আচ্ছা পাঠক, বলুন তো- মৃত্যুর কি কোনো রঙ হয়? হাবিজাবি প্রশ্ন হয়ে গেল কি? তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করা যাক, আপনি কি শীল’স গ্রীন-এর নাম শুনেছেন, এককালে যা হয়ে উঠেছিল ‘দ্য ডেডলি ওয়ালপেপার’?
চলুন, অদ্ভুত, স্বল্পজ্ঞাত এক ইতিহাসই শোনানো যাক আপনাদের।
১৭৭৫ (মতান্তরে ১৭৭৮) সালে জার্মান-সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল উইলহেল্ম শীল এক নতুন রঞ্জক পদার্থ উদ্ভাবন করেন, যার রাসায়নিক নাম কিউপ্রিক হাইড্রোজেন আর্সেনাইট। অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে এটি শীল’স গ্রীন, সুইডিশ গ্রীন, কিউপ্রিক গ্রীনের মতো নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
অদ্ভুত ধরনের মায়াকাড়া এই সবুজ রঙ অল্প সময়ের ভেতরেই আর্টিস্ট ও হোম ডিজাইনার সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু… কিন্তু কী? আচ্ছা, আপনি এই রাসায়নিক পদার্থটির নাম আরেকবার মন দিয়ে পড়ুন তো- “কিউপ্রিক হাইড্রোজেন আর্সেনাইট”; আর্সেনিকের উপস্থিতি খুঁজে পেলেন কি?
এখন ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে আরও বেশ কয়েক দশক এগিয়ে যাওয়া যাক। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে ১৮৩৭-১৯০১ সাল এর মধ্যবর্তী যে ৬৩ বছর, সেটাকে বলা হয় ভিক্টোরিয়ান যুগ, কারণ সেই সময় সিংহাসনে ছিলেন রানী ভিক্টোরিয়া। এই ভিক্টোরিয়ান যুগেই একসময় দেখা গেল হুটহাট মানুষজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে, সেটাও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই।
তাদের সাপ্লাইয়ের পানি পরীক্ষা করা হলো, সেখানে কোনো সমস্যা নেই। খাবারদাবার পরীক্ষা করা হলো, সেখানেও বিষাক্ত কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। ঠিকমতো চেক করা হলো তাদের ঘরও, সেখানেও এমন কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না যা তাদের এমন অদ্ভুত অসুখের কারণ হতে পারে। তবে অসুস্থ সকলের বেলাতেই একটা বিষয় কমন পাওয়া গেল- ওয়ালপেপার। তাদের সবার ঘরেই ওয়ালপেপার ছিল, যেখানে সবুজাভ ভাব আনতে জনপ্রিয় সেই শীল’স গ্রীনকেই বেছে নেয়া হয়েছিল।
অবশেষে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে লন্ডন হসপিটালে কর্মরত রসায়নবিদ ড. লেথারবি এক ঘোষণা দিয়ে বসলেন। কিছুদিন আগেই মারা যাওয়া এক বাচ্চা মেয়ের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করলেন আর্সেনিককে, যা এসেছিল ঐ রঙ থেকে। একজন চিকিৎসকের মুখ থেকে এমন কথা আসায় পত্রপত্রিকাগুলোও লুফে নিল সেই খবর, ফলাও করে প্রচারিত হতে লাগল তার কথাগুলো। তিনি পরে এটাও দাবি করেন যে, এই শীল’স গ্রীন দিয়ে আক্রান্ত হতে ওই রঙের কোনো অংশ আপনার পেটে যাবার দরকার নেই, এমনকি ওটা যে রুমে আছে সেই রুমে আপনার ঘুমানোরও দরকার নেই, বরং ঐ রঙ দিয়ে আঁকা ওয়ালপেপার যে রুমে থাকবে সেখানে কিছুক্ষণ থাকলেই আপনি এর দ্বারা আক্রান্ত হবেন!
