লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, প্যারিস-হেলেন কিংবা রোমিও-জুলিয়েটের মতো অসংখ্য প্রেম জুটির উপাখ্যান বিশ্ব সাহিত্যের পাতায় পাতায় আমরা পড়ে থাকি। কালজয়ী এসব উপাখ্যান আজও আমাদের কাছে রোমাঞ্চকর প্রেমভাব বিনিময় কিংবা সাহিত্য চর্চার অন্যতম উপাদান। কিন্তু এসব ঘটনা আসলেই কি কোনোকালে ঘটেছিল?
এর সরল কোনো উত্তর দেয়া কঠিন। সাহিত্যিকগণ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেমন এসব উপাখ্যান রচনা করতে পারেন, তেমনি আবার নিজেদের উর্বর মস্তিষ্কের গভীর সাহিত্য ভাবনা থেকেও এসব রচনা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো কোনো ঘটনা কখনো গল্প কিংবা উপন্যাসকেও হার মানায়। তেমনই এক সত্যিকারের প্রেমের কাহিনী রচিত হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক সময়ে পার্শ্ববর্তী মালব রাজ্যে। আর সেই উপাখ্যানের প্রেমিক পুরুষ ছিলেন স্বয়ং মালব রাজা বাজ বাহাদুর খান আর প্রেমিকা ছিলেন রাজ্যের প্রধান নর্তকী পদ্মিনী রূপমতি।
সুলতান বাজ বাহাদুর খান ছিলেন মধ্য ভারতের মালব রাজ্যের রাজা। পিতা সুজাত খানের মৃত্যুর পর ১৫৫৪ সালে তার রাজ্য তিন শাহাজাদার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। তিন শাহাজাদা হলেন দৌলত খান, বায়েজীদ খান এবং মোস্তফা খান।
দ্বিতীয় ভাই বায়েজীদ খান হঠাৎ করে বড় ভাই দৌলত খানের রাজ্য আক্রমণ করে তাকে পরাজিত ও নিহত করেন এবং ভাইয়ের রাজ্য নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পার্শ্ববর্তী উজ্জয়িনী ও মান্ডু জয় করে বায়েজীদ খান সুলতান ‘বাজ বাহাদুর খান’ উপাধি ধারণ করেন। এরপর ছোট ভাই মোস্তফা খানের রাজ্যকেও নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন তিনি। অতঃপর তিনি গোন্ডাওনা রাজ্যে আক্রমণ করেন। কিন্তু গোন্ডাওনার রাজা বীরেন্দ্র নারায়ণ এবং তার মা রানী দুর্গাপতির নিকট পরাজিত ও আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি পালিয়ে নিজ রাজ্যে চলে আসেন। এ পরাজয়ের ফলে অন্যের রাজ্য দখলের স্বাদ মিটে যায় তার।
সুলতান বাজ বাহাদুর প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন একজন শিল্পী ও সংগীতজ্ঞ। সংগীত ছাড়াও তার আরেকটি প্রতিভা ছিল শিল্পকলায়। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও হিন্দুস্তানী সংগীতে তিনি অকল্পনীয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
ভারত উপমহাদেশের সুলতান-বাদশাহদের মধ্যে নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন- এরূপ ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব মালব রাজা বাজ বাহাদুর ছাড়া আর কেউ ছিলেন- ইতিহাসের পাতায় এমন সাক্ষ্য মিলে না। এছাড়া তিনি একজন উঁচু মানের নৃত্যশিল্পীও ছিলেন।
বাজ বাহাদুর খানের নৃত্যচর্চার আসর বসতো রাজদরবারেই। অন্যান্য নৃত্যশিল্পীদের মতো তিনিও নৃত্য পরিবেশনের সময় পায়ের গোড়ালীতে তামা বা পিতলের তৈরি ঘুঙুর ব্যবহার করতেন। তবে সেই ঘুঙুর থাকতো মণি-মুক্তার তৈরি। দরবারে পরিবেশিত তার নৃত্যের বিষয়বস্তু থাকতো হিন্দু ধর্মের উচ্চমার্গীয় প্রেমালাপ। প্রধান বিষয়টি ছিল প্রভু কৃষ্ণ এবং তার প্রেয়সী রাঁধা সংক্রান্ত।
