১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসটি ছিল ফিলিস্তিনের ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ মাসগুলোর মধ্যে একটি। সে সময় ১০ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন পিএলওর তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়, হাজার হাজার নেতাকর্মী বন্দী হয়, এবং কয়েক বছর ধরে তাদের প্রধান আশ্রয়স্থল জর্ডান থেকে তাদেরকে সদলবলে উচ্ছেদ হতে হয়।
কিন্তু ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া এ যুদ্ধ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং এটি ছিল জর্ডান এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ! ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের পথকে বাঁকিয়ে দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এই ঘটনাটি ইতিহাসে আইলুল আল-আসওয়াদ তথা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে পরিচিত।
কী এই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর? এর পটভূমিই বা কী? দুই পর্বের এই লেখায় সে ব্যাপারেই বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের পটভূমি, আর এই পর্বে আলোচনা করা হচ্ছে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অপারেশনের বিবরণ এবং তার প্রভাব ও ফলাফল নিয়ে।
গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি
১৯৭০ সালের পুরো প্রথমার্ধ জুড়ে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনি গেরিলা তথা ফেদাঈনদের ছোটোখাটো সংঘর্ষ হয়ে আসছিল। জুনের ৭ তারিখে ফেদাঈনরা জর্ডানীয় গোয়েন্দা সংস্থা মুখাবারাতের হেডকোয়ার্টার লক্ষ্য করে গুলি চালায়। বাদশাহ হুসেইন যখন হেডকোয়ার্টার পরিদর্শন করতে যান, তখন তার গাড়িবহর লক্ষ্য করেও গুলিবর্ষণ করা হয়। হুসেইন বেঁচে যান, কিন্তু তার এক দেহরক্ষী নিহত হয়।প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সেনাবাহিনীর বেদুঈন ইউনিট ফিলিস্তিনিদের দুটি ক্যাম্পে অভিযান চালালে তা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। সেনাবাহিনীর সাথে ফেদাঈনদের এই যুদ্ধ তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। নিহত হয় অন্তত ৩০০, আহত হয় আরও ৭০০।
জুলাই মাসে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের আমেরিকার প্রস্তাবিত শান্তি প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘ওয়ার অফ অ্যাট্রিশন’ বন্ধে সম্মত হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিরা রাজধানী আম্মানে বিশাল সমাবেশ করে। তারা নাসেরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপমানজনক শ্লোগান দেয়। ক্ষুব্ধ নাসের ফিলিস্তিনিদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাদশাহ হুসেইনকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার ইঙ্গিত দেন। হুসেইনের পথের সামনে থেকে প্রথম বাধা অপসারিত হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন আরও উপযুক্ত সুযোগের জন্য। আর সে সুযোগই চলে আসে সেপ্টেম্বর মাসে।
সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে বাদশাহ হুসেইন যখন তার কায়রো-ফেরত কন্যা আলিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে আম্মান এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলেন, তখন তার গাড়িবহরের উপর আবারও হামলা হয়। এটি ছিল মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার উপর দ্বিতীয় হত্যাচেষ্টা। এবং আবারও শুরু হয় সেনাবাহিনীর সাথে ফেদাঈনদের যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই, ৬ সেপ্টেম্বর এমন নাটকীয় ঘটনা ঘটে, যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।
পিএলওর অঙ্গ-সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপ্লবী চরিত্রের একটি দল ছিল মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট আদর্শধারী পিএফএলপি তথা পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন। সংগঠনটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওয়াদি হাদ্দাদ ছিলেন বিমান ছিনতাইয়ের মাস্টার মাইন্ড। তার পরিকল্পনায় ১৯৬৮-৬৯ সালে পিএফএলপি সদস্যরা একাধিক ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা বিমান ছিনতাই করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিংবদন্তী নারী বিমান ছিনতাইকারী লায়লা খালেদও ছিলেন এই পিএফএলপিরই একজন কর্মী।