বলা বাহুল্য, ড. লেথারবির এই দাবি অনেকেই মানতে চাইল না। পত্রপত্রিকায় নিয়মিতই চিঠি আসত এই বিষয়ে, অধিকাংশই এই দাবির সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিয়ে। সেই সময় লেথারবি পাশে পেলেন ড. থমাস অর্টনকে। তারা দুজন মিলে সমান তালে সেসব সন্দেহবাদীর চিঠির জবাব দিয়ে যেতে লাগলেন নিজেদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। একবার ড. অর্টন তার নিজেরই এক অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করলেন,
আমি এক পরিবারের কথা জানি, যাদের বাচ্চা বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিল। তাদেরকে গ্রামে যাবার পরামর্শ দিলাম, তারা গেল, আর বাচ্চাটাও সুস্থ হয়ে গেল। এরপর তারা আবার শহরে তাদের বাড়িতে ফিরে এলো আর বাচ্চাটাও আগের মতো অসুস্থ হয়ে পড়লো। এরপর তাদের বাড়ির সেই ওয়ালপেপার সরিয়ে ফেলা হলে বাচ্চাটা অল্পদিনের ভেতরেই সুস্থ হয়ে যায়।
আমার এক প্রতিবেশীর কথাই বলা যাক। বাড়ি পরিষ্কারের সময় সেই মহিলা কেবল তার ওয়ালপেপারটা ব্রাশ দিয়ে ঝেড়েছিলেন। অল্প সময়ের ভেতরেই তিনি আর তার স্বামীর চোখ আর মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে যায়, ঠোটের উপরিভাগ আর নাকে জ্বালাপোড়া করতে থাকে, দমবন্ধ লাগার মতো অনুভূতিও ছিল। ফলে সারা রাত তারা ঘুমাতে পারেননি।
তবে চিকিৎসকরা যতকিছুই বলুক না কেন, দিনশেষে রঙ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর কাছে এটা তখন আয়ের অন্যতম বড় এক উৎস। ফলে তারা এই দাবি সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। অবশেষে ১৮৫৯ সালের দিকে ব্রিটেনে প্রথম চমক নিয়ে হাজির হয় উইলিয়াম উলামস এন্ড কোম্পানি। তারা বাজারে প্রথমবারের মতো নিয়ে আসে আর্সেনিক-মুক্ত সবুজ রঙ। এর কিছুদিন পর ক্রেতাদের ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলে’ বিখ্যাত ওয়ালপেপার প্রস্তুতকারক কোম্পানি মরিসও আর্সেনিক-মুক্ত সবুজ রংযুক্ত ওয়ালপেপার নিয়ে আসে।
‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলে’ অংশটুকু আলাদাভাবে চিহ্নিত করার কারণ বলতে পারেন? কারণ হলো, জনতার চাহিদার কথা মাথায় রেখে মরিস এন্ড কো. হয়তো আর্সেনিক-মুক্ত ওয়ালপেপার এনেছিল, কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা নিজেই এই শীল’স গ্রীনের বিষাক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না। তার মতে, ডাক্তাররা রোগীদের রোগের কোনো কারণ খুঁজে না পেয়েই ওয়ালপেপারের উপর দায় চাপিয়ে পার পেতে চাচ্ছিলেন!
অবশ্য এই কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, সেই সময় এই আর্সেনিক পয়জনিংয়ের জন্য শুধু যে ওয়ালপেপার দায়ী ছিল তা বলা যাবে না, বরং যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের ব্যবহৃত আরও অনেক কিছুই এর পেছনে দায়ী ছিল।
মহিলারা যেসব প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার করতেন, সেসবের অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিল আর্সেনিক। পাশাপাশি তাদের কাপড় ও গলার হারেও সবুজাভ ভাব আনতে ব্যবহার করা হতো আর্সেনিকই। আবার পুরুষরা যেসব ওয়েস্টকোট ও নেকটাই ব্যবহার করতেন, সেসবেও সবুজ রঙের উৎস ছিল শীল’স গ্রীন। ফসলে ছিটানো কীটনাশকে থাকতো আর্সেনিক, মাংসের দোকানে মাংসকে আর্সেনিকের দ্রবণে ডুবিয়ে তোলা হতো যেন সেটার উপর মাছি না বসে। ফলে কেবল ওয়ালপেপার না, বরং সেই আমলে কোথায় ছিল না এই আর্সেনিক!
অবশেষে ১৮৭৯ সালে এসে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। ব্রিটিশ রাজপরিবারের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কার্যালয় বাকিংহাম প্যালেসে এসেছিলেন উচ্চপদস্থ এক ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনিও রহস্যময় সেই অসুস্থতার শিকার হন। এবার যেন রানীর ধৈর্যের বাঁধ ভাংলো। ফলে একেবারে আইন করে ওয়ালপেপারে শীল’স গ্রীন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
একটা সময় ফ্যাশন ট্রেন্ড থেকে এই সবুজের কদর কমতে শুরু করলো, ফলে আস্তে আস্তে কদর কমতে লাগলো বিচিত্র এবং একইসাথে ‘অভিশপ্ত’ এই সবুজেরও। পরবর্তী সময়ে এসে জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক বিভিন্ন বাড়ি থেকেও সেই শীল’স গ্রীন ব্যবহার করে বানানো ওয়ালপেপারগুলো খুলে ফেলা হয়।