Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রিটিশ ভারতের ‘স্বাধীন’ রাজারা

‘রাজা-রাজড়ার খেয়াল’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। রাজা-বাদশাহারা জমকালো হবেন, হীরা, মোতি, মাণিক্যের ছটায় সবাইকে থ করে দেবেন- এমনটিই সবাই ধরে নেয়। আর সেদিক দিয়ে দেখলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের রাজারা যে এককাঠি বেশী সরেস, এ কথা বলাই বাহুল্য। বিরাট প্রাসাদ, অমূল্য রত্নরাজি আর বেশুমার হাতি, বাঘ, ঘোড়ার জাঁকালো সমারোহে তারা আমাদের লোককাহিনীতে স্থান করে নিয়েছেন বহু শত বছর ধরে।

ব্রিটিশরা যখন গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে বশে আনলো, তখনও কিন্ত এখানে স্বাধীন রাজন্যদের কোনো কমতি ছিল না। ব্রিটিশদের নীতি ছিল আজব, স্থানীয় রাজারা বশ্যতা স্বীকার করলে তাদেরকে সেই অঞ্চলে রাজত্ব করবার অনুমতি দেওয়া হত। বিনিময়ে ব্রিটিশরা পেত নির্দিষ্ট অংকের ভ্যাট এবং বৈদেশিক নীতি আর নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুবিধা। আজকে এসব ‘স্বাধীন’ রাজাদের নিয়েই আলোচনা হবে।

ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীন রাজা

ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীন রাজাদের সংখ্যাটা বড় কম নয়। মোট ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য বা ‘প্রিন্সলী স্টেট’ ছিল ব্রিটিশ ভারতে। এদের মধ্যে হায়দ্রাবাদের আয়তন ছিল ফ্রান্সের প্রায় অর্ধেক, আবার জুনাগড়ের নবাবের রাজত্ব ছিল মাত্র কয়েক বর্গ কিলোমিটারের। কোনো কোনো রাজ্য, যেমন পাতিয়ালা, কাশ্মীর আর হায়দ্রাবাদের ছিল নিজস্ব সেনাবাহিনী, ট্যাংক বহর, এমনকি নিজেদের রেল ব্যবস্থাও। অনেকের শাসনব্যবস্থা ছিল ব্রিটিশদের থেকেও উন্নত। মোটমাট হিসেবে বলা যায়, ব্রিটিশ ভারতের এক-চতুর্থাংশ জনগণ আর এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল এসব রাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তা বলে ব্রিটিশদের বিরোধিতা তারা মোটেই করতেন না। প্রত্যেক রাজত্বে নিযুক্ত থাকতো একজন ব্রিটিশ কর্মচারী, সে-ই বড়লাটের সাথে রাজাদের যোগাযোগের বিষয়াদি দেখতো। আর রাজারা নিজেদের সাধ্যমত ব্রিটিশদের তোয়াজ চালাতেন। আনুগত্যের বিনিময়ে রাজারা পেতেন বিরল রাজকীয় সম্মান, তোপধ্বনি করে সম্মান জানানো হত তাদেরকে। বড় রাজ্যগুলো পেত ২টি তোপের আখ্যা, কেও পেত ১৯, কেও ১৫, কেও ৯ ইত্যাদি। এর সাথে সাথে নানা সম্মানমূলক পদক আর উপাধিও দেওয়া হত ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে। সম্বোধন করা হত ‘হিজ হাইনেস’ বলে।

Source: pinterest

রাজাদের ধনসম্পদ

ভারতের রাজাদের ধনসম্পত্তির কথা যেকোনো রুপকথাকেও হার মানায়। সম্পদের দিক দিয়ে সবথেকে জাঁকালো ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহাদুর সিপাহী সালার ফতে জং মীর ওসমান আলী খান সিদ্দিকি। তিরিশের দশকেই তার মোট সম্পত্তির অর্থমূল্য ছিল দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার (তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাজেটের ২ শতাংশের সমান)। দীর্ঘদিন বিশ্বের শীর্ষ ধনীর খেতাবটা তার দখলেই ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক লহমায় ২৫ লক্ষ পাউন্ড দান করে ব্রিটিশদের কৃতার্থ করে দিয়েছিলেন তিনি। ১৮৫ ক্যারাট ওজনের প্রকান্ড এক হীরা ব্যবহার করতেন পেপার ওয়েট হিসেবে। এছাড়া মুক্তা, পান্না, চুনী মিলিয়ে তার হাতে ছিল প্রায় ১৭০ এর বেশী রত্ন। রানী এলিজাবেথের বিয়ের সময় বহুমূল্য একটি হীরের জড়োয়া নেকলেস দিয়েছিলেন এই নবাব। শুধু তা-ই না, বলা হয় তার বাগানে নাকি সোনার তাল বোঝাই ১২টি ট্রাক মজুত থাকতো, ভূগর্ভে জমা ছিল প্রায় ২০ লক্ষ পাউন্ড নগদ অর্থ।

