
ভুল ভুলাইয়া নামটা শুনে অনেকের মানসপটেই হয়তো ভেসে উঠেছে অক্ষয় কুমারের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘ভুল ভুলাইয়া’ সিনেমাটির কথা। সিনেমাটির নামকরণ করা হয়েছিল ভারতের লক্ষ্মৌ রাজ্যের বড় ইমামবাড়ার অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি গোলকধাঁধা ভুল ভুলাইয়ার নাম অনুসারে। কাবাব এবং নবাবদের শহর লক্ষ্ণৌয়ের এই গোলকধাঁধাটি ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ বিখ্যাত।
প্রায় হাজারখানি অলিগলি দিয়ে ঘেরা এই গোলকধাঁধা বিভিন্ন দেশের অভিযাত্রীদের পাশাপাশি স্থপতিদেরও আকৃষ্ট করে আসছে প্রায় দু’শ বছর ধরে। অযোধ্যার চতুর্থ নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা ১৭৮৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় সাধারণ মানুষের থাকার একটু জায়গা করে দেয়ার জন্য বড় ইমামবাড়া তৈরি করেন। বাড়িটির কাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই তা লক্ষ্ণৌয়ের গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হয়ে আছে। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী সময়ে নবাবরা তাদের বিবিদের সাথে লুকোচুরি খেলতে ইমামবাড়ার অভ্যন্তরে তৈরি করেন এই গোলকধাঁধার জটিল রাজ্য। কত শত মানুষ যে ঘুরতে এসে এই গোলকধাঁধায় পথ হারায় তা গুনে শেষ করা যাবে না! একবার এক তরুণ মাতাল অবস্থায় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে একা ঐ গোলকধাঁধায় প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ফেলে। প্রায় দু’দিন পর ভেতরের দিকের এক গলিতে খুঁজে পাওয়া যায় তার লাশ। ইমামবাড়ার অভ্যন্তরে তাই গাইড নিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

বড় ইমামবাড়া; Source: learningwhileilive.com
অনেকেই প্রশ্ন করেন ‘ভুল ভুলাইয়া’ নামটির অর্থ কি? কোত্থেকেই বা আসলো এই নাম? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া খুব একটা সহজ কাজ না। মজার ব্যাপার হলো অন্য কোনো ভাষায় এই নামটির অনুবাদ করলেও তা ঠিক যথার্থ হয় না। বাংলা ভাষায় ‘ভুল ভুলাইয়া’র অনুবাদ করার চেষ্টা করুন তো? ভুলিয়ে দেয়া বা এ ধরনের কোনো আক্ষরিক অনুবাদই এক্ষেত্রে যুতসই হবে না। ‘ভুল ভুলাইয়া’ বলতে আসলে এমন একটি জায়গার কথা বলা হয় যেখানে সহজেই যে কেউ পথ হারিয়ে ফেলবে, দিক খুঁজে পাবে না আর পরিচিত দুনিয়ায় ফেরার পথও ভুলে যাবে।

শিল্পীর তুলিতে নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা; Source: bp.blogspot.com
‘ভুল ভুলাইয়া’ সম্পর্কে জানতে হলে এর নির্মাতাদের কথা অর্থাৎ নবাবদের সম্পর্কে জানাটা খুব জরুরি। আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা রয়েছে। আমরা নবাব আর রাজাদের সমগোত্রীয় ভেবে ভুল করি। অনেকে বলেন মোঘল রাজারা যখন মনের সুখে রাজ্য শাসন করছিলেন, ঠিক সেই সময়েই দিল্লীর আশেপাশে থেকে রাজাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে সুখে-শান্তিতে রাজত্ব করছিলেন নবাবরা। কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ‘নবাব’ শব্দটি এসেছে ফার্সি শব্দ ‘নাইব’ থেকে, উৎপত্তিগত দিক থেকে যার অর্থ ‘সহকারী’। ‘নবাব’ ছিল একটি উপাধি, উত্তর ভারতের মুঘল রাজারা তাদের সহকারীদের কাজে খুশি হয়ে তাদেরকে এই উপাধিতে ভূষিত করতেন। এই উপাধিটি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো ‘বেগম’ খেতাবটি। বেগমদের মধ্যে তখন সবচেয়ে নামকরা ছিলেন ‘বেগম নাজরাত মহল’।