ভৌগলিকভাবে পুরো পৃথিবীকে যদি একটি দেশ ধরা হয়, তবে কোন শহরকে এর রাজধানী গণ্য করা হবে? খুব সম্ভবত তুরস্কের শহর ইস্তানবুল এখনও এই তালিকায় সবার উপরের দিকেই থাকবে। ভাবছেন- এর মধ্যে ইস্তানবুলের কথা কেন চলে আসলো? আজকের ইস্তানবুলকেই মুসলিমরা জয় করে নেয়ার আগে যে ডাকা হতো কন্সটান্টিনোপল নামে! চলুন ঘুরে আসা যাক বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্ভেদ্য আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ শহর কন্সটান্টিনোপল থেকে।
খ্রিষ্টের জন্মের ও প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর আগে পৌত্তলিক গ্রিকের শহর মাগেরার রাজা বায়জাস বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম তীরে জনপদ খুঁজে পান। প্রণালীটি কৃষ্ণসাগর আর ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে। পরের কয়েক শতাব্দী শহরটি পার্সিয়ান, অ্যাথেনিয়ান, স্পার্টানদের হাত বদল হয়। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দুশো বছর আগে রোমান শাসক সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস শহরটি আক্রমণ করে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলেন। তবে এই ধ্বংসই মূলত কন্সটান্টিপোলের মূল বিকাশের সূত্রপাত ঘটায়। শহরটি আবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে নতুন এবং পুরাতন নির্মাণগুলোর সংমিশ্রণে।
কন্সটান্টাইনের জন্ম ম্যাক্সিমিয়ান সাম্রাজ্যে। তার বাবা কন্সটান্টিয়াস তখনকার সম্রাট অগাস্টাসের একজন সামরিক অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ক্রমানু্যায়ী পদোন্নতি পেয়ে তিনি কায়সার বা সম্রাটের ডেপুটি পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে রোমের পশ্চিম অংশের শাসক হবার কথা থাকলেও পূর্ব অংশের শাসক ম্যাক্সিমিয়ানের বিশ্বাসঘাতকতায় তা হাতছাড়া হয়ে যায়। কন্সটান্টিয়াস ব্যাপারটা খুব সহজে নেননি। প্রায় এক যুগ ধরে চলে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু এই দীর্ঘ যুদ্ধের ফলাফল আসার আগেই কন্সটান্টিয়াস মারা যান। তরুণ কন্সটান্টাইন বাল্যকাল থেকেই সমর, ভাষা এবং দর্শনের পাঠ লাভ করেন। পুরো সৈন্যদলের কতৃত্ব তার উপর ন্যাস্ত হয়।
৩১২ সনের শরতে কন্সটান্টাইনের সৈন্যদল অনেক ঘটনার পর রোমের পশ্চিমে, চল্লিশ মাইল দূরে ক্যাম্প করে। ততদিনে রোমের শাসক ম্যাক্সিমিয়ান গত হয়েছেন। তার স্থলে তার ছেলে ম্যাক্সিন্টিয়াস অভিষিক্ত। কিন্তু ম্যাক্সিন্টিয়াস শাসক হিসেবে অযোগ্য ছিলেন। কন্সটান্টাইন ক্রমেই সামনে এগিয়ে আসছিলেন। রোমের জনগণ তখন প্যাগান দেবতাদের পূজার্চনা করত। কিন্তু কন্সটান্টাইন তেমন ধর্মকর্ম মানতেন না। ল্যাকটেন্টিয়াস নামক এক পাদ্রী ক্রমাগত তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার ধ্যানজ্ঞান তখন অন্য কোথাও। সেসময় খ্রিস্টধর্ম গরীব-অচ্ছুতদের ধর্ম,অনেক রাজ্যে একে গোপনে পালন করা হতো।
