Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার মর্মান্তিক বর্ণনা

১৯৪৫ সালের ৯ আগস্টের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের নির্দেশে জাপানের নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর তিনদিন আগে অবশ্য প্রথম আঘাত হানা হয়েছিলো হিরোশিমায়। তবে আমাদের আজকের মনোযোগ নাগাসাকিতে কেন্দ্রীভূত থাকবে বলে সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। নাগাসাকিতে সেদিনের সেই ভয়াবহ হামলায় নিহতের সংখ্যা আশি হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছিলো বলে ধারণা করা হয়।

সেদিন শহরটির লাখো আক্রান্তের মাঝে পনের বছর বয়সী কিশোরী মিচি হাত্তোরিও ছিলো। বিষ্ফোরণের সময় স্কুলে ছিলো সে। বিষ্ফোরণের মুহূর্ত থেকে শুরু করে পরবর্তীতে তার স্বচক্ষে দেখা বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এ প্রত্যক্ষদর্শী নির্ভর লেখাটি।

“সম্ভবত আমি স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলাম না, কিন্তু নিয়মকানুনের ব্যাপারে সম্ভবত আমিই ছিলাম সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধাশীল। যখন শহরে বিমান আক্রমণের সতর্কীকরণ এলার্ম বাজানো হলো, তখন আমি যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব দৌঁড়ে পাহাড়ের পাশে এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, যা সরকার থেকে আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।

সবসময়ই ক্লাসের অন্যান্যদের তুলনায় আমি আগেই আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে যেতাম। ‘সবসময়ই’ বলছি, কারণ সেদিনের আগে নাগাসাকিতে আরো পাঁচবার বোমা হামলা করা হয়েছিলো। স্কুল থেকে আমরা বিষ্ফোরণের শব্দ শুনতে পেতাম, দেখতে পেতাম অগ্নি স্ফুলিঙ্গও, কিন্তু সেগুলো কখনোই আমাদের কাছে আসতো না। এমনকি আশেপাশের পাহাড়ের কারণে অধিকাংশ সময় সেই শব্দগুলোর তীব্রতাও কমে যেত।

আগস্টের ৯ তারিখের সতর্কীকরণ এলার্মটিকেও আমরা আগের আক্রমণগুলোর মতোই ভেবেছিলাম। সেজন্য অনেক মেয়েই স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। তখন পর্যন্ত তিন দিন আগে হিরোশিমাতে ঘটা পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয় নি। শিক্ষকেরা আমাদেরকে ক্লাস থেকে বের হয়ে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বললেন। আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের অধিকাংশই স্কুলের উঠোনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। ‘B-San (Mr. B)’-কে আকাশে উড়ে যেতে দেখা তখন খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না। আমরা সবাই ‘B-29’-কে এ নামেই ডাকতাম। একটিমাত্র B-San কখনোই তেমন কোনো ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি। আমরা ধারণা করতাম যে, তারা হয়তো আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করছে কিংবা উপকূলের ছবি তুলছে।

যখন বোমটি বিষ্ফোরিত হলো, তখন আমি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হাত নেড়ে নেড়ে মেয়েদেরকে ভেতরে আসতে বলছিলাম। প্রথমেই দেখা গেলো আলোর ঝলকানি, আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো। সেদিন আকাশটা ছিলো মেঘাচ্ছন্ন এবং মুহুর্তের মাঝে সবকিছু উজ্জ্বল সাদা হয়ে গেলো। আমার চোখ আর সইতে পারলো না। কিছুক্ষণের জন্য আমি যেন অন্ধ হয়ে গেলাম।

আলোর ঝলকানির পরপরই প্রচন্ড উত্তাপ এসে আমাকে ঝলসে দিলো। এক মুহুর্তের জন্য আমি আবছাভাবে গুহার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোকে ঝলসে যেতে দেখলাম। বোলিং পিনের মতো তারা একেক দিকে পড়ে যাচ্ছিলো। চিৎকার করতে করতে জ্বলন্ত স্কুল ইউনিফর্মটাকে হাত দিয়ে চাপড়াচ্ছিলো ওরা। এরপর ক্ষণিকের জন্য আমি কিছুই দেখতে পেলাম না।