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর নবাব এবং তাদের ক্ষমতা উভয়েই বিলুপ্ত হয়ে যায়, শুধু রয়ে যায় তাদের কেতাবি খেতাবটুকু। পরবর্তীতে এটি পারিবারিক পদবীতেও পরিণত হয়। এখনো পর্যন্ত লক্ষ্ণৌতে গেলে প্রকৃত নবাবদের দেখা পাওয়া যায়, যদিও তাদের ক্ষমতা আর অর্থবিত্ত অনেকটাই কমে গেছে। বলিউডের অন্যতম খ্যাতিমান তারকা সাইফ আলী খানের পিতা মনসুর আলী খান পতৌদী, যিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ছিলেন, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পতৌদীর নবাব হিসেবে সিংহাসন অলংকৃত করেন। পরবর্তীতে ভারতীয় সংবিধানের ২৬ তম সংশোধনীর মাধ্যমে নবাবদের এই উপাধি বর্জন করা হয় এবং তাদের ক্ষমতা লুপ্ত করা হয়।
অযোধ্যার প্রথম নবাব ছিলেন নবাব সাদাত খান (১৭২২-১৭৩৯)। এরপর যথাক্রমে নবাব হন নবাব সফদার জং (১৭৩৯-১৭৫৪), নবাব সুজাউদ্দৌলা (১৭৫৪-১৭৭৫) এবং নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা (১৭৭৫-১৭৯৮)। এরপর নবাব ওয়াজের আলী, সাদাত আলী খান, নাসিরুদ্দিন হায়দারসহ আরও অনেকে নবাব হন। আমরা বরং ‘ভুল ভুলাইয়া’র নির্মাতা আসাফ-উদ্-দৌলার দিকে নজর দিই। আসাফ-উদ্-দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকে অযোধ্যার রাজনীতিতে বহুবিধ পরিবর্তন আসে। ১৭৭৫ সালে তিনি অযোধ্যার দরবার ফায়জাবাদ থেকে স্থানান্তরিত করে লক্ষ্ণৌতে নিয়ে আসেন। তখনকার দিনে অখ্যাত লক্ষ্ণৌ ক্রমেই শিয়াদের সংস্কৃতিতে নতুন রূপে সজ্জিত হতে থাকে। শিয়া গোত্রীয় এই নবাবরা ইরান এবং ইরাকের অনুসরণে বেশ দাপটের সাথে একটি শিয়াভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলে। অচিরেই ইরানসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর শিয়াদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে লক্ষ্ণৌ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দিক থেকেও বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করে শহরটি। দৌলত খানা, আসফি মসজিদ, রুমি দরোজা, বড় ইমামবাড়া, ভুল ভুলাইয়া, বিবিয়াপুর কোঠি, চিনহুট কোঠি এগুলো সব তারই কীর্তি। ক্লড মার্টিনের কনস্ট্যানিয়া ভবনটি দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন নবাব। দশ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে ভবনটি কিনে নিতে চান তিনি। সেই সওদা পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৭৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা।

ভুল ভুলাইয়ার অভ্যন্তরে; Source:nativeplanet.com