হিন্দু ধর্মমতে, ঈশ্বর প্রেমময়। ঈশ্বরের প্রেম প্রতিফলিত হয় দেবী রাঁধা এবং মহেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের পারস্পরিক প্রেমের রূপে। এই প্রেমে কৃষ্ণ হলেন স্রষ্টা আর রাঁধা হলেন সৃষ্টি। তাদের মধ্যকার নৃত্য হলো ঐশ্বরিক নৃত্য। রাঁধা-কৃষ্ণের নৃত্যের মধ্যে সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়। রাঁধা হলেন মানবজাতীর প্রতীক। বৃন্দাবনে রাঁধা শুধু একাই ছিলেন না। তার সাথে গোপী সখীগণও ছিলেন। তারা হলেন অন্যান্য সৃষ্টির প্রতীক।
বৃন্দাবনে গোপীদের সাহচর্যে ঈশ্বর কৃষ্ণ এবং মানবতার প্রতীক রাঁধার প্রেমলীলা রাঁধা-কৃষ্ণ নৃত্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতো। বৃন্দাবনে রাঁধা নৃত্যে রঙ-বেরঙয়ের জল নিয়ে হলি নৃত্য হতো। বৃন্দাবনে রাঁধা কৃষ্ণের প্রতীকী নৃত্যের মাধ্যমে একজন সঙ্গীকে হঠাৎ করে দেখা যায় রাঁধার দৈব সিংহাসন থেকে পতন ঘটতে এবং নৃত্য সংগীতের মাধ্যমে স্রষ্টা কৃষ্ণের কাছে করুণা কামনা করতে। যদিও রাঁধা-কৃষ্ণ নৃত্যের মাধ্যমে দেখা যায় রাঁধার অধঃপতন, কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমের অন্তঃসলীল রাঁধা হৃদয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে রাধারূপ সৃষ্টি রক্ষা পেয়ে যায়।
রাঁধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সংক্রান্ত এই নৃত্যনাট্যের রচয়িতা এবং প্রধান নায়িকা ছিলেন মালব রাজ দরবারের প্রধান নর্তকী রূপমতি। গানের কলি দিল্লি ও মিরাটের স্থানীয় কথ্যভাষায় রচিত ছিল। অর্থাৎ নর্তকী রূপমতি ছিলেন একজন বড় মাপের কবি ও সংগীত রচয়িতা। রূপমতির রচনা ছিল বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল ভাষায়। রূপমতির নৃত্য সংগীতগুলোর একটি সংকলন ১৯২৬ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ‘দি লেডি অফ দি লোটাস’ বা ‘পদ্মার রানী’ নামে প্রকাশিত হয়।
রূপমতি কর্তৃক রচিত ও গীত সংগীত সমূহের মর্মবাণী হলো- আমি রাঁধা হীন, দীন, পাপী, বিশ্বাস ভঙ্গকারী, নির্দেশ লংঘনকারী, আমার সর্বাঙ্গ পাপে নিমজ্জিত। কিন্তু আমার একমাত্র অনুভূতি হলো- আমি তোমার; তুমি আছো আমার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে। আমি তোমাকে কোনো পত্র লিখি না, কারণ তুমি আছো আমার অতি নিকটে। তোমার আসন আমার হৃদয়ে।
অর্থাৎ নৃত্যশিল্পী রূপমতি ছিলেন একজন বিদুষী কবি, গায়িকা, আবৃতিকারক, হাস্য বিশারদ, আনন্দদায়ী ও মহিয়সী। সমকালীন ইতিহাসে এ ধরনের মহিলাদেরকে ‘পদ্মিনী’ খেতাব দেয়া হতো। রূপমতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর পদ্মিনী রূপমতির শারীরিক সৌন্দর্য, উচ্চতা, বাচনভঙ্গী, আনুগত্য, ব্যক্তিত্ব ও শিল্পে অসাধারণ দক্ষতা মন কেড়ে নিয়েছিল রাজা বাজ বাহাদুর খানের।
তাছাড়া রাঁধাকৃষ্ণ নৃত্যনাট্যে তারা উভয়ে একইসাথে অভিনয় করতেন। রূপমতি হতেন রাঁধা আর বাজ বাহাদুর হতেন প্রভু কৃষ্ণ। নৃত্যনাট্যের শ্লোকগুলো একসময় রাজা বাজ বাহাদুরের হৃদয়ের গভীরে আঘাত করতে থাকলো। আর রূপমতি নিজেও মুগ্ধ হতে থাকলেন রাজার রোমান্টিক গুণাবলীতে। একপর্যায়ে তারা গভীর প্রেম ও আনুগত্যের আকন্ঠ জলে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন।