সাথে সাথেই প্রচন্ড শক্তিশালী বাতাসের ঝাপ্টা এসে আমাকে আঘাত করলো। সেটা আমাকে গুহার আরো ভেতরে নিয়ে ফেললো, ঠিক তখনই ওটা আমাকে গুহার প্রবেশদ্বার দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললো। আমার মনে হয় শকওয়েভটা গুহার পেছনে আঘাত করে আবার বাউন্স করেছিলো। এটাই আমি সহ অন্যান্যদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমরা সবাই মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ি।

কী ভয়ানক এক অনুভূতি! আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার হাত-মুখ পুড়ে গিয়েছিলো, সারা শরীর ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। আমি একটু হাঁটার চেষ্টা করে পড়ে থাকা একটি গাছের সাথে হোঁচট খেলাম। আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম। তখনও আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম না আমি আসলে কোথায় আছি এবং আমার সাথে আরো কিছু ঘটতে যাচ্ছে কিনা।

যখন আমার জ্ঞান ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো, তখন আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে আমি মেয়েদের কান্না শুনতে পেলাম। একজন বাদে সবাই দাঁড়িয়ে ছিলো এবং তাদের গায়ে ফুঁ দিচ্ছিলো। যে মাটিতে পড়ে ছিলো, তার দিকে চেয়ে দেখলাম তার পা দুটো অদ্ভুতভাবে বেঁকে গেছে। আজ পর্যন্ত আমরা জানি না কিভাবে তার পা ভেঙে গিয়েছিলো। অন্যান্য মেয়েদের হাত-মুখ খুব দ্রুতই উজ্জ্বল রক্তবর্ণ ধারণ করলো। আমার মনে হয় গুহার কিছুটা ভেতরে থাকায় আমি রক্ষা পেয়েছিলাম, কারণ আমার জ্বালাপোড়া কিছুদিনের মাঝেই কমে গিয়েছিলো।

সাহায্য আনতে যাবার আশ্বাস দিয়ে আমরা হারুকোকে, যে মেয়েটি মাটিতে পড়ে ছিলো, শুয়ে থাকতে বললাম। আমাদের চারদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিলো। কাগজ, কাঠের টুকরা, এমনকি ধ্বংসপ্রাপ্ত নানা স্থাপনা থেকে আগুন জ্বলছিলো। ঘন ধোঁয়া এবং ধূলায় ভারী হয়ে গিয়েছিলো চারপাশের বাতাস। আগুনই যেন ছিলো আলোর একমাত্র উৎস। দুপুর বেলাতেও সূর্যের আলো যেন মেঘমালা ভেদ করে আসতে পারছিলো না। মেয়েদেরকে আমি কেবল একটি শব্দই বলতে শুনছিলাম- ‘জিগোকু’, যার অর্থ জাহান্নাম। জাহান্নামের সবচেয়ে বেশি হলে এতটুকু কাছেই আমি যেতে চাই।

তখন এক ক্লাসমেট পরামর্শ দিলো যে, “চলো স্কুলে ফিরে যাওয়া যাক। এটা এখান থেকে মাত্র কয়েকশ মিটার।” আমরা খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছিলাম, কারণ প্রতিটি পদক্ষেপেই শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছিলো। আমরা ভেবেছিলাম যে, আশ্রয়কেন্দ্রের খুব কাছেই কোথাও হয়তো বোমটি বিষ্ফোরিত হয়েছে। আমরা তখন চিন্তাও করি নি যে, আমাদের পুরো শহর জুড়ে আসলে ধ্বংসের মাত্রা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

স্কুলে যাবার রাস্তাটাকে অদ্ভুত রকমের সমতল আর জনশূন্য লাগছিলো। কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো, “আমরা যখন আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছিলাম, তখন কি এখানে বাড়িঘর ছিলো না?” পুরো বাস্তব জগতটাকে এতটাই পরাবাস্তব বলে মনে হচ্ছিলো আমাদের কাছে যে, আমরা ধরেই নিয়েছিলাম পৃথিবীর বুক থেকে কোনো স্থাপনা উধাও হয়ে যেতে পারে। ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।

আমার ক্লাসমেট ফুমিকো হঠাৎ করে সামনে ৫০ মিটারের মতো দৌড়ে গেলো। সে কেন ডাকছে এটা দেখতে যখন আমি তাকালাম, তখন দেখলাম সে মাটিতে পড়ে থাকা বড় কিছু একটার দিকে ইশারা করছে। “ওদিকে দেখ”, সে চিৎকার করে উঠলো, “ওটা চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে এসেছে। ওটা একটা কুমির!

