কনফেডারেশন অফ রাইনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে নেপোলিয়ন জার্মানিতে ফরাসি আদলে আইন প্রণয়ন করতে চাপ দেন। প্রুশিয়ার ফ্রান্স বিরোধীরা একে স্বাধীন জার্মানির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে। রানী লুইসা এবং রাজপুত্র লুইস দুজনেই সমমনা রাজনীতিবিদদের সাথে নিয়ে নেপোলিয়নের বিপক্ষে ক্ষোভ উস্কে দিতে থাকেন। এর মধ্যে প্যারিস থেকে ১৮০৬ সালে প্রুশিয়ান রাষ্ট্রদূত ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের আলোচনার খবর দেন। তার বার্তায় ফ্রেডেরিকের জন্য ছিল অশনি সংকেত। রাষ্ট্রদূত জানালেন শান্তির বিনিময়ে নেপোলিয়ন হ্যানোভার ইংল্যান্ডকে বুঝিয়ে দেবার আশ্বাস দিয়েছেন। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রুশিয়া যে অন্য এলাকা চাইবে তারও উপায় নেই। ফ্রেডেরিকের নজর ছিল পোমেরানিয়ার যে অংশ প্রুশিয়ার নাগালে এখনো আসেনি তার দিকে। কিন্তু নেপোলিয়ন নাকি সেটাও রাশিয়াকে দেবেন। শুধু তা-ই না, নেপোলিয়ন পোলিশ প্রুশিয়া নিয়ে নতুন করে পোল্যান্ড গঠন করবেন।
রাগে অস্থির প্রুশিয়া দিকে দিকে দূত পাঠাল। জার আলেক্সান্ডার নেপোলিয়নের হাতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব। তিনি ফ্রেডেরিককে কথা দিলেন সসৈন্যে শীঘ্রই তিনি এসে পৌঁছবেন। ফ্রেডেরিক তার বাহিনী লেলিয়ে দিলেন স্যাক্সোনির দিকে। সেখানকার রাজা বাধ্য হলেন তার দলে যোগ দিতে। সুইডেন আর ইংল্যান্ডও ফ্রেডেরিককে উৎসাহ দিল, এগিয়ে যাও আমরা পাশে আছি। গড়ে উঠল চতুর্থ কোয়ালিশন। অপসারিত হার্ডেনবুর্গকে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়া হলো।
আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান প্রুশিয়া ফ্রান্সে এবার বার্তা পাঠাল, জার্মানি থেকে নেপোলিয়নের সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। অক্টোবরের আট তারিখের ভেতর জবাব দেবার সময়সীমা বেধে দেয়া হয়, এর মধ্যে কোনো ইতিবাচক উত্তর না আসলে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হবে।
জার্মানিতে নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড আর্মির ১,৮০,০০০ সেনা মোতায়েন ছিল। তাদের বিপক্ষে প্রুশিয়ার আর স্যাক্সোনি সেই মুহূর্তে হাজির করতে পারত দেড় লাখের মতো সেনা। ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের প্রুশিয়ান বাহিনী এখন কেবলই তার ছায়া। সেনাদের উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। রাজা শুধু নামেই ফ্রেডেরিক, সমরকৌশলের বেলায় তার ধারে কাছেও নেই।