১৯৭০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর লায়লা খালেদসহ এই পিএফএলপির সদস্যরা মোট তিনটি প্লেন হাইজ্যাক করে। লায়লা খালেদের এবারের অপারেশন অবশ্য ব্যর্থ হয়, তার সহকর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এবং তিনি নিজে ধরা পড়ে যান। কিন্তু অন্য দুটি প্লেন – একটি আমেরিকান, একটি সুইস – সফলভাবে হাইজ্যাক করে পিএফএলপির কর্মীরা জর্ডানের জারকা শহরের পরিত্যক্ত একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। তিন দিন পর আরেকটি ব্রিটিশ বিমানও হাইজ্যাক করে একই এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন শতাধিক জিম্মির মুক্তিপণ হিসেবে পিএফএলপি ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা কারাগারগুলোতে বন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দাবি করে।
একসাথে একাধিক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে জর্ডানীয় সেনাবাহিনী ডওসন’স ফিল্ড নামের বিমান বন্দরটি ঘিরে ফেলে। কিন্তু ওয়াদি হাদ্দাদ পিছু হটার মানুষ ছিলেন না। তিনি জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফকে হুমকি দেন, তার বাহিনী যদি পিছু না হটে, তাহলে তিনি প্লেনগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দেবেন। এবং জর্ডানীয় বাহিনী যখন পিছু হটতে অস্বীকার করে, তখন সত্যি সত্যই ১২ই সেপ্টেম্বর তিনি যাত্রীদেরকে বের করে সাংবাদিকদের টিভি ক্যামেরার সামনে প্লেন তিনটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেন।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর
পিএফএলপির এই নাশকতার ঘটনা বাদশাহ হুসেইনের সামনে এক বিরল সুযোগ এনে দেয়। ১৬ই সেপ্টেম্বর তিনি দেশে সামরিক আইন জারি করেন, বেসামরিক সরকার ভেঙে দিয়ে সামরিক সরকার গঠন করেন, এবং ফেদাঈনদের স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত অবসান ঘটানোর পদক্ষেপ নেন। ১৭ তারিখে সেনাবাহিনী চারদিক থেকে রাজধানী আম্মানে প্রবেশ করে এবং ফেদাঈনদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি ওয়াহদাত ক্যাম্পে আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ভেতরে ফেদাঈনদের কাছেও ট্যাঙ্কসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ছিল। তারা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একইসাথে অন্যান্য শহরের ফেদাঈনদের ক্যাম্পগুলোতেও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
শীঘ্রই বিদেশীরাও এই সংকটে জড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ান সেনাবাহিনী তিন শতাধিক ট্যাঙ্ক নিয়ে জর্ডানের দিকে অগ্রসর হয়। উপায়ান্তর না দেখে বাদশাহ হুসেইন আমেরিকা এবং ইসরায়েলের কাছে সাহায্য চান। আমেরিকা তাদের ষষ্ঠ নৌবহর নিয়ে জর্ডানের কাছাকাছি ইসরায়েলি উপকূলে গিয়ে উপস্থিত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অগ্রসরমান সিরিয়ান বাহিনীর উপর দিয়ে মহড়া দেয়। এই সুযোগে জর্ডানীয় বিমান বাহিনী সিরিয়ান বাহিনীর উপর হামলা করে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে সিরিয়ান বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সিরিয়ানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার পর জর্ডানীয় সেনাবাহিনী নবোদ্যমে ফেদাঈনদের ক্যাম্পগুলোতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হতে থাকে। আলোচনা করার জন্য সুদানের প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেরির নেতৃত্বে আরব লিগের একটি প্রতিনিধি দল জর্ডানে আসেন। প্রতিনিধি দলের মধ্যে একজন ছিলেন কুয়েতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ সাদ আব্দুল্লাহ আল-সাবাহ। তিনি ইয়াসির আরাফাতকে কুয়েতি শেখদের মতো আলখাল্লা পরিয়ে গোপনে তার সাথে করে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
জর্ডানের অব্যাহত অভিযানের প্রতিবাদে আরব রাষ্ট্রগুলোতে নিন্দার ঝড় ওঠে। কায়রোতে আরব লিগের জরুরি অধিবেশন বসে। সেখানে লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফির চাপে পড়ে জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে বসেন। অন্যদিকে স্বজাতির উপর এই নির্মম অভিযান এবং হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে না পেরে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর প্রায় তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি সেনাসদস্য পদত্যাগ করে। বাদশাহ হুসেইন বাধ্য হন সমঝোতায় বসতে।