ম্যাক্সিন্টিয়াসের সৈন্যদল টাইবার নদীর পশ্চিম থেকে পিছু হটলে কন্সটান্টাইন আরো সামনে এগোতে থাকেন। কিন্তু পথিমধ্যে চর খবর আনে যে ম্যাক্সিন্টিয়াস প্রায় দশ হাজার নতুন সৈন্য সাহায্য পেয়েছেন মিত্রদের কাছ থেকে। কন্সটান্টাইন দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ঠিক ঐ মূহুর্তে একটি উল্কাপিন্ড অদূরেই আছড়ে পড়ে। ল্যাকটেন্টিয়াস একে ঈশ্বরের চিহ্ন দাবী করেন। ঐতিহাসিকরা এ ঘটনাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তবে বাস্তবে যা-ই ঘটে থাকুক, আদতে একে কীভাবে অনুবাদ করা হয়েছিল সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। কন্সটান্টাইন এ ঘটনার পর সাহায্য আসার জন্য অপেক্ষা করেন, যুদ্ধের পরিকল্পনা নতুন করে সাজান এবং সব সৈন্যদের ঢালে খ্রিস্টধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীক আঁকতে নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে, ম্যাক্সিন্টিয়াস টাইবার নদীর ওপর থাকা মিলভিয়ান ব্রিজকে সামনে রেখে রণকৌশল সাজান। তার পঁচাত্তর হাজার সৈন্যদলের প্রায় পুরোটাই নদীর বিপরীত পাশে অবস্থান নেয়। কন্সটান্টাইন কিছু একটা গড়বড় আছে বুঝতে পেরে নদী অতিক্রম না করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। টোপ হিসেবে পাঠানো সৈন্যদের ক্রমান্বয়ে হত্যা হতে দেখে ম্যাক্সিন্টিয়াসের সৈন্যদের সাহসে চিড় ধরে। লড়াইয়ের একপর্যায়ে ব্রিজ ধসে গিয়ে ম্যাক্সিন্টিয়াস নিজের পাতা ফাঁদেই নিহত হন।
কন্সটান্টাইন বিজয়ীর বেশে বাইজেন্টিয়ামে প্রবেশ করলেন। ম্যাক্সিন্টিয়াসের দুঃশাসনে বিরক্ত সাধারণ নাগরিকরা সাদরে নতুন শাসককে বরণ করে নিল। কিন্ত বাধ সাধলো প্যাগান ধর্মযাজকরা, যাদের হোফগোথি নামে ডাকা হতো, কারণ রাজা না তাদের পুরাতন দেবতাদের মানছেন, না তাদের আচার অনুষ্ঠানগুলোকে আমলে নিচ্ছেন। অপরদিকে ল্যাকটেন্টিয়াস এবং তার সাথে খ্রিস্টধর্ম কন্সটান্টাইন আরো কাছাকাছি চলে আসছিল।
পশ্চিম বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পুরোপুরি হাতে চলে আসার পর সম্রাট এবার পূর্বে মনোনিবেশ করলেন। পূর্ব অংশে শাসন করছিলেন দুই বিপ্রতীপ শাসক ডায়ার এবং লিসিনিয়াস। কন্সটান্টাইন সেখানে শৃংখলা আনতে লিসিনিয়াসকে সমর্থন দিলেন। কেবল সমর্থন দিলেন বলা ভুল, তার বোন কন্সটান্টিয়াকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্কই স্থাপন করে ফেললেন। বিনিমিয়ে লিসিনিয়াসের রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের অবাধ বিকাশ আর দুই অংশের মধ্যে শান্তিরক্ষার রাজনৈতিক রফা হয়। যৌথ সামরিক শক্তির কাছে প্রায় চার মাসের যুদ্ধে ডায়ার পরাজিত এবং নিহত হন। পূর্ব অংশ লিসিনিয়াসের একচ্ছত্র আধিপত্যে চলে আসে।