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮০৬ সাল। প্যারিসের টিলরেরি প্রাসাদ থেকে রওনা হলেন নেপোলিয়ন। রাইনের অববাহিকায় জমায়েত হয়েছে ফরাসই বাহিনী। তিনি তাদের সাথে যোগ দেবেন। তিনি জানতেন আলেক্সান্ডারের আসতে মাসখানেক লাগবে। রাশান জার আসবার আগেই প্রুশিয়াকে পদানত করবার ইচ্ছা ছিল তার। দ্রুত ফরাসি বাহিনী রাইন পার হয়ে এল। নেপোলিয়ন প্রুশিয়ানদের সেনা উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তার পাঠানো চিঠি থেকে জানা যায় শত্রুবাহিনীতে প্রুশিয়ান রানী লুইসা এবং রাজপুত্র লুইসও ছিলেন। সেনাপ্রধান ৭১ বছর বয়স্ক ফার্দিন্যান্দ, ডিউক অফ ব্রান্সউইক। তার সাথে কয়েকজন সেনা অফিসার যারা ভবিষ্যতে প্রুশিয়ান সেনাদের পুনর্গঠন এবং নেপোলিয়নের পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন। এদের মধ্যে অন্যতম ব্লুশা (Gebhard von Blücher), কাউসোভিতজ, শ্যানহর্স্ট এবং বয়েন।
ব্যাটল অফ জেনা/ আওয়াস্টেড
প্যারিস থেকে বার্লিনের সোজা রাস্তা হল মাইয়েন্স থেকে উত্তর-পূর্বে এরফুর্ট আর ওয়েইমার এলাকার মধ্য দিয়ে। এখানে এল্বে নদী বরাবর বেশ কয়েকটি সুরক্ষিত দুর্গ আছে। এল্বে পার হয়ে প্রুশিয়ান বাহিনী মাইয়েন্সের রাস্তা ধরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে অগ্রসর হলো। ১৮০৬ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখে তারা এরফুর্টে এসে হেডকোয়ার্টার বানায়। বাহিনী ছড়িয়ে ছিল প্রায় নব্বই মাইল জুড়ে। থুরিঙ্গিয়া প্রদেশের জঙ্গলের কাছে জেনা শহরের দক্ষিণে ছিল এর বাম বাহু। নেপোলিয়নের ইচ্ছা ছিল বাম বাহুকে ঘিরে ফেলে ধ্বংস করে দেয়া।
১৪ অক্টোবর জেনারেল রুশেলের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট বর্কে ২২০০০ সৈন্য নিয়ে জেনার পশ্চিমে ঘাঁটি করেন।শহরে থাকা বাহিনীর নেতৃত্বে হনলোয়া। এদিকে নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড আর্মি তিনটি কলামে এগুচ্ছিল। প্রথম কলামে ৫০০০০, দ্বিতীয় কলামে ৭০০০০ আর তৃতীয় কলামে ৪০০০০ সেনা। মার্শাল সল্ট এবং নেই ডানে, বার্নাডোট এবং ডেভোঁ মাঝে, ল্যানেস এবং অঝিরু বামে। ১০/১১ অক্টোবর তারা জেনার কাছে প্রুশিয়ানদের নাগাল পেলেন। তারা এল্বের দিক থেকে প্রুশিয়ানদের সরবরাহ পথ এবং যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দিতে সমর্থ হন। এদিকে ফার্দিন্যান্দ নেপোলিয়নের আসবার খবর পেয়ে পূর্বদিকে পিছিয়ে যেতে চাইলেন, যাতে সরবরাহ এবং যোগাযোগের পথ খোলা থাকে। কিন্তু তিনি দেরি করে ফেলেছেন।
১৩ তারিখ ল্যানেসের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে নেপোলিয়ন জেনায় এসে উপস্থিত হন। ল্যানেস শহর দখল করে রেখেছেন। শহরের ঠিক সামনে খাড়া টিলায় ফরাসী ঘাঁটি। প্রুশিয়ানরা সরে গিয়ে শিবির করেছে টিলার বিপরীত প্রান্তরে বর্কের বাহিনীর সাথে। নেপোলিয়ন ল্যানসকে টিলা বরাবর সেনা মোতায়েনের আদেশ দিয়ে সল্ট, নেই আর অঝিরুকে দ্রুত জেনায় চলে আসতে বললেন। প্রুশিয়ানদের সংখ্যা দেখে তার ধারণা ছিল এরাই মূল বাহিনী। বার্নাডোট এবং ডেভোঁ অভিযান অব্যাহত রাখলেন ন্যুমবার্গে প্রুশিয়ান মধ্যভাগের দিকে। সেখানের পাঁচ মাইল পশ্চিমে ছোট্ট গ্রাম আওয়াস্টেডে হবে লড়াই।