২৭ সেপ্টেম্বর মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের উদ্যোগে ইয়াসির আরাফাত এবং বাদশাহ হুসেইন যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ততদিনে নিহত হয়েছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক। ইয়াসির আরাফাত অবশ্য প্রথমে ২৫ হাজার এবং পরে ১০ হাজার নিহতের অভিযোগ তুলেছিলেন, কিন্তু ফাতাহর অন্যান্য নেতাদের মতেও এই সংখ্যা ছিল অতিরঞ্জিত। বাস্তবে তাদের হিসেবেও এই সংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি না। অন্যদিকে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর নিহতের সংখ্যা ছিল পাঁচ শতাধিক।
২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি হলেও সংঘর্ষ পুরোপুরি থামেনি। জর্ডানীয় বাহিনী ধীরে ধীরে অধিকাংশ ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৩ অক্টোবর হুসেইন এবং আরাফাত আরেকটি চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী আরাফাত সম্মত হন, পিএলওর সদস্যরা জর্ডানের ভেতর নিজস্ব ইউনিফর্ম পরিধান করবে না এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন করবে না। কিন্তু আরাফাত চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পিএলওর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলো, বিশেষ করে পিএফএলপি এবং ডিএফএলপি এই শর্ত মানতে রাজি ছিল না। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
ততদিনে জামাল আব্দুল নাসের মৃত্যুবরণ করায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী কোনো নেতাও ছিল না। ফলে হুসেইন পুনরায় পিএলওর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন এবং ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ফেদাঈনদেরকে জর্ডান থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করেন। জুলাই মাসে সর্বশেষ ২,০০০ ফেদাঈন জর্ডানীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর তাদেরকে সিরিয়া হয়ে লেবাননে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ফেদাঈনদের কাছে এটা এমনই অপমানজনক পরাজয় ছিল যে, অনেকে জর্ডানের কাছে আত্মসমর্পণ না করে নদী পেরিয়ে ইসরায়েলে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে।
প্রভাব এবং পরিণতি
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল চিরতরে। এর আগে তারা জর্ডানের বিশাল ভূমিতে প্রায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারত, কিন্তু ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের পর তাদেরকে ঘুরে বেড়াতে হয় একের পর এক আশ্রয়ের খোঁজে। শুধু ফিলিস্তিন না, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ঘটনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে বিশ্বের অন্তত আধ ডজন দেশে। বিপুল সংখ্যক ফেদাঈন জর্ডান থেকে বিতাড়িত হয়ে লেবাননে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার রাজনীতিকে আমূল পাল্টে দেয়। এবং কয়েক বছর পর সেখানেও ফিলিস্তিনি গেরিলা, ডানপন্থী খ্রিস্টান বাহিনী, সিরিয়া এবং ইসরায়েলের মধ্যে বহুমুখী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সময় সিরিয়ার ডিফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাথ পার্টির নেতা সালাহ জাদিদ। আর তার বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন হাফেজ আল-আসাদ। সালাহ জাদিদের নির্দেশে সেনাবাহিনী ট্যাংক নিয়ে ফিলিস্তিনিদেরকে সাহায্য করতে অগ্রসর হলেও সম্ভাব্য আমেরিকান এবং ইসরায়েলি আক্রমণের আশঙ্কায় হাফেজ আল-আসাদ তার নির্দেশ অমান্য করে বিমান বাহিনীকে কাজে লাগানো থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং এর কয়েক মাস পরেই এক অভ্যুত্থানে সালাহ জাদিদকে সরিয়ে হাফেজ আল-আসাদ ক্ষমতা দখল করে নেন।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়তো আরো দীর্ঘদিন চলতে পারত, কিন্তু মিশরে আরব লিগের বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নাসের উভয় পক্ষকে চাপ দিয়ে সমঝোতায় আসতে বাধ্য করেন। কিন্তু এর আগে দুবার হার্ট অ্যাটাক করা নাসের নিজেই এই উত্তেজনা সহ্য করতে পারেননি। সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে হুসেইন এবং আরাফাতের মধ্যে চুক্তি করিয়ে দিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার পর সকালে তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন। পিএলওর জন্য তার অকালমৃত্যু ছিল অপূরণীয় ক্ষতি। তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসরায়েলের সাথে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তা বাস্তবায়নও করেন।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের আরেকটি ফলাফল ছিল পরবর্তীকালের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের উত্থান। ১৯৭০ সালে জিয়াউল হক ছিলেন জর্ডানে নিযুক্ত পাকিস্তানের ডিফেন্স অ্যাটাশে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তার দায়িত্বের চেয়েও বেশি ভূমিকা পালন করেন। বাদশাহ হুসেইন তার নিজের সেনাবাহিনীর ফিলিস্তিনি বা ফিলিস্তিনিদের প্রতি অনুগত কমান্ডারদের উপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলেন না। কাজেই তিনি জিয়াউল হককে দায়িত্ব দেন অপারেশন পরিচালনা করার।