রাঁধা-কৃষ্ণ নৃত্য নাটকের নৃত্য-গীত পটিয়সী রূপমতি স্বীয় গুণাবলীতে রাজরানী হওয়ার জন্য ছিলেন পুরোপুরি উপযুক্ত। অভিনয় মঞ্চের গল্প স্বাভাবিকতায় রূপ লাভ করার সুযোগ এলো। উভয়ে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেন। কিন্তু বাজ বাহাদুর খান তো ইসলাম ধর্মের অনুসারী! শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো তারা উভয় ধর্মের রীতি অনুসারে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন, অর্থাৎ তারা দুবার দুই ধর্ম অনুসারে বিয়ে করবেন।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পদ্মিনী রূপমতি বিয়ের জন্য একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। তাকে বিয়ে করতে হলে তার জন্য একটি প্রসাদ নির্মাণ করতে হবে। আর সেই প্রসাদ হতে হবে নর্মদা নদীর তীরে, যেখানে বসে তিনি পৃথিবীর সর্বাধিক সুখ অনুভব করতে পারবেন। রূপমতির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া রাজা বাজ বাহাদুর এই শর্ত অনায়াসে মেনে নিলেন। শর্তানুসারে নর্মদা নদীর তীরে এক প্রাসাদ গড়ে তুললেন। তাদের বিয়ে হয়ে গেলো।
রাজার এমন বিয়ে রাজ্যের সবাই মেনে নেয় ঠিকই, কিন্তু একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষত দুজন দুই ধর্মের হওয়া এবং রাজা হয়ে নর্তকী বিয়ে করাকে রাজ্যের অনেকে সহজভাবে নিতে পারছিল না। ফলশ্রুতিতে রাজ্যের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার সর্বস্তরে একটি বড় ধরনের অবক্ষয় ঘটে। প্রজারা রাজার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
এদিকে রাজা বাজ বাহাদুর খান রূপমতির প্রেমে এতটাই মশগুল ছিলেন যে, ততদিনে রাজ্যের সেনাবাহিনী প্রায় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। সীমান্ত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বিয়ের পরও তারা রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে প্রেমলীলায় ডুবে থাকলেন। মালব রাজ্যের এই প্রেমকাহিনী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি তরুণ সম্রাট আকবরের কাছে পৌঁছে গেল। দূরদর্শী আকবর এই সময়কে মালব রাজ্য জয়ের সুবর্ণ সুযোগ মনে করলেন। তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না।
মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৬০ সালে সেনাপতি আদম খান, আতকা খান এবং পীর মুহাম্মদ শিরওয়ানির নেতৃত্বে মালব বিজয়ের জন্য একটি মজবুত বাহিনী প্রেরণ করলেন। রাজা বাজ বাহাদুরের বাহিনী মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার পূর্বেই মুঘল সৈন্যগণ মালব রাজধানী মান্ডুর প্রতিরক্ষা প্রাচীরের দুই মাইলের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন। নামমাত্র যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হয়ে চরম অবমাননার বোঝা মাথায় নিয়ে সব কিছু রেখে রাজা বাজ বাহাদুর খান কোনোমতে জীবন নিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন।