হনলোয়ার ধারণা ছিল আক্রমণ আসলে আসবে দক্ষিণ দিক থেকে। সেদিকে ছিল সমতল রাস্তা। অন্যান্য দিকে পাহাড়ি এলাকা থাকায় তিনি সেদিকে বেশি সেনা রাখেননি। তার কাছে সেনাও বেশি নেই, জেনারেল রুশেলের তরফ থেকে সহায়তা আসার পর তার কাছে ছিল ৪৭,০০০ এর মতো সেনা, নেপোলিয়নের সেনাসংখ্যা এর প্রায় দ্বিগুণ।
১৩ তারিখ সারারাত ধরে চুপিসারে হনলোয়ার যেদিকে পাহাড় সেদিকে নেপোলিয়ন সমস্ত সৈন্য আর কামান বসালেন। পরদিন সকাল দশটার দিকে কুয়াশা সরে যেতে প্রুশিয়ানরা হতভম্ভ হয়ে পড়ল। নেপোলিয়ন ল্যানেসকে মধ্যভাগে এবং সল্ট, নেই আর অঝিরুকে দুই পাশে আঘাত হানার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মার্শাল নেই অতি উৎসাহী হয়ে আগেভাগে আক্রমণ করে বসলে প্রুশিয়ান গোলাবর্ষণে তার অবস্থান ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। নেপোলিয়ন দ্রুত ল্যানেসকে সেদিকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল গার্ড’দের নিয়ে মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে যান। প্রুশিয়ান কম্যান্ডার যদি নেইয়ের দিকে শক্তি নিয়োগ করতেন তাহলে সম্ভব ছিল তিনি নেপোলিয়নের ব্যুহ ভেঙে ফেলতে পারতেন। তিনি তা করেননি, ফলে নেই নিরাপদেই পিছিয়ে যান। সংগঠিত হয়ে ফরাসিরা এরপর দুই পাশে প্রচন্ড আক্রমণ করে। দুপুরের দিকে মার্শাল মুরাতের অধীনে অশ্বারোহীরা লড়াইয়ে অংশ নিল। দু’পাশ গুটিয়ে আসলে প্রুশিয়ার মধ্যভাগ পালাতে চেষ্টা করে। প্রায় দশ হাজার সেনা মারা যায়, সমসংখ্যক বন্দী হয়।
এদিকে আওয়াস্টেড গ্রামের কাছে ডেভোঁর ২৭,০০০ সেনা মূল প্রুশিয়ান বাহিনীর ৫৫,০০০ সৈন্যের মুখোমুখি হল। এদের সাথে কম্যান্ডার ফার্দিন্যান্দ এবং রাজা তৃতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামও ছিলেন। প্রুশিয়ানরা চলেছিল ন্যুমবার্গের দিকে, উদ্দেশ্য বার্লিনের দিকের প্রধান সড়ক বন্ধ করে এল্বে ধরে পিছু হটার রাস্তা পরিস্কার রাখা। কিন্তু ন্যুমবার্গ আর আওয়াস্টেডের মাঝে ইতোমধ্যে ডেভোঁ অবস্থান নিয়েছেন। ব্লুশা অশ্বারোহীদের নিয়ে হামলা করে ব্যর্থ হলেন। ফার্দিন্যান্দ কয়েকবার একই কাজ করেও ফল না পেয়ে এবার সেনাদের চার্জ করতে নির্দেশ দিলেন।
সমস্যা হলো তারা তখনো ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের পুরনো পদ্ধতিই অনুসরণ করছিলেন, যেখানে প্রুশিয়ান সেনারা সারিবদ্ধভাবে শত্রুর দিকে অগ্রসর হত। কিন্তু সামরিক কৌশল এতদিনে পাল্টে গেছে। ফরাসিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে লুকিয়ে থেকে অগ্রবর্তী বাহিনীর উপর গুলি ছুঁড়তে থাকলে প্রুশিয়ানদের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাদের বহু অফিসার মারা যায়। ফার্দিন্যান্দ গুলির আঘাতে দুই চোখ হারান। সাংঘাতিকভাবে আহত কম্যান্ডারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এই আঘাতেই নভেম্বরের ১০ তারিখ তার মৃত্যু হয়।