তবে জিয়াউল হকের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সিরিয়ান বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধ করে দেওয়া। সিরিয়ান বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার সংবাদ শুনে হুসেইন জিয়াউল হককে প্রেরণ করেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। জিয়াউল রিপোর্ট করেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় জর্ডানীয় বিমান বাহিনী দিয়ে সিরিয়ানদের উপর আক্রমণ করা। হুসেইন তার পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং বিমান বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ানদেরকে পরাজিত করেন।
জর্ডানে জিয়াউল হকের এই বিজয়ের তাৎপর্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপমানজনক পরাজয়ের পর জুলফিকার আলি ভুট্টোর একজন জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য সেনা কর্মকর্তা প্রয়োজন ছিল। এ সময় বাদশাহ হুসেইনের পরামর্শে তিনি জিয়াউল হককে তার সাফল্যের জন্য পদোন্নতি দিয়ে সামনে নিয়ে আসেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি জিয়াউল হককে একের পর এক আরও পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে দায়িত্ব দেন। এবং এরপর ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হক নিজেই ভুট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীতে তার আমলেই ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের আরেকটি ফলাফল ছিল ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। যুদ্ধে পরাজয়ের পর ফাতাহর এক নেতা আবু আইয়্যাদ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নতুন একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির নামও রাখা হয় ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর। তারা জর্ডান থেকে ফিলিস্তিনিদেকে উচ্ছেদের জন্য জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী ওয়াসফি আল-তালকে প্রধান অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং ২৮ নভেম্বর কায়রোর একটি হোটেলের সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করে।
পরের বছর জার্মানির মিউনিখে অলিম্পিক গেমস চলার সময় তারা ১১ জন ইসরায়েলি খেলোয়াড় এবং কোচকে জিম্মি করে এবং মুক্তিপণ হিসেবে বিভিন্ন দেশে আটক ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দাবি করে। কিন্তু ইসরায়েল তাদের সাথে আলোচনায় বসতে রাজি না হওয়ায় এবং জার্মান পুলিশের অদক্ষতায় শেষ পর্যন্ত জিম্মি নাটকের রক্তাক্ত অবসান ঘটে। জিম্মিদের সবাই এবং ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ৫ জন সদস্য নিহত হয়। মিউনিখ ম্যাসাকার নামে পরিচিত এই হত্যাকাণ্ড পিএলএর ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ করে, যা পুনরুদ্ধার করতে আরাফাতকে চড়া মূল্য দিতে হয়।
উপসংহার
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে পিএলও যেভাবে রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র কায়েম করছিল, তাতে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের মতো একটি ঘটনা অনিবার্য ছিল। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কোনো এক পক্ষকে এককভাবে দোষারোপ করা কঠিন। একদিকে ফিলিস্তিনি গেরিলারা নিজেদের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীও বেসামরিক জানমালের তোয়াক্কা না করে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল।
তবে এ কথা বলাই যায়, ফিলিস্তিনি গেরিলারা যদি একাধিক দল-উপদল-আদর্শে বিভক্ত না হতো, যদি বিশৃঙ্খল না হয়ে সুসংগঠিত হতো, যদি জর্ডানের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করত, যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে প্রাধান্য দেওয়ার লক্ষ্যে অন্যান্য ব্যাপারে আরো ছাড় দিত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।