মুঘল বাহিনী রাজধানী পদানত করে রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়লো। প্রতিরোধের চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাসাদ রক্ষীদের অনেকেই নিহত হলো। অন্তপুরের মহিলারাও পালাতে গিয়ে অনেকে আহত ও নিহত হলো। যারা পালাতে পারলেন না তারা রাজ-অন্তঃপুরের গোপন কক্ষগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
মুঘল সেনাপতি আদম খান রানী রূপমতির খবর নিয়ে জানতে পারলেন, তিনি আহত এবং মুমূর্ষু অবস্থায় এখনো বেঁচে আছেন। আদম খান রানীসহ সকল আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি রানী রূপমতিকে জানালেন, তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেই তাকে তার পলাতক স্বামী বাজ বাহাদুর খানের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হবে। তখন স্বকৃতজ্ঞ রূপমতি একটি ফার্সি শ্লোক গেয়ে বিজয়ী বীর আদম খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন, যার সারমর্ম হলো-
এই শুভ সংবাদ আমার জন্য এত আনন্দদায়ক এবং তৃপ্তির যে, এই আনন্দে আমি মরণেও সম্মত।
কিন্তু আদম খান রানী রূপমতি সুস্থ হওয়ার পরেও তাকে পলাতক স্বামী বাজ বাহাদুর খানের নিকট পাঠাতে সম্মত হলেন না। বরং ঘোষণা করলেন, পলাতক বাজ বাহাদুর খান সম্রাট আকবরের নিকট আত্মসমর্পণ করলেই রানীকে তার সঙ্গে মিলনের জন্য মুক্ত করে দেয়া হবে। এই ঘোষণার নেপথ্যে অন্য কারণ ছিল। এ ক’দিনে আদম খান রানী রূপমতির রূপের বর্ণনা শুনে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে ছলে-বলে-কৌশলে রূপমতিকে বশ করার চিন্তাই তারা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
অবশেষে এক রাতে সেনাপতি আদম খান রূপমতিকে স্বীয় প্রাসাদে আনার জন্য প্রতিহারী বাহিনী (ঘটক) প্রেরণ করলেন। রূপমতি আদম খানের প্রাসাদে আসতে রাজি হলেন। তবে, একটি শর্ত দিলেন। তা হলো, পদ্মিনী রূপমতিকে আদম খানের প্রাসাদে গমনের জন্য সুসজ্জিত হওয়ার সময় দিতে হবে। অতঃপর তাকে নেওয়ার জন্য আদম খানকে নিজেই আসতে হবে।
এই খবর শুনে আদম খান উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তিনি নিজেও সুসজ্জিত হয়ে মহানন্দে রূপমতির প্রাসাদে আসার প্রস্তুতি নিলেন। রূপমতি নব বিবাহের কনের ন্যায় সুন্দরতম পোশাকে সুসজ্জিত হলেন। অঙ্গে মূল্যবান মণি-মুক্তার অলংকার ও কণ্ঠহার ধারণ করলেন। পুরোপুরি বিয়ের সাজে সজ্জিত হলেন। দেহের চারিদিকে ছড়িয়ে দিলেন পুষ্পের মালা। কক্ষটি করে তুললেন সর্বোত্তম সুগন্ধিতে মোহিত।
আদম খান যথাসময়ে যথাযথভাবে রূপমতির শয়ন কক্ষে প্রবেশ করলেন। রূপুমতি তখন স্বীয় শয্যায় চিরনিদ্রায় আচ্ছন্ন। না, রূপমতি আদম খানের অপেক্ষায় নিদ্রা যাপন করছেন না, একেবারে চিরনিদ্রায় চলে গিয়েছেন। আদম খানের আশা আর পূর্ণ হলো না। সেই করুণ মৃত্যুর বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে ‘মুসলিম সংগীত চর্চার সোনালী ইতিহাস’ গ্রন্থে এ. জেড. এম. শামসুল আলম লিখেছেন,