নিরুপায় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ওয়েইমারের দিকে পিছিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এদিকে জেনার দিক থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের পিছু নিয়ে মার্শাল মুরাতের ফরাসি অশ্বারোহীরা তাদের উপর হামলা করে। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রায় ১৩,০০০ সেনা নিহত হয়, আরো অনেকে বন্দী হলো। প্রুশিয়ার সামরিক শক্তি ভেঙে পড়ে এই দুই লড়াইয়ে। তাদের বিশ হাজারের উপর সেনা হতাহত হয়, আরো বিশ হাজার বন্দী হয় নেপোলিয়নের হাতে।
নেপোলিয়ন ডেভোঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বার্নাডোটকে কঠোরভাবে তিরস্কার করেন। বার্নাডোটের যুদ্ধকালীন কলাকৌশলে তিনি অত্যন্ত নাখোশ হয়েছিলেন। এজন্য পরে নেপোলিয়নকে মূল্য দিতে হয়। ১৮১০ সালে রাজনীতির মারপ্যাঁচে সুইডেনের নিঃসন্তান রাজা ত্রয়োদশ চার্লসের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত হন, এরপর তিনি প্রাক্তন কর্তার বিরোধী দলে যোগ দেন।
বার্লিনের পতন
স্যাক্সোনি বাধ্য হয়েছিল ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের সাথে যোগ দিতে। জেনার পরপরেই নেপোলিয়ন তাদের বুকে টেনে নিলে তারা আবার ফরাসিদের সাথে একত্রিত হয়। দিকে দিকে প্রুশিয়ার দুর্গ প্রায় বিনা প্রতিরোধে ফরাসিদের দখলে চলে যায়। ফ্রেডেরিক আর লুইসা পূর্বাঞ্চলে পালালেন, বার্লিন থেকে রাষ্ট্রীয় অর্থও সরিয়ে ফেলা হলো। ফ্রেডেরিক শান্তির প্রস্তাব দিলে নেপোলিয়ন কর্ণপাত করলেন না। ২৪ অক্টোবর ১৮০৬ সালে বিজয়ী বাহিনী বার্লিনে প্রবেশ করে। তিনদিন পর নেপোলিয়ন রাজধানীতে আসেন। এ সময় পার্শ্ববর্তী পটসড্যামে যান সম্রাট। সেখানে ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সমস্ত জেনারেলদের এক করলেন তিনি। “ভদ্রমহোদয়গণ,” নেপোলিয়ন তাদের বললেন, “এই ব্যক্তি যদি আজ প্রুশিয়ার সিংহাসনে থাকতেন, তাহলে আজ বার্লিনে উপস্থিত হবার সৌভাগ্য আমাদের হত না।”
প্রুশিয়ান বাহিনীর একাংশ নিয়ে হনলোয়া আর অন্য অংশ নিয়ে ব্লুশা পালাচ্ছিলেন। হনলোয়ার ইচ্ছা ছিল বার্লিনের দিকে যাবার, কিন্তু সেখানে ফরাসিরা ইতোমধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তদুপরি হনলোয়াকে তাড়া করছেন মার্শাল মুরাতের অশ্বারোহী দল। তার সাথে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ শেষে ২৮ অক্টোবর প্রেঞ্জলাউ শহরে এসে প্রুশিয়ানরা আশ্রয় নেয়। মুরাত তাদের পেছন পেছন শহরের দোরগোড়ায় উপস্থিত হলেন। তার সাথে লড়াই করে হনলোয়া সুবিধে করে উঠতে পারলেন না। চতুর মুরাত সরাসরি শত্রু কম্যান্ডারের সাথে দেখা করেন, তিনি শপথ করে বললেন মার্শাল সল্ট বিরাট সেনাদল নিয়ে মুরাটের সাথে যোগ দিয়েছেন এবং ফরাসিরা শহর ঘিরে ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে হনলোয়া আত্মসমর্পণ করলেন।
