নাৎসি বাহিনীর কুখ্যাত বন্দী শিবির অশউইটজে সবাই যখন প্রতিটি মুহূর্তে নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন সেখানেরই আরেক বন্দীর প্রেমে পড়েছিলেন লেইল সোকোলোভ। তিনি ছিলেন বন্দী শিবিরের প্রধান উল্কি আঁকিয়ে, যার কাজ ছিল নবাগত বন্দীদের বাহুতে কালি দিয়ে স্থায়ীভাবে তাদের সিরিয়াল নাম্বার এঁকে দেওয়া। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসের এক সকালে নবাগত এক কিশোরীর বাহুতে তার সিরিয়াল নম্বরটি এঁকে দেওয়ার জন্য যখন তার হাত স্পর্শ করলেন, তখনই বুকের ভেতর যেন উথাল পাথাল ঝড় বইতে শুরু করল তরুণ বন্দী লেইল সোকোলভের। প্রথম দর্শনেই তিনি প্রেমে পড়ে গেলেন গিতা ফুরমানোভার। তার ভাষায়,
“যখন আমি তার বাহুতে তার সিরিয়াল নম্বর খোদাই করে দিচ্ছিলাম, তখন সে আমার হৃদয়ে তার নাম খোদাই করে দিয়েছিল।”
The Tattooist of #Auschwitz – and his secret love https://t.co/xUrdZt9lsa #WW2 pic.twitter.com/faDujGDQ4t
— The History Press (@TheHistoryPress) January 8, 2018
লেইল সোকোলভের জন্ম ১৯১৬ সালে, স্লোভাকিয়ার এক ইহুদী পরিবারে। ১৯৪২ সালে তাদের শহরটা ছিল নাৎসি জার্মানদের অধীনে। সে সময় নাৎসিরা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সেঁটে জানিয়ে দেয়, প্রতিটি ইহুদী পরিবার থেকে বাধ্যতামূলকভাবে একজন যুবককে জার্মানদের অধীনে কাজ করার জন্য যেতে হবে। লেইলের অন্য ভাইরা সবাই ছিল বিবাহিত এবং চাকরিজীবী, তাই লেইল নিজেই জার্মানদের হাতে ধরা দিতে রাজি হলেন এই আশায় যে, এতে তার পরিবারের অন্য সদস্যরা বেঁচে যাবে।
১৯৪২ সালের এপ্রিলে লেইলকে ট্রেনে করে প্রাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েক সপ্তাহ একটি স্কুলঘরে আটক রাখার পর স্লোভাকিয়া থেকে ধরে নিয়ে আসা অন্যান্য ইহুদী বন্দীদের সাথে তাকে তুলে দেওয়া হয় পোল্যান্ডগামী একটি গবাদি পশুর ট্রেনে। তার স্থান হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প অশউইটজে, যেখানে প্রায় ১১ লাখ বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল।
অশউইটজ এবং এ জাতীয় অন্যান্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীর কোনো নাম থাকত না। সবাইকে একটি সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হতো, যা দিয়ে তারা পরিচিত হতো। বন্দী শিবিরের মলিন কাপড়ের গায়ে ছাড়াও এই সিরিয়াল নম্বর তাদের বাহুতে ট্যাটু বা উল্কি এঁকে স্থায়ীভাবে লিখে দেওয়া হতো। লেইল যখন অশউইটজে প্রবেশ করেন, তখন তার নাম হয় বন্দী নম্বর ৩২,৪০৬। তার হাতে উল্কি এঁকে দেন সেখানকার প্রধান উল্কি আঁকিয়ে, এক ফরাসি বন্দী, পেপ্যান। তখনও তাদের কেউই জানতেন না, কিছুদিন পরেই লেইলই হয়ে উঠবেন শিবিরের প্রধান উল্কি আঁকিয়ে।
সে সময় অশউইটজে প্রতিদিন নতুন নতুন বন্দী আনা হচ্ছিল এবং তাদের স্থান সংকুলানের জন্য ক্যাম্পটির আয়তন বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। আর এসব কাজে খাটানো হচ্ছিল সমগ্র ইউরোপ থেকে ধরে আনা ইহুদী বন্দীদেরকেই। লেইলকেও ক্রমবর্ধমান অশউইটজের নতুন বন্দীদের জন্য আবাসস্থল নির্মাণের কাজে নিযুক্ত করা হয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহ তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তার শরীর বেশিদিন সইতে পারেনি। শীঘ্রই তিনি আক্রান্ত হন টাইফয়েডে।
টাইফয়েডে আক্রান্ত লেইলকে নিক্ষেপ করা হয় মুমূর্ষুদের জন্য নির্ধারিত স্থানে। তার জীবনের হয়তো সেখানেই সমাপ্তি ঘটতে পারত, কিন্তু তার সহবন্দীরা তাকে দেখতে পেয়ে তার সেবা-শুশ্রূষা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে তাকে সারিয়ে তোলেন। লেইলের দেখাশোনার ব্যাপারে এগিয়ে আসেন পেপ্যান, অশউইটজের প্রধান উল্কি আঁকিয়ে। জার্মানদের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ চাকরি করার সুবাদে অন্য বন্দীদের তুলনায় তার কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ছিল। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি লেইলকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেন এবং তাকে নিজের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন।