আমাদের যাত্রাপথে ঐ জন্তুটা ছিলো। তাই আমরা সতর্কতার সাথে এগোতে থাকলাম। ফুমিকো একটা পাথর খুঁজে নিলো। ওটার কাছে গিয়ে ফুমিকো সতর্কতার সাথে পাথরটা মাথার উপর তুলে নিলো নিক্ষেপের জন্য। তখন হঠাৎ করেই ফুমিকো যেন স্থির হয়ে গেলো, সে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকলো। আমাদের দিকে মুখ তুলে বুকে ভর দিয়ে চলতে থাকা প্রাণীটা ছিলো একজন মানুষ!

চিৎকারের জন্য আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সেই মানুষটি আসলে কী বলতে চাচ্ছে। আমি শুধু দেখলাম সে কিছু একটা চাচ্ছে, সম্ভবত পানি। তার শরীরে কোনো কাপড় কিংবা চুল দেখা যাচ্ছিলো না, শুধু মাথা ও শরীর জুড়ে বড়, ধূসর পোড়া দাগই দেখা যাচ্ছিলো। আগুনে তার চোখের আশেপাশের চামড়া ঝলসে গিয়ে অক্ষিগোলক বেরিয়ে এসেছিলো। সেগুলো ছিলো বেশ বড় ও ভয়াবহ। সে কি পুরুষ না নারী ছিলো তা আমি বুঝতে পারি নি।

এরপর তার মাথাটি মাটিতে পড়ে গেলো, মুখটি ধুলোর উপরে। শরীরটি এরপর আর নড়লো না। ফুমিকো মাটিতে বসে পড়লো, আমিও তার পাশে বসে পড়লাম।

… যখন মনে হলো আমরা উঠে দাঁড়াতে পারবো, তখন ধীরে ধীরে স্কুলের দিকে এগোতে লাগলাম আমরা। চলার পথে দুই-তিন দল মানুষের সাথে দেখা হলো আমাদের। তাদেরকে দেখে নির্জীব বলে মনে হচ্ছিলো। মাটিতে পড়ে থাকা লোকগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। তাদের সাহায্য করার মতো কিছুই করার ছিলো না আমাদের। আমরা এগোতে থাকলাম স্কুলের দিকে।

ধূলাবালি ও ধ্বংসাবশেষের কারণে একেবারে কাছে যাওয়ার আগে আমরা স্কুলটিকে ঠিকমতো দেখতে পারছিলাম না। এটাকে মোটামুটি অক্ষতই লাগছিলো, শুধু জানালাগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা স্কুলে থেকে যাওয়া অন্যান্যদের দেখা পেলাম। সৌভাগ্যই বলতে হবে তাদের, কারণ বিষ্ফোরণের বিপরীত দিকে তাদের অধিকাংশ ছিলো।

দুটি মেয়ে হাতে অস্থায়ী ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রেখেছিলো। জানালা থেকে ছুটে আসা কাঁচে তাদের হাত কেটে যায়। তাদের অনেকের হাত ও মুখই একবারে রক্তবর্ণ ধারণ করেছিলো, যা সেকেন্ড ডিগ্রি বার্নের নমুনা বলে পরে আমি জেনেছি। আমরা ভেবেছিলাম যে, রিইনফোর্সড কনক্রিট ব্লকের বিল্ডিংটি পরবর্তী আরো বিষ্ফোরণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। সেজন্য পরবর্তী আধা ঘন্টা আমরা সেই দলটির সাথেই থাকলাম।