এদিকে ব্লুশা ৬ নভেম্বর মুরাট, বার্নাডোট আর সল্টের অধীনস্থ সেনাদের হাতে লুবেকে নাজেহাল হন। ১০,০০০ সেনা নিয়ে ব্লুশা ড্যানিশ সীমান্তের দিকে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চারদিকে ফরাসিরা তাকে ঘিরে ফেলে। গোলাবারুদ আর রসদপত্র শূন্যের কোঠায়, ফলে ব্লুশা বাধ্য হন আত্মসমর্পণে।
শান্তি আলোচনা
বার্লিনে বসে এবার নেপোলিয়ন ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের শান্তির প্রস্তাব শুনলেন। তার শর্ত ছিল কঠোর, এল্বে নদীর পশ্চিমে সমস্ত অঞ্চল প্রুশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে। বার্লিনের শার্লটেনবার্গ প্রাসাদে ৩০ অক্টোবর কিছুটা গাইগুই করার পর ফ্রেডেরিক চুক্তিতে সই করেন। কিন্তু নেপোলিয়ন মত পাল্টান। তিনি এবার দাবি করেন প্রুশিয়াকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণে তিনি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রুশিয়ান মন্ত্রী এতে রাজি ছিলেন, ফ্রেডেরিক উইলিয়াম সম্মত হলেন না। তিনি আলেক্সান্ডারের উপর ভরসা রাখতে চাইলেন, যিনি খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন।
১৮০৭ সালের ফেব্রুয়ারির ৭-৮ তারিখ পঁয়সো-শাইলাও (Preußisch-Eylau, বর্তমান রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ জেলাতে পড়েছে) শহরের কাছে রাশিয়ান এবং ছোট একটি প্রুশিয়ান বাহিনীর হাতে ফরাসিদের একটি দল পরাস্ত হয়। নেপোলিয়ন এবার প্রুশিয়াকে রাশিয়াতে আক্রমণের জন্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের দাবি থেকে সরে এলেন। কিন্তু আলেক্সান্ডারের বিজয়ে উল্লসিত ফ্রেডেরিক শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বসেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হার্ডেনবুর্গ ২৬ এপ্রিল সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রুশিয়া এবং রাশিয়ার সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তবে এই চুক্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী।
তিলসিত চুক্তি
রাশিয়ানরা পঁয়সো-শাইলাও বিজয়ের সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি। উল্টো নেপোলিয়ন ফেব্রুয়ারির মধ্যে সিলিসিয়া দখল করে নেন। জুনে তিনি ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ১৪ তারিখে অ্যালে নদীর ধারে ফ্রিডল্যান্ড শহরের কাছে এক যুদ্ধে রাশিয়ানদের চরমভাবে পর্যুদস্ত করেন। ২৫ জুন নেপোলিয়ন এবং অ্যালেক্সান্ডার নিমান (Niemen) নদীর উপরে এক সুসজ্জিত নৌকাতে মিলিত হলেন, দুই তীরে দু’পক্ষের সৈনিকেরা সমরসাজে ছিল। রাশিয়ান সেনাদের সাথে প্রথম দিন ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ছিলেন শুধুই দর্শক। নেপোলিয়ন তাকে আলোচনায় যোগদানের উপযুক্ত মনে করেননি। তার ভাগ্য ঝুলছে বন্ধু আলেক্সান্ডারের উপর। দ্বিতীয় দিন নেপোলিয়ন তাকে উপস্থিত থাকবার অনুমতি দেন, কিন্তু হাবভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে ফ্রেডেরিক কিছু বলবেন তা তিনি প্রত্যাশা করেন না।
