Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানুষ হিসেবে যেমন ছিলেন সম্রাট হুমায়ুন

একজন শাসক হিসেবে সম্রাট হুমায়ুন ঠিক যতটা ব্যর্থ ছিলেন, মানুষ হিসেবে ঠিক ততটাই সফল ছিলেন। ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন আহমেদ সম্রাটকে ফেরেশতাদের গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কথাটি অতিরঞ্জিত সন্দেহ নেই, তবে সমস্ত মুঘল সম্রাটের মাঝে তাকেই সবচেয়ে ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে ধরা হয়। একাধারে তিনি একজন ধার্মিক, বীর, দয়ালু ও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। 

স্বভাবগত দিক থেকে তিনি ছিলেন যথেষ্ট ভদ্র। কখনো কাউকে কটু কথা বলেননি। কারো উপর বিরক্ত হলে বা রাগ প্রকাশ করতে শুধু ‘মূর্খ’ শব্দটি ব্যবহার করতেন।

মসনদে সম্রাট হুমায়ুন; Image Source: britishmuseum.org

মানুষ হিসেবে তিনি যথেষ্ট স্নেহ পরায়ণ ছিলেন। নিজ আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি তার ছিল অগাধ ভালোবাসা। তার আপনজনেরা বিশেষ করে ভাইয়েরা বারবার তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পরও যখনই তারা ক্ষমা চাইতো, তিনি ক্ষমা করে দিতেন। এই বিষয়টিকে অবশ্য সম্রাটের দুর্বলতা হিসেবেও ধরা যায়। গুলবদন বেগম তার লেখাতে ভাই-বোন, আত্মীয়দের প্রতি সম্রাটের ভালোবাসার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

পারিবারিক জীবনে সম্রাট হুমায়ুনের ৮ জন স্ত্রীর কথা জানা যায়। এদের মাঝে বেগা বেগম, হামিদা বানু আর মাহ চুচক বেগম বিশেষ গুরুত্ব বহন করতেন। বেগা বেগমকে তিনি সম্রাট বাবরের জীবদ্দশাতেই বিয়ে করেছিলেন। সম্রাটের বাংলা অভিযানের সময় তিনি সম্রাটের সাথেই ছিলেন এবং শের শাহের হাতে বন্দী হন। শের শাহ বেগা বেগমকে বিন্দুমাত্র অসম্মান না করে মুঘল দরবারে ফেরত পাঠিয়ে দেন। 

হামিদা বানুকে সম্রাট হুমায়ুন অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তাকে সম্রাট যখন বিয়ে করেন, তখন হিন্দুস্তানের এক ইঞ্চি জমিও তার দখলে ছিল না। পথের ফকির এই সম্রাটকে বিয়ে করতে হামিদা বানুও তেমন আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু সম্রাটের ইচ্ছা বলে কথা, হোক না তিনি নির্বাসিত।

সম্রাটের এই স্ত্রীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আকবর। যিনি ভবিষ্যতে মুঘল মসনদে বসবেন এবং তার হাতেই পূর্ণতা পাবে মুঘল সালতানাত।

মাহ চুচক বেগমের সাথে সম্রাটের বিয়ে হয় ১৫৪৬ সালে। তার গর্ভে হুমায়ুনের দুই পুত্র ও চার কন্যার জন্ম হয়েছিল। সম্রাটের মৃত্যু ও আকবরের মসনদ আরোহণের পর তিনি কাবুলে বসবাস শুরু করেন।

হুমায়ুনের অন্যান্য স্ত্রীরা হচ্ছেন- গুণবার বেগম, চাঁদ বিবি, শাদ বিবি, গুলবর্গ বেগম বারলাস এবং মেওয়াজান। এদের মাঝে চাঁদ বিবি ও শাদ বিবি চৌসার যুদ্ধের পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা মারা যান, নয়তো পালানোর সময় পানিতে ডুবে মারা যান। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, সম্রাটের কোনো স্ত্রীই রাজনীতির সাথে তেমন সম্পৃক্ত ছিলেন না। 

পড়াশোনার প্রতি সম্রাট হুমায়ুনের এক বিচিত্র ঝোঁক ছিল। তিনি একাধারে আরবী, ফারসি ও তুর্কী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। চুগতাই তুর্কী ছিল মূলত মুঘলদের মাতৃভাষা। দিল্লি সালতানাতের সময় হিন্দুস্তানের রাজভাষা হিসেবে ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হতো। মুঘলরা এসে ফারসিকেই রাজভাষা হিসেবে বহাল রাখেন। সম্রাটের ফারসি ভাষার দক্ষতা তার পারস্যবাসের সময় শাহের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ ফলপ্রসু হয়েছিল। সমসাময়িক সময়ে কবি হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। ফারসি ভাষায় তিনি কবিতাও লিখেছেন। অটোমান অ্যাডমিরাল সাইয়িদি আলি রইস সম্রাটের কাব্য প্রতিভার বেশ প্রশংসা করেছিলেন।

বাদশাহ হুমায়ুনের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ভবন; Image Source: smithsonianmag.com

সম্রাট হুমায়ুন নিয়মিত কোরআন পাঠ করতেন। কোরআনের বেশ কিছুটা অংশ তার মুখস্তও ছিল এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত আয়াত পাঠ করতে পারতেন। ইসলাম, দর্শন, তুর্কী আর ফারসি সাহিত্যে তার অসাধারণ দখল ছিল। এছাড়া ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তার আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি সম্রাটের বিশেষ আগ্রহ ছিল। আকবরের সভাসদ আবুল ফলজের বর্ণনামতে, সম্রাট একটি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সংগ্রহ করা হয়েছিল।

তার দরবারে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ছিলেন। এদের মাঝে শাহ তাহির দক্ষিণী ও মাওলানা ইলিয়াস উল্লেখযোগ্য। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বেশিরভাগ জ্ঞানই লাভ করেছেন মাওলানা ইলিয়াসের কাছ থেকে। এছাড়া, ঐতিহাসিকদের মাঝে বায়েজিদ, খন্দমীর আর জওহর সম্রাটের দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন।

তার শাসনামলের লিখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ‘জওয়াহিরুল উলুম’ বা ‘বিজ্ঞানের রত্ন’। মাওলানা মুহাম্মদ কর্তৃক ফারসি ভাষায় রচিত এ গ্রন্থটিতে দর্শন, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ প্রায় ১২০টি বিষয়ের উপর বিপুল তথ্য ছিল। এটি ছিল অনেকটা এ যুগের বিশ্বকোষ ঘরানার বইয়ের মতো। এছাড়া, সম্রাট জ্ঞানী পণ্ডিতদের সাথে বিজ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করতেন।

সম্রাট জ্ঞানী গুণিদের সাথে আলোচনাই যে শুধু করতেন তা না, তিনি সবসময়ই বিদ্বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বিদ্বানদের প্রতি তার এই উদারতার সংবাদ শুনে বুখারা, সমরকন্দ থেকে শুরু করে তুর্কীস্তান আর পারস্যের জ্ঞানী-গুণি ও কবিরা সম্রাটের দরবারে ভিড় জমাতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন বুখারার জাহী আজমান, মা ওয়ারা উন্নাহারের হায়রাতী, তুর্কীস্তানের মাওলানা আবদুল বাকী সদর, বুখারার মীর আবদুল হাই, মাওলানা বজমী, খাজা হিজরি জামী, মোল্লা জান মুহাম্মদ ও মোল্লা মুহাম্মদ সালীহ। উল্লেখিত সবাই সম্রাটের হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার অভিযানের সময় সম্রাটের সাথে যোগ দেন।

সম্রাট হুমায়ুন বইপ্রেমী ছিলেন। কি যুদ্ধ কি শান্তি, সবসময় তার কাছে বই থাকতো। যুদ্ধের সময়ও সাথে করে পুরো একটি গ্রন্থাগার নিয়ে তিনি ঘুরতেন। তালিকান যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। পরাজয়ের সংবাদ পাওয়ার পর তার প্রথম প্রশ্ন ছিল- বইগুলোর কী অবস্থা?

কিপচাকের যুদ্ধে তার কিছু বই হারিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে বইগুলো তিনি ফেরত পেয়েছিলেন। বইগুলো ফেরত পাওয়ার পর সম্রাটের খুশি দেখে মনে হচ্ছিল কোনো শিশু তার হারিয়ে যাওয়া খেলনা খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে! বইপ্রেমী এই সম্রাট কিন্তু মারাও গিয়েছিলেন তার গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে।

সম্পদের প্রতি প্রায় সবারই আকর্ষণ থাকে। সম্রাট হুমায়ুন এর ব্যতিক্রম ছিলেন। সম্পদের প্রতি তার তেমন মোহ ছিল না। নিজের জন্য আলাদা করে সম্পদ জমানোরও কোনো চেষ্টা করেননি। দান-সাদাকাহে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। বদায়ূনী লিখেছেন, তিনি এত বেশি দান করতেন যে, মাঝে মাঝে মনে হতো পুরো হিন্দুস্তানের কোষাগারও তার দানের জন্য যথেষ্ট না।

যা-ই হোক, অতিথি আপ্যায়নেও তিনি কোনো কমতি করতেন না। অতিথিদের প্রচুর খাওয়াতেন। সেই সাথে উপহারও দিতেন। ২৮তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে সম্রাট তার সমান ভরের স্বর্ণ দান করেন। পরিমাণে তা ছিল প্রায় ১৫ হাজার স্বর্ণমুদ্রা।

বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধি; Image Source: Wikimedia Commons

এই হাতখোলা স্বভাবের জন্য তার নিজস্ব ধনসম্পদ তেমন ছিল না। তার এই স্বভাবের খারাপ দিকটা বুঝতে পারেন নির্বাসনের সময়। এ সময় তার হাত একেবারেই খালি হয়ে গিয়েছিল। সৈন্যদের বেতন দিতে না পারায় তাদের ছাটাই করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশেষ প্রয়োজনে তারই অধীনস্ত এক আমিরের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়েছিলেন।

সম্রাটের চরিত্রের সবচেয়ে বাজে দিকটি ছিল তার অলসতা আর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এ দুটি বৈশিষ্টের কারণে তাকে জীবনে বহু কষ্ট করতে হয়েছে। তিনি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চাইতেন না। বাস্তবতা থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতে চাইতেন।

এসব বৈশিষ্ট্য তাকে ঝামেলায় ফেলে দিতো। যেমন গুজরাট অভিযানের সময় যাত্রাপথে লম্বা বিরতি, আসকারি মির্জা গুজরাটের বিদ্রোহ সামলাতে অপারগ হলে তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে না যাওয়া, গুজরাট হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর আগ্রায় ফিরে দ্রুত পদক্ষেপ না নিয়ে উৎসবে মেতে থাকা, বাংলা বিজয়ের পর দীর্ঘ সময় বাংলায় নিষ্ক্রিয় থেকে বাংলার সৌন্দর্য্য উপভোগ করা, চৌসা ও কনৌজের যুদ্ধে শত্রুর শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে না পারা, এমনকি যুদ্ধের কৌশলে ভুল করা- এত কিছুর মূলে সম্রাটের বদ অভ্যাসগুলোই দায়ী।

এই কবরটিতেই শুয়ে আছেন বাদশাহ হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

তবে, তার চরিত্র বেশ আকর্ষণীয় ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আকর্ষণীয় হলেও তিনি তার এই চরিত্র দিয়ে মানুষকে বেশিক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে পারতেন না, যা একজন সম্রাটের থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া, সম্রাট হুমায়ুন দৃঢ়চেতা ছিলেন না, সবসময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন। আবার যখন দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়া উচিত, তখনও যথাসময়ে উত্তম সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন না।

তিনি নিয়মিত কুরআন পাঠ করতেন। সবসময় অজুর মাধ্যমে পবিত্র থাকতেন। এমনকি অযু ছাড়া তিনি কখনোই আল্লাহ বা মুহাম্মদ (সা.) এর নাম মুখে নিতেন না। ইসলামে এমন করার বাধ্যবাধকতা নেই, তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই নিয়মটি খুব কঠোরভাবে মানতেন। এমনকি কারো নামের কোন অংশে যদি আল্লাহ বা মুহাম্মদ (সা.) এর নাম থাকতো, তিনি আল্লাহ ও মুহাম্মদ (সা.) এর নামটি বাদ দিয়ে বাকি অংশে ডাকতেন। তিনি ভাগ্য বা তাকদীরে বিশ্বাস করতেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামী নিয়ম-কানুন মানার চেষ্টা করতেন।

তবে, ধার্মিক হওয়া স্বত্বেও তিনি ধর্মান্ধ ছিলেন না। তার দরবারে যেমন সুন্নি আমির ছিল, তেমনই শিয়া আমিরও ছিল। তার দরবারে শাহ আবুল মালির মতো সুন্নীরাও প্রভাবশালী ছিল, আবার বৈরাম খানের মতো শিয়ারাও প্রভাবশালী ছিল। তবে সম্রাট হুমায়ুন হয়তো কখনোই কল্পনা করতে পারেননি, যে একসময় এই সুন্নি-শিয়া দ্বন্দ্বে পড়েই মুঘল সাম্রাজ্য ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে যাবে।

সম্রাট হুমায়ুন সুন্নি মুসলিম ছিলেন আগেই বলা হয়েছে। তবে শিয়া শাসিত পারস্যে যাওয়ার পর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, যার কারণে সম্রাট শিয়া মত গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন। পারস্যে যাওয়ার পর শাহ তাকে শিয়া মত গ্রহণ করার জন্য উপর্যুপুরি চাপ দিতে থাকেন, এবং বলেন শিয়া মতবাদ গ্রহণ করলে তাকে হিন্দুস্তানের অভিযান চালানোর জন্য সেনাবাহিনী দেওয়া হবে। সম্রাট এই প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দেন যে রাজত্ব করার ইচ্ছা তার শেষ। এখন তিনি মক্কায় গিয়ে শান্তিতে দিন কাটাতে চান।

শাহ এর উত্তর আরও ভয়ানকভাবে দেন। তিনি জানান শীঘ্রই তিনি সুন্নিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় তার হাতে বন্দী একজন ধর্মপ্রাণ সুন্নি শাসক তাকে নানাভাবে কূটনৈতিক সুবিধা দিবে। এমনকি একপর্যায়ে শিয়া মত গ্রহণ না করলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে, এমন হুমকিও দিয়ে বসেন।

পরবর্তীতে অনেক ঘটনাপ্রবাহের পর সম্রাট শিয়া মত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, অন্তত পারস্যে অবস্থানের সাময়িক সময়টুকুতে। এ সময়টুকুতে সম্রাট শিয়াদের মতো করে চুল কেটেছিলেন, টুপি পরেছিলেন, খুতবায় ১২ ইমামের নাম পর্যন্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে মজার বিষয় হলো, পারস্য ত্যাগের পরই সম্রাট হুমায়ুন শিয়াদের সমস্ত চিহ্ন নিজের বিশ্বাস থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন। 

সম্রাট হুমায়ুন হয়তো শিয়া মত মন থেকে গ্রহণ করেননি, তবে তার পারস্য যাত্রা শিয়াদের জন্য হিন্দুস্তানের দরজা আজীবনের জন্য খুলে দিল। পরবর্তীতে শিয়ারা দলে দলে মুঘল হিন্দুস্তানে আসতে শুরু করলো। মুঘল সম্রাটদের ধর্মীয় উদারতার ফলে তারা দরবারের উঁচু উঁচু পদ দখল করতে শুরু করে দিলো। তবে, যতদিন সম্রাটরা নিজেরা শক্তিশালী ছিলেন, ততদিন তারা দলাদলির সুযোগ পায়নি। পরবর্তী দুর্বল মুঘল শাসকদের যুগে এই শিয়াদের কারণে মুঘল দরবারে সুন্নি-শিয়া ধর্মীয় বিভাজন শুরু হয়, যা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য কোনোদিক দিয়েই সুফল বয়ে আনেনি।

নিজে মুসলিম হলেও অন্যান্য মুসলিম এবং মুঘল সম্রাটদের মতো সম্রাট হুমায়ুন কখনো কোনো হিন্দুকে অত্যাচার করেননি কিংবা তাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধও ঘোষণা করেননি। নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার হুমায়ুনের রাজত্বে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মালম্বীদের ছিল। 

হিন্দুদের প্রতি তার উদারতার ফল তিনি হাতেনাতে পেয়েছিলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে রাজপুতদের সহযোগীতা পেয়েছিলেন তিনি। চৌসার যুদ্ধের পরাজয়ের পর রাজা বীরভান তাকে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগীতা করেন। আবার শের শাহের ধাওয়া খেয়ে হিন্দুস্তান ত্যাগের পর যোধপুরের রাজা মালদেব তাকে আন্তরিকভাবেই সহযোগীতা করতে চেয়েছিলেন।

সম্রাটের পারস্য যাত্রার আরেকটি ফল হলো মুঘল চিত্রকলার বিকাশ। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিম হিন্দুস্তানের প্রাচীন শিল্পকলা ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়ছিল। কিন্তু, হিন্দুস্তানের পাশেই পারস্যে চিত্রকলা বলতে গেলে নব একটি যুগ লাভ করে। পারস্যে অবস্থানের সময় এই পারসিক চিত্রকলার দ্বারা সম্রাট বিপুল উৎসাহিত হন, যা পরবর্তীতে মুঘল চিত্রকলার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

তাবরিজে অবস্থানকালে সম্রাটের সাথে মীর সৈয়দ আলী ও আবদুস সামাদ নামে দুই চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচয় হয়। পারস্য থেকে ফিরে সম্রাট হিন্দুস্তান অভিযান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। পরবর্তীতে কাবুল বিজয়ের পর ১৫৫০ সালে এই দুই চিত্রশিল্পী সম্রাট হুমায়ুনের দরবারে চলে আসেন। সম্রাট তাদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। হুমায়ুনের নির্দেশে তারা ফারসি ‘দাস্তানে আমীর হামজা’ গ্রন্থের চিত্রণ কাজে মনোনিবেশ করেন। ১২ খণ্ডে মোট ১২০০টি চিত্র অঙ্কনের জন্য ঠিক করা হয়। পরবর্তী ৭ বছরে তারা ৪টি খণ্ড সমাপ্ত করেন। সম্রাট হুমায়ুন হুট করে মারা যাওয়ার পরও এই কাজ চলতে থাকে। আকবরের শাসনামলে এই কাজ শেষ হয়।

দিনশেষে সম্রাট হুমায়ুন একজন মানুষ ছিলেন। তার চরিত্রে দুর্লভ কিছু গুণের সমাহার যেমন ঘটেছিল, তেমনই কিছু ত্রুটিও তার চরিত্রে ছিল। তবে মানুষ হিসেবে যে তিনি অসাধারণ ছিলেন, তা যে কেউই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, তিনি জন্মেছিলেন একটি রাজবংশে, বেড়ে উঠেছিলেন একটি রাজবংশে, আর তার নিয়তিই তাকে শাসকের পদে বসিয়ে দেয়। তবে, তাইমুরি বংশের তেজ তার ভেতরে কখনোই দেখা যায়নি। তার ভাগ্যই ছিল এমন যে, ভবিষ্যতে একজন মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত হওয়ার চেয়ে একজন শাসক হিসেবে তার মূল্যায়নটা মূখ্য হয়ে উঠবে। আর এই দিকটিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।

পিতার কাছ থেকে বিশাল এক সাম্রাজ্য পেয়েছিলেন তিনি। তবে যে কারণেই হোক, তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। তবে ভাগ্যের বিষয় হলো, পিতার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্য তিনি পুনরুদ্ধার করে রেখে যেতে পেরেছিলেন। একজন শাসক হিসেবে এটাই তার সফলতা।

[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]

This article is written in Bengali. It describes Humayun's personality as a human.

References:

1. মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড. হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

2. মোগল শাসন ব্যবস্থা, মূল (হিন্দি): ড. হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী, ২০০৭

3. ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

Feature Image: Wikimedia Commons

Related Articles