এখন ভাবলে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে যে, আমি ভেতরে গিয়ে আমার বই আর অন্যান্য জিনিসগুলো নিয়ে আসতে চাচ্ছিলাম। আমাদের গ্রুপের একজন বলেছিলো যে, “আমার মনে হয় আমাদের একজন শিক্ষক মারা গিয়েছেন।” সেদিন বইগুলো হঠাৎ করে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিলো তা ভাবলে এখনো আশ্চর্য লাগে। তবে আমার বাবা-মা তাদের সামান্য আয় থেকে সেগুলো কিনে দিয়েছিলেন। তাই আমি ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।

বিষ্ফোরণে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিলো। ফলে হলের ভেতর দিয়ে যেতে আমার ভয় করছিলো। ধুলাবালি ও ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে সামান্য আলোই আসতে পারছিলো। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরির পর আমি আমাদের রুম ‘1-Kumi’ খুঁজে পেলাম। মেঝে ও ডেস্কের উপর কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিলো। কিন্তু আমার বইগুলো ছিলো অক্ষত। বইগুলো আমি হাতে নিলাম, হ্যাটটা ঠিকমতো পরে নিলাম।

হলওয়েতে আমি কারো গলার স্বর শুনতে পেলাম। আমাদের রুমের সামনের রুম ‘3-kumi’-এর দরজা কিছুটা খোলা ছিলো। ভেতরের মানুষটি বলছিলো, “Mizu, Mizu” অর্থাৎ “পানি, পানি”। লোকটি দরজার সাথে ঠেস দিয়ে থাকায় তা শক্ত হয়ে আটকে ছিলো। আমি সর্বশক্তিতে ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দরজাটা তার শরীরকে নাড়িয়ে দিলে তিনি ব্যথায় কাতরে উঠলেন। আমি আমাদের শিক্ষক সাকামোতোকে চিনতে পারলাম। তিনি তার রক্ত ঝরতে থাকা পায়ের চারদিকে শার্ট মুড়িয়ে রেখেছিলেন। তার গলার পাশ দিয়েও রক্ত বেয়ে পড়ছিলো। মাথা ঝুঁকিয়ে কোনোভাব রক্তে লাল শার্টটাকে তুলে ধরে তিনি তার পা নাড়ালেন।

খুব অস্পষ্ট শব্দ করছিলেন তিনি। তার পায়ের বড় ক্ষতটা আমি দেখলাম। তার উর্বস্থিকে রক্তের পুলের মাঝে একটি সাদা অংশের মতো লাগছিলো। তিনি আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন এবং ‘মিজু’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। আমি ছুটে গেলাম আমাদের রুমের দিকে, কারণ কাপ আর চায়ের পট কোথায় রাখা হয় তা আমি জানতাম। ফিরে এসে তার মুখের সামনে কাপটি ধরলাম আমি পান করানোর জন্য।

এটা শেষ করে তিনি কিছু ওলটপালট হয়ে থাকা ডেস্কের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তিনি ফিসফিস করে কী বললেন তা আমি বুঝতে পারলাম না। কানটি আরো কাছে নেয়ার পর আমি কেবলমাত্র একটি শব্দই বুঝতে পারি- “তানি”।

তানি আপা?”, জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মাথা নাড়লেন। আমি সেই ডেস্কগুলোর পেছনে গেলাম এবং একজন মহিলার বুকে জানালার একখন্ড গ্লাস ঢুকে থাকতে দেখলাম। আমার বই দিয়ে কাঁচের টুকরাটিকে মুড়িয়ে তা তুলতে চাইলাম আমি। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে সম্ভবত তার মাথাটি দেখে আমি চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম। তার চোখগুলো খোলা ছিলো, মাথাটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছিল। তার শ্বাসনালীর ভেতরের সেই ভয়াবহ দৃশ্য আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়।

মি. সাকামোতোর চায়ের কাপটিতে আরো চা দিয়ে আমি বের হয়ে আসলাম। তার কিংবা মিস তানির জন্য আমার আর কিছুই করার ছিল না।