আলেক্সান্ডার ফ্রেডেরিককে আসলেই সাহায্য করেছিলেন। নেপোলিয়ন প্রুশিয়াকে পৃথিবী থেকে মুছে দিতে মনস্থ করলেও জারের চাপেই রাজি হন খুব সামান্য হলেও ছোট একটি প্রুশিয়ান রাষ্ট্র বজায় রাখতে। ৯ জুলাই তদানীন্তন পূর্ব প্রুশিয়ার তিলসিতে শান্তিচুক্তিতে (Peace of Tilsit) সব পক্ষ সম্মতি দেয়। ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের হাতে রইল কেবল ব্র্যান্ডেনবার্গ, পোমেরানিয়ার প্রুশিয়ান অঞ্চল, সিলিসিয়া, পূর্ব প্রুশিয়া এবং প্রথম পার্টিশনে প্রাপ্ত পোল্যান্ডের দিকে একচিলতে জমি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পার্টিশনে পাওয়া সব পোলিশ অঞ্চল নিয়ে নেপোলিয়ন গঠন করলেন ওয়ার’শ ডাচি, সম্ভবত মানচিত্রে পোল্যান্ডকে পুনরায় স্থাপন করার ইচ্ছা তার ছিল।
এল্বে নদীর পশ্চিমে প্রুশিয়ার অঞ্চল নিয়ে ওয়েস্টফ্যালেয়া রাজ্য তৈরি করা হলো। হার্ডেনবুর্গের অপসারণও শর্তের মধ্যে ছিল। প্রুশিয়ার উপর চাপিয়ে দেয়া হলো প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের বোঝা। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৪২,০০০-এ বেধে দেয়া হলো। সিলিসিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে তার দুর্গগুলোতে অবস্থান নিল ফরাসি সেনারা। ফ্রেডেরিক কঠোর শর্ত নমনীয় করতে স্ত্রী লুইসাকে নেপোলিয়নের কাছে পাঠিয়েছিলেন। নেপোলিয়ন লুইসার দৃঢ়তায় মুগ্ধ হলেও শর্ত শিথিল করলেন না। এক ধাক্কায় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের রাজ্য আগের আয়তন এবং জনসংখ্যার অর্ধেকের থেকেও কমে গেল। পরবর্তী পাঁচ বছর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ টানতে টানতে প্রুশিয়া চরম দুর্ভোগের সময় পার করে।
এদিকে ১৮০৭ সালে রাশিয়ার সাথে সম্পাদিত চুক্তির পর চতুর্থ কোয়ালিশনের সমাপ্তি হয়। জার আলেক্সান্ডার ইংল্যান্ড-বিরোধী নেপোলিয়নের পররাষ্ট্রনীতি কন্টিনেন্টাল সিস্টেমে সংযুক্ত হয়েছিলেন, যার মূলনীতি ছিল ফ্রান্সের মিত্র সকল রাষ্ট্র ইংল্যান্ডের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেবে। তবে রাশিয়া আর অস্ট্রিয়া গোপনে গোপনে ঠিকই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইংল্যান্ড পাল্টা ফ্রান্স ও তার জোটের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে বসে। নেপোলিয়নের চূড়ান্ত সফলতার সময়েও সাগরপথে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আধিপত্য বজায় রেখেছিল, ফরাসি নৌবাহিনী কখনোই রয়্যাল নেভির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে এই সিস্টেমে ইংল্যান্ডের ক্ষতি ছিল সামান্যই।