লেইল বেশ চৌকস ছিলেন। তার স্লোভাকিয়ান, জার্মান, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, হাঙ্গেরিয়ান এবং কিছুটা পোলিশ ভাষাও জানা ছিল। নিজের জ্ঞান এবং দক্ষতা ব্যবহার করে খুব শীঘ্রই তিনি নতুন চাকরিতে জার্মানদের মন জয় করতে সক্ষম হন। লেইল যোগদান করার কয়েক সপ্তাহ পর হঠাৎ করেই একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান পেপ্যান। তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সেটা লেইল কখনোই জানতে পারেননি। কিন্তু পেপ্যান চলে যাওয়ার পর জার্মানরা লেইলকেই তার স্থলাভিষিক্ত করেন। লেইল হন অশউইটজের নতুন প্রধান ট্যাট্টুশিল্পী বা উল্কি আঁকিয়ে (Tatowierer)।
অশউইটজের সব বন্দীর হাতেই উল্কি আঁকা হতো না। কিছু বন্দীকে ক্যাম্পে আনার পর প্রাথমিক পরীক্ষা শেষেই সরাসরি গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে হত্যা করা হতো। যারা তুলনামূলকভাবে ভাগ্যবান, তাদেরকেই কেবল বাঁচিয়ে রাখা হতো জার্মানদের অধীনে কাজ করার জন্য। তাদের জামা-কাপড় সহ সব সম্বল নিয়ে নেওয়া হতো এবং মাথা ন্যাড়া করে, বন্দী শিবিরের নির্ধারিত মলিন কাপড় পরিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হতো একে একে লেইলের অফিসে গিয়ে হাতে সিরিয়াল নম্বরের উল্কি আঁকিয়ে আনার জন্য।
অশউইটজের ট্যাটুশিল্পী হিসেবে দীর্ঘ আড়াই বছরের জীবনে লেইল লক্ষাধিক বন্দীর হাতে উল্কি এঁকেছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি ঘটনা তার জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে লেইলের সামনে আসে ভয়ে কাঁপতে থাকা আঠারো বছর বয়সী এক কিশোরী। মেয়েটির সরল চেহারা ও উজ্জ্বল দু’চোখ দেখে এবং তার নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে লেইল সাথে সাথেই তার প্রেমে পড়ে যান। তখনও তিনি তার নাম জানতেন না, শুধু জানতেন তার পরিচয় ছিল বন্দী নম্বর ৩৪,৯০২।
প্রধান ট্যাট্টুশিল্পী হিসেবে লেইল অন্য বন্দীদের চেয়ে কিছুটা বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতেন। কাগজে-কলমে তিনি ছিলেন জার্মানির এসএস বাহিনীর পলিটিক্যাল উইংয়ের কর্মচারী। সে হিসেবে তাকে থাকার জন্য অন্য বন্দীদের চেয়ে পৃথক একটি কক্ষ দেওয়া হয়। তার খাবারের ব্যবস্থাও ছিল প্রশাসনিক ভবনে, খাদ্যের বরাদ্দের পরিমাণও ছিল সাধারণ বন্দীদের তুলনায় অনেক বেশি। তাকে দেখাশোনার জন্য যে এসএস গার্ড নিযুক্ত ছিল, তার সাথেও লেইলের মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে লেইলের পক্ষে বন্দী নম্বর ৩৪,৯০২ এর পরিচয় খুঁজে পেতে বেশি দেরি হয়নি। তিনি জানতে পারেন, মেয়েটির নাম গিতা ফুরমানোভার, যার স্থান হয়েছিল নারীদের জন্য নির্মিত পৃথক ক্যাম্প বিরকেনৌতে (Birkenau)।
লেইল তার ব্যক্তিগত এসএস গার্ডের সাহায্যে গিতার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি তাকে নিয়মিত চিঠি পাঠাতে শুরু করেন। তার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করার সুযোগও বের করে নেন তিনি। বন্দী শিবিরে সবচেয়ে কষ্ট ছিল খাবারের কষ্ট। লেইল তার অতিরিক্ত বরাদ্দের খাবার থেকে গোপনে গিতা এবং তার বান্ধবীদেরকে খাবারের ভাগ দিতেন। তিনি তার গার্ডকে অনুরোধ করে গিতাকে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমের কাজ দেওয়ারও ব্যবস্থা করেন। লেইল ছিলেন প্রচন্ড আশাবাদী ধরনের মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন জার্মানদের চোখে ধুলো দিয়ে তারা পালিয়ে যাবেন অশউইটজ থেকে। গিতা অবশ্য খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না, কিন্তু একটি একটি দিন করে বেঁচে থাকার তাগিদেই তিনিও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন লেইলের দেখানো ভবিষ্যতের স্বপ্ন দ্বারা।