পেছনের দরজার কাছাকাছি এসে আর একটু হলেই ভেতরে ছুটে আসা ক্লাসমেটদের ধাক্কায় আমি পিষ্ট হচ্ছিলাম। “আমার হাতটা দেখ”, বলেই একজন সেটা আমাকে দেখালো। আমি সেখানে বড়, কালো, ভেজা দাগ দেখতে পেলাম। সে বলতে লাগলো, “বৃষ্টির রঙ কালো হয়ে গেছে… ফোঁটাগুলো বেশ বড় এবং গায়ে পড়লে ব্যথা হচ্ছে।

আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আমি স্কুলে আসার আগে আমাদের মাঝে যে চারজনের শরীর সবচেয়ে বেশি পুড়ে গিয়েছিলো, তারা গায়ে পানি দিতে নদীর দিকে গিয়েছিলো। নদীর ঠান্ডা পানিতে গোসল করে তারা কিছুটা স্বস্তি পেতে চাইছিলো। বিষ্ফোরণে সম্ভবত শহরের পানির টাওয়ারগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। ফলে আমাদের স্কুলে পানির চাপ নেমে এসেছিলো শূন্যের কোঠায়। উরাকামি নদীটি শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নাগাসাকি পোতাশ্রয়ে গিয়ে পড়েছে। নদীটি থেকে কয়েকশ মিটার দূরেই ছিল আমাদের স্কুলের অবস্থান।

আমি জানি না এমন মানসিক আঘাতে আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিলো কিনা, তবে আমি চাইছিলাম আমাদের শিক্ষকদের অবস্থা সম্পর্কে দলটাকে বলতে। চারজন মেয়ের দলটা যখন উরাকামি নদী থেকে ফিরে এলো, তখন আমি তাদেরকে বলার জন্য কথা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। দুজন একেবারে উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলো। বাকিরা এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে এবং সাথে সাথেই ব্যাথায় নিজেদের ছাড়িয়ে নেয়।

তারা আমাদেরকে জানালো কিভাবে তারা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছালো যেখানে কিনা শত শত লোক তাদের ক্ষতের জ্বালা উপশমের জন্য পানিতে নেমেছিলো। হাত ও মুখ থেকে চামড়া ঝুলে যাওয়া লোকগুলোকে বাকল ঝুলে পরা গাছের মতোই লাগছিলো মেয়েগুলোর কাছে। নদীর তীর জুড়ে ভাসছিলো অনেক মানবদেহ, কোথাও কোথাও একসাথে দুটি-তিনটি করে। কেউ কেউ তখনও নড়ছিলো, তবে তীরে পৌঁছানোর মতো শক্তিটা তাদের দেহে আর ছিলো না।

বেশ কয়েকজন মেয়ের অভিভাবক এসে তাদের মেয়েদের নিয়ে গেলো। কিন্তু আমার মা-বাবা এলো না। আমার মনটা কেমন যেন খচখচ করতে লাগলো। তারা কি মারা গেছে নাকি আহত হয়েছে? যা-ই ঘটুক না কেন তা মেনে নেয়ার মানসিকতা নিয়ে আমি ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। হারুকোকে সাহায্য করার জন্য দুজন বন্ধু গাছের শাখা দিয়ে ক্রাচ বানিয়ে নিয়ে গেলো। বইগুলো পিঠে চাপিয়ে আমি অন্যদের থেকে বিদায় নিলাম।

দুইবার মনে হয়েছিলো যে, আমি যেন নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। রাস্তাঘাট ছিলো ধ্বংসাবশেষে পরিপূর্ণ। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাই বিষ্ফোরণের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ৩০ মিটার উঁচু এক ভূমি আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী এবং আমার বাড়ির রাস্তার মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে ছিলো।

… সেই উঁচু ভুমি পেরিয়ে এলে সম্পূর্ণ বিপরীত এক পৃথিবী আমাকে স্বাগত জানালো। কোনো ধ্বংসস্তূপ আমার নজরে এলো না, ঘাসগুলো ছিলো সবুজ, রাস্তা ধরে ছুটে চলেছিলো একটি ট্রাক। আমি থমকে দাঁড়ালাম, নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলাম যে, গত দু’ঘন্টা কি তাহলে কেবলই ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন ছিলো? নাকি সেগুলো বাস্তবেই ঘটেছে?