বরোদার রাজাদের একটি বহুমূল্য নেকলেস; Source: pinterest.com

অন্যান্য রাজারাও তা বলে কম যান না। মহীশূরের রাজারা পাক্কা এক টন সোনা দিয়ে বানানো এক রাজাসন ব্যবহার করতেন। পাতিয়ালার মহারাজদের ছিল হীরে-মুক্তা বসানো এক বর্ম। তিন হাজার রত্ন বসানো ভরতপুরের মহারাজার পাগড়ী দেখলে যে কারো চোখ ঝলসে যেত। জয়পুরের কিংবদন্তীতুল্য কোষাগার লুকানো থাকতো আরাবল্লী পাহাড়ের তলে। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম হীরা ‘স্টার অব দ্য সাউথ’ ছিল বরোদার মহারাজার সংগ্রহে। সোনার জালি দিয়ে বানানো যে পোশাকটা তিনি পরতেন সেটি বানাতো শহরের একটি বিশেষ পরিবার।

হায়দ্রাবাদের একটি বহুমূল্য অলংকার; Source: India Times

রাজাদের খেয়াল

রাজা মানেই হাতে অসীম ক্ষমতা। এদিকে নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা নেই। কাজেই হাতে অঢেল অবসর। রাজারা সময়টা পার করতেন মদ, নারী আর শিকার নিয়ে মেতে থেকে। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে কী পরিমাণ অপব্যয় করতেন এই উচ্ছৃংখল রাজারা।

মহীশূরের সোনার সিংহাসন; Source: India Times

পাতিয়ালার মহারাজ ভূপিন্দর সিং এর নারীপ্রীতির ব্যাপারে কুখ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই হারেম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এই রাজা। শোনা যায়, তার হারেমে বন্দিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিনশো। অন্যান্য রাজারাও বিয়ে করা বা উপপত্নী রাখার ব্যাপারে কোনোরকম কার্পণ্য করতেন না।

গোয়ালিয়রের মহারাজা তার খাবার টেবিলে বসিয়েছিলেন ছোট্ট এক রেলপথ। রসুইঘর থেকে হরেক রকমের খাবার নিয়ে অতিথিদের প্লেটে পরিবেশন করতো এই বিদ্যুতচালিত ছোট্ট ট্রেন। আলওয়াড়ের মহারাজার ছিল এক সোনার পাতে মোড়া রোলস রয়েস গাড়ি। শোনা যায়, এই গাড়ির কোম্পানীর ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি নাকি একবার রাজ্যের সমস্ত রোলস রয়েস গাড়ি ভাগাড় পরিষ্কারের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। গাড়ি ছাড়াও রাজাদের জাঁক দেখাবার অন্যতম উপকরণ ছিল হাতি। মহীশূরের মহারাজা দশেরা উৎসবের সময় যখন হাতি নিয়ে রাস্তায় নামতেন, চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে যেত। সোনার সিংহাসন বসানো থাকতো রাজার হাতির পিঠে, কানে ঝুলতো সোনার দুল। গোয়ালিয়রের মহারাজা তো একবার প্রাসাদের ছাদে ক্রেন দিয়ে হাতি তুলিয়েছিলেন ছাদের স্থায়িত্ব পরখ করবার জন্য। কাশীর ধার্মিক রাজার অভ্যাস ছিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই গাভী দর্শন করা। তা একবার রাজামশাই রামপুরের নবাবের তিনতলার ভবনে অতিথি হলে দেখা দিল বিপত্তি। তিনতলায় গাভী নিয়ে যাওয়া যায় কীভাবে? শেষমেশ ক্রেনে করে গাভী নিয়ে যাওয়া হলো কাশীর রাজার শয্যাঘরের জানালার পাশে। জুনাগড়ের নবাবের নেশা ছিল আবার কুকুরের। প্রায় চারশো কুকুর ছিল তার সংগ্রহে এবং প্রত্যেকের জন্য নিযুক্ত ছিল একজন করে কর্মচারী। নবাব আবার ঘটা করে এদের বিয়েও দিতেন। শিকারেও রাজাদের অরুচি ছিল না। গোয়ালিয়রের রাজা এক জীবনে শিকার করেছিলেন ১,৪০০ বাঘ।