ভুল ভুলাইয়ার ইতিহাস জানতে হলে ভ্রমণ শুরু করতে হবে বড় ইমামবাড়ার ইতিহাস থেকে। ইমামবাড়া না কোনো মসজিদ, না দরগাহ। ইমামবাড়া এমন একটি হল যেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিয়া মুসলিমরা একত্রিত হয়, বিশেষ করে মহররম স্মরণে সেখানে ‘মাতম’-এর আয়োজন করা হয়। এশিয়ার অন্যান্য অংশে; যেমন- বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান প্রভৃতি জায়গায়ও ইমামবাড়া আছে, কিন্তু বড় ইমামবাড়া শিয়াদের মধ্যে বেশ প্রসিদ্ধ। ভুল ভুলাইয়ার সাথে মিশে আছে বড় ইমামবাড়ার অস্তিত্ব। ১৮ শতকের শেষদিকে অযোধ্যা দারুণ দুর্ভিক্ষ আর বেকারত্বের সাথে যুঝছিল। জনগণের অন্তত মাথা গোঁজার ঠাই সুনিশ্চিত করতে নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা নির্মাণ করান বড় ইমামবাড়া। এটাকে অনেকটা এমজিএনআরইজিএ (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট)-এর সাথে তুলনা করা যায়। এই একই কারণে ভারতে আরও বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ নির্মিত হয় যার মধ্যে রয়েছে পুনের আগা খাঁর প্রাসাদও।
চৌদ্দ বছর সময় নিয়ে ইমামবাড়া নির্মাণ করা হয়। এরপর হাত দেয়া হয় ভুল ভুলাইয়ার নির্মাণকাজে। বড় ইমামবাড়া এবং ভুল ভুলাইয়ার নির্মাণকাজে অংশ নেয়া শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে অর্থ সংকট থেকে মুক্তি দেয়াই ছিল নবাব আসাফ-উদ্-দৌলার প্রধান উদ্দেশ্য। একটি কথা প্রচলিত আছে যে, “আম আদমিরা সারাদিন যা গড়তো রাতে রইস আদমিরা তা ধ্বংস করতো।” কথাটি হয়তো নিছকই কথার কথা, তা নাহলে মাত্র ছয় বছরে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। অনেকে আবার ইমামবাড়াকেই ‘ভুল ভুলাইয়া’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এতোই বিশাল যে লেখার মাধ্যমে তা হয়তো পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে ইমামবাড়ার আটটি ঘরে। প্রতিটি ঘরেই গম্বুজ রয়েছে। ইমামবাড়ার মূল আকর্ষণ অবশ্য এর কেন্দ্রীয় ঘরটি। ৫০x১৬x১৫ মিটার আকৃতির এই ঘরে কোনো খিলান নেই, থাম নেই, কোনো লোহা বা কংক্রিট এতে ব্যবহৃত হয়নি। দেয়ালগুলোর ভার অনেক বেশি হওয়ায় ভেতরটা ফাঁপা রাখা হয়েছে যেহেতু এদের ভার নেয়ার জন্য কোনো পিলারের ব্যবস্থা করা হয়নি। দেয়ালের এই ফাঁপা জায়গাগুলোর ভেতরে ৪৮৯টি গলিপথ তৈরি করা হয়েছে, যা ‘ভুল ভুলাইয়া’ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের পর থেকে এই গলিপথগুলো লুকোচুরি খেলার জায়গায় পরিণত হয়েছে।

ভুল ভুলাইয়ার অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানো অভিযাত্রীরা; Source: bp.blogspot.com
লুকোচুরি খেলার আদর্শ এই জায়গাটি এতোটাই চোরাগোপ্তা উপায়ে তৈরি যে, পরবর্তীতে বড় ইমামবাড়াকে ছাপিয়ে পর্যটকদের সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয় ‘ভুল ভুলাইয়া’। অনেকে আবার গোলকধাঁধার পাশেই একটি সুড়ঙ্গের অবস্থানও নিশ্চিত করেছেন। নবাবরা তাদের হেরেমের জেনানাদের সাথে এখানে মৌজমাস্তি করতে আসতেন বলে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘বাদশাহি আংটি’ গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফিচার ইমেজঃ bp.blogspot.com