বাড়ির কাছাকাছি এসে আমি রাস্তায় বেশ কিছু মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাদের সবাই বুঝতে পারছিলো যে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে গেছে। কিন্তু কী হয়েছে তা তারা জানতো না, জানতাম না আমি নিজেও। তাদের সাথে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পর আমি দ্রুত ছুটলাম আমার বাসার দিকে।

বাড়ির কাছের রাস্তায় এসে দেখলাম আমার বাবা-মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমাকে খুঁজে একটু আগে তারা বাড়ি ফিরেছিলেন। কাছাকাছি এরোপ্লেনের যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানোর ছোটখাট একটি ফ্যাক্টরিতে তারা উভয়েই চাকরি করতেন। ফ্যাক্টরিতে কাজ করা সকলেই আলোর ঝলকানি দেখেছিলো, বিল্ডিংটির কেঁপে ওঠাও তারা টের পেয়েছিলো। তবে তারা সবাই এটাকে ভূমিকম্প ভেবেছিল। একসময় ফ্যাক্টরির ম্যানেজার যখন বুঝতে পারলেন যে কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে, তখনই তিনি সকল কর্মচারীকে ছুটি দিয়ে দেন।

সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের সিভিল ডিফেন্স ব্লক ক্যাপ্টেন সকলকে জড়ো করলেন এবং উদ্ধারকারী দল গঠন করলেন। আমরা সকলে মিলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে গেলাম। প্রথমদিকে ধ্বংসের মাত্রা দেখে আমাদের দলের সবাই চমকে উঠেছিল, কিন্তু আমরা সবাই মানিয়ে নিলাম। প্রথম সন্ধ্যায় সবকিছু ছিলো বেশ গোলমেলে, তবে পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে আমরা একটি অস্থায়ী মর্গ ও চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তুললাম।

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও আমি ভাবতাম যে, কাগজ দিয়ে আঙুল কেটে গেলে আমি মারাত্মক ভয় পাব। আর এখন সেই আমিই মৃতদেহ বয়ে নিয়ে চলেছিলাম, যাদের চামড়াগুলো আমার হাতে খুলে খুলে আসছিলো। আমি বেশ কিছু লোককে দেখেছিলাম, বিষ্ফোরণে যাদের কিমোনোর (কিমোনো জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী পোষাক) ছাপ তাদের গায়ে বসে গেছে।

আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আহতদের থেকে মাছি তাড়িয়ে রাখতে। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন অজস্র মাছি এসে উপস্থিত হচ্ছিলো। তারা আহতদের পাশে উড়ে বেড়াতো, চেষ্টা করতো ক্ষতস্থানে ডিম পাড়তে। মাছিগুলো আমার ব্যান্ডেজের নিচেও ঘুরে বেড়াত। রাতের বেলায় বিশ্রামের জন্য আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে কাজ করতেন বাবা-মা।

লোকজন বলাবলি করতে লাগলো যে, যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। এর জন্য আমরা বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছিলাম। … আগস্টের শেষের দিকেও তেজস্ক্রিয়তাজনিত অসুখে ভুগে অনেকে মারা যাচ্ছিল। আমরা তখনও জানতাম না যে, তারা কেন মারা যাচ্ছে। জনসাধারণ এবং যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা সৈন্যরা মিলে রাস্তা থেকে সকল ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলেছিলো।”

পরবর্তী জীবনে মিচি হাত্তোরি বিয়ে করেছিলেন এক আমেরিকানকে, নাম রেমন্ড বার্নস্টেইন। অবশ্য বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের সাত বছরের মাথায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। ২০০৩ সালে মিচি মৃত্যুবরণ করেন। তার ক্যান্সারও হয়েছিলো। তবে সেটা কি নাগাসাকিতে সংঘটিত পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণের জন্যই কিনা, সে কথাটি নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় নেই। তার এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন উইলিয়াম এল. লিয়ারি।

তথ্যসূত্র

১) historynet.com/michie-hattori-eyewitness-to-the-nagasaki-atomic-bomb-blast.htm

২) en.wikipedia.org/wiki/Atomic_bombings_of_Hiroshima_and_Nagasaki

Related Articles