পাতিয়ালার একটি প্রাসাদ। মোতি বাগ; Source: pinterest

রাজাদের ভাল কাজ

তবে সব রাজাই যে অমন বেহিসেবী পাগলাটে জীবনযাপন করতেন তা কিন্তু না। বরোদার রাজা এদিক দিয়ে অগ্রগণ্য। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালুর পাশাপাশি বহুবিবাহ আর জাতিভেদ প্রথা দূরীকরণে তিনি অনেক অবদান রেখেছেন। প্রখ্যাত বাঙ্গালী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী দীর্ঘদিন বরোদার রাজার আমন্ত্রণে সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। মহীশূরের রাজা হাইড্রো ইলেকট্রিক বাধ বানিয়ে রাজ্যে সেচকাজের অনেক উন্নতি করেছিলেন। জয়পুরের রাজা বানিয়েছিলেন এক মানমন্দির। বিকানীরের রাজা মরুকরণ দূর করবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। পাতিয়ালার শেষ রাজা ক্ষমতা পেয়েই প্রাসাদ থেকে হারেম প্রথা উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া দুটি বিশ্বযুদ্ধেই রাজারা প্রভূত সাহায্য করেছেন মিত্রপক্ষকে। জয়পুর আর পাতিয়ালার মহারাজা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন যথাক্রমে ইতালি আর বার্মাতে। গোয়ালিয়রের রাজা একটি জাহাজ হাসপাতাল পাঠিয়েছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধে। বিকানীরের উট বাহিনী লড়েছে দুই বিশ্বযুদ্ধেই।

রাজাদের পতন

রাজাদের অমন সাধের রাজ্যপাটের ইতি ঘটা শুরু করে ১৯৪৭ এর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট এর পর পর। দেশীয় রাজন্যদের বলা হয় যেন তারা ভারত বা পাকিস্তান যেকোনো একটিকে বেছে নেয়। ফলে কালাত, সোয়াত, ভাওয়ালপুরের মতো রাজ্যগুলো পাকিস্তান সরকারের করতলগত হয়। ভারতেও এমন অসংখ্য রাজ্য ছিল। বেশিরভাগই বিনা প্রতিবাদে স্বাধীন ভারতের সাথে মিশে যায়। তবে গোল বাধে হায়দ্রাবাদ আর কাশ্মীরের মতো শক্তিশালী রাজ্যগুলো নিয়ে।

হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহাদুরের কথা আগেই বলা হয়েছে। রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ ভারতের সাথে যোগ দেওয়ার দাবী জানালেও নিজাম গোঁ ধরে রইলেন যে তিনি স্বাধীন থাকবেন। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সরকার এহেন আবদার যে মেনে নেবে না তা বলাই বাহুল্য। তৎকালীন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। গোড়া জাতীয়তাবাদী এই মানুষটি কালবিলম্ব না করে ১৯৪৮ এর সেপ্টেম্বরে অসংখ্য সৈন্য পাঠিয়ে দিলেন রাজ্যটিকে বশে আনতে। নিজাম বেশ জোরালো প্রতিরোধ গড়েছিলেন, হতাহতের সংখ্যাটা অনেকের মতে ৩০ হাজার থেকে ২ লক্ষের মধ্যে ছিল। তা যা-ই হোক, শেষমেশ হায়দ্রাবাদ ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।

স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন নিজাম বাহাদুর মীর আসফ আলী খান; Source: Pinterest

গোল বেধেছিল কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে নিয়েও। হরি সিং ঘোষণা করেছিলেন, ভারত বা পাকিস্তান, কোনো রাজ্যেই তিনি যোগ দেবেন না; স্বাধীন থাকবেন। কিন্ত তা কী হয়! ১৯৪৭ এর অক্টোবর মাসে, পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের পার্বত্য গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদতে ঢুকে পড়ে পাহাড়ি এই রাজ্যটিতে। ভীত হরি সিং উপায়ন্তর না দেখে দ্বারস্থ হন ভারত সরকারের। ভারতও সেনা পাঠিয়ে দিল। যুদ্ধশেষে রাজ্যটির এক-তৃতীয়াংশের দখল যায় পাকিস্তানের কাছে (আজাদ কাশ্মীর), বাদবাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ভারত।

ভূরাজনৈতিক জটিলতায় হার মানতে বাধ্য হন হরি সিং; Source: pinterest.com

সর্বশেষ স্বাধীন রাজ্য ছিল হিমালয়ের পাদদেশের সিকিম রাজ্যটি। ১৯৭৫ সালে এক গণভোটের রায় অনুযায়ী প্রায় ৯৮ শতাংশ সিকিমবাসী ভারতে যোগ দেওয়ার আর্জি জানালে সিকিম এর রাজপরিবার অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ ভারত সরকারের হাতে তুলে দেয়, অবসান ঘটে প্রায় ৩২০ বছরের রাজত্বের। বলা যায়, সিকিমের পতনের পর পরই ভারতীয় উপমহাদেশের রূপকথাতুল্য রাজারা ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ীভাবে ঠায় নেয়, অবসান ঘটে শতাব্দী প্রাচীন এক ঐতিহ্যের।

তথ্যসূত্র

ল্যারি কলিন্স, দোমিনিক লাপিয়ের, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট (১৯৭৫)

ফিচার ইমেজ: pinterest.com

Related Articles