে। কিন্তু এটি একা নয়। স্পেসক্রাফটটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ইউজিন শোমেকারের কিছু দেহভস্ম। চাঁদের মাটিতে পুঁতে দেয়া হলো তার দেহাবশেষ। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র মানব হিসেবে চাঁদের মাটিতে সমাহিত করা হলো ইউজিনকে। সেদিন যদি ইউজিন বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেখতে পারতেন- তাকে এখনো পৃথিবীবাসী ভোলেনি। ভোলেনি জ্যোতির্বিদ্যায় তার অবদানের কথা। সেদিন হয়তো এডিসন’স ডিজিজের জন্য তিনি আর চাঁদে পা রাখতে পারেননি, কিন্তু চিরদিনের জন্য এখন তাকে সেই চাঁদেই সমাহিত করা হলো।
কে এই ইউজিন শোমেকার? আর কেনই বা তাকে এভাবে সম্মানিত করা হলো?
১৯২৮ সালের ২৮ এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেন ইউজিন। এক অতি সাধারণ পরিবারেই জন্ম হয় তার। ছোটবেলা থেকেই ভূতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে তার জানার আগ্রহ ছিল বেশি। কোনো আকরিক কিংবা খনিজ পদার্থ পেলেই বাসায় নিয়ে এসে হাতে নিয়ে সূক্ষ্মভাবে দেখতেন। ১৬ বছর বয়সেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বের হন। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ভূতত্ত্ববিদ্যায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি যুক্ত্ররাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভেতে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তার এই গবেষণার বিষয়বস্তুও ছিল অনেক মজার। আর এটাই তার সুনাম বাড়িয়ে তুলেছিল পরে। তিনি গবেষণা করেছিলেন ব্যারিংটন ক্রেটার নিয়ে।
ব্যারিংটন ক্রেটার মূলত একটি বড়সড় গর্ত, যেটা আমেরিকার আরিজোনা মরুভূমিতে অবস্থিত। আগে ধারণা করা হতো যে, এই বিশাল গর্তটি কোনো অগ্ন্যুৎপাতের কারণে হয়তো তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরে ইউজিন পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন যে, এটি কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতুর তীব্রগতিতে পৃথিবীতে পতনের ফলেই তৈরি হয়েছিল।
১৯৬১ সালে ইউজিন আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভের অ্যাস্ট্রোজিওলজি সেন্টার অফ অ্যারিজোনাতে প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল কীভাবে চাঁদে সফলভাবে অবতরণ করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করা। জ্যোতির্বিদগণ কীভাবে সফলভাবে চাঁদে ল্যান্ড করবেন সেটার জন্য চাঁদের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে মাথা খাটাতে হতো তাকে, করতে হতো প্রচুর গবেষণা। বলা হয়ে থাকে, তার এই গবেষণার ফলগুলোই চাঁদে মানুষের প্রথম পদচারণায় প্রধান ভূমিকা রাখে।
শুধু তা-ই নয়, ইউজিন তার অনেক গবেষণা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন ভূ-জ্যোতির্বিদ্যাকে। চাঁদ থেকে নিয়ে আসা মাটি নিয়ে গবেষণা করে তিনি চাঁদের ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন, যা পরবর্তীতে চাঁদের আবহাওয়া এবং চাঁদে প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
১৯৬৩ সালে তিনি প্রস্তাব করেন- ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্রাণও এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে প্রবেশ করতে পারে সেই গ্রহ থেকে নিক্ষিপ্ত কোনো পাথরের অন্য গ্রহে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে। এভাবে তিনি প্ল্যানেটারি সায়েন্সে তার দক্ষতা দেখিয়ে যান। বিভিন্ন গ্রহাণু, উল্কাপিন্ড আর ধূমকেতুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে প্ল্যানেটারি সায়েন্স এ তার গবেষণালব্ধ ফলাফল লিপিবদ্ধ করে বিজ্ঞানের এই শাখাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।
ইউজিনের স্ত্রী ক্যারোলিনও জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান রাখেন। যদিও তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যায় ছিল তার অশেষ আগ্রহ। ১৯৯০ সালের দিকে ক্যারোলিন ৩২টি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন, যেখানে ইউজিনের অবদান ছিল ২৯টি আবিষ্কারে।