অপরদিকে কন্সটান্টাইন রোমে একের পর এক চার্চ তৈরি করতে শুরু করেন। প্যাগানরা অনেকভাবেই তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনোভাবেই সফল হতে পারেনি। অবশেষে তারা কন্সটান্টাইনের ভগ্নিপতি লিসিনিয়াসের কাছে যায় এবং তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে তাদের পুরনো দেবতাদের রক্ষার্থে কন্সটান্টাইনকে কেন সরিয়ে দেয়া প্রয়োজন। লিসিনিয়াস তাদের সবুজ সংকেত দেন, কিন্তু কন্সটান্টাইন তার বোনের মারফত এই ষড়যন্ত্রের সংবাদ আগেই পেয়ে যান। অবধারিতভাবেই ঘটনাটা যুদ্ধে মোড় নেয়। কিন্তু প্রথম দফার যুদ্ধে কোনো পক্ষ সত্যিকারের বিজয় পেতে ব্যর্থ হয় এবং উভয়ের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হয়। কিন্তু লিসিনিয়াস প্রায় সাত বছর পর ৩২৩ খ্রিস্টাব্দে চার্চগুলোয় আক্রমণ করে বিশপদের হত্যা করতে শুরু করলে দ্বিতীয় দফার যুদ্ধ শুরু হয়।
তুরস্কের কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় কন্সটান্টাইনের সৈন্যদল লিসিনিয়াসের বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। কিন্তু শেষপর্যন্ত লিসিনিয়াস পরাজিত হয়। বাইজেন্টিয়ামের সম্পূর্ণ দখল চলে আসে কন্সটান্টাইনের হাতে। যদিও তার বোন অনেকভাবে স্বামী এবং পুত্রের জীবন রক্ষার চেষ্টা চালান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে সমগ্র বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে কন্সটান্টাইনের একচ্ছত্র শাসন কায়েম হয়। তিনি পুরো সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বেছে নেন বাইজেন্টিয়ামকে এবং এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন কন্সটান্টিনোপোল।
সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণার পাশাপাশি কন্সটান্টাইন রোমের শিল্প, কৃষ্টি আর অন্যান্য মূল্যবান সৃষ্টিগুলোকেও নতুন রাজধানীতে আনতে থাকেন। এ তালিকায় যেমন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজারের মূর্তি ছিল, তেমনি ছিল গ্রিকদের পুরাতন দেবতাদের মূর্তি। জানা যায়, সেখানে কন্সটান্টাইনের নিজের মূর্তিও ছিল, যেখানে তিনি ছিলেন গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর ভূমিকায়। তিনি রোমের অলংকারগুলো এনে এভাবেই কন্সটান্টিপোলকে সাজাতে থাকেন। এর প্রভাবে অচিরেই আশেপাশের সব সাম্রাজ্য থেকে সেখানে বিদ্বান এবং অভিজাতদের সামারোহ ঘটতে থাকে, তিনি তাদের সবাইকে উষ্ণভাবেই গ্রহণ করেন। শহরের জনগণ বৃদ্ধির জন্য কন্সটান্টাইন নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে রেশন পদ্ধতি চালু করেন। তিনি পুরো সাম্রাজ্যকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৪টি ভাগে বিভিক্ত করেন এবং শহরের প্রতিরক্ষা দেয়ালের বাইরের পাশে আরো একটি দেয়াল তৈরি করেন। কন্সটান্টাইনের শাসিত কন্সটান্টিনোপলের বিচার চালিত হতো রোমান আইনে, যদিও এর দর্শন ছিল খ্রিষ্টীয় এবং ভাষা ছিল গ্রিক।
এটিই খ্রিস্টধর্মের প্রথম ধর্মরাজ্য এবং খ্রিস্টানদের প্রথম রাজা কন্সটান্টাইন স্বয়ং। পুরো ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনেও এই ঘটনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ৩৩৭ সালে তার মৃত্যু হয়। বাইজেন্টাইন শাসকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় একটানা শাসন করতে সক্ষম হন।