১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী যখন পোল্যান্ড মুক্ত করতে শুরু করে, তখন জার্মানরা অশউইটজের বন্দীদেরকে সরিয়ে নিতে থাকে। জানুয়ারির ২৫ তারিখে জার্মানরা গিতা সহ অশউইটজের সকল নারী বন্দীকে ট্রেনে করে অন্যত্র নিয়ে যায়। কেউ জানত না তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিংবা তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। এর দু’দিন পরেই রাশিয়ানরা অশউইটজের বন্দীদেরকে মুক্ত করে। মুক্ত হয়ে লেইল প্রথমে তার বাড়িতে ফিরে যান, কিন্তু শীঘ্রই একটি ঘোড়ার গাড়ি জোগাড় করে আবারও যাত্রা শুরু করেন পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে, গিতার সন্ধানে।
বন্ধী শিবিরের লুকোচুরি করে দেখা করার দিনগুলোতে তারা শুধু পরস্পরের নামই জেনেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, কিংবা যুদ্ধ শেষে কে কোথায় যাবেন, তার কিছুই আলাপ করার মতো সময় বা সুযোগ তাদের হয়নি। কাজেই লেইল ব্রাতিসলাভার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদেরকে চেকোশ্লোভাকিয়ায় ফিরে যাওয়ার সময় ব্রাতিসলাভা হয়ে যেতে হতো। লেইল ব্রাতিসলাভা ট্রেন স্টেশনে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করলেন। শেষপর্যন্ত স্টেশন মাস্টার তাকে পরামর্শ দেন রেডক্রসের কাছে যাওয়ার জন্য।
রেডক্রসের কাছে যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখা যেত, বেঁচে যাওয়া বন্দীরা দল বেঁধে পায়ে হেঁটে ফিরে আসছে। লেইল উৎসুক নয়নে তাদের মধ্যে গিতার খোঁজ করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি না, গিতাই তাকে খুঁজে বের করে। ভীড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে পথ আগলে দাঁড়ায় তার ঘোড়ার গাড়ির সামনে। তার উজ্জ্বল দু’চোখ দেখে তাকে চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হয়না লেইলের। গিতার মুখ থেকে প্রথম যে কথাটি বের হয়, তা ছিল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” আর লেইলের জবাব ছিল, “তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”
লেইল এবং গিতার বন্দী শিবিরের প্রেম শেষ পর্যন্ত শুভ পরিণতি লাভ করেছিল। তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে। সে সময় গণহত্যা থেকে বেঁচে ফেরা ইহুদীদের মধ্যে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেশ সাড়া ফেলে। লেইল ইসরায়েলের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে গিয়ে সরকারের নজরে পড়েন এবং বন্দী হন। প্রায় তিন বছর পর তারা এক ছুটির দিনে চেকশ্লোভাকিয়া ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেন।
লেইল এবং গিতার কাহিনী দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিশ্ববাসীর কাছে অজানা ছিল। তারা এমনকি তাদের একমাত্র সন্তান গ্যারিকেও তাদের জীবনের কাহিনী পুরোপুরি জানাননি। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল, লেইল যে বন্দী থাকা অবস্থায় নাৎসি বাহিনীর রাজনৈতিক শাখার অধীনে প্রধান ট্যাটুশিল্পী হিসেবে চাকরি করেছিলেন, তা জানাজানি হলে উগ্রপন্থী ইহুদীরা হয়তো তাকে নাৎসিদের প্রতি অনুগত ভেবে বসতে পারে এবং তার উপর আক্রমণ করতে পারে। দীর্ঘদিন পরে লেখিকা এবং চিত্রনাট্যকার হেদার মরিস লেইলের সন্ধান পান এবং দীর্ঘ তিন বছরের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে তার বিশ্বাস অর্জন করে তার কাছ থেকে তার জীবনের কাহিনী জানতে সক্ষম হন।
২০০৬ সালে, ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন লেইল সকোলোভ। তার মৃত্যুর পর মরিস অশউইটজের পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে তার ট্যাটুশিল্পী হিসেবে চাকরির করার কাহিনীর সত্যতা খুঁজে পান। মরিস আরো জানতে পারেন, লেইল অশউইটজে পৌঁছার কিছুদিন আগেই তার বাবা-মাকেও অশউইটজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। লেইলের সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য নথিপত্রের উপর ভিত্তি করে মরিস ২০১৮ সালে তার উপর একটি বই প্রকাশ করেন, যার নাম দ্য ট্যাটুইস্ট অফ অশউইটজ (The Tattooist of Auschwitz)। বইটি সানডে টাইমসের বেস্টসেলারের মর্যাদা লাভ করে। এই বই পড়েই বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো জানতে পারে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভেতরের কঠিন জীবনের ভেতরেও সৃষ্টি হওয়া এক অবিশ্বাস্য প্রেমকাহিনী সম্পর্কে।
ফিচার ইমেজ- worldnews.easybranches.com