১৯৯৩ সালে ঘটে যায় আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা। ইউজিন, ক্যারোলিন আর লেভি মিলে আবিষ্কার করেন একটি ধূমকেতু (Comet Shoemaker–Levy 9), যা বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘুরছিল। ক্যালিফোর্নিয়ার পালোমার পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় আকস্মিকভাবেই এটা আবিষ্কার করেন তারা। তারা দেখতে পান যে, এ ধূমকেতুটি প্রায় ২০-৩০ বছর আগেই বৃহস্পতির মধ্যাকর্ষণ সীমার ভেতরে চলে যায় এবং তারপর থেকে এটা গ্রহটিকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।
পরে তারা হিসেব করে দেখতে পান- একটি নির্দিষ্ট সময় পর এ ধূমকেতুটি বৃহস্পতির সাথে ধাক্কা খাবে। এ খবরটি বিজ্ঞানীমহলে খুবই সারা ফেলে, কারণ এর আগে কেউই কখনো পৃথিবীর বাইরে দুটি বস্তুর সংঘর্ষ দেখেনি। আর যদি সত্যিই এই সংঘর্ষ হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদেরকে অনেক অজানা তথ্য দিতে সক্ষম হবে। যেমন এই বৃহস্পতির ক্ষেত্রেই। আগে কেউ জানত না যে, বৃহস্পতির ভেতরের আবহাওয়া কেমন, সেখানকার পরিবেশ কেমন। কিন্তু যদি একবার সেই ধূমকেতুর বৃহস্পতির সাথে সংঘর্ষ ঘটে, তাহলে বৃহস্পতির ভেতরের অনেক অজানা তথ্যই বিজ্ঞানীদের কাছে উন্মুক্ত হবে, কারণ সংঘর্ষের ফলে বৃহস্পতির ভেতরের বায়ুমন্ডল থেকে অনেক পদার্থ নির্গত হবে, যা বিজ্ঞানীদেরকে সেখানকার আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।
যতই সংঘর্ষের দিন ঘনিয়ে আসছিল, ততই যেন বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বেড়েই চলছিল। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর সম্ভাব্য দিন (১৬ জুলাই, ১৯৯৪) চলে এলো। জ্যোতির্বিদেরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন পৃথিবীর বাইরে ঘটে চলা অদ্ভুত এক বিস্ময়কে। পৃথিবীতে বসেই যে পৃথিবীর বাইরে এত দূরের কোনো কিছু এত সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাবে তা অনেক জ্যোতির্বিদই এর আগে কখনো ভাবতে পারেননি। ইউজিন এভাবেই জ্যোতির্বিদ্যায় অনন্য অবদান রেখে গিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালের ১৮ জুলাই। একটি খবর অনেক পত্রিকাতেই শিরোনাম হিসেবে আসে- “ইউজিন শোমেকার আর নেই।” অস্ট্রেলিয়ায় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। তার স্ত্রী ক্যারোলিন শোমেকার গুরুতর আহত হন। মুহূর্তেই যেন শোকের বন্যা বয়ে গেল পুরো বিজ্ঞানমহলে। পরদিনই শোমেকারের প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী ক্যারোলিন পোর্সো এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তিনি জানতেন- তার শিক্ষকের খুব ইচ্ছা ছিল চাঁদের মাটিতে সশরীরে অবতরণের। কিন্তু এডিসন ডিজিজের জন্য সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। যখন ইউজিনের শবদাহ করা হলো, তখন তিনি সেই মৃতদেহের ভস্ম থেকে ২৮ গ্রাম তুলে নিয়ে নাসার লুনার প্রস্পেক্টর স্পেসক্রাফটে দিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল, চাঁদের মাটিতে তার মৃতদেহের এই ভস্মটুকু দাফন করা।
একটা পলিকার্বোনেট ক্যাপসুলে করে তার এই ভস্মটুকু নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদে। ইউজিন তার সারাজীবন যে জ্যোতির্বিদ্যার পেছনে উৎসর্গ করে গেলেন, সেটার তুলনায় এতটুকু সম্মান অবশ্যই তার প্রাপ্য। প্রায় এক বছর পর যখন লুনার স্পেসক্রাফট চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায়, তখন উপর থেকে সেই পলিকার্বোনেট ক্যাপসুলটি চাঁদের মাটিতে ফেলে দেয়া হয়, আর সেই সাথে ইউজিনের দেহভস্ম চাঁদের মাটিকে স্পর্শ করে।
পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র মানব হিসেবে ইউজিনের নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হলো, যাকে চাঁদের মাটিতে সমাহিত করা হয়েছে। ইউজিনের পুরো জীবনের কৃতকর্মের প্রতিদান হিসেবে তাকে এই সম্মানটুকু দেওয়াতে বিজ্ঞানমহলের সবাই খুব খুশি হলেন। আর এই সমাহিত করার বিষয়ে তার স্ত্রীকে কিছু বলতে বললে ১৯৯৮ সালের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ক্যারোলিন বলেন, “এখন থেকে আমরা যখনই চাঁদের দিকে তাকাবো, তখনই আমাদের মনে হবে- ইউজিন সেখানেই আছে।“
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/