রানী রূপমতির আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আদম খান রূপমতির মন মানসিকতা ও প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি অবহিত হতে চাইলেন। আদম খানের প্রতিহারী বাহিনীকে ফেরত দেওয়ার পরেই স্বামী বাজ বাহাদুর খানের স্মৃতিচারণ করে রানী রূপমতি অত্যন্ত করুণ এবং মর্মান্তিক ক্রন্দন করেন। তারপর রাজকীয় অলংকার ও মণিমুক্তা দেহে ধারণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় ভূষণে ভূষিত হন।
বিবাহের কন্যার সাজে সজ্জিত হয়ে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্পূর জহর বিষ হাতে নিয়ে শয্যায় শায়িত হন। পরম তৃপ্তির সাথে হাস্য মুখে এবং স্বামী বজ বাহাদুরের স্মৃতি চারণ করে ক্রন্দনরত অবস্থায় বিষপান করেন।
এভাবেই ইতিহাসের এক সত্যিকারের প্রেম উপাখ্যানের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়। সম্রাট আকবর সেনাপতি আদম খানের এমন কর্মকাণ্ড জানতে পেরে মর্মাহত হন। তিনি আদম খানকে পদচ্যুত করেন এবং পীর মুহাম্মদ খান শেরওয়ানকে সুবেদার নিযুক্ত করেন। এমন করুণ ঘটনা জানার পর পাঠক হয়তো আর বাজ বাহাদুরের খবর জানতে চাইবেন না। তবুও তার বাকি জীবনের গল্পটি জানিয়ে যাই।
রানী রূপমতির আত্মহত্যার খবর পেয়ে পলাতক সুলতান বাজ বাহাদুর খান খান্দেশের অধিপতি মিরন মোবারক শাহের নিকট আত্মসমর্পণ করে তার কাছে সাহায্য চান। খান্দেশ অধিপতি মিরন মোহাম্মদ শাহ প্রদত্ত ক্ষুদ্র বাহিনী সাথে নিয়েই বাজ বাহাদুর খান বিরাট মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান বাজ বাহাদুর রূপমতির স্মৃতি বিজড়িত মালব পুনঃবিজয় করেন। কিন্তু পরম পরাক্রমশালী মুঘলদের বিরুদ্ধে তিনি বেশি সময় টিকে থাকতে পারেননি। পরবর্তী মুঘল সুলতান সুবেদার আব্দুল্লাহ খান মালব পুনরুদ্ধার করেন।
বাজ বাহাদুর আব্দুল্লাহ খান উজবেকের নিকট পরাজিত হয়ে নতুনভাবে সৈন্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তিনি আহমাদ নগরের সুলতান বুরহানুল মুলক, মেবারের রাজা উদায় সিং এবং গুজরাটের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট সাহায্যের প্রত্যাশায় দীর্ঘকাল ঘোরাঘুরি করেন। কিন্তু হতাশ হন। তাছাড়া মুঘলরাও তার পিছু নিয়েছিল। আত্মরক্ষার জন্য সুলতান অরণ্য ও গুহায় আত্মগোপন করেন। এ সময় তিনি লোক মারফত সম্রাট আকবরের মহানুভবতার কথা শুনতে পারেন। ফলে তিনি সব আশা হারিয়ে মুঘল সম্রাট আকবরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
সম্রাট আকবর তাকে নিরাশ করেননি। মুঘল রাজ বাহিনীতে তিনি দুই হাজার সওয়ার, দুই হাজার জাট বাহিনী এবং এক হাজার পদাতিক বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্ব পান। ব্যক্তি হিসেবে বাজ বাহাদুর ছিলেন দক্ষ তীরন্দাজ, সুনিপুণ পলো খেলোয়াড় এবং সুদক্ষ অশ্বারোহী। আর সংগীতের দখল তো ছিলই। জীবনের বাকি সময়গুলো যুদ্ধ কিংবা সংগীত গেয়েই পার করে দিয়েছিলেন চিরদুঃখী প্রেমিক বাজ বাহাদুর খান।
সূত্র
১. এ. জেড. এম. শামসুল আলম, মুসলিম সংগীত চর্চার সোনালী ইতিহাস, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, প্রথম প্রকাশ ২০১২
২. R.C. Majumdar, The Mughul Empire, Mumbai:Bharatiya Vidya Bhavan, 2007