২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি মার্কিন মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগান যুদ্ধ (১৯৭৯–১৯৮৯) সম্পর্কে মন্তব্য করেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল কারণ আফগানিস্তান থেকে ‘সন্ত্রাসবাদী’রা সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপ্রবেশ করছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ ‘সঠিক’ ছিল বলেও তিনি মতামত প্রকাশ করেন। স্বভাবতই, ট্রাম্পের প্রায় সকল কথার মতো এই কথাটিও বিতর্কের জন্ম দেয় এবং বিশেষত মার্কিন গণমাধ্যমে ট্রাম্পের এই বক্তব্যের তুমুল সমালোচনা হতে থাকে।
এটা সত্যি যে, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে আফগান সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশ’ আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ ছিল না। আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল চলমান আফগান গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত আফগান কমিউনিস্ট সরকারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করা। এবং এটাও সত্যি যে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের পূর্বে আফগান মিলিট্যান্টরা (বা মিলিট্যান্ট ও তাদের সমর্থকদের ভাষায়, ‘মুজাহিদিন’) সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করে নি।
কিন্তু আফগান যুদ্ধের যে অধ্যায়টি অনেকের কাছেই অজানা, সেটি হলো আফগান যুদ্ধ চলাকালে আফগান মিলিট্যান্টরা সত্যিই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বেশকিছু আক্রমণ চালিয়েছিল। এবং এই আক্রমণে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, যাদেরকে পর্দার অন্তরাল থেকে সমর্থ দিচ্ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ!
১৯৭৯ সালে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে দুইটি ঘটনা ঘটে, যেগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এর একটি হচ্ছে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব, যার ফলে ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি ইসলামপন্থী সরকার ইরানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এর ফলে একদিকে যেমন ইরানে মার্কিন প্রভাবের বিলুপ্তি ঘটে (যেটি মস্কোর জন্য ছিল সুসংবাদ), অন্যদিকে তেমনি ইরানে সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের পথও রুদ্ধ হয়, কারণ ইরানের নতুন সরকার ইরানি কমিউনিস্টদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতন শুরু করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ শুরু করে।
অপর ঘটনাটি হচ্ছে – আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের বিস্তার। ১৯৭৮ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে (যেটিকে তারা ‘সাউর বিপ্লব’ নামে অভিহিত করেছিল) আফগান কমিউনিস্টরা আফগান রাষ্ট্রপতি দাউদ খানকে খুন করে এবং ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু তাদের বৈপ্লবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি রক্ষণশীল আফগান জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং অচিরেই পাকিস্তান ও ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় (এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ মদদে) বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপ আফগান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। এর ফলে আফগানিস্তানের ৮০% ভূমি আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তদুপরি, আফগান কমিউনিস্টদের মধ্যে ত্রিমুখী অন্তর্দ্বন্দ্বে আফগান সরকার প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে এবং ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে একটি অভ্যুত্থানে আফগান রাষ্ট্রপতি নূর মুহম্মদ তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন ক্ষমতা দখল করেন। বাহ্যিকভাবে আমিন ছিলেন একজন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট, কিন্তু সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি তাকে মার্কিন গুপ্তচর বলে সন্দেহ করত।
সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য এই পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে ৬টি ছিল মুসলিম–অধ্যুষিত। এগুলোর মধ্যে ৫টি (কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান) ছিল মধ্য এশিয়ায় এবং ১টি (আজারবাইজান) ছিল দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত। ১৯৩০–এর দশকের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সবগুলো প্রজাতন্ত্রের মধ্যে এই প্রজাতন্ত্রগুলো ছিল মস্কোর প্রতি সবচেয়ে অনুগত। প্রজাতন্ত্রগুলো ছিল প্রচুর পরিমাণ খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এই প্রজাতন্ত্রগুলোতে শিল্পায়ন ঘটিয়েছিল এবং জল, স্থল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। সে সময় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সোভিয়েত মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর জীবনযাত্রার মান ছিল সবচেয়ে উন্নত এবং সাক্ষরতার হারও ছিল সবচেয়ে বেশি।
সর্বোপরি, সামরিক কৌশলগত দিক থেকে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো ছিল মস্কোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিআইএর পরিচালক (১৯৮১–১৯৮৭) উইলিয়াম কেসি মধ্য এশিয়াকে সোভিয়েত ভাল্লুকের ‘নরম তলপেট’ (soft underbelly) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বাস্তবেও সোভিয়েত কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাত শ্রেণি (এবং মধ্য এশীয় আঞ্চলিক রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি) কোনোক্রমেই মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোকে হাতছাড়া করতে প্রস্তুত ছিল না।
এজন্য ইরানি বিপ্লব ও আফগান গৃহযুদ্ধ মস্কোয় ভীতির সৃষ্টি করে। মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে ইরানি বিপ্লবের অনুকরণে বিপ্লব ঘটার আশঙ্কা মস্কো, তাসখন্দ, আলমা–আতা ও অন্যান্য প্রজাতান্ত্রিক রাজধানীতে কমিউনিস্ট অভিজাতদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তদুপরি, আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে আফগান সরকারের পতন ঘটলে তদস্থলে একটি ধর্মীয় উগ্রপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারত এবং এর ফলে আফগানিস্তান হয়ে উঠত সোভিয়েত মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে অস্থিতিশীলতার উৎস। এজন্য কাবুলের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে। প্রত্যুত্তরে আফগানরা সেটাই শুরু করে, যেটা তারা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণের সময় থেকে বিদেশি সৈন্যদের বিরুদ্ধে করেছে – প্রবল প্রতিরোধ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তানকে মস্কোর ‘ভিয়েতনাম’ বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং আফগান মিলিট্যান্টদের পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। একজন সোভিয়েত জেনারেলের মতে, আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পাকিস্তানি–আফগান সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করার মাধ্যমে মিলিট্যান্টদের (বা ‘মুজাহিদ’দের) দমন করতে কমপক্ষে ৩৬ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রধানত রাজনৈতিক (এবং অংশত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত) কারণে মস্কো আফগানিস্তানে মাত্র ৪ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করেছিল এবং ৯ বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধে দেশটিতে নিয়োজিত সোভিয়েত সৈন্যসংখ্যা কখনো ১,১৫,০০০–এর বেশি ছিল না। অন্যদিকে, সোভিয়েত সৈন্যবাহিনীর নানা রকম ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সামরিকভাবে পরাজিত করা মিলিট্যান্টদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সোভিয়েত প্রতিশোধের ভয়ে আফগান মিলিট্যান্টদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কিন বা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা সরাসরি সংযুক্ত ছিল না, বরং পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার–সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ (আইএসআই) এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত। ১৯৮৪ সালে সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম কেসি আফগান যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাকিস্তানে আসেন। তার আগমনের ফলে আফগান যুদ্ধে একটি নতুন দিকের সৃষ্টি হয়।
কেসি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ রোমান ক্যাথলিক, রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত রক্ষণশীল ও রিপাবলিকান দলের সমর্থক এবং পররাষ্ট্রনীতিতে তীব্রভাবে সোভিয়েতবিরোধী। বলা হয়ে থাকে যে, কেসি সিআইএ তে এসেছিলেন সংগঠনটির সংস্কার বা কার্যপদ্ধতির উন্নয়নের জন্য নয়, বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। কেসির মতামত ছিল যে, ‘নাস্তিক’ কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান ও মুসলিমদের একত্রিত হয়ে যথাক্রমে ‘ক্রুসেড’ ও ‘জিহাদ’ পরিচালনা করা উচিত।
বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অ–রুশ অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। ইউক্রেনীয় ও বাল্টিক জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সিআইএর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, কিন্তু মধ্য এশিয়ায় তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। কেসি তার পাকিস্তান সফরকালে আইএসআই কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন যে, তাদের উচিত সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়িয়ে দেয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর জন্য আফগান গেরিলাদের উৎসাহিত করা! এই উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সোভিয়েতবিরোধী প্রচারণা চালানো এবং অস্ত্র সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও তিনি তাদের উৎসাহ দেন।
পাকিস্তানিদের এই পরামর্শ দিয়ে কেসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন ভঙ্গ করেছিলেন, কারণ একমাত্র মার্কিন রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তার সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সশস্ত্র আক্রমণ চালানোর অনুমতি প্রদানের এখতিয়ার ছিল না। কেসির সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, এবং পরবর্তীতে মার্কিন সরকার পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের এ ধরনের কোনো আক্রমণে অনুমতি দেয়ার কথা অস্বীকার করে। এই ধরনের আক্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কারণ পারমাণবিক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ধরনের আক্রমণের জবাব কীভাবে দেবে সেটা কারোরই জানা ছিল না।
আইএসআই অবশ্য এ ব্যাপারে খুবই উৎসাহী ছিল। এর কারণ ছিল বহুবিধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে পাকিস্তানিরা খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখত; সাধারণভাবে কমিউনিজম বা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ ছিল না; আফগান যুদ্ধের ফলে প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল, যা ছিল পাকিস্তানের জন্য এক বিরাট বোঝা; পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যদের উপস্থিতিকে ভীতির চোখে দেখতেন, কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগরের উষ্ণ জলীয় বন্দরে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারে; এবং আফগানিস্তানে একটি পাকিস্তানপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদী আফগানদের ‘বৃহত্তর পশতুনিস্তান’ দাবির অবসান ঘটানো এবং পাকিস্তানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ (strategic depth) বৃদ্ধি করাও তাদের লক্ষ্য ছিল। শুধু তাই নয়, সিআইএর তথ্যমতে, পাকিস্তানের ইসলামপন্থী সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে একটি মুসলিম ‘ফেডারেশন’ বা ‘কনফেডারেশন’ সৃষ্টিরও ইচ্ছা পোষণ করতেন।
ফলশ্রুতিতে আইএসআই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে আফগান মিলিট্যান্টদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। আইএসআই এর কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ ইউসুফ এই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে আফগান মিলিট্যান্টদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ব্যাপক হারে প্রচারণা চালানো হবে। এরপর আফগানিস্তানের ভূমি থেকে সোভিয়েত ভূমিতে নিয়মিত গোলাবর্ষণ করা হবে এবং সোভিয়েত–আফগান সীমান্তবর্তী আমুদরিয়া নদীতে চলমান নৌকা ও স্টিমারগুলো ডুবিয়ে দেয়া হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন সোভিয়েত স্থাপনার ওপর রকেট হামলা চালাবে, মাইন পুঁতে রাখবে, ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলবে এবং সোভিয়েত সৈন্যদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালাবে। সিআইএ এবং আইএসআই এর আশা ছিল, এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিমরা মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩টি প্রজাতন্ত্রের – উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান – সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত ছিল এবং আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে বহুসংখ্যক তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেন জাতিভুক্ত মানুষ বসবাস করত। আফগান তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেনদের সঙ্গে সোভিয়েত উজবেক, তাজিক ও তুর্কমেনদের জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং গোত্রগত সামঞ্জস্য ছিল এবং সিআইএ ও আইএসআই এই সামঞ্জস্যকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
১৯৮৪ সালেই পাকিস্তানের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আইএসআই এর তত্ত্বাবধানে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপ্রবেশ করানোর উদ্দেশ্যে বাছাইকৃত আফগান মিলিট্যান্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একই সময়ে আইএসআই তাদের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে পবিত্র কুরআনের কপি প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিআইএতে কর্মরত একজন উজবেক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী উজবেক ভাষায় লিখিত কিছু উপন্যাস প্রেরণেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই উপন্যাসগুলোতে উজবেকদের ওপর সোভিয়েতদের কথিত ‘নৃশংসতা’র বিবরণ ছিল। কুরআন প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত মুসলিমদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা, আর উপন্যাসগুলো প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল তাদের মধ্যে সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব গঠন করা। মার্কিনি ও পাকিস্তানিরা আশা করছিল, এর ফলে সোভিয়েত মুসলিমরা আফগান মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যোগ দেবে কিংবা নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে।
পরিকল্পনা মোতাবেক সিআইএর উদ্যোগে পবিত্র কুরআনকে আরবি ভাষা থেকে সিরিলিক লিপিতে লিখিত উজবেক ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং এর ১০,০০০ কপি তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে উজবেক ভাষায় লিখিত সোভিয়েতবিরোধী উপন্যাসগুলোরও কিছু কপি তৈরি করা হয়। ১৯৮৫ সালে আফগান মিলিট্যান্টরা সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুপ্রবেশ করে এবং সোভিয়েত উজবেকদের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ কুরআনের কপি বিলি করে। সোভিয়েত উজবেকরা কুরআনের কপিগুলো উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করে, কিন্তু সোভিয়েতবিরোধী উপন্যাসগুলো ফিরিয়ে দেয়। খুব কম সংখ্যক সোভিয়েত মুসলিমই আফগান মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যোগ দিতে বা সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহী ছিল। এভাবে আইএসআই এর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এই ব্যর্থতার পর মার্কিন সরকারের চাপে সিআইএ আইএসআইকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অভিযান চালানো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়, কিন্তু আইএসআই তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করতে থাকে। অবশ্য সিআইএ কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে আইএসআইকে তাদের পরিকল্পনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন, কিন্তু পাকিস্তানিদের সরাসরি কোনো সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সিআইএর কাছে সোভিয়েত–আফগান সীমান্তবর্তী সোভিয়েত অঞ্চলগুলোর বিস্তারিত মানচিত্র চেয়েছিলেন, কিন্তু সিআইএ এতে অস্বীকৃতি জানায়। সিআইএ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য ছিল, আইএসআই নিজ উদ্যোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করলে করুক, কিন্তু তাতে যেন মার্কিন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়া যায়।
১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে আফগান মিলিট্যান্টরা আফগানিস্তানের ভূমি থেকে সোভিয়েত–আফগান সীমান্তবর্তী আমুদরিয়া নদীতে চলমান মালবাহী সোভিয়েত নৌকা ও স্টিমারগুলোর ওপর আক্রমণ চালায় এবং ব্রিটিশদের সরবরাহকৃত লিম্পেট মাইন ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি সোভিয়েত নৌযান ডুবিয়ে দেয়। আফগান ভূমি থেকে তারা সীমান্তের অপর পাশে অবস্থিত সোভিয়েত গ্রাম ও শহরগুলোর ওপরেও গোলাবর্ষণ শুরু করে দেয়। তাদের এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আইএসআই আরো বড় পরিকল্পনা হাতে নেয়।
আমুদরিয়া নদীর ওপরে অবস্থিত সোভিয়েত–নির্মিত ‘সোভিয়েত–আফগান মৈত্রী সেতু’টি বিস্ফোরকের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়ার জন্য আইএসআই পরিকল্পনা করে। এই সেতু দিয়েই সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল এবং এটির মাধ্যমে আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহ করা হত। এজন্য এটি ছিল কৌশলগতভাবে সোভিয়েতদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদেরকে গুরুতর সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক এই পরিকল্পনার কথা জানতে পারার সাথে সাথে এটিকে বাতিল করে দেন। কারণ তার আশঙ্কা ছিল যে, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সোভিয়েতরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বড় বড় স্থাপনায় আক্রমণ চালাতে পারে।
এই পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার পরও আইএসআই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত চালানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। সোভিয়েত উজবেকিস্তানের সমরখন্দ থেকে আফগান সীমান্তের নিকটবর্তী তেরমেজ শহর পর্যন্ত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ছিল। এটির মাধ্যমে সোভিয়েত সৈন্যরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহ করত। ১৯৮৬ সালে আইএসআই এই রেলপথটি উপড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে পরপর দুইটি প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই অনুপ্রবেশকারী আফগান গেরিলারা সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’র হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। এরপরও ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে আফগান মিলিট্যান্টরা সোভিয়েত তাজিকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানকার দুইটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আক্রমণ চালায়, কিন্তু এই আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য।
এখন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আইএসআই এর তত্ত্বাবধানে আফগান গেরিলারা যে আক্রমণ করেছিল, তাতে সোভিয়েতদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম। কিন্তু ১৯৮৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। এ সময় আফগান মিলিট্যান্টদের একটি দল সোভিয়েত তাজিকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে এবং সোভিয়েত ভূমিতে প্রায় ২০ কি.মি. অগ্রসর হয়ে ভরোশিলোভাবাদ শহরের একটি শিল্প কারখানায় রকেট হামলা চালায়। এই আক্রমণের ফলে কারখানাটির বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং বেশ কয়েকজন কারখানাকর্মী নিহত হয়। ভাগ্যের পরিহাসে, নিহত ব্যক্তিদের সবাই ছিল সোভিয়েত মুসলিম, যাদেরকে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করানোর জন্যই আইএসআই এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিল।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইউসুফের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই আক্রমণটিতে অংশগ্রহণকারী আফগান গেরিলা দলটি নিরাপদে আফগানিস্তানে ফিরে আসে, কিন্তু এরপর পথিমধ্যে দলটির অধিনায়ক সোভিয়েতদের পুঁতে রাখা ‘মানববিরোধী মাইন’ (anti-personnel mine) এর আঘাতে পঙ্গু হয়ে যায়। ইউসুফ এই ব্যক্তিটিকে ‘ওয়ালী বেগ’ ছদ্মনামে আখ্যায়িত করেছেন।
ভরোশিলোভাবাদের আক্রমণের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষিপ্ত হয়। তারা ভালোভাবেই জানতো এই আক্রমণগুলো কাদের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত আব্দুররহমান ওয়াজিরভ নাটকীয়ভাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করেন এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের হুমকি দেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আক্রমণ বন্ধ না হলে পাকিস্তানকে এর চরম মূল্য দিতে হবে!
পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ জিয়াউল হক এবং প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ খান জুনেজো উভয়েই সোভিয়েত হুমকিতে আতঙ্কিত হন এবং আইএসআই মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুলকে ডেকে কঠোর ভাষায় নির্দেশ দেন যে, কোনো অবস্থাতেই যেন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে কোনো আক্রমণ চালানো না হয়। বস্তুত, এই পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার আরম্ভ করেছিল এবং এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নিরর্থক শত্রুতা বৃদ্ধির কোনো ইচ্ছে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ছিল না।
কিন্তু আফগান মিলিট্যান্টরা কোনো সময়ই পুরোপুরিভাবে আইএসআই এর হাতের পুতুল ছিল না এবং তারা নির্দেশ দিলেই যে আফগান গেরিলারা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে আক্রমণ পরিচালনা বন্ধ করবে এর কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বহু প্রচেষ্টা, মধ্যস্থতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পর পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে আর আক্রমণ না করার জন্য আফগান মিলিট্যান্ট নেতাদের রাজি করাতে সক্ষম হন। এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম–অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ায় বিদ্রোহ সৃষ্টির মার্কিন ও পাকিস্তানি পরিকল্পনার অবসান ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তীতে ঠিকই ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু বিদেশি হস্তক্ষেপ নয়, কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মূল কারণ।
উল্লেখ্য, সিআইএর পরামর্শে আইএসআই নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। এই ব্যাপারে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নও ধোয়া তুলসী পাতা ছিল না। ১৯৮০–এর দশকে কেজিবি আফগান গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অসংখ্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। পরবর্তী কোনো